পুঁথি ২৩-০৭-০৭
পুঁথিটা পাবার পর জীবনটা আমার নতুন দিকে মোড় নিয়েছে।আপন মানুষেরা দূরে সরে গেছে ধীরে ধীরে। আমি হয়ে ঊথেছি ক্ষমতাবান। বিয়ে করা হয়নি- করলে হয়ত বউটাকে হারাতে হত।
মা অসুস্থ- পায়ে বাতের ব্যাথা-প্যারালাইসিস। আগে প্রতিদিন মায়ের পায়ের কাছে বসে হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিতাম। এখন মাকে ডাইনি বলে মনে হয়। হটাত হটাত ইচ্ছে করে গোলা টিপে মেরে ফেলি।বাবা নেই আমার- থাকলে হয়ত আমার হাতেই মারা যেতেন।
আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। সবাই একে একে আমাকে ছেড়ে চলেগেছে। কাকা জ্যাঠারা সবাই একে কে মারা গেছে চোখের সামনে। আমি চেয়ে চেয়েদেখেছি। আপন বলতে আছে আমার মা- আর দূর সম্পর্কের এক বোন। আর আমাদের দেখাশোনা করার জন্য এক কাজের মেয়ে এবং আমার এই পুঁথি।
কি? বুঝতে পারছেন না? আ,আর একটা পুরনো আমলের পুঁথি আছে।
অনেক পুরানো একটা পুঁথি। আজ থেকে মাস ছয়েক আগে পেয়েছিলাম। এখন আমার এই পুথিটাই আমার সব।আশ্চর্য আজব এই পুঁথি। অনেক অনেক পুরনো। হয়ত হাজার বছরের ও আগের। হয়ত কোন এক বড় পুথির অংশবিশেষ। আমি অবশ্য সে সব নিয়ে মাথা ঘামাইনা। আমার শুধু পুঁথি হলেই চলে- সেটা যে নরক থেকেই আসুক না কেন।কি? আমাকে পাগল মনে হচ্ছে? ভাবছেন এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লেন?
মা কালীর কিরে কেটে বলছি, আমার একটা পুঁথি আছে- এবং এটাই আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে। আচ্ছা-বলছি সব......
আমাদের গ্রামের একদম শেষে আমাদের চৌধুরী বাড়ি। অনেক কাল আগে আমরা জমিদার ছিলাম। কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমার ঠাকুরদাদার বাবা বড়দা চরণ চৌধুরী গায়েব হয়ে যাবার পর আমাদের জমিদারি শেষ হয়ে যায়। জমি জমা সব আশেপাশের লোকজন দখল করে নেয়। প্রভাব প্রতিপত্তি যা- সব এই জমিদারবাড়ির ভেতরে এসে ঠেকে।
অবশ্য এখন ও আমাদের কথার মুল্য দেয় দশ গ্রামের মানুষ- তবে পেছন ফিরলেই গালিও দেয় অনেকে। যে লোকগুলো বড়দা চরণ চৌধুরীকে দেখলে মাথা নুইয়ে রাখত- তাদের ছেলে মেয়েরা এখন আমি রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী কে দেখলে উঠে নমষ্কার পর্যন্ত দেয়না।অবশ্য দেবেই বা কেন- এখন তো আবার গণতন্ত্র- সবার সমান অধিকার- কিন্তু সমান অধিকার দিয়েই হল যত যন্ত্রনা- কেউ কারো কথা শোনেনা- সবাই আমাদের জমিজমা দখল করে বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করল। কি আর করা- আমাকে ও মেনে নিতে হল তাদের রায়। আমার পরদাদা বড়দা চরণ চৌধুরী ই সুদুর বার্মা থেকে অনেক গুলো দুর্লভ বইয়ের সাথে এই পুঁথিটা নিয়ে আসেন। কালের অতলে হারিয়ে গেছে যার অনেক গুলো পাতা।
বড়দা চরণ চৌধুরী হটাত করে ষাট বছর বয়সে অদৃশ্য হয়ে গেলে আমাদের অবস্থা হয় শোচনীয়। দাদু শচিন্দ্রলাল চৌধুরী কোন রকমে গ্রাম ডাক্তারি করে সংসার চালাতেন। আমার বাবা সেটা ও পারেন নি। বলা বাহুল্য বাবা এজন্য আমাদের আত্মীয় স্বজন দের দায়ী করেন- যারা নিজেদের মাঝে জমিজমা ভাগ করে নেবার সময় নিরীহ বাবাকে ছিটে ফোটা ও দেয়নি।
বাবা কিছু না পেলে ও আমি কিন্তু ঠিক পেয়েছি। এই যে অমুল্য এই পুঁথিটা – যেটা আমাকে করেছে অমিত শক্তির আঁধার। জীবনের মোড় আমার ঘুড়িয়ে দিয়েছে অন্য দিকে। পুথিতে লেখা আছে আশ্চর্য সব কথা। এসব কথা প্রকাশ করা বারন- তাই লিখলাম না- তবে এই কথা গুলোই অমিত শক্তির উৎস।
এই পুঁথিটা লেখা হয়েছে অনেক পুরানো বাংলা ভাষায়- একার আকার নাই। অনেক কষ্টে আমি এটা থেকে বাংলা উদ্ধার করি। আর সেটা পড়েই আমি অভিভুত হয়ে যাই।
লেখা আছে বন্ধ ঘরে একটা কালো মোরগের মাথা ছিড়ে কাপালাক্ষি মন্ত্র পড়তে পড়তে সেই তাজা রক্ত খেলে কোন দিন খিদে লাগবেনা।
খিদে না লাগলে তো কাজ ও করতে হবেনা- এই ভেবে অলস আমি অনেক কষ্টে একটা খালি ঘর বের করে জঞ্জাল পরিষ্কার করে সেখানে একটা কালো মোরগের মাথা একটানে ছিড়ে কাপালাক্ষি মন্ত্র তিনবার পড়ে গরম গরম রক্ত মুখের কাছে এনে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম কিছুটা- কিন্তু এর পড়েই ঘটল অঘটন- হটাত তীব্র বেগে আমি আমার নিজের শরীরের উপরে বমি করে দিলাম।
বিফল মনোরথে আমি ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। ভালমত শরীর ধুয়ে ও সেই রক্তের বিটকেলে গন্ধ টা গেল না। রাতে খাওয়া দাওয়া করার পড়েই পেটে আমার কেমন যেন করতে শুরু করল। মনে হল পেটে আমার কিছু একটা নড়াচড়া শুরু করেছে। আমি কিছু হবেনা ভেবে যেই এক গ্লাস গরম দুধ খেতে যাব তখনি বুঝলাম পেটের ভেতর আমার কোন কিছু একটা নড়া চড়া করছে। আমি ভয়ে দুগ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। পানি পেয়ে জিনিসটা আরও বেশি ফুলে ফেঁপে উঠল। আর আমি হাটলেই আরও দ্বিগুণ গতিতে নড়াচড়া করতে লাগলো। আমি ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
দুদিন পর আমার সেই দুঃসম্পর্কের বোন আমাকে ডাক্তার বদ্যি দেখিয়ে যখন সুস্থ করে তুলল-এর মাঝে আমাকে অনেক কিছু খাওয়াতে চেয়েছে। আমি নাকি খাইনি কিছু। এবং এর পরদিন ও আমি কিছু খাবার কোন অনুভুতি না পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার খিদে নাই হয়ে গেছে।
সমস্যার শুরু সেই দিন থেকেই। আমার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেতে লাগলো। আমি গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে গেলাম। পানি খেলাম কিন্তু শরীর থেকে এক ফোটা ও পানি বের হলনা। ফলাফল হল আমার হাত পা ফুলে ঊঠল।আমি রীতিমত অসুস্থ হয়ে গেলাম।আর সমাধান খুঁজে পেলাম সেই পুঁথির তিন নম্বর পাতায়। এক অক্ষত যোনির কুমারি কন্যার হৃদপিন্ডের তাজা রক্ত খেতে হবে। তাহলেই পরিত্রান।
আর এর সমাধান ও দিল আমার খুব কাছের সেই দুঃসম্পর্কের বোন। ওর সাথে শুধু শুধু খারাপ ব্যাবহার করলাম। মাকে এটা সেটা বুঝিয়ে ওকে মামা বাড়িতে দিয়ে আসব বলে ওকে নিয়ে রওনা হলাম। এবং ওকে সেখানে না নিয়ে গিয়ে এক নির্জন নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করলাম। বুক চিড়ে হৃদপিন্ড টা কেটে নিয়ে লাশটা ভাসিয়ে দিলাম নদীতে। তারপর সেখানে বসেই সন্ধিপনি মন্ত্র পড়ে খেয়ে ফেললাম সবটুকু রক্ত।এবার কোন সমস্যা হলনা। মানিয়ে নিলাম নিজেকে। বেঁচে থাকার জন্য এটা আমার খুব দরকার ছিল।
তারপর থেকে আমি কিছু না খেয়েই বেঁচে রইলাম । আমাকে কিছু খেতে হয়না। এরপর আমি কতকিছু খেলাম।গায়ে গতরে আমি খাটো ছিলাম বলে লম্বা হবার জন্য খেলাম ইদুরের রক্ত। স্বাস্থ্য ফিরে পাবার জন্য কালো বেড়ালের লেজের রক্ত, মাথার চুল গজাবার জন্য গুইসাপের চোখ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
শুধু রূপ নয়- ধন দৌলত ও দিতে পারে এই পুঁথি। পুথিতে লেখা একটা মিত্রবিশবা শ্লোক আমি তিনদিন লাল মাটি গায়ে মেখে পানিতে নেমে পূর্বমুখি হয়ে তিন লক্ষ বার পড়তেই আমি ফিরে পেলাম আমার পরদাদার আমলে হারিয়ে যাওয়া একশোটা সোনার মোহর।
মানুষকে বশ করার জন্য মরা গরুর পচে যাওয়া ভাড়াল চিবিয়ে খেতেই আমি ফিরে পেতে শুরু করলাম আমার হারানো প্রতিপত্তি। আমার কথা যারা কোনদিন শুনতোনা তারা এখন আমাকে দেখলেই সম্মোহিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু আজ আমি এক অনন্য ক্ষমতা লাভ করব।আজ আমি অদৃশ্য হব। সত্যি বলছি আমি আজ দেহ শুন্য হব। ফলে আমি যে কোন স্থানে চলে যেতে পারবো নিমিষেই। আমি মাতাল নই- পাগল নই- আমি বলছি আমি আজ পুরোপুরি স্বাধীন হব।আমি আজ অদৃশ্য হব- আমি হব সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী......
কাজটাতে একটু ঝুকি আছে। যদিও আমি ধর্মে বিশ্বাস করিনা- কিন্তু একলা একলা মন্দিরে যেতে ভয় পাই। কারণটা নাইবা জানলেন। আমাকে একটা মানুষের মাথার খুলি জোগাড় করতে হবে। তারপর একটা নির্জন কালী মন্দিরের পেছনে গিয়ে অমাবস্যা রাতে ভোর হবার আগে একটা চিদাম্ব্রম মন্ত্র দশলক্ষবার জপ করতে হবে।
আমাকে এখন যেতে হবে। আমাকে দেখতে না পেলে ও আশা করি এই লেখা খাতাটা আর এই পুঁথিটা আপনারা পাবেন। অবশেষে বিদায়- ভাল থাকবেন সবাই- ইতি- রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
চিঠিটা চিলেকোঠায় পেয়ে একনিমিষে পড়ে ফেলে সৈকত। বাবাকে সেটা দেখাতেই সৈকতের বাবা সেটাকে গাজাখুড়ি বলে ঊড়িয়ে দিলেন। বললেন- ঐ রাজেন্দ্র বেচারা পাগল হয়ে গিয়েছিল মাঝ বয়সে এসে।অভাবে পাগল হয়ে যাওয়া সেই রাজেন্দ্র পাগল হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ওদের পুরনো জমিদার বাড়িটায় কোন কিছু পাওয়া যায়নি। পুঁথি একটা ছিল বটে তবে সেটা এখন জাতীয় জাদুঘরে শোভা বাড়াচ্ছে।শুনে সৈকত ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটায় না।
এর ঠিক একবছর পর সৈকতদের স্কুল থেকে শাহবাগ জাতীয় গাদুঘরে ওদের শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হল। কাঁচের বাক্সের আড়ালে এটা সেটা দেখতে সামনে একটা পুঁথি দেখতে পেল সে।পুঁথির নিচে সেই জমিদার বাড়ি আর সেই চৌধুরী পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা ছিল। সৈকত বুঝল এটা সেই পুঁথি যেটা পড়ে রাজেন্দ্র নামে সেই পাগল লোকটা অনেক ক্ষমতা পেয়েছিল।অনেক কষ্টে লুকিয়ে সেটার ছবি তুলে নিল সে তার মুঠোফোনে। তারপর বাসায় প্রিন্টার থেকে ছবিটা প্রিন্টআঊট নিল। তারপর সেই পাতায় লেখা অনুযায়ী একটা টিকটিকি ধরে লেজ ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মুখে পুড়ে দিল সে।তারপর সেই পাতায় লেখা মন্ত্রটা তিনবার পড়তেই অজ্ঞান হয়ে গেল সৈকত।
****************************
এখন সৈকত হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছে। আর শুয়ে শুয়েই সে ডাক্তারের মনের কথা শুনতে পারছে। প্রথম মনে করেছিল মনের ভুল- কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারল- তার চোখ যার দিকেই পড়ছে তারই মনের কথা বুঝতে পারছে সে। মনে মনে একচোট হেসে নিল সৈকত- তারপর আপন মনেই বলল-
যা পেয়েছি- সেই ক্ষমতাতেই সারা জীবন কেটে যাবে-আর কোন দিন আমি সেই পুঁথি মুখো হবোনা- বলেই মনে মনে একচোট হেসে দিল- আর সামনে থাকা নার্সের মনের কথা শুনে ফেলল বেচারা- নার্স মনে মনে বলছেন-“ছেলেটা পাগল নাকি? মনে মনে হাসছে কেন?”
শুনেই হাসি থামিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল সৈকত -ওর যে এই ক্ষমতা আছে সেটা কেঊকে বুঝতে দেয়া চলবে না.....
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:০৭