কখনো কখনো নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু বিনা প্রয়োজনে কোনো স্খাপনার নাম পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবে নেয়া হয় না। তার ওপর রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার কারণে নাম পরিবর্তন একধরনের অপরাধ। পরশ্রীকাতরতা। কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই বোঝা যায়, সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে শুধু রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে। প্রধানমন্ত্রীও এ ক্ষেত্রে অকপট। তবে এভাবে ভাবমর্যাদার নাক কেটে জাতির যাত্রা ভঙ্গ করার জন্য খেসারত দিতে হবে শত শত কোটি টাকা। বিএনপি’র গায়ে জ্বালা ধরাতেই নাকি এ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্খা। জিয়ার স্খলে এর নতুন নাম হবে হজরত শাহজালাল রহ: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বাংলার মানুষের কাছে শাহজালাল রহ: একজন প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ, বুজুর্গ ও যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত, একই সাথে পরম শ্রদ্ধেয়ও। হজরত শাহজালালের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা এ নামকরণের পেছনে কাজ করেনি। মন্ত্রিসভা অতশত ভাবেনি। ভেবেছে জিয়া অসহ্য, তাই বিতর্ক এড়াতে ধর্মীয় আবেগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার তাগিদ জেগেছে। মন্ত্রিপরিষদের সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব সাংবাদিকদের নতুন নামকরণের উদ্ভট এক কারণ জানিয়েছেন। যে কারণটি সুস্খ বিবেকের কোনো মানুষ মেনে নেয়নি। অনেকের স্মরণে থাকার কথা ১৯৮১ সালে তদানীন্তন সরকার শহীদ জিয়ার নামে এর নাম দিয়েছিল। এর আগে এটির নাম ছিল কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। আরো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকার শহীদ জিয়াউর রহমানের নামে কোনো স্খাপনা না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জিয়ার নাম উপড়ে ফেলার এ সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তব তার চেয়েও বড় প্রশ্ন এটা কোন ধরনের ক্ষমতার দাপট! ইতিহাস-সচেতন কোনো মানুষের এত দাপট থাকতে নেই। এত দাপটের শেষ ভালো হয় না। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক থেকেও জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দেয়া হচ্ছে। নাম বাদ দেয়া, ফলক উপড়ে ফেলা ও নাম মুছে দেয়ার তালিকা নেহাত ছোট নয়। মজার ব্যাপার যে, নাম পরিবর্তনের পক্ষে আদালতের একটি রায়ের বরাত দেয়া হয়েছে। সরকার দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষকে হয় বোকা ভাবে, নয়তো মানুষরূপেই গণ্য করে না। নয়তো আদালতের যে রায়টির কোনো চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি তার বরাতে এভাবে প্রতিপক্ষের নাম-নিশানা মুছে ফেলার উৎসবে মেতে ওঠা কি ক্ষমতার বিকার নয়! আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে আর কত বাড়াবাড়ি করা হবে। পরশ্রীকাতরতায় ভর করে জিয়ার নাম পরিবর্তন করতে শুধু বিমানবন্দরের ক্ষেত্রেই প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। অন্য একটি পত্রিকার সূত্র মতে, এক হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। নাম পরিবর্তন করতে ডকুমেন্টেশন ছাড়াও ১৭৮টি সেগমেন্টে পরিবর্তন আনতে হবে, যা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার শ্রাদ্ধ মাত্র। এটা যেন ঘোড়ারোগ ও রাজনৈতিক বিলাস।
দেশের একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, যিনি একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক, মুক্তিযোদ্ধা এবং সেক্টর কমান্ডারও বটে, তার নামটি ৩০ বছর পর এভাবে উপড়ে ফেলা কোনোমতেই যৌক্তিক বলে প্রমাণ করা যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে যে যুক্তি দেয়া হয়েছে, সেটি উদ্ভট, মনগড়া এবং বিলুপ্তপ্রায় রাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বহি:প্রকাশ মাত্র। এতে সরকারের ও মন্ত্রিপরিষদের ভাবমর্যাদাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এটা যে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষের একটি জঘন্য নজির, তা জাতির সামনে স্পষ্ট। এর মাধ্যমে সরকার কিছুই অর্জন করবে না, বরং এর মাধ্যমে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার সাথে দলাìধ ভাবনারও বহি:প্রকাশ ঘটেছে, যা শুধু ঘৃণারই প্রসার ঘটাবে। নতুন নামকরণের রাজনৈতিক দুরভিসìিধ আড়াল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, যদিও দৃষ্টি ফেরানোর জন্য সরকার ধর্মীয় আবেগ ও চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে। একজন মহান সুফি-সাধকের নাম টেনে এনে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের হীনম্মন্যতাও এখানে স্পষ্ট। এর মাধ্যমে সরকারের দেউলিয়াপনা ও স্ববিরোধিতা আড়াল করার আর কোনো সুযোগ রইল না।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনুমোদনযোগ্য; কিন্তু রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের নামই ধর্মব্যবসায় হলে এ ধরনের গর্হিত কাজ ধর্ম ব্যবসয়ের নামান্তর ভাববো না কেন, যা বকধার্মিকতা হিসেবেও সব যুগেই চিহ্নিত এবং নিন্দিত হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশকে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে নিতে আগ্রহী। অতি উৎসাহী ও বাঙালি মুসলমানের মন বুঝতে অক্ষমরা ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ডিইসলামাইজেশনের কাজটাও শেষ করতে চান। যদিও এ ধরনের বাড়াবাড়ির খেসারত হবে মারাত্মক। অর্জন হবে শূন্য। ধর্মীয় সংগঠন, সংস্খা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে সরকারের নেতিবাচক অবস্খান ও প্রচারণা তুঙ্গে। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, তালেবান, লাদেন বাহিনী কত নামেই না ধর্মপন্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষোদ্গার করা হচ্ছে। কিন্তু একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ, ইসলামের দাওয়াত দানকারী, যিনি প্রত্যক্ষ জিহাদে অংশ নিয়ে সিলেট বিজয়ের রূপকার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন, সেই মহান সুফি সাধকের নামকে বিদ্বিষ্ট রাজনীতির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা অত্যন্ত অশোভন নয় কী! সব ইতিহাসবিদ একমত হবেন হজরত শাহজালাল রহ: এ যুগে একই ভূমিকা পালন করলে তাকে জঙ্গিবাদী বলা হতো, সাম্প্রদায়িক কিংবা মৌলবাদী ধর্মাìধ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। হজরত শাহজালাল ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, এর প্রতিবìধকতা সৃষ্টিকারী অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। বিজয়ী হওয়ার পর তার শিষ্যদের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে মুসলিম শাসনের সপক্ষে কাজ করতে ও ইসলামের গৌরবগাথা প্রচারের দায়িত্ব পালনের তাগিদ দিয়েছেন, যা মোটেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নয়। হজরত শাহজালাল ছিলেন আপাদমস্তক ধর্মপন্থী এবং বাগদাদভিত্তিক খেলাফতব্যবস্খার আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি। একই সাথে আদর্শ হিসেবে ইসলামের বিজয়কামী। এখনো তিনি ইসলামের প্রতিষ্ঠাকামীদেরই প্রেরণার উৎস। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রেরণা পুরুষ নন।
এত আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় জানা দরকার কে এই শাহজালাল রহ:। শাহজালাল রহ: বাংলার একজন প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক ও আউলিয়া। সিলেট বিজয়ের এ সাহসী যোদ্ধা সিলেটের মাটিতেই সমাহিত আছেন। আমাদের অনেক রাজনীতিবিদই হজরত শাহজালালের কবর জিয়ারত করেই নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। যদিও হজরত শাহজালাল রহ: প্রচলিত ক্ষমতাìধ রাজনীতির কোনো ধারারই প্রেরণা পুরুষ ছিলেন না। এখনো নন।
সিলেট জয়ের সাথে হজরত শাহজালাল রহ:-এর নাম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ইতিহাসের বক্তব্য হচ্ছে, গৌরগোবিন্দ নামে একজন নিপীড়ক ও দুর্বিনীত হিন্দু রাজা সিলেট অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। বুরহানুদ্দীন নামে একজন মুসলমান তার এলাকায় বাস করতেন। তার পুত্রের আকিকা উপলক্ষে তিনি একটি গরু জবাই করেছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে একটি চিল জবাই করা গরুর এক টুকরা গোশত নিয়ে এক ব্রাহ্মণের ঘরে (অন্য এক বিবরণ অনুযায়ী রাজার মন্দিরে) ফেলে। এ জন্য রাজার আদেশে শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং বুরহানুদ্দীনের হাত কেটে ফেলা হয়। বুরহানুদ্দীন গৌড়ে গিয়ে সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহর কাছে বিচার প্রার্থনা করেন। সুলতান তার ভ্রাতুষ্পুত্র সিকান্দর খান গাজীর নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী পাঠান। গৌরগোবিন্দ দুইবার তাকে পরাজিত করেন। এরপর সুলতান তার সিপাহসালার নাসিরুদ্দীনকে যুদ্ধে যেতে নির্দেশ দেন। ঠিক সে সময়ই ৩৬০ জন সাথী নিয়ে শাহজালাল রহ: বাংলায় আসেন এবং সিলেট অভিযানে মুসলমান সৈন্যবাহিনীর সাথে যোগ দেন। এবার মুসলমান সৈন্যরা জয়লাভ করেন। গৌরগোবিন্দ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং সিলেট মুসলমানদের শাসনাধীন হয়।
এ কাহিনী ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত। রাজা গৌরগোবিন্দ, সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ, সিকান্দর খান গাজী, নাসিরুদ্দীন, শাহজালাল রহ: তারা সবাই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ ১৩০১ থেকে ১৩২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন এবং চার দিকেই তিনি রাজ্যবিস্তার করেছিলেন। শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে সিলেট বিজয়ের এবং এর সাথে শাহজালাল রহ:-এর সংশ্লিষ্টতার ঐতিহাসিকতা লিপিগত এবং সাহিত্যিক উৎসগুলো দ্বারাও সমর্থিত।
সোনারগাঁয়ে সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর রাজত্বকালে (১৩৩৮-১৩৪৯ খ্রি ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন। তিনি ১৩৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহজালাল রহ:-এর সাথে তার খানকায় সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং সেখানে তিন দিন অবস্খান করেছিলেন। ইবনে বতুতা এই দরবেশের নাম শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজিরূপে লিপিবদ্ধ করেছেন।
মুসলমানদের প্রথম সিলেট বিজয় এবং সেখানে ইসলামের আবির্ভাব সম্পর্কিত প্রথম এবং গ্রহণযোগ্য তথ্যের উৎস হচ্ছে একটি ফারসি শিলালিপি। এটির তারিখ হচ্ছে ৯১৮ হিজরি/১৫১২ খ্রিষ্টাব্দ এবং এটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর রাজত্বকালে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এ শিলালিপি অনুসারে শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে সিকান্দর শাহ গাজী ৭০৩ হিজরি/১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সিলেট জয় করেন। শিলালিপিটি শায়খ জালাল মুজাররদ ইবন মুহম্মদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এটি ঘটনার নির্ভুল তারিখ এবং ইতিহাস সত্যের প্রমাণ উপস্খাপন করে।
হজরত শাহজালাল রহ: ও তার সাথীদের সিলেট বিজয়ের বিবরণ গওছীর গুলজার-ই-আবরার গ্রন্থেও পাওয়া যায়। শায়খ আলী শের-এর লেখা একটি পূর্বতন গ্রন্থ শরহ্-ই-নুজহাত-উল-আরওয়া থেকে নেয়া উপাদানের সাহায্যে এটি লেখা হয়েছিল। শায়খ আলী শের ছিলেন শায়খ নূরুল হুদা আবুল কারামতের বংশধর। শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন হজরত শাহজালাল রহ:-এর সাথী এবং তিনি সিলেট বিজয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এই উৎস অনুসারে শায়খ জালালুদ্দীন মুজাররদ ছিলেন তুর্কিস্তানে জন্মগ্রহণকারী সিলেটের অধিবাসী এবং তিনি ছিলেন সুলতান সাইয়্যদ আহমদ ইয়াসাভীর খলিফা। পীরের অনুমতি নিয়ে তিনি তার ৭০০ সঙ্গীসহ জিহাদে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে আসেন এবং বাংলায় পৌঁছার সময় তার সাথে ৩৬০ জন সঙ্গী ছিলেন। তারা সিলেটের রাজা গৌরগৌবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। গৌরগোবিন্দ পালিয়ে যান এবং সিলেটের আশপাশ এলাকা বিজয়ীদের দখলে আসে। শাহজালাল রহ: তার শিষ্যদের মধ্যে বিজিত অঞ্চল ভাগ করে দেন। যাতে তারা ইসলামের দাওয়াত দিতে পারেন এবং ইসলাম অনুসরণে জীবনযাপনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন।
শাহজালাল রহ:-এর পিতার নাম মুহম্মদ এবং তিনি ছিলেন ইয়েমেনের একজন সুফি সাধক। বাল্যকালে তিনি তার পিতা-মাতাকে হারান এবং তার চাচা সাইয়্যদ আহমদ কবীর, যিনি ছিলেন একজন বড় বুজুর্গ, তাকে লালন-পালন করেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভের পর তিনি তার মামার কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করেন। তার পর মামা তাকে একমুঠো মাটি দিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতে যেতে নির্দেশ দেন। তিনি তাকে আরো বলে দেন, যে জায়গায় অনুরূপ রঙ ও গìধযুক্ত মাটি পাওয়া যাবে তিনি যেন সেখানেই প্রার্থনা ও ধ্যানে তার বাকি জীবন কাটান। পথে শাহজালাল রহ: দিল্লিতে শেখ নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহ:-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। নিজামুদ্দীন আউলিয়া রহ: তাকে এক জোড়া কবুতর দিয়েছিলেন। এ ধরনের কবুতর এখন সিলেটে শাহজালালের দরগায় এবং বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। এরপর শাহজালাল বাংলায় চলে আসেন। এ সময় সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের সৈন্যদল সিলেটের রাজা গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। শাহজালাল রহ:, তার সাথী ও শিষ্যরা যুদ্ধে যোগদান করেন। যুদ্ধে মুসলমান সেনাবাহিনী জয়লাভ করে।
কিছুটা সত্যতা, কিছুটা কিংবদন্তি ও জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে পরে রচিত গ্রন্থ হলেও সুহায়েল-ই-ইয়ামানকে অনেক দিন পর্যন্ত হজরত শাহজালাল রহ:-এর মানসম্পন্ন জীবনীগ্রন্থরূপে বিবেচনা করা হতো। এ গ্রন্থানুসারে শাহজালাল রহ: এসেছিলেন ইয়েমেন থেকে। কিন্তু ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটে আবিষ্কৃত একটি শিলালিপিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, শাহজালাল রহ: ছিলেন কুনিয়ায়ি অর্থাৎ তিনি এসেছিলেন তুরস্কের কুনিয়া শহর এলাকা থেকে। এ শিলালিপি অনুসারে শাহজালাল তুরস্ক থেকে এসেছিলেন।
সৌভাগ্যক্রমে ইবনে বতুতার ভ্রমণ-রোজনামচা-য় হজরত শাহজালাল সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি শাহজালালকে একজন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন অতিবৃদ্ধ মহান সুফি সাধকরূপে বর্ণনা করেছেন। তাকে বলা হয়েছিল, শাহজালাল বাগদাদে খলিফা আল-মুস্তাসিম বিল্লাহকে দেখেছিলেন এবং খলিফার হত্যার সময় তিনি সেখানে ছিলেন। পরে তার অনুচররা ইবনে বতুতাকে বলেছিলেন, হজরত শাহজালাল ১৫০ বছর পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেছিলেন। তিনি প্রায়ই রোজা রাখতেন। অনেক সময় সারা রাত নামাজ পড়তেন। তিনি ছিলেন শীর্ণ, লম্বা এবং তার সামান্য দাড়ি ছিল। সিলেট, আসাম ও করিমগঞ্জের পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দারা তার কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
ইবনে বতুতা হজরত শাহজালাল রহ:-এর কিছু কারামতও বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, পরের বছর বেইজিংয়ে থাকাকালে তিনি এই আউলিয়ার মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেয়েছিলেন। আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যায়, ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন ১৩৪৫-১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। তাই হজরত শাহজালালের মৃত্যু তারিখ ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্ধারণ করা যায়।
হজরত শাহজালাল রহ:-এর জীবন, কর্ম এবং ভূমিকা অবশ্যই আমাদের প্রেরণার উৎস। কিন্তু তিনি প্রচলিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক কদর্য রাজনীতির উপাত্ত হয়ে ব্যবহার হলে আমরা লাভবান হবো না, বরং রাজনীতির পঙ্কিল ও কদর্য রূপ এই মহান সাধকের ভাবমর্যাদার ওপর শুধু কালিমাই লেপন করবে।
এটা জানা কথা, জাতীয় নেতারা কেউ সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে থাকেন না; তারা কেউ দরবেশ বা আউলিয়া নন। দোষ-গুণ নিয়েই তারা জাতীয় নেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। তাদের সাথে আমাদের সংযোগ শুধু রাজনৈতিক কারণেই নয়, তারা ইতিহাস-ঐতিহ্যেরও অংশ হয়ে থাকেন। নাম পরিবর্তনের এ বিদ্বেষপূর্ণ ভাবনা একধরনের ভ্রান্তি এবং অপরিণামদর্শিতাও। এর ফলে ইতিহাসের সাথে অনেক সম্পর্ক চুকে যায়। জাতির ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে।
নানা কারণে সরকারের সাফল্যের ঝুড়ি প্রায় শূন্য। তাই জাতিকে বিভাজনের কাজটি পুরোদমে চলছে। এখন সরকার দিন বদলের পরিবর্তে নাম বদলের যে অপসংস্কৃতির চর্চা করে চলেছে, তাতে জাতি আরো বেশি বিভক্ত হয়ে পড়বে। জাতীয় নেতারা কেউ পক্ষবিশেষের রোষানলের ঊর্ধ্বে থাকবেন না। রাজনীতিতে এই বিভাজন প্রক্রিয়ার প্রভাব কোনো দিন শেষ হবে না। ফলে ক্ষমতার দাপটের কাছে জাতীয় ঐক্যচিন্তার অপমৃত্যু ঘটবে। অন্যদের উপড়ে ফেলার কাজে লিপ্ত সরকার এক সময় নিজেই উপড়ে যেতে বাধ্য হবে।
তা ছাড়া ‘মৌলবাদের’ ভূত তাড়াতে জিহাদ ঘোষণা করে সরকার নিজেই মৌলবাদের পক্ষপুটে ঢুকে পড়েছে। আওয়ামী লীগের ইতিহাস যদ্দুর জানি, এ দলটি কোনো দিনই অসাম্প্রদায়িক ছিল না। মুসলিম লীগের অপভ্রংশ হিসেবেই এর জন্ম এবং বিকাশ। এ দলটি ধর্মকে রাজনীতি থেকে উপড়ে ফেলার জিগির তোলে, কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থে ও নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার শত গুণ বাড়িয়ে দেয়। ওলামা লীগকে দিয়ে বিবৃতি দেয়ার ব্যবস্খা করে। আজকের আওয়ামী লীগকে দিয়ে বঙ্গবìধুর রাজনীতি বিচার করলে বঙ্গবìধু একজন মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত হবেন কি না ভেবে দেখা যেতে পারে। তার মাদ্রাসার প্রতি দরদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন, ওআইসিতে যাওয়ার ঘটনা, ৭ মার্চের ভাষণে ইনশাআল্লাহর বুলন্দ উচ্চারণ, দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের ভাবনা অতি প্রগতিবাদীরা কিভাবে নেবেন, সেটা নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
আমরা মনে করি, সরকার বঙ্গবìধুর পথ থেকেও বিচ্যুত হয়েছে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে এখন শঙ্কর। তা ছাড়া হাজার বিতর্কের ইস্যু ছুড়ে দিয়ে সরকার ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। এর ফলে বিতর্কের ইস্যু বাড়বে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্র আরো ধোঁয়াটে হবে। সেই সাথে পদক্ষেপগুলো অসহিষäু রাজনীতিকে আরো বেশি মাত্রায় গ্রাস করবে। এ বিপজ্জনক বাড়াবাড়ি থেকে সরে আসা উচিত। সরকার আমাদের সুফি সাধকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিকল্প পথ নিয়ে ভাবতে পারে। দেশের স্খপতি এবং জাতীয় নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা অটুট রাখতে বিতর্ক পরিহার করে দূরদর্শিতা ও সুস্খ চিন্তার বহি:প্রকাশ না ঘটালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আওয়ামী লীগ। বাংলার জমিনকে পাহারা দিচ্ছেন পীর-মাশায়েখ-আউলিয়ারা। এক কোণে খানজাহান আলী, অন্য কোণে শাহ মখদুম, অপর প্রান্তের এক পাশে বারো আউলিয়া, অন্য পাশে শাহজালাল রহ:। তারা কেউ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না। যেমন ধর্মনিরপেক্ষ নন বাংলার মানুষ। হিন্দু-বৌদ্ধ নির্বিশেষে এখনকার সব মানুষ ধর্মপ্রাণ। হাজার বছরের ইতিহাস ধর্মপ্রাণ মানুষের সহাবস্খানের ইতিহাস। বাংলায় মুসলিম শাসনকালই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসের স্রষ্টা। ইসলামের প্রকৃত অনুসারীরা কোনো দিন ধর্মাìধ হন না, সাম্প্রদায়িক হন না, সন্ত্রাসী হন না। কারণ সন্ত্রাস মোকাবেলা করেই নবী-রাসূলরা ইসলামকে বিজয়ী করেছেন। বাংলার মানুষ ধার্মিক কিন্তু ধর্মাìধ নয়, সম্প্রদায় পরিচিতি স্পষ্ট কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। ইসলামের এই ভারসাম্যমূলক শাশ্বত আহ্বান ও মানবিক আদর্শ কোনো প্রান্তিকতাকে ঠাঁই দেয় না। এটাই শাহজালাল রহ:সহ আউলিয়াদের শিক্ষা, যা এ দেশের উল্লেখযোগ্য আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ অনুসরণ করে চলেছেন। যেটি আমাদের ঐতিহ্যও।
পরিশেষে আমরা যখন আওলিয়া প্রীতির ভড়ং দেখছি, তখনই লক্ষ করছি দাড়ি-টুপি পরা ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং পর্দা পরা মেয়েরা নিজেদের অরক্ষিত ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্ররা। বাংলাদেশের মানুষ দলবিশেষকে যেমন ধর্ম-কর্মের লিজ দেয়নি, তেমনি ইসলাম নির্মূলের বা উৎখাতের ঠিকাদারিও কাউকে দেয়নি। সরকার যেনো ঠাণ্ডা মাথায় ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মপ্রীতিকে কটাক্ষ করে চলেছে। এ মাটি এ ধরনের ধৃষ্ঠতা কখনো সহ্য করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। আবার যদি মানুষ উপসংহার টেনে নেয় এ সরকার ধর্মের প্রতিপক্ষ, তাহলে শেষ রক্ষার কোন উপায় থাকবে না।
লেখক--- মাসুদ মজুমদার