ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ১৪/এ সড়কের ৩৫ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রতি বছর এখানে প্রথম বর্ষে ৭০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। কিন্তু প্রথম বর্ষ পার হওয়ার আগেই শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২৫ থেকে ৩০ জনে। কারণ একটাই, শিক্ষার্থীদের ওপর নানা নির্যাতন। মানসিক নির্যাতনই বেশি হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষার্থীদের বাবা-মাকে জড়িয়ে কটূক্তি করে মানসিকভাবে হেনস্থা করা হয়। ৪ বছরের কোর্স ৮ থেকে ১০ বছরেও শেষ হয় না। মানসিক নির্যাতন আর প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে কেউ কেউ কোর্স শেষ হওয়ার আগে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, চিকিৎসা সেবার আড়ালে ‘টর্চার হোম’-এ পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজ। শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ইউটিউবে। নির্যাতনের কারণে গত শিক্ষাবর্ষে এক র্যা ব সদস্যের মেয়ে কলেজ ছেড়ে চলে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওপরই মূলত নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। নির্যাতনে টিকতে না পেরে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখাই ছেড়ে দেন। কেউ কেউ বছরের পর বছর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে আসছেন। সমপ্রতি প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হওয়ায় টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। মানসিক নির্যাতনের বর্ণনা করে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান, অনারারি সেক্রেটারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, ফেকালটি অব মেডিকেল, কলেজের অধ্যক্ষ, পুলিশের আইজিপি, র্যা বের ডিজিসহ আরও কয়েকজনের কাছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরের ২৬শে জানুয়ারি ৪র্থ তলায় প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের তীর কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক লাবুদা সুলতানা ও ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল মেটিরিয়ালসের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সেঁজুতি হকের বিরুদ্ধে। অধ্যাপক সেঁজুতি হকের অনৈতিক কাজে সমর্থন দেন অধ্যক্ষ। তিনি কার্যকরী কোন ব্যবস্থা নেন না।
অধ্যাপক সেজুতি হক প্রথম ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের বলেন, আমি অন্যদের চেয়ে অন্যরকম। অনেক সময় কুকুরের মতো আচরণ করবো। এজন্য তোমরা প্রিপেয়ার থেকো। শিক্ষার্থীরা জানান, ১০ই জুন পরীক্ষা হচ্ছিল। প্রত্যেকটা বিভাগেই টিউটোরিয়াল বা প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়। কিন্তু অধ্যাপক সেঁজুতি হকের বিভাগে দীর্ঘদিন ধরেই টিউটোরিয়াল পরীক্ষা হয় না। শিক্ষকদের অসহযোগিতার জন্য অনেক শিক্ষার্থী ৪-৫ বছরেও প্রথম বর্ষ শেষ করতে পারেনি। ১০ই জুন প্রথম বর্ষের ১ম সাময়িক (ফার্স্ট টার্ম) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে এপ্রিলে প্রস্তুতিমূলক ফার্স্ট কার্ড পরীক্ষা হয়। ওই পরীক্ষায় ১০-১২ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারেননি। ১ম সাময়িক পরীক্ষা চলাকালে পরীক্ষা না দেয়া সবাইকে দাঁড় করিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করেন। একজন শিক্ষার্থী জবাবে বলেন, তার দাদি মারা যাওয়ার কারণে তিনি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এ সময় অধ্যক্ষ সেঁজুতি হক বলেন, যত বুড়োবুড়ি মারা যায় আমার পরীক্ষার সময়। এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা আলোচনা করেন। ১১ই জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। তাতে ৮০ জন শিক্ষার্থী স্বাক্ষর করেন। আলোচনার কথা বলে ১৫ই জুন ৫ম তলার হলরুমে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসেন অধ্যক্ষ অধ্যাপক লাবুদা সুলতানা। এ সময় হলরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের বলা হয়, তোমাদের অভিযোগের কারণে অধ্যাপক সেঁজুতি হক মানহানি মামলা করবেন। এখনও সময় আছে দুঃখ প্রকাশ করলে আমরা তোমাদের প্রটেকশন দেবো। এ সময় ভয়ে অনেকেই বলেন, আমরা অভিযোগে স্বাক্ষর করলেও বিষয়টি পড়িনি। এ সময় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই একই ধরনের কথা বলেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের বক্তব্য ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখা হয়। এর আগে অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের এককভাবে ডেকে নানা ধরনের হুমকি দেন। সেই সঙ্গে প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের বাবা-মাকে ফোন করে বলেন, আপনার সন্তান কলেজে এসে গুন্ডামি করছে।
ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একজন ছাত্রী বলেন, অধ্যাপক সেঁজুতি হক আমাদের সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করেন। কিছু কিছু শিক্ষার্থীকে তিনি টার্গেট করেন। তিনি সবসময় আমাদের নির্যাতন করেন। মা-বাবাকে উল্লেখ করে কথা বলেন। আমাদের আগের ব্যাচের এক ছাত্রী নির্যাতনের কারণে কলেজ ছেড়ে চলে গেছেন। আরেকজন ছাত্রী বলেন, এখানে তেমন কোন পড়ালেখা হয় না। প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা ছাড়াই ডাইরেক্ট টার্ম পরীক্ষায় চলে যায়। ম্যাডাম আমাদের অনেক অপমান করেন। মুখে ওড়না দেয়া এক ছাত্রী বলেন, একটি বই কিনতে দেরি হলেই ম্যাডাম আমাদের বলেন, তোমরা কি গরিবের বাচ্চা? তোমার বাবা-মা’র কি টাকা নেই? ওই ছাত্রী বলেন, ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলার অধিকার কোন শিক্ষকের নেই। ফাইনাল ইয়ারের এক ছাত্র বলেন, আজকে যারা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে এর পেছনে একটা কারণ আছে। তিনি বলেন, ইনটার্নাল শিক্ষক চাইলে একজন ছাত্রকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন। আমরা অনেক সমস্যা পেরিয়ে এসেছি। তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় ৭০ জন শিক্ষার্থী। অথচ দ্বিতীয় বর্ষে দেখা যায় মাত্র ২৫ জন শিক্ষার্থী আছে। বাকিরা যায় কোথায়? তিনি বলেন, বর্তমানে ১৮তম ব্যাচ চলছে। অথচ ৫ম ব্যাচের শিক্ষার্থী এখনও রয়ে গেছে। এর কারণটা কি? তিনি বলেন, মানুষ বাঘকেও এত ভয় পায় না। আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী একই ধরনের কথা বলেন।
ডেন্টাল কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, এখানে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা সত্য। এখানে কেউ প্রতিবাদ করলেও লাভ হয় না। কয়েকদিন আগে কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে একটি মিটিং হয়। কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে বাধা দেয়া হয়। প্রতিবাদে কয়েকজন শিক্ষক মিটিং থেকে ওয়াকআউট করেন। বক্তব্যের জন্য কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক লাবুদা সুলতানার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। আমরা এখনও রিপোর্ট পাইনি। এ বিষয়ে অধ্যাপক সেঁজুতি হক বলেন, কিছু শিক্ষার্থী না বুঝে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। পরে তারা ক্ষমা চেয়েছে। বিষয়টা মীমাংসাও হয়ে গেছে। নির্যাতনের বিষয়টাও সঠিক নয়। ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও সম্পর্কে তিনি বলেন, বিষয়টা আমি এখনও জানি না। ওই ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। রিপোর্টটি এখনও পৌঁছেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাবি’র কলেজ পরিদর্শক ড. বিমল কান্তি গুহ বলেন, আমরা এখনও তদন্ত রিপোর্ট পাইনি। তিনি বলেন, বিষয়টি দেখার দায়িত্ব গভর্নিং বডির। তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আমরা বিষয়টা দেখবো।
তথ্যসূত্র দেখতে এখানে ক্লিক করুন