আজকের মিডিয়া অংশত শৃঙ্খলিত। সাংবাদিক সমাজ ধারা বিভক্ত। চিন্তার সতীত্ব বলতে যা বোঝায়, তা অনেকেরই নেই। অনেক তুখোড় পেশাজীবী সাংবাদিকও দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন করতে অভ্যস্ত। এটা দোষের নয়, দোষটা তখনই হয় যখন পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন, বস্তুনিষ্ঠতা ও সততা সংরক্ষণের চেয়েও দলীয় আনুগত্যের দায় বড় হয়ে যায়। সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী সমাজ দলান্ধ কিংবা একচোখা হলে জাতীয় সমস্যা প্রকট হয়। এই দুই শ্রেণীর ভেতর দলান্ধ রাজনীতি প্রবেশ করলে গণতন্ত্র মূর্ছা যায়। জাতীয় ঐক্যের ভিত টলে যায়। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার অপমৃত্যু ঘটে। ক্ষমতাসীনরা বেপরোয়া হয়। জাতীয় স্বার্থ উচ্ছন্নে যায়। বর্তমান অবস্থায় দলান্ধ ও মতান্ধ সাংবাদিকতার কারণে জাতি অনেকটা দিকনির্দেশনাহীন। কোনো কোনো সংবাদপত্র দলান্ধ সাংবাদিকতার কারণে মালিকের ইচ্ছাপত্র হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে। কারণ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথিকৃৎদের অভাব বাড়ছে। নবীনদের মধ্যে রোমাঞ্চ আছে, সত্য প্রকাশের উদ্দীপনা নেই। সুযোগও কম। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আরো দুঃখের খবর হচ্ছে, একে একে বিদায় নিচ্ছেন যশস্বী সাংবাদিকরা। গেল সপ্তায় বিদায় নিলেন বরেণ্য সাংবাদিক, লেখক আখতার-উল-আলম। ২৩ জুন বুধবার রাত ১২টা ১০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। একাত্তর বছর পার করে বাহাত্তরের ঘরে পা দিয়েই তিনি বিদায় নিলেন। এভাবে সবাইকে বিদায় নিতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে। একজন বিশ্বাসী ও খ্যাতিমান সাংবাদিকের মৃত্যুর খবর স্বভাবতই ব্যথাতুর। আরো কষ্টের কারণ, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন। আমাদের অনুপ্রেরণার বাতিঘরগুলোর বাতি নিভে যাচ্ছে। তার পরও অনিবার্য এ পরিণতি মানতে আমরা বাধ্য। কারণ ইন্তেকাল মানে স্থানান্তর। তাই মৃত্যু সংবাদ শুনে আমরা পড়ে থাকি আল্লাহর কাছ থেকে আসে, তার কাছে ফিরে যায়। এই ফিরে যাওয়ার গতি রোধ করার সাধ্য কারো নেই। সব দাম্ভিকদের দম্ভ, অহমিকা ও ক্ষমতার দাপট এখানে এসে থেমে যায়।
কিছু দিন ধরে আলম ভাইয়ের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না। দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মরহুমের সুযোগ্য সন্তান রিজু আলম ফোনে সংবাদটি অবহিত করেন। আলম ভাই নেই এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তার পরও মনকে প্রবোধ দিলাম, তিনি আগে গেলেন, আমরা অপেক্ষমাণের তালিকায়। লাশ কবরে নামাতে এমন দোয়াই পড়া হয়। তাই সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। অনেককে সংবাদটা জানালাম। ব্যথাতুর মনে পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখলাম তার মৃত্যু সংবাদটি অনেক জাতীয় দৈনিকের পাতায় যথাস্থানে নেই। যে পত্রিকার তিনি ভারপ্রাপ্ত ও উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেও তার প্রাপ্যতার ব্যাপারে কার্পণ্য দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না অকৃতজ্ঞ বন্ধুরা কে কতটা কুপমণ্ডুক হতে পারে। কতটা বিদ্বেষী ও পরশ্রীকাতর হলে একজন সম্পাদকের অবদান অস্বীকৃতির এ মাত্রায় যেতে পারে। আজকে যারা তার জায়গায় আছেন তারাও সমান আচরণের শিকার হলে আমরা কী বলব! কার কাছে দুঃখবোধ জানাব?
তুখোড় সাংবাদিকতার ক্ষেত্র ছাড়াও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের ধারায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে যে লোকটির উপস্থিতি একসময় অস্বীকার করা ছিল অপরাধ কিংবা অজ্ঞতা, সেখানে আজ তিনি যেন অপাঙক্তেয়। এ কার্পণ্য হয়তো ইতিহাস ক্ষমা করবে না। যার যার প্রতিদান ‘সময়’ যথারীতি পাইয়ে দেবে। কিন্তু আমাদের দায়টা তো থেকেই গেল।
আখতার-উল-আলম এই জনপদে কোনো ভূঁইফোড় লোকের নাম নয়। তিনি ষাটের দশকে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রায় দুই যুগ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তার শুরুটাও ছিল বর্ণাঢ্য। একসময়ের প্রভাবশালী দৈনিক আজাদেই তার পেশা জীবনের শুরু। মাসিক মোহাম্মদীর মতো মর্যাদাশীল ও খ্যাতনামা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। পথিকৃৎ সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তার। দৈনিক পয়গামেও কাজ করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও শেষে উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন পেশাদার সাংবাদিক হলেও বছর চারেকের মতো সময় তিনি সফল কূটনীতিক হিসেবে বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে দেশে ফিরে দৈনিক দিনকালের সম্পাদনার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। পূর্বাপর সাংবাদিকতা পেশার সুযোগ্য প্রতিনিধি ও প্রতিভাধর সাংবাদিক আলম ভাই সাবলীল গদ্যের একজন কুশলী লেখক ছিলেন। অনুবাদেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। মাস দুয়েক আগে ফোন করে নতুন করে নয়া দিগন্তের কলাম লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তার আর কলাম লেখা হলো না। তবে আমৃত্যু লিখেছেন। তার সর্বশেষ লেখা হিমালয় বিজয়ী মুসা ইব্রাহিমকে নিয়ে। দেশপ্রেম তাকে কতটা আপ্লুত করত এটাও একটা প্রমাণ হতে পারে।
প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী একজন মানুষ কতটা ব্যক্তিত্বশালী ও বিনয়ী হতে পারেন তার প্রমাণ আখতার-উল-আলম। আলম ভাই মঞ্চ এড়াতেন। নেপথ্যে থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতেন। পাঠক হিসেবে তিনি ছিলেন যাকে বলে গ্রন্থকীট। হাতে বই, পত্রিকা; নয়তো কলম। এটা ছিল তার স্বভাব। তিনি ছোট-বড় ৩৩টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে পাশ্চাত্যের পণ্ডিত ডক্টর মরিস বুকাইলির সাড়া জাগানো গ্রন্থ বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞানের অনুবাদ কতটা প্রাঞ্জল পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করেছেন। বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, প্রিয় নবীর প্রিয় কথা, নিপাতনে সিদ্ধ, আমার বাংলাদেশ, দি চয়েস, রুমির রাজত্ব, মানুষের আদি উৎস, নগরে নির্জনে ও আসমানে চাঁদ দেয় আজান এসব গ্রন্থের সাথে তার জীবনবোধ, বিশ্বাস ও দেশপ্রেম লেপ্টে আছে। দৈনিক ইত্তেফাকে তিনি রাষ্ট্রাচার, রাজনীতি ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে ‘লুব্ধক’ ছদ্মনামে স্থান-কাল-পাত্র শিরোনামে এক অসাধারণ কলামের স্রষ্টা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এটি ইত্তেফাকের অন্যতম জনপ্রিয় কলামের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছিল। পাঠক এ নন্দিত কলামটির জন্য সাত দিন অপেক্ষা করতেন। জাতীয় জীবনের নানা অসঙ্গতির সাথে তার দিকনির্দেশনা পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতিতে দেশাত্মবোধে উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি জাতির জন্য তার দিকনির্দেশনা ছিল অনেক বেশি বাস্তবসম্মত এবং দলমতের ঊর্ধ্বে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
আবুল মনসুর আহমদ, খন্দকার আবদুল হামিদ, জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমদ হুমায়ুন প্রমুখসহ হাতেগোনা লেখক-সাংবাদিকরাই ছিলেন সেই সময়ের দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব ও দিকপাল। একজন প্রাজ্ঞ ও পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে তার অবদান ছিল কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করার মতো। জাতীয় জীবনের নানা সন্ধিক্ষণে তার সাবলীল ও মননশীল লেখা জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে এ সত্যটি স্বীকৃতিদানে তার শত্রুরাও অকৃপণ। বিশ্বসাহিত্যের বোদ্ধা পাঠক আলম ভাই ছিলেন প্যান ইসলামিজমের সমর্থক। একই সাথে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভালো সমজদারও ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের অনারারি নাগরিক হয়েও তিনি ছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার ঘোরতর সমালোচক। মুসলিম বিশ্বের অখণ্ড ভ্রাতৃত্ব কামনায় তার সংবেদনশীলতার কোনো জুড়ি ছিল না। তবে পাশ্চাত্যের তুলনায় মুসলিম বিশ্বের অনগ্রসরতাকে তিনি ভাবতেন গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডুকতা। দায়ী করতেন শাসকদের। জামাল উদ্দীন আফগানী, সাইয়েদ কুতুব, হাসান আল বান্নার মতো লোকদের ব্যাপারে তার প্রচুর আগ্রহ ছিল। আধুনিক মালয়েশিয়া ও এর নেতৃত্বকে বাংলাদেশে পরিচিত করিয়েছেন তিনি। দেশের লোকজ ঐতিহ্য এবং সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন সময়ের অন্যতম যোগ্য প্রতিনিধি। বাঙালি মুসলমানের মানস গঠনে তার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। একই সাথে তিনি ছিলেন মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সপক্ষে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কলমসৈনিক। সংবাদপত্র শিল্পকে আজকের অবস্থানে আনতে যাদের অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়, তার মধ্যে মরহুমের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকের মর্যাদা রক্ষা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টাকে আমরা বিনম্রচিত্তে স্মরণ করছি। অনুজের পক্ষ থেকে অগ্রজের প্রতি এই কৃতজ্ঞতাবোধ একধরনের দায়। কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের যোগ্য ব্যক্তিত্বকে সম্মান দেখানোর ক্ষেত্রে আজকের দিনে এ কোন ধরনের কার্পণ্য লক্ষ করছি।
কথায় আছে, পেশাগত জীবনে নিরপেক্ষ সাংবাদিকের বন্ধু থাকে না, আবার মৃত্যুর পর শত্রুও থাকে না। আখতার-উল-আলমের মতো সাংবাদিকের বেলায় এ সত্যটি অধিকতর প্রতিফলিত হলে আজকের দিকপালদের সম্মান ও মর্যাদা বাড়ত। জাতীয় দৈনিকের পাতায় আখতার-উল-আলমকে নিয়ে যে মৌনতা লক্ষ করলাম, তাতে হৃদয়ের অবিরত রক্তক্ষরণের মাত্রা বাড়ল। শুনেছি আলম ভাই চাননি তার লাশ জাতীয় প্রেস ক্লাবে যাক। তিনি হয়তো জানতেন অকৃজ্ঞ সতীর্থদের দেউলেপনা ও মতান্ধ ভাবনা কোন পর্যায় পৌঁছেছে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জাতির প্রতি যে সাংবাদিকের দায় পূরণের মাত্রা ছিল উপচেপড়া, সেই সাংবাদিক অন্তরনিংড়ানো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পাবেন না কেন? তিনি তো কোনো দিন কোনো দলের লোক ছিলেন না। কোনো বিশেষ মতকেও প্রতিনিধিত্ব করেননি। তিনি ষোলো কোটি বাঙালির হৃদয়ছোঁয়া বিশ্বাস ও দেশাত্মবোধকে উচ্চকিত করার জন্য শেষ দিন পর্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন। তার প্রতি এ কোন ধরনের মৌনতা কিংবা অবহেলা?
তাকে কাছে থেকে জেনেছি। সান্নিধ্য পেয়েছি। হৃদয় মাপার যন্ত্র থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারতাম এত বড় মাপের মানুষকে যারা শ্রদ্ধা জানাতে জানেন না, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন না, ভালোবাসেন না তাদের বিবেক মরে গেছে। ক্ষুদ্র মনের ক্ষুদ্র পরিধিতে তারা ডুবে আছেন। মানসিক বৈকল্যের কাছে তারা হেরে গেছেন। দলান্ধ মত ও পথের কাছে আত্মসমর্পিত এই মানুষগুলো পেশাগত সম্ভ্রম হারিয়ে দিগভ্রান্ত হয়ে গেছেন। আলম ভাই, আমাদের ক্ষমা করবেন আমরা সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি, তাই আমরা বিবেকবর্জিত একদল মানুষরূপী কূপমণ্ডুক মাত্র। অকৃতজ্ঞতাই আমাদের শ্রেণীচরিত্র। এসব সীমাবদ্ধতার অনেক ঊর্ধ্বে আপনার অবস্থান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব সুকৃতির বিনিময় দিয়ে আপনাকে সম্মানিত করে জান্নাতবাসী করবেন।
২.
২৭ জুন ছিল বিএনপি আহূত বিরোধীদল-সমর্থিত সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ভিন্ন মত নিয়েও আমরা হরতাল সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। এর আগেও শত শত হরতাল হয়েছে। আজ যারা নিন্দাবাদের ঝড় বইয়ে দিচ্ছেন তারাই হরতাল সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ক’দিন আগেও। অবস্থানগত কারণে এখন সুর ভিন্ন। কমবেশি সব হরতালেই সংঘর্ষ-সঙ্ঘাত হয়েছে। ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে। তার পরও স্বীকৃতি দিতে হবে হরতালভিত্তিক রাজনীতি এবং বিরোধীদলীয় অবস্থানে আওয়ামী লীগ বেশ পারঙ্গম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচর্চায় যতটা আনকোরা, রাজপথের আন্দোলনে ততোধিক অভিজ্ঞ এবং সক্ষমতা প্রদর্শনে পারদর্শী। এ মূল্যায়ন একেবারে তাৎপর্যহীন নয়। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ শত মুখে চিৎকার করে বলতে জানে, যা অন্যরা জানে না।
দীর্ঘ দিন পর আহূত ২৭ জুনের হরতাল ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সমর্থন-অসমর্থনের কথা বাদ দিয়েও বলতে হবে বিরোধী দল আহূত সকাল-সন্ধ্যার এ হরতাল পালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কারণ যা-ই হোক, এর রূপ ছিল সর্বাত্মক। হরতাল ভয়তাল বলে যত বিদ্রূপই করা হোক এ হরতালে অর্জিত বিরোধী দলের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরবে বলে মনে হয় না। তাই সরকার সঠিক বার্তা গ্রহণ করলেই ভালো করবে। তবে সরকারের নৈতিক শক্তি শুধু দুর্বলই হয়নি ব্যাপক পিকেটিং ছাড়া এভাবে হরতাল পালিত হওয়ায় সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার গ্লানির সাথে একধরনের অসহায়ত্বও প্রকাশ পেয়েছে। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের এগারো দফার সাথে জনগণের একাত্মতা প্রকাশ পেয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়। সরকারি দলের মুখপাত্ররা কতটা অস্বস্তিতে আছেন তার প্রমাণ তো সৈয়দ আশরাফের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ ক্যামেরা ট্রায়ালের প্রশ্ন তুলে প্রমাণ করেছেন তিনিও বিব্রত। এখন আওয়ামী লীগ নেতারা হামলাকারীদের দায়িত্ব নিতে নারাজ। প্রশ্ন, পুরো দায় কি ডিএমপি কমিশনারের। নয়তো রাজপথে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের যৌথ হামলার দায়দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে। দেশে ক’টা সরকার আছে। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের কাছে নেই। জনগণকে বোকা ভাবা শাসকশ্রেণীর একধরনের বাতিক, দুরারোগ্য ব্যাধিও। ভাটির টান শুরু হলে ক্ষমতায় ধস নামে, তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কথা বলার সময় আত্মঘাতী কথা বলা হয়ে যায়। ওপরের দিকে থু থু ছিটানোর মতো ঘটনা ঘটে যায়। খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো অবস্থায় পড়ে গেলে, না ভেবে রগুড়ে ভাষায় কথা বলে সাহস তখনই দেখানোর গরজ বাড়ে। পুলিশকে আক্ষরিক অর্থে পেটোয়া বাহিনীর স্তরে নামিয়ে এনে এবার যেমনটি করল সরকারি দলের মুখপাত্ররা, তারাও বুঝতে পেরেছেন এভাবে আনা ঠিক হয়নি।
পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইনের ঊর্ধ্বে কোনো বাহিনীকে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। তাতে মানবাধিকারই শুধু লঙ্ঘিত হয় না, সেই বাহিনীর পেশাগত মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। এবার হরতালে পুলিশ ও র্যাবের অতি উৎসাহ ও তাণ্ডব প্রমাণ করেছে তারা পেশাগত দায়িত্ব পালন করেনি। সরকারের গুড বুকে থাকার জন্য আনুগত্যের প্রতিযোগিতা প্রদর্শন করেছে। নিম্ন মানের রাজনৈতিক লাঠিয়ালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে গিয়ে পেশাদারিত্বের প্রতি ঘৃণা ও অসম্মানের মাত্রা বাড়িয়েছে।
রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের কারণ হিসেবে যা বলা হচ্ছে তা রীতিমতো হাস্যকর, উদ্ভট ও প্রলাপের মতো শোনায়। সবচেয়ে ভয়াবহ ও মারাত্মক কর্মটি ঘটেছে মির্জা আব্বাসের বাড়িতে হামলার মাধ্যমে। তাকে গ্রেফতারের কারণ যা-ই হোক রাজনৈতিক অভিসন্ধি স্পষ্ট। সেটাও মানা যেতে পারে, কিন্তু তার বাড়িতে হামলা, ঘরে ঢুকে নারী-শিশু-বৃদ্ধা নির্বিশেষে বেধড়ক লাঠিপেটা করার কিভাবে আইনি ব্যাখ্যা দেয়া হবে? টিভি ক্যামেরা, সংবাদপত্রের ছবিতে নিপীড়ন ও বর্বরতার যে চিত্র ও প্রমাণ জনগণ প্রত্যক্ষ করল তারই বা ব্যাখ্যা কী! ছবিতে স্পষ্ট কোনো ধরনের প্রতিরোধ নেই, র্যাবের পোশাক ও জ্যাকেট পরা লোকেরা ঘরে ঢুকে মহিলাদের বেপরোয়া পেটাচ্ছে আর অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছে। এরা র্যাব না পোশাকি কোনো ছদ্মবেশী লাঠিয়াল জনগণ জানতে আগ্রহী। আমরা বিস্মিত এ-ই প্রথম দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল এলিট বাহিনীকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়ার জন্য অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে ব্যবহার করা হলো। কথিত র্যাবের অ্যাকশন থেকে বৃদ্ধা-যুবা রেহাই পেল না। তা হলে র্যাব নামের এলিট ফোর্সের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হলো? আমরা স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায়বোধ করি এ লজ্জা আমাদের সবাইকে ডোবাবে। রক্ষী বাহিনীর সমার্থক করে র্যাবকে রাজনৈতিক ব্যবহারের পরিণতি হবে অনেক ভয়াবহ এবং কল্পনাতীতভাবে ক্ষতিকর। কারণ র্যাবের ক্রসফায়ার নিয়ে কথা থাকলেও এই এলিট ফোর্সের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ ছিল না। মা-বোনদের ইজ্জত-আব্রু নিয়ে এভাবে জঘন্য আচরণের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা জানি না, এর সাথে কোনো অতি উৎসাহী লোক জড়িত কি না। আমরা জানতাম, বিভিন্ন বাহিনী থেকে বাছাই করা সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও কমিটেড জনবল নিয়ে এলিট ফোর্স র্যাবের যাত্রা শুরু। মির্জা আব্বাসের বাড়িতে র্যাবের পোশাকে যে তাণ্ডব ও বেপরোয়া ভাব প্রত্যক্ষ করল দেশবাসী, যে ভাষায় মা-বোনদের গালি দেয়া হলো তাতে নিজের কান-চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এই কী আমাদের ‘এলিট ফোর্স’, না কোনো মহল এই ফোর্সটিকে ধ্বংস করার জন্য এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছিল? একজন রাজনীতিবিদ গ্রেফতার হতে পারেন। তার জেলও হতে পারে। সেটি আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়। কিন্তু কোনো রাজনীতিবিদের আবাসস্থল, পাকঘর, শয়নকক্ষও নিরাপদ নয় এ ভাবনা রীতিমতো বিস্ময়কর এবং বড় ধরনের অঘটনের অশনি সঙ্কেত। গণতান্ত্রিক দেশে, গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনা করছে। সংসদ চলছে। অথচ ঘরের মহিলারাও নিরাপদ নয় এ যেন একাত্তরের দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। দেশে তো জরুরি অবস্থা চলছে না। কারফিউ বা সান্ধ্য আইনও কার্যকর নেই। এক শ’ চুয়াল্লিশ ধারাও জারি করা হয়নি। তা হলে দিনদুপুরে র্যাবকে কারা কিভাবে ঘরে ঢুকে অত্যাচারের নির্দেশ দিয়েছে তা স্পষ্ট হতে হবে। এ বাহিনীর ভাবমর্যাদা নষ্ট করার কোন দুরভিসন্ধি এর সাথে সংশ্লিষ্ট কি না, তাও তদন্ত হওয়া দরকার। কারণ এভাবে হামলে পড়ার দৃশ্য ভারত অধিকৃত কাশ্মীর, ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিন কিংবা মার্কিন দখলদারদের দিয়ে ইরাক-আফগানিস্তানে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে তা মানায় না। এ জন্য আইন কোনো সুযোগ রাখেনি। তা হলে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ সরকারের গণতন্ত্র চর্চার যে বীভৎস ও কুৎসিত চেহারা ফুটে উঠল তার ব্যাখ্যা কে দেবে? কে নেবে এর দায়?
কোথায় কী ঘটেছে সেসব নিয়ে এন্তার ভাবার সুযোগ আছে। চামড়া বাঁচাতে হলে সবাইকে এ নিয়ে ভাবতে হবে কার ইন্ধনে, কিভাবে, কেন বাড়িতে ঢুকে এমন তাণ্ডব সৃষ্টি করা হলো। বাড়িতে র্যাব ব্যবহারের ব্যাখ্যা এক্ষুনি পাওয়া জরুরি। দেশবাসীকে বোঝতে হবে এটি কিসের আলামত। এলিট বাহিনীকে ঘৃণিত করে ধ্বংস বা বিতর্কিত করার ফন্দি, না গণতন্ত্র হত্যার নতুন তাণ্ডব সৃষ্টির প্রাথমিক পদক্ষেপ?
পরিশেষে একজন মায়ের কাছে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। মা উহ্ করলে দোজখের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। মা’র দোয়ায় জাহান্নামের আগুন নিভে যায়। সেই মাকে ঘরে ঢুকে অসম্মান ও বিব্রত করার জন্য পুরো জাতির ক্ষমা চাওয়া উচিত। খালেদা জিয়া সশরীরে গিয়ে দায়মুক্ত হয়েছেন। লজ্জায় মাথা হেঁট হওয়ার কথা বলে সাবেক আইনমন্ত্রীও সময়োচিত কাজ করলেন। অ্যামনেস্টির প্রতিনিধিও কর্তব্য কাজটি সেরে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী তার দু’জন নারী মন্ত্রী ও সংসদ উপনেতাকে নিয়ে একজন মা, একজন বোন ও নিজঘরে নিগৃহীতদের সান্ত্বনা দিতে গেলে অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেত। উদারতা ও দায়বোধের নজিরও সৃষ্টি হতো। মির্জা আব্বাসের মা বলে কথা নয়, মা তো মা। তার অসম্মান পুরো মাতৃজাতির প্রতি অসম্মান। যে তরফ থেকেই হোক এ ধরনের অসম্মান মেনে নিলে আমাদের লজ্জা ঢাকবার সুযোগ থাকবে না।
লেখক --- মাসুদ মজুমদার