দেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা কমছে না। এসব ঘটনায় মামলাও হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় নারী নির্যাতনের মামলাকে মিথ্যা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্রমূলক জড়ানো হচ্ছে। ফলে আসল নির্যাতনের ঘটনা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ছে এবং প্রকৃত অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে।
ট্রাইব্যুনালে আজ বিচারপ্রার্থী পঞ্চাশোর্ধ্ব মমতাজ বেগম। সঙ্গে তাঁর মেয়ে জুলি। আসামিদ্বয় শিহাব আলম ও সোহেল আলম কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে করজোরে কম্পমান। অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। মমতাজ বেগম তাঁর মেয়ে জুলিকে নিয়ে বসবাস করেন শ্বশুরের ভিটায়। স্বামী একজন সরকারি কর্মকর্তা, চাকরির কারণে তিনি অবস্থান করেন উত্তরাঞ্চলে। সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে নৈমিত্তিক ছুটি যুক্ত করে মাসে কমপক্ষে একবার বাড়ি এসে পরিবার-পরিজনদের দেখে যান। মমতাজ বেগমের অভিযোগের বর্ণনায় বলা হয়েছে তিনি ও তাঁর মেয়ে ঘটনার দিন নিজ বসতঘরে অবস্থান করছিলেন। তখন বিকেল প্রায় চারটা। আকস্মিকভাবেই তাঁর ঘরে আগমন করল আসামিরা। কিছু বোঝার আগেই মমতাজ বেগমকে শিহাব ধর্ষণ করতে শুরু করল। একইভাবে জুলিকে পাশের ঘরে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে সোহেল । ধর্ষণ শেষে আসামিরা বীরদর্পে বেরিয়ে গেল। চিৎকার দিয়ে ডাকাডাকি করলেও পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ এগিয়ে আসেনি। কারণ আসামিরা অত্যন্ত দাঙ্গাবাজ লোক। অভিযোগের বর্ণনা দিতে গিয়ে মমতাজ বেগম তাঁর আঁচল দিয়ে ও মেয়ে জুলি তাঁর ওড়নায় মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কেঁদে ফেললেন। এজলাস কক্ষে এক অভাবনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। উপস্থিত জনগণ পারলে আসামিদের পিটুনি শুরু করে দেয়। কিন্তু মাননীয় বিচারক মহোদয়ের এজলাস কক্ষে এরূপ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার সুযোগ কারও নেই। তাই রক্ষে। আসামিরা করজোরে বিচারকের কাছে নিবেদন করল তারা দুই ভাই নির্দোষ, তারা বিচারপ্রার্থী। সাজা এড়াতে অপরাধীরা এরূপ বেশভুষায় সজ্জিত হয়ে থাকে। তাই আসামিদের কথার সত্যতা বিচারের আগেই এরূপ পরিবেশে নির্ণয় করার সুযোগ খুবই কম। বিজ্ঞ বিচারক বিচারের দিন ধার্য করলেন। নির্ধারিত দিনে বিচারকাজ শুরু হলো। পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোকদ্দমা বিচারের জন্য উন্মুক্ত করলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে ডাক পড়ল ফরিয়াদী মমতাজ বেগমের। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মমতাজ বেগম হলফ পড়লেন ‘আমি প্রতিজ্ঞাপূর্বক বলিতেছি যে এই মোকদ্দমায় আমি যে সাক্ষ্য দিব তা সত্য হইবে, ইহার কোনো অংশ মিথ্যা হইবে না এবং আমি কোনো কিছু গোপন করিব না।’ বিচারক লক্ষ করলেন মমতাজ বেগম হলফ পড়তে গিয়ে ইতস্তত করছিলেন এবং তাঁর গলা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছিল। বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন সাক্ষী মমতাজ বেগমকে তাঁর ফরিয়াদের কথা। সবাই উদগ্রীব নির্যাতিতা মমতাজ বেগমের ফরিয়াদ শোনার জন্য। কিন্তু মমতাজ বেগমের মুখে কোনো কথা নেই। প্রশ্ন জাগে, কেন এই নীরবতা। বিচারক অত্যন্ত সহানুভূতিমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন মমতাজ বেগমকে, তাঁকে কেউ ভয় দেখিয়েছে কি না। তার পরও মমতাজ বেগম নীরব। বিচারকের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, বার বার তিনি মমতাজ বেগমকে অভয় দিতে থাকেন, আশ্বাস দিতে থাকেন তাঁর সর্বাঙ্গীন নিরাপত্তা বিধানের। সব শেষে মমতাজ বেগম অস্ফুট কণ্ঠে বলেন, ‘সব দিয়ে দিয়েছে’। বিস্মিত বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, কী দিয়ে দিয়েছে? এ সময় এগিয়ে আসেন আইনজীবী, তিনি জানান যে পৈর্তৃক সম্পত্তিতে ফরিয়াদির স্বামীর প্রাপ্য অংশ দিয়ে দিয়েছে আসামিদ্বয়। এবার বিচারের কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান ফরিয়াদি মমতাজ বেগমকে জিজ্ঞেস করেন আসামি তাঁকে ধর্ষণ করেছে কি না। প্রশ্ন শুনে লজ্জাবনত হয়ে পড়েন মমতাজ বেগম, তিনি জবাব দেন ‘না, আমার ভাসুর শিহাব আলম একজন সজ্জন ব্যক্তি। তিনি আমার সঙ্গে কখনোই কোনো খারাপ বা অশালীন আচরণ করেননি। সম্পত্তির ভাগাভাগি ত্বরান্বিত করার জন্যই মামলা করেছিলাম। নালিশ দরখাস্তের বক্তব্য আমার নয়, ভাশুরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে নালিশ দায়ের করতে আমি কাউকে কোনো নির্দেশনা দিইনি।’ এরপর ডাক পড়ে সাক্ষী জুলির। যথারীতি হলফ পড়ানোর পর তাঁকেও বিচারক জিজ্ঞাসা করেন, আসামি সোহেল আলম তাঁকে ধর্ষণ করেছে কি না। তিনিও তাঁর মায়ের মতোই জবাব দেন। তাঁর সঙ্গে শ্রদ্ধেয় চাচাকে জড়িয়ে ধর্ষণের যে কথা বলা হয়েছে তা জেনে তিনি যারপরনাই লজ্জিত হন। ঘটনা এরপর পরিষ্কার হয়ে যায় ট্রাইব্যুনালের সামনে। শিহাব আলম, সোহেল আলম ও সাজ্জাদ আলম এঁরা তিন ভাই। তাঁদের এজমালি সম্পত্তিতে রয়েছে একটি বিশাল জামগাছ। ওই গাছের জাম পাড়তে গিয়েছিলেন জুলি। জামগাছের ডাল ভেঙে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁকে ওই সময় জাম পাড়তে নিষেধ করেন তাঁর চাচা। এই নিয়েই বিরোধের সূত্রপাত। তখন মমতাজ বেগম সিদ্ধান্ত নেন তাঁর স্বামীর পৈর্তৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নেবে। তাঁর স্বামী এতে রাজি হননি। তখন মমতাজ বেগম তাঁর স্বামীকে না জানিয়ে শরণাপন্ন হন পরিচিত এক ব্যক্তির। তার পরই মামলার সূত্রপাত।
নারী পাচারের অভিযোগ ও দালাল
ওসমান ও রোকাইয়া দুজনই অধ্যাপনা করেন রাজধানী ঢাকায়। বাসায় ঘর-গৃহস্থালি কাজের জন্য নিয়ে গেলেন মুনাকে। ২০ বছরের অবিবাহিতা মুনা ঘর-গৃহস্থালির কাজে খুব পটু। খান পরিবারের সব কাজ তিনি নিপুণ কর্মতৎপরতার মধ্যেই সম্পন্ন করে আসছিলেন। তাঁকে খাওয়া-পরাসহ পোশাক-পরিচ্ছদ, চিকিৎসাসেবা এবং আকর্ষণীয় বেতন দিতে খান দম্পতির এতটুকু কার্পণ্য ছিল না। মাস ছয়েক পর সেই মুনা হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন। থানায় সাধারণ ডায়েরি অন্তর্ভুক্ত করে ওসমান হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করলেন সারা শহরে। কিন্তু মুনার সন্ধান কেউ দিতে পারল না। এভাবে অতিবাহিত হলো ১৫ দিন। বিস্ময়ে একদিন জানতে পারলেন ওসমান সাহেব যে তাঁদের বিরুদ্ধে নারী পাচারের মামলা দায়ের করেছে মুনার মা। এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। একই সঙ্গে নীতিবিগর্হিত অনৈতিক কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নারী পাচারের কাজে সহায়তা করার জন্য এই দম্পতির উভয়ের বৃদ্ধ মা-বাবাকেও ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অধ্যাপক দম্পতির মানসম্মান আর রইল না। ছুটি নিয়ে তাঁরা ট্রাইব্যুনালে হাজির হলেন। আতঙ্ক, যদি হাজতে যেতে হয় তাহলে চাকরির ক্ষেত্রেও তাঁদের মারাত্মক সমস্যা হবে। তাঁরা ট্রাইব্যুনালে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ পেলেন। বিচারক তাঁদের জামিন মঞ্জুর করলেন। সন্ধ্যার পর তাঁরা মুনার মাকে নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেন, কিন্তু মুনার মা রাজি হলেন না। উপরন্তু তিনি বলে পাঠালেন তাঁকে এক লাখ টাকা দেওয়া হলে তিনি আর সাক্ষ্য দেবেন না। সে ক্ষেত্রে দম্পতি ও তাঁদের উভয়ের মা-বা ট্রাইব্যুনাল থেকে খালাস পেয়ে যাবেন। আইনজীবীর মধ্যস্থতায় ৭৫ হাজার টাকায় রফা হলো। মুনার মা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, তাঁর মেয়ে কোথায় গেছে তিনি তা জানেন না। কথিত মতে, আসামিরা কেউ অনৈতিক, নীতিবিগর্হিত কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে মুনাকে অপহরণ করেনি। এজাহার তিনি নিজে দেননি। টিপসহিও তাঁর নয়। ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে দম্পতিসহ সব আসামিকে খালাস দিলেন। রায় ঘোষণার পর দম্পতি ও তাঁদের মাতা-পিতাসহ স্বজনেরা যখন আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে আসছেন তখন তাঁরা দেখলেন মুনা ও তাঁর মা সহাস্যে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের বুঝতে বাকি রইল না যে চাপ দিয়ে টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যেই এই মামলা করা হয়েছিল এবং একই উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবেই তাঁদের বাড়িতে কাজ করার জন্য মুনাকে পাঠানো হয়েছিল। সব ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী একজন চিহ্নিত দালাল, তাঁর হাতে এরূপ অনেক মামলা আছে।
মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগ
শিক্ষক হিসেবে ফিরোজ বখত সাহেবের তুলনা নেই। সারা শহরে তাঁর সুনাম আর সুখ্যাতি। ১৫ বছর ধরে একনাগাড়ে তিনি পালন করে আসছেন সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব। তাই ঈর্ষান্বিত তাঁর অধীন শিক্ষকেরা। একসময় কতিপয় শিক্ষকের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন ফিরোজ বখত। তাঁরা কেউই সুযোগ করতে পারছিলেন না ফিরোজ বখতকে পদ থেকে অপসারণ করার। অবশেষে একদিন সুযোগ এসে গেল। ওই বিদ্যালয়ের দপ্তরি ছিলেন মনোয়ারা বেগম, তিনি একদিন পরীক্ষার কিছু সাদা খাতা লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। শিক্ষক ফিরোজ বখত হাতেনাতে ধরে ফেলেন মনোয়ারাকে। সঙ্গে সঙ্গে মনোয়ারার বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এই মনোয়ারাকেই দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মনোয়ারা অভিযোগ করেন, তাঁকে একা পেয়ে ফিরোজ বখত ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। তবে তিনি প্রাণান্ত চেষ্টা করে আত্মরক্ষা করতে পেরেছেন। গুরুতর অভিযোগ, ফিরোজ বখত দীর্ঘদিনের ছুটি নিলেন। শহরময় প্রচার করা হলো তাঁর বদনাম। তবে বিচারক প্রথম শুনানিতেই ফিরোজ বখতকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দিলেন। কিন্তু নিষ্কলুষ শিক্ষকের মর্যাদার যে ক্ষতি হলো তা তো পূরণ হওয়ার নয়।
আছে কঠিন শাস্তি
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের (সংশোধনী ২০০৩) সুযোগ নিয়েই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিল। যদিও আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জানিয়াও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান তাহা হইলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করাইয়াছেন উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
এই রক্ষাকবচ সত্ত্বেও ওইসব অন্যায্য মামলা দায়ের করা বন্ধ হয়নি। এসব অন্যায্য মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেওয়া এবং দরখাস্ত মুসাবিদা করে দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। অনেক ক্ষেত্রেও এইসব দরখাস্তগুলো অশালীন ভাষায় লেখা হয়। এই আইনের অধীনে মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সাজা হচ্ছে খুব কম। কম সাজা হওয়ার কারণগুলো উপরের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১২ রাত ১২:১১