ঘুটঘুটে অন্ধকারে যেন কালো স্বপ্নটা আরো বেশি চকচকে হয়েছিল।আকাশের চাঁদ উঠেছে কিনা তাও দেখা যায়না।
তারাগুলোও যেন ভয় পেয়ে আকুতি মিনতি করে আড়াল হয়ে গেছে।মেঘের ভিতর কান্না জমে জমে শিশির হয়ে আছে।
অন্ধকার ঘরে টেবিলের উপরের স্বপ্নটাও স্থির, যেন কেউ তাকে খেলাচ্ছলে বলেছিল বরফ হয়ে যাও।
এভাবে অনন্তকাল চলে যেতে পারত, কিংবা হঠাৎ এক দস্যি হাওয়া এসে সাদা-কাল স্বপ্নটা উড়িয়ে দিতে পারতো, পাশের বাড়ির হুলো বিড়ালটা সেটা কোৎ করে গিলে ফেলতে পারতো, ঝাকড়া আম গাছের বুড়ো, বদ মেজাজি কাকটা এসে তা ঠুকরে দিতে পারত, কিংবা কোন নাম না জানা ঝড় এসে স্বপ্নটা দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারতো, বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে ঠিক স্যাঁতস্যাতে করে দিতে পারত, পারত কোন অলিক চরিত্র এসে স্বপ্নটা কে বাক্সবন্দি করতে...কিন্তু এমন কিছুই হল না। সাদা স্বপ্নটা ফ্যাকাশে হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকল, কাল স্বপ্নটুকু যেন এক অসীম শক্তি নিয়ে ঘন হতে থাকল।
শহরের সব আলোগুলো একটা দুটা করে নিভে যাচ্ছে, অন্ধকারগুলো স্তুপ হয়ে চেপে আছে চারপাশে। থমথমে বাতি নেভা ঘরগুলো কাল ছায়া হয়ে দাড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে জোনাক পোকার মত কিছু তারা উঁকি দিতে চাচ্ছে। সাদা স্বপ্নটার মৃত্যু যেন তারা হতে দিতে চায় না। বিশাল আকাশটা অসহায়ের মত একরাশ কালো মেঘগুলো নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে থাকে।তারাগুলো ফিস ফিস করে যেন আপনমনেই প্রশ্ন করে- তবে কি একটা স্বপ্নর মৃত্যু ঘটবে আজ? কিন্তু এর কোন প্রতি উত্তর আসেনা। গোলাপ বাগানের গোলাপগুলো বিমর্ষ হতে থাকে। আর সেই টেবিলের পাশে থাকা রঙ তুলির বাক্সর রঙ ও যেন শুকিয়ে যেতে থাকে। চারপাশে মৃদু গুঞ্জন আসে বার বার...আর একটু পরই একটি সাদা স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে...মৃত্যু ঘটবে...মৃত্যু ঘটবে...মৃত্যু ঘটবে...মৃত্যু ঘটবে...মৃত্যু ঘটবে............
হঠাৎ করে অস্পষ্ট গাছ, আকাশ,আর বাড়িগুলো ক্রমাগত ঘুরতে থাকে...যেন একটা বাঁধনে আটকে পড়ে গেছে তারা এই বিশ্বের সাথে...সে বাঁধন কিছুতেই আর খোলা যাচ্ছেনা, তাই বার বার অন্ধকারে অন্ধকারে ফিরে আসছে...গাছ,আবার বাড়ি,আবার আকাশ, আবার কাল মেঘ, আবার টেবিল ফের গাছ ফের বাড়ি। মেঘগুলো একটু বিব্রত হয়ে পিছু হটে যায়...প্রায় মৃত সাদা স্বপ্নর গায়ে আলতো এক যাদুরঙ্গা আলো এসে পরে। যেন শেষ নিঃশ্বাস এর পাপড়িগুলো সযত্নে তুলে দিচ্ছে কেউ। অদ্ভুত সেই আলো আরেকটু পরশ বুলায় সেই মৃতপ্রায় সাদা স্বপ্নর বুকে। আকাশের তারাগুলো ইতিউতি তাকায়। তারপর মায়া করা সেই তারার আলো অনেক দূর থেকে যতটাই পারে ঠিকরে দেয় সেই সাদা স্বপ্নর গায়ে।
কাল স্বপ্ন আর্তনাদ করতে থাকে। গুমোট সেই মেঘগুলো তখন আকাবাঁকা পথ হয়ে জোস্নার আলোকে ঠেলে দেয়। অন্ধকারে হাহাকার বাড়তে থাকে, স্তুপ হয়ে থাকা আধাঁরগুলো তিব্র চিৎকার দিয়ে নিমিষেই মিলিয়ে যেতে থাকে। সাদা স্বপ্নের স্পন্দন ধুক পুক ধুক করে বেড়ে যায়। রং তুলির বাক্সের রংগুলো আরো প্রানবন্ত হতে থাকে। তারাগুলো হাজারো জোনাক পোকা হয়ে জলতে থাকে। সেই টেবিলের সাদা স্বপ্নটা জোস্নার আলোয় একটু একটু করে আরো আরো উদ্ভাসিত হতে থাকে। এক সময় ম্যাজিকের মত কাল স্বপ্নটা মিলিয়ে যায়...সাদা স্বপ্নটা চুপটি করে বসে থাকে...
***
সারা রাত দুঃস্বপ্ন দেখার পর মেয়েটি ভোর হওয়ার আগে থেকে এক অদ্ভুত স্বপ্নময় প্রহরে চলে যায়। তার মুখের উপর একটু একটু করে জোস্নার পরশ বেড়ে যায়। এক যাদুকরি আলোর ছটা বিন্দু বিন্দু করে তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েটি পাশ ফিরে, কিন্তু কোন স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যথা না বরং দুঃখ, বেদনা ভয় আর দুঃস্বপ্নরা যেন কেবলই কাল ডানা মেলে উড়ে চলে যায়। কালো স্বপ্নগুলো নিরবে কেঁদে উঠে...আর শুভ্র সাদা স্বপ্নগুলো স্মিত হেসে মেয়েটির কানে কানে বলে যায়...
“যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরনীতে
যে নদী মরূ পথে হারাল ধারা...
জানি হে জানি তাও হয়নি হারা...”
বাস্তবতার ক্যানভাসে স্বপ্নকথার বন্দনা চলতেই থাকে...আর চলতেই থাকে...