এক এগারোর পর থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের করুণ দশা নিয়ে বহুবার আক্ষেপ করে লিখেছি। তাতে কাজের কাজ কিছু না হলেও দেশে-বিদেশে নিত্যনতুন শত্রু তৈরিতে এরই মধ্যে বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছি। আওয়ামী লীগ সমর্থকগোষ্ঠী আমাকে পাকিস্তানের দালাল এবং ভারতবিদ্বেষী বলে অবিরাম গাল দিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশকে একটি বিনিয়োগ-বান্ধব রাষ্ট্ররূপে প্রচারের কৌশল হিসেবে টাটার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টার অপরাধে একই গোষ্ঠী আমাকে তখন ভারত ও টাটার দালাল সাব্যস্ত করেছিল। অপরদিকে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে জাতীয়তাবাদী ঘরানারও এক উল্লেখযোগ্য অংশ আমাকে কেবল একজন হঠকারী ও বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচনা করে না, সেই সঙ্গে বিদেশি শক্তির আশীর্বাদে পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ক্ষমতালাভের প্রধান অন্তরায় রূপেও মনে করে থাকে। অথচ এদেশের সুশীল (?) মিডিয়া এবং ভারতপন্থী কথিত বাম রাজনীতিকরা ফুলবাড়ি কয়লাখনি খ্যাত এশিয়া এনার্জির সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্কের সর্বৈব মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণায় মাঠ গরম করতে কসুর করেনি।
দেশবাসীর অনেকেই হয়তো জানেন না যে, এশিয়া এনার্জির পর্দার অন্তরালের ঘনিষ্ঠ মিত্র আদতে এসব সুশীল (?) মিডিয়ার কর্ণধাররাই। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার এশিয়া এনার্জির সঙ্গে যে চুক্তি সম্পাদন করেছিল, তার মধ্যকার দেশের স্বার্থবিরোধী ধারাগুলো, যেমন—মাত্র ৬ শতাংশ রয়্যালটির বিনিময়ে লাইসেন্স প্রাপ্তি এবং উত্তোলিত কয়লা অবাধে রফতানির সুযোগ আমিই জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলাম। এসব জাতীয় স্বার্থবিরোধী ধারা যে মানা যাবে না, তাও স্পষ্ট করেই বলেছিলাম। এর ফলেই এশিয়া এনার্জির বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। তবে একই সঙ্গে আমি এটাও বলেছিলাম যে, একটি রাষ্ট্র কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার পর ক্ষতিপূরণ প্রদান ব্যতিরেকে একতরফাভাবে সেই চুক্তি বাতিল করার আর সুযোগ থাকে না। সেই জন্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে চুক্তি বাতিলের হঠকারী দাবির সঙ্গে আমি কখনও সহমত পোষণ করিনি। আমি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তির ধারা পরিবর্তনের পক্ষে ছিলাম। সরকারের দায়িত্বে এখন না থাকলেও আমার সেই যৌক্তিক অবস্থান পরিবর্তন করিনি। বুদ্ধিমান রাজনীতিক, বুুদ্ধিজীবীরা অবশ্য সময় পাল্টালে রং পাল্টাতে মুহূর্তকাল বিলম্ব করেন না। সুবিধামত আপস না করার ব্যাপারে আমার নির্বুদ্ধিতা এবং গোঁয়ার্তুমির কারণেই বন্ধুসংখ্যা যে দ্রুত কমে আসছে সেটা অবশ্য দেখতেই পাচ্ছি। আবার সরকারের সব ধরনের হুমকি, নির্যাতন উপেক্ষা করে রাস্তায় একা হেঁটে যাওয়ার সময় অচেনা পথচারী যখন কুশল জিজ্ঞাসা করেন, আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানান, তখন এদেশে জন্মলাভ করার জন্য নিজেকে বড়ই সৌভাগ্যবান মনে হয়।
যাই হোক, স্বীকার করতেই হবে যে, বর্তমান সরকারের বন্ধুভাগ্য ঈর্ষণীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তাবত্ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং ভারতের সরাসরি আশীর্বাদ নিয়ে এ সরকার ক্ষমতাসীন হলেও একদা সমাজতন্ত্রী চীনের সঙ্গেও সমানতালে সখ্য বজায় রাখতে পারাটা নিঃসন্দেহে তাদের এক বড় সাফল্য। বোধগম্য কারণেই এই বন্ধুদের তালিকায় কোনো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের নাম নেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষিত সঙ্গী বিশ্বের সব ইসলামিক রাষ্ট্রকে শত্রু হিসেবে গণ্য করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বাংলাদেশের বিমূঢ় জনগণ এখনও উপলব্ধি করতে পারছেন কিনা জানি না, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সাফল্য পাওয়ার বিনিময়ে দেশের সার্বভৌমত্ব পুরোটাই বিকিয়ে দেয়া হয়েছে।
ক’দিন আগে সংসদে দাঁড়িয়ে উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের অপরাধে সরকার কর্তৃক আমাকে শায়েস্তা করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেছেন, আমার দেশ যা খুশি তাই লেখে, মাহমুদুর রহমানকে সতর্ক করে দেয়ার পর সে আরও খারাপ ভাষায় জবাব দেয়। তাই তো। সরকার সতর্ক করে দেয়ার পর খাটের নিচে পালিয়ে না থেকে উল্টো জবাব দেয়ার এই স্পর্ধা কি ক্ষমতাবানরা ক্ষমা করতে পারে? এই ভয়ঙ্কর অপরাধ করার পর জেল-জুলুম, হাতুড়ি পেটা—এসব তো তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আমার প্রাপ্যই। সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে নিগৃহীত তো অনেক হলাম। আজকের মন্তব্য প্রতিবেদনে সরকারের সাফল্যের গীত গেয়ে মহাজোটের মহানেত্রীকে বরঞ্চ কিছুটা খুশি করার চেষ্টা করি। বিদেশিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে চারদলীয় জোট সরকারের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক। বিদেশে কর্মরত কূটনীতিকদের ভিয়েনা কনভেনশন মান্য করে চলাটাই রীতি। ওই কনভেনশন অনুযায়ী কোনো কূটনীতিক মেজবান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্তত প্রকাশ্যে মন্তব্য অথবা হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। ‘অন্তত প্রকাশ্যে’ বলার হেতু হলো, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র ও সামরিক শক্তির বিচারে দুর্বল রাষ্ট্রের রাজনীতি যে বহুলাংশে বিশ্ব ও আঞ্চলিক মোড়লদের ইশারা-ইঙ্গিতে পরিচালিত হয়, এই সত্য অস্বীকার করা আর নিজেকেই নিজে ঠকানোর মধ্যে কোনো তফাত্ নেই। অর্থাত্, চড়-থাপ্পড় যাই দাও ভাই, দয়া করে দরজা বন্ধ করে দিও না—মাত্র এটুকুই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময় থেকে ২০০৮-এর নির্বাচন পর্যন্ত এদেশে কর্মরত কূটনীতিকরা বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় উপনিবেশের অধিক সম্মান যে দেয়নি, সেটি তো নিশ্চয়ই পাঠক এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাননি। সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের এই অবমাননাকর কর্মকাণ্ডে সহায়তা করার জন্য সেই সময় এ দেশেরই সুশীল (?) সমাজ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়ার সহায়তায় দিনের পর দিন মাতৃভূমির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপতত্পরতা চালিয়েছে। অপরদিকে কূটনীতিকের ছদ্মাবরণে এ কালের ভাইসরয়কুল অনেকটা সিবিএ’র (ঈড়ষষবপঃরাব ইধত্মধরহরহম অমবহঃ) আদলে ‘ট্যিউসডে গ্রুপ’ নামক সরাসরি ভিয়েনা কনভেনশন বিরোধী সংগঠনের জন্ম দিয়ে রাষ্ট্র এবং সরকারকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে। অর্থ, পদবি, পুরস্কার এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বিদেশি শক্তির পদলেহনকারী দালালদের অভাব বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কখনই হয়নি। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশেইবা তার ব্যতিক্রম ঘটবে কেন?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ নাম দিয়ে নীলনকশার এক সংগঠনকে মাঠে নামিয়ে এক এগারোর পথ প্রশস্ত করা হয়, যার পরিণামে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে সেক্যুলার একটি সরকারকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকার এসব ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড কেবল সহ্যই করেনি, তাদের নীতিনির্ধারকরা সস্তা প্রচারের লোভে যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের সভা-সেমিনারে উপস্থিত থেকে দেশবিরোধীদের এক ধরনের বৈধতাও দিয়েছে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের পদলাভের সঙ্গেই কাকতালীয়ভাবে ট্যিউসডে গ্রুপ এবং যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন উভয় সংগঠনেরই স্বেচ্ছামৃত্যু ঘটেছে। যোগ্য প্রার্থী আন্দোলনের প্রধান কুশীলব অবশ্য জরুরি সরকারের আমলে রাষ্ট্রের আইন ভেঙে এবং আদালতের নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে মইনের আশীর্বাদে জেনেভার বাংলাদেশ মিশন প্রধানের চাকরিটি বাগাতে পেরেছিলেন। সেই চাকরির সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি পেতেও তার কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এর বিনিময়ে বাংলাদেশের কী লাভ হয়েছে, তার জবাব দেয়ার জন্য মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন গং-এর কোনো চাঁইকেই এখন আর হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে ট্যিউসডে গ্রুপের কেন পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটল, সেই তথ্যটি জানার আমার অন্তত যথেষ্ট কৌতূহল রয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকরা প্রতি মঙ্গলবার নিজেদের মধ্যে মিলিত হয়ে আনন্দ-ফুর্তি করলে এদেশের জনগণের কিছুই যায়-আসে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত সব কূটনীতিক বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালীন প্রায় রাজকীয় জীবনযাপন করলেও তারা যে একেবারেই ভিন্ন পরিবেশে তিন-চার বছর কাটিয়ে যান, এটা তো খুবই সত্যি কথা। যদিও এদের সম্পর্কে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহলে এক মজার কৌতুক চালু আছে। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে কূটনীতিকের পদপ্রাপ্তি নিয়ে বিদেশিরা নাকি দু’বার কাঁদেন। প্রথমবার যখন পদপ্রাপ্তির সংবাদটি তাদের হোম অফিস থেকে জানানো হয়। কারণ, এই একবিংশ শতাব্দীতেও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানান কিসিমের আজগুবি প্রচারণা রয়েছে। যাই হোক, অশ্রুপাত করতে করতে এদেশে পৌঁছানোর পর দূতাবাস এবং বাসগৃহের শান-শওকত দেখে দন্তবিকশিত হতে তাদের খুব একটা সময় লাগে না। এদেশে সদ্য আগত রাষ্ট্রদূতদের স্বাগত জানাতে দূতাবাসের বাইরে তৈলভাণ্ড হাতে অপেক্ষমাণ বিশেষ শ্রেণীর ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সুশীল (?) প্রজাতি এবং করিত্কর্মা সম্পাদককুলের সারিও বিদেশিদের দ্রুত মনোরঞ্জনে যথেষ্টই সহায়তা করে। বাংলাদেশের মেয়াদকালে এসব দূত যেখানেই বিচরণ করেন, সেখানেই আবার দণ্ডহাতে দণ্ডায়মান ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা তাদের শান বৃদ্ধি করে থাকেন। বাঙালি ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের বহুল প্রচলিত প্রবচন, ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’—এসব মিডিয়ার কল্যাণে পরিবর্তিত হয়ে এখন রাষ্ট্রদূতদের কথা অমৃতসমানে পরিণত হয়েছে। শুনেছি, স্বল্প সময়ের মধ্যেই আবার হৃদয় আদান-প্রদানের মতো রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপারও নাকি ঘটে থাকে। না ঘটে উপায়টাই বা কী? হালে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত ভ্যালেন্টাইন ডে ভারতীয় পুরাণের মদনদেবের সঙ্গে মিলে পরবাসী মনকে নানা রঙে রাঙিয়ে ছেড়ে দেয়। এমন সুখের সাগরে ভেসে বেড়ালে তিন বছর নিমেষে পার হয়ে তো যাবেই। তারপর বিদায়বেলা দ্বিতীয়বারের অশ্রুপাত। হিজ এবং হার এক্সিলেন্সিদের বাংলাদেশে প্রায় রাজাধিরাজের জীবন কাটিয়ে
ফিরে যেতে হয় নিজ দেশে অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে। ভেজাল রাজপুত্রের পুনর্বার ব্যাঙের আদিরূপে প্রত্যাবর্তন আর কি!
ধান ভানতে খানিকটা শিবের গীত গাওয়া হয়ে গেল। পাঠককুল তো অবহিত আছেনই যে, শেখ হাসিনার সরকার আমাকে বাংলাদেশের ভেতরেই আটকে রাখতে চায়। জিয়া বিমানবন্দরে পা রাখা মাত্র ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের মধ্যে সাজসাজ রব পড়ে যায়। আমার এ লেখাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তার সেই উদ্দেশ্যপূরণে আশা করি যথেষ্ট সহায়তা করবে। কারণ, লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ ঢাকার দূতাবাসগুলোতে একটু কষ্ট করে পৌঁছে দিলেই আমার ভিসা প্রাপ্তি যে অসম্ভব হয়ে পড়বে, সেটি হলফ করেই বলা যায়।
যাই হোক, মহাজোট সরকারের চৌদ্দ মাসে সরকার তাদের দিনবদলের ইশতেহারে জনগণের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পালনে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেও কূটনীতিকদের মুখ বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। দেশে রীতিমত ঘোষণা দিয়ে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন চলছে। বিরোধী মতাবলম্বীদের গণগ্রেফতার করা হয়েছে, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাত্রা জেনারেল মইনের আমলকে লজ্জা দিচ্ছে, বিরোধী দল ও মতাদর্শের মধ্যকার অপছন্দের ব্যক্তিদের দুগ্ধপোষ্য শিশুসমেত গ্রেফতার করে মাসের পর মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হচ্ছে, সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকের মৌলিক অধিকারের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্র চলছে এবং স্বাধীনতার নামে বিচার বিভাগ, দুদক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ক্ষমতাসীনরা দেশবাসীকে পুতুল নাচ দেখাচ্ছে। তারপরও কোনো বিদেশি কূটনীতিককে ভিয়েনা কনভেনশন অমান্য করে অন্তত প্রকাশ্যে আগের মতো সরকারের মৃদু সমালোচনা করতেও শোনা যায়নি। দেশে নির্বিচারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চললেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ দীপু মনি জেনেভায় মানবাধিকার-বিষয়ক সম্মেলনে অকাতরে অসত্য বক্তব্য দেয়ার পরও সভাস্থলে পচা ডিম, টমেটো বর্ষণ ব্যতিরেকে সুস্থদেহে দেশে ফিরতে পেরেছেন। অথচ ১৯৯৫-৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ-জামায়াত ইসলামীর যৌথ আন্দোলনের সময় তোফায়েল আহমেদসহ কয়েকজন বিরোধীদলীয় নেতাকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য গ্রেফতার করা হলে তত্কালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে একই দেশের কূটনীতিকরা কোনোরকম রাখ-ঢাক করেননি। গ্রেফতারকৃতদের পরিবারের প্রতি আকুল হয়ে সমবেদনা জানানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা তখন দেখা গিয়েছিল। অতীত এবং বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ সত্যটি অস্বীকারের উপায় নেই যে, আওয়ামী লীগ নেতারা বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণের কৌশলটা ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ অকাতরে বিসর্জন দিয়ে দেশে দেশে বন্ধু সৃষ্টির নীতি গ্রহণ না করার শাস্তি বিএনপিকে পেতে তো হবেই।
তবে বিরোধী দল ও মতের বিরুদ্ধে মহাজোট সরকারের সব ধরনের নির্যাতনকে বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে পশ্চিমাদের অতি স্পর্শকাতরতা সামপ্রতিক ঘটনাবলীতে পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে। বাঘাইছড়ির ঘটনার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচার দাবি করে ব্রাসেলস থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পূর্ণ একপেশে যে বিবৃতিটি প্রকাশ করেছে, সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপেরই আর এক দলিল। পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে উভয় সমপ্রদায়ের মানুষই দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিহত হলেও কমিশনের বিবৃতিতে বাঙালি হত্যা এবং তাদের সম্পদ ধ্বংসের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। চিটাগাং হিলট্র্যাক্ট কমিশনসহ অসংখ্য এনজিওদের অর্থায়ন এবং সরাসরি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘ দিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্রমেই একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছে। বাংলাদেশে পূর্ব তিমুরের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা সামপ্রতিক ঘটনাবলীতে অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানালেও ব্রাসেলস’র দাবি অনুযায়ী পার্বত্যাঞ্চলের সামরিক কমান্ডে ঠিকই পরিবর্তন এনেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মহাজোটের ভেতর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অনুসরণ করে আমাদের সামরিক বাহিনীর
সদস্যদের বিচার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি খেদানোর দাবি তোলা হয়েছে।
নৌকায় সওয়ার হয়ে ডিজিটাল নির্বাচনের ম্যাজিকে যেসব রাজনীতিবিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখন বাংলাদেশের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ববিরোধী বক্তব্য রাখছেন, তারা কেউই কিন্তু পাহাড়িদের ভোটে নির্বাচিত হননি। মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পরবর্তী চার দশকে প্রমাণিত হয়েছে যে, বিদেশি শক্তির আনুকূল্য লাভ করতে হলে আত্মমর্যাদা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দাবিদার হলেও সাম্রাজ্যবাদ এবং আধিপত্যবাদের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কৌশল নিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করতে কিছুমাত্র সঙ্কোচবোধ করেনি। বিভিন্ন লেখায় বহুবার উল্লেখ করেছি, দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে আপসকামী রাজনীতিবিদদের প্রত্যাখ্যান করে দেশের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে জনগণকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। না হলে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে মানুষ এবং মাটি হয়তো থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী।