সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষিত বেকার। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, কাজের সুযোগ না পেয়ে অসংখ্য বেকার যুবক হতাশা থেকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হতাশা থেকে আত্মহননের পথও অনেকে বেছে নিচ্ছেন। একই কারণে নিকটাত্মীয়কে হত্যা করার মতো ঘটনাও এই সমাজে ঘটছে।
চাকুরির প্রতি আসক্তি আমাদের অনেক । যারা চাকুরি করছে প্রচলিত কয়েকটি অজুহাত হল ঃ
>> ব্যবসা করতে প্রচুর টাকা লাগে। আমার যথেষ্ট টাকা নেই।
>> আমি কখনই চাকুরি ছাড়তে পারবনা যেহেতু আমার সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আমার।
>> আমার মানুষের সাথে তেমন পরিচয় নেই/আমি খুব আত্মকেন্দ্রিক। আমাকে দিয়ে হবেনা।
>> আমি সফল ব্যক্তিদের মত অতটা স্মার্ট নই।
>> ব্যবসা করার জন্য আমার হাতে একটুও সময় নেই। আমি অন্য কাজে প্রচুর ব্যস্ত থাকি।
>> আমাকে ব্যবসায় সাহায্য করতে পারে এমন একজনকেও আমি খুঁজে পাইনি এবং পাবওনা।
>> একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে প্রচুর সময় দিতে হয়। আমার অত ধৈর্য্য নেই।
>> আমার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে। এসময় নতুন করে ব্যবসা শুরু করা কঠিন।
>> টাকায় টাকা আনে। যেহেতু আমার এখন টাকা নেই তাই আমি কখনই অনেক টাকার মালিক হতে পারবনা।
>> আমি একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েছি। এখান থেকে কিছুই করা সম্ভব নয়।
>> আমার পরিবার বা গোষ্ঠীতে কেউ ব্যবসা করেনি। তাই আমিও করতে পারব না।
>> ব্যবসা করার মত কোন সুযোগ আমার কাছে নেই।
>> ব্যবসা করার জন্য যেসব যোগ্যতা প্রয়োজন তার কোনটাই আমার মধ্যে নেই।
>> আমার স্ত্রী/স্বামী/পরিবার/আত্মীয়-স্বজন কখনই ব্যবসা করার বিষয়টা সাপোর্ট করবে না।
>> আমি ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্র নই। তাই ব্যবসার বিষয়াদি সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান নেই।
>> মানুষ ব্যবসায়ীদেরকে সম্মান করেনা। আমার কাছে অর্থের চেয়ে সম্মানের মূল্য বেশি।
>> ব্যবসা বিষয়টাকেই আমার ভাল লাগেনা তা সেটা যে ধরনের ব্যবসাই হোক।
>> ব্যবসায় ঝামেলা বেশি। আমি ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি।
>> ব্যবসা শুরু করার পর লোকসান হলে আমি সেটা কাটিয়ে উঠতে পারব না।
>> অনেক দক্ষ, শিক্ষিত এবং যোগ্য ব্যক্তিও ব্যবসায় লোকসান করেছে। সেখানে আমার মত মানুষ কখনই লাভ করতে পারবে না।
>> ব্যবসার বিষয়টা আমি একটু ভেবে দেখি। যদি মন:পূত হয় তবে শুরু করব।
>> ব্যবসা না করেও হাজার হাজার মানুষ সুখী জীবন-যাপন করছে। সুতরাং ব্যবসা যে করতেই হবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
>> আমার জন্ম যদি আজ থেকে ৪০-৫০ বছর পূর্বে হত তাহলে খুব সহজেই ব্যবসা করতে পারতাম।
প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ চিন্তা করে তারা তাদের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে অথবা চাকুরির পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবসা গড়ে তুলবে। কিন্তু কেবলমাত্র ব্যর্থ হবার ভয়ে তারা শুরু করে না। তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাদের নিয়মিত চাকুরিতেই পুনরায় মনোনিবেশ করে। এদের মধ্যে প্রচলিত কয়েকটি অজুহাত হল :
>> আমি কিছুদিন পর শুরু করব।
>> যখন সর্বোত্তম সুযোগটি আসবে তখন আমি ব্যবসা শুরু করব। >> যখন আমার হাতে টাকা আসবে আমি তখন শুরু করব।
>> যখন সঠিক সময় আসবে তখন আমি শুরু করব।
>> যখন আমার প্রচুর অবসর সময় থাকবে তখন আমি শুরু করব।
>> যখন আমি সঠিক পার্টনার পাব তখন আমি শুরু করব।
>> যখন আমার সন্তানের পড়াশোনা শেষ হবে তখন আমি শুরু করব।
>> বিক্রির বিষয়টা আমার পছন্দ নয়। চাকুরিতে কোন কিছু বিক্রি না করেও বেতন পাওয়া যায়।
>> যদি আমি ব্যর্থ হই তবে আমার কি হবে?
>> চাকুরিতে বেতনের নিশ্চয়তা আছে কিন্তু ব্যবসায় সেটা নেই। আমি নিশ্চিত বেতন ছেড়ে ব্যবসা করতে পারবনা।
>> ব্যবসা করে অর্থোপার্জন করাটা চাকুরির চেয়ে অনেক বেশি কঠিন এবং কষ্টকর। শুধু শুধু কষ্ট বাড়িয়ে লাভ নেই।
>> জীবন-যাপন করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং চাকুরির বেতনই যথেষ্ট, ব্যবসা করাটা খুব বেশি জরুরী নয়।
>> আমি ব্যর্থ হলে মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারব না।
এসবই আমাদের মন গড়া চিন্তা ভাবনা।
বিপরীত মুখী কিছু উদাহরণ-
ঘটনাটা ৩১ বছর আগের। এক তরুণী জীবিকার তাগিদে কাজ নেন পোশাক কারখানায়। মাননিয়ন্ত্রণকর্মী িহসেবে ৮০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু। কাজে যোগ দিয়ে কিছু সময় যেতেই নিজের ভেতরই যেন পরিবর্তনের ডাক পেলেন—এভাবে হবে না। এগোতে হলে শিখতে হবে মেশিনের কাজ। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ধরলেন মেশিন। কাজের দক্ষতায় পেতে থাকেন পদোন্নতি। এবার সচল হলো স্বপ্নও। পোক্ত হয়ে একসময় কাজ ছেড়ে নিজেই গড়লেন প্রতিষ্ঠান। শূন্য হাতে শুরু করে তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর নাম বেবি হাসান। বিএস অ্যাপারেল নামের একটি বায়িং হাউসের কর্ণধার তিনি।
নিজের শ্রম ও মেধা দিয়ে সফল উদ্যোক্তাদের একজন হয়েছেন বেবি হাসান। তাঁর অধীনেই কাজ করছেন প্রায় অর্ধশত কর্মী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোশাক রপ্তানির কাজ করে তাঁর প্রতিষ্ঠান। বছরে লেনদেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।(প্রথম আলো )
শখ থেকে সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প নিজেই শুরু করলেন শাহনাজ ইসলাম। বলেন, ‘পড়াশোনার শখ ছিল। দুই সন্তান কোলে নিয়েই ১৯৯২ সালে এইচএসসি পাস করেছি। হাতের কাজের শখ ছিল। ১৯৯৫ সালে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেছি। তিনি বুটিক হাউসের উদ্যোক্তা ছিলেন। ওই বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বুটিকের স্টল দিয়েছেন তিনি। হাতের কাজের আগ্রহ দেখে আমার কাছে ২০টি শাড়ির অর্ডার দিলেন। রাতেই দোকান থেকে শাড়ি কিনে কয়েক দিন ধরে তাতে হাতের কাজ করলাম। ৮০০ টাকা করে আমার কাছ থেকে শাড়ি কিনে সেই আত্মীয় ওই শাড়ি মেলায় ২০০০ টাকায় বিক্রি করলেন। চোখ খুলে গেল আমার। মাথায় এল শখের এই কাজ করে তো আমি ঘরে বসেই বাড়তি লাভ করতে পারি। এরপর বগুড়ায় ফিরে মালতিনগরের বাসাতেই ১৫ হাজার টাকার পুঁজিতে বুটিক হাউস খুলে বসলাম। সাড়াও পেতে শুরু করলাম ভালো। পরিবার থেকেও উৎসাহ মিলল।’
শাহনাজ ইসলাম বলেন, এক বছরের মাথায় জলেশ্বরীতলায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ‘শখ’ বুটিক শপ খুলে বসেন তিনি। নিজেই ডিজাইন করেতে শুরু করেন। কারিগরেরা বাড়িতে কাজ করতেন। অল্প দিনেই শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল শখ-এর পরিচিতি। তখন বগুড়া শহরের নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তিনি বলেন, ‘নিজেই ব্যবসাতে বসতাম। নিজেই কাঁচামাল কিনতাম। নিজেই ব্যাংক করতাম। নিজেই পাইকারি অর্ডার নিতাম। একজন নারী হয়ে দোকানে বসে ক্রেতা সামলানোর বিষয়টি তখন অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু স্বামী শফিকুল ইসলাম ব্যবসায় উৎসাহ দিতেন। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ব্লক, বাটিক ও নকশার কাজ করা সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, শাড়ি, বিছানার চাঁদর, কুশন কভার, শাল চাদরের ব্যাপক চাহিদা বাড়তে লাগল।’(bdlive24.com)
নকলা উপজেলার বালিয়াদী গ্রামের উসমান আলী গত নয় বছর ধরে পোনা মাছ উৎপাদন করে আসছেন। স্বপ্ন দেখছেন স্বাবলম্বী হওয়ার। বর্তমানে ছয় একর জমি নিয়ে তার মাছের বিশাল খামার রয়েছে। রুই, মৃগেল, কাতল, কার্ফ, সিলভার, বৃকেট, ইলিশা ভাটা, পুঁটি এ জাতীয় মাছ উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করেন তিনি। বছরে তিনি অন্তত ১৫ লক্ষ টাকার পোনা মাছ বিক্রি করেন। কর্মসংস্থান করেছেন কয়েকজন লোকের।(deshprtidin.com)
এমনি আমাদের চারিপাশে অনেকেই আছে যাদের গল্প আমাদের জানা ।
একজন উদ্যোক্তার মাথায় যখন ব্যবসায়িক বুদ্ধি আসে, তখন নিজের সাধ্যমত অর্থ দিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন৷ তার পর হাত পাতেন পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনদের কাছে ৷কিন্তু তখন তাদের উপর বিস্বাস করার মতো লোক খুজে পাওয়া যায় না । অনেকের কাছেই যাওয়া হয় অর্থের যোগানের জন্য কিন্তু হতাশার বাণী ছাড়া আর কিছুই মেলেনা ।
উদ্যোক্তা হতে হলে কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। তিল তিল করে গড়ে তোলা বিজনেস এক সময় বিশাল শিল্প সামাজ্য করে সাজাতে সততা আর পরিশ্রমের বিকল্প নেই।অধিক পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। কোনো কারণে কাজে সফল না হতে পারলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। অধিক মনোবল নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আপনার হার না মানা মনোভাব থাকতে হবে। চেতনা থাকতে হবে যে কাজটি আপনি শুরু করবেন তার শেষ আপনাকে অবশ্যই করতে হবে। সফল উদ্দ্যোগ আর সঠিক চিন্তা আপনাকে দিতে পারে সাফল্য। আপনি যখন উদ্যোগ নিতে যাবেন তখন অনেকেই আপনাকে খারাপ বুদ্ধি দিতে পারে আবার অনেকেই ভাল বুদ্ধি দিতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই হচ্ছে সফল ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য।আত্মবিশ্বাস এক জাদুকরি শক্তি যা নিজের কর্মকাণ্ড এবং নিজের শক্তি-সামর্থের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। বলা হয়- আত্মবিশ্বাসই সফলতার মূল শর্ত। একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে এ গুণটি থাকা অপরিহার্য।আরো দরকার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা। একজন সফল উদ্যোক্তা শুধু কিছু কাজই সম্পাদন করেন না। বরং সব সময় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মনযোগী হন।
পরিশেষে একটাই কথা বলা যায় , চাকুরিটা জীবনের লক্ষ্য নয় , লক্ষ্য হয়া চাই সফলতা। আর সফলতার জন্য কেবল মাত্র চাকুরিই মাধ্যম নয় । পরিশ্রমি, আত্মবিশ্বাসি, বুদ্ধিদিপ্ত উদ্যোক্তা হতে পারলে সফলতা নিশ্চিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ রাত ১১:১১