শোন,
কুয়াশার রাতের রূপকথার গল্প কোন;
বিছানায় জেগে থেকে কাটিয়েছি দীর্ঘরাত,
চেয়ে দেখেছি তোমার ঘুম চোখে স্বপ্নের কারুকাজ।
আমাকে তুমি বোঝনি;
মিথ্যে অভিমানে উদাস থেকেছো,
হিসাবের গরমিল হতেই পারে!
চেয়ে দেখো -
ছেলেটির হাতের কোমল স্পর্শ,
আমাকেও কতটা ব্যাকুল করে !
তোমার - আমার এইতো সুখের সোপান;
যেখানে মশারির ওপাশে নিমগ্ন জোছনায় শিশির ঝরে।
তুমি যারে সংসার ভেবে অনুযোগী হও,
আমিও তারে স্বর্গ ভেবেই নীড়ে ফিরি,
তবু আমার চৌকাঠে ঘূণে ধরে,
অন্ধকারের মোহনায় তেলাপোকা খুঁজে ফেরে;
জীবন মৃত্যুর দ্বৈরথে বেঁচে থাকার উৎস।
ভোর হয়,
আকাশে সূর্য হাসে নিজ প্রতিভায়,
মরুপাতার ফাঁকে রোদের পরিহাস,
আমার কপালেও নোনা ঘাম হয়ে স্বপ্ন ঝরায়,
যখন তুমি খুনসুটি করে চলো;
হাড়ি আর খুন্তির দন্দে জলন্ত উনূনে।
জানি ঘুমহীন দুপুর তোমাকে কাটাতে হয়না,
যানজটের তীব্র ধকল পোহাতে হয়না,
তবু তোমার জন্য লাল গোলাপ নিয়ে তবেই নীড়ে ফেরা।
*******
সাগরের মাঝপথে উত্তাল জলরাশির কোলাহলে যখন নিঃসঙ্গ একাকী,
যখন পালে দমকা বাতাস লেগে সময়গুলোকে করে তোলে উদাসী,
আকাশের নীলিমা জুড়ে চন্দ্রিমার লাজুক ঠোঁটে খুঁজে ফিরি নক্ষত্র বিলাসী,
মাস্তুলের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দূরের সাইরেন দ্বীপে দেখি তোমাকে জলদেবী।
গাঙচিলের ডানায় কত শত সহস্রাব্দের চিঠি লিখে ডেকেছি তোমাকে,
নারকেল, সুপারি, আর ঝাউবনে রোদের কার্নিশে খুঁজেছি নিজেকে,
বালুমাখা শরীরের উষ্ণ অনুরাগে দিকহারা নাবিকের মতো হয়েছি স্বপ্ন অভিমানী,
তব নোঙরের মায়ায় নীল তিমিকে দূত করে ছুটে চলে আমার বিষাদের তরণী।
*******
মাগো কতদিন দেখিনা তোমার ওই হাসিমাখা মুখ;
আঁচল পেতে কাঁদছো তুমি,
আর আমার চেতনায় জমেছে ধুলোবালির সুখ।
এখন আর সূর্যের কাছ থেকে অধিকার খুজিনা,
অমানিশার কোলে মাথা গুঁজে দিয়ে ঘুমাই আমি।
শিকারির চোখে রক্তের তৃষ্ণা,
তক্ষকের মতো জেগে রয় তোমাকে ছিঁড়ে খাবে বলে।
অহেতুক করুনা নয়,
তোমার মুখে একটুখানি হাসি দেখব বলে;
আমি অকারণ হাসি,
আমিও হাসতে চাই বলে;
বারবার আশাহত হই,
অতৃপ্ত নোনা পানিতে তার তৃষ্ণা মেটেনা।
কেউ বলেনা,
কেউ দেখেনা,
শূন্য পাতায় কেউ খোজেনা,
আমি তব মাগো তোমার মুখের হাসি হব;
কেউ বলেনা, কেউ বলেনা !!
*******
তিনটি কবিতার শিরোনাম যেখান থেকে ভাবনায় এসেছেঃ
শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবাদির প্রতি বলেন, "বন্ধন আর মুক্তি, দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তাঁর দয়া হলেই মুক্ত"।
তিনি “ভববন্ধনের বন্ধনহারিণী তারিণী”।
এই বলে গন্ধর্বনিন্দিত কন্ঠে রামপ্রসাদের গান গাইলেন;
শ্যামা মা উড়াচ্ছ ঘুড়ি (ভবসংসার বাজার মাঝে)৷
(ওই যে) আশা-বায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি।
কাক গণ্ডি মণ্ডি গাঁথা, পঞ্জরাদি নানা নাড়ী৷
ঘুড়ি স্বগুণে নির্মাণ করা, কারিগরি বাড়াবাড়ি৷
বিষয়ে মেজেছ মাঞ্জা, কর্কশা হয়েছে দড়ি৷
ঘুড়ি লক্ষের দুটা-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত-চাপড়ি৷
প্রসাদ বলে, দক্ষিণা বাতাসে ঘুড়ি যাবে উড়ি৷
ভবসংসার সমুদ্রপারে পড়বে গিয়ে তাড়াতাড়ি৷
“তিনি লীলাময়ী! এসংসার তাঁর লীলা। তিনি ইচ্ছাময়ী, আনন্দময়ী। লক্ষের মধ্যে একজনকে মুক্তি দেন।”
ব্রাহ্মভক্ত বলেন, "মহাশয়, তিনি তো মনে করলে সকলকে মুক্ত করতে পারেন। কেন তবে আমাদের সংসারে বদ্ধ করে রেখেছেন?"
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, "তাঁর ইচ্ছা। তাঁর ইচ্ছা যে, তিনি এইসব নিয়ে খেলা করেন। বুড়ীকে আগে থাকতে ছুঁলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। সকলেই যদি ছুঁয়ে ফেলে, খেলা কেমন করে হয়? সকলেই ছুঁয়ে ফেললে বুড়ি অসন্তুষ্ট হয়। খেলা চললে বুড়ীর আহ্লাদ"।
তাই “লক্ষের দুটো-একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত-চাপড়ি।” (সকলের আনন্দ)
“তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, 'যা, এখন সংসার করগে যা।’ মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়া দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়।”
ঠাকুর সংসারীর ভাবে মার কাছে অভিমান করে গাইলেন;
আমি ওই খেদ খেদ করি৷
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি৷
মনে করি তোমার নাম করি, কিন্তু সময়ে পাসরি ৷
আমি বুঝেছি জেনেছি, আশয় পেয়েছি এ-সব তোমারি চাতুরী৷
কিছু দিলে না, পেলে না, নিলে না, খেলে না, সে দোষ কি আমারি ৷
যদি দিতে পেতে, নিতে খেতে, দিতাম খাওয়াতাম তোমারি৷
যশ, অপজশ, সুরস, কুরস সকল রস তোমারি৷
(ওগো) রসে থেকে রসভঙ্গ, কেন কর রসেশ্বরী৷
প্রসাদ বলে, মন দিয়েছ, মনেরি আঁখি ঠারি৷
(ওমা) তোমার সৃষ্টি দৃষ্টি-পোড়া, মিষ্টি বলে ঘুরি৷
“তাঁরই মায়াতে ভুলে মানুষ সংসারী হয়েছে। প্রসাদ বলে মন দিয়েছে, মনেরি আঁখি ঠারি।”