১
ব্যাপারটা মনের মাঝে খচখচ করছিল গত বুধবার রাত থেকেই। টিভির সামনে বসার সময় হয় না বললেই চলে। তাই অবসর পেলে নাটক, মুভি যা দেখি সব কম্পুতে। সেদিন দেখতে বসেছিলাম ৭ পর্বের ঈদ স্পেশাল নাটক “এই সময়ে সেই সব মানুষেরা”। পরিচালনা ও নাট্যরূপ “রেদওয়ান রনি”। আজকাল যারা নিয়মিত নাটক দেখেন তাদের কাছে অতি সুপরিচিত নাম। এই নাটকের মুল আকর্ষণ ছিল হুমায়ূন আহমেদের গল্প, নাটক, উপন্যাসের বিখ্যাত সব চরিত্র নিয়ে। অর্থাৎ কনসেপ্ট ছিল, তারা যদি এ সময়ে থাকত তবে কেমন হত। এই নাটকে ছিল হিমু, বড় চাচা, মিসির আলী, বাকের ভাই, মোনা, রুপা, বাদল সহ সকল বিখ্যাত চরিত্র। অভিনয়ে ছিলেন মোশাররফ করিম, তিন্নী, সুবর্ণা মোস্তফা, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের সহ অনেকেই। প্রথম দৃশ্যেই দেখা গেল হিমু কারাগারে, পুলিশ অফিসার তাকে ডেকে নিলেন জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। গম্ভীর মুখে বসা পুলিশ অফিসার সিগারেটের ধোঁয়ার পেছন থেকে তার জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপর দেখা যায় বাকের ভাই হিমুর সাথে দেখা করেছেন, হাতে সিগারেট। মিসির আলীর কাছে হিমু যখন যায় তখন দেখা যায় তার এসট্রেতে একগাদা সিগারেট, হিমুর রুমমেট রাতে রুমে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। পুরো নাটকে সিগারেট খাওয়ার ছড়াছড়ি। আমার কথা হল হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই সহ এই সব চরিত্রের ভক্ত সংখ্যা অনেক। যারা দেখছেন অনেকেই ধূমপানে আরও বেশি অতি উৎসাহী হয়ে যাবে। অবস্থা থেকে মনে হচ্ছিলো নাটকের নাম হওয়া উচিৎ “এই সময়ে সেই সব মানুষের হাতে হাতে সিগারেট”। শুধু বিনোদনের কথা মাথায় না রেখে, বিনোদনের সাথে সাথে সচেতনতা মূলক দৃশ্ব্য যুক্ত করলে তো আমি কোন সমস্যা দেখিনা। এই নাটক দেখার পর দিনই আমি দেখলাম চারতলায় থাকা আন্টির ছেলে যে কিনা মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে, সে আমার ভাগ্নিকে অভিনয় করে দেখাচ্ছে, নাটকে পুলিশ অফিসার কিভাবে বসে বসে সিগারেট টানছিল। সেও নাকি বড় হয়ে পুলিশ হবে ও এভাবে সিগারেট খাবে।
২
কলেজে পড়ার সময় “ঢাকা কমার্স কলেজের” এই স্যরের নাম শুনলে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। আমি যদিও কমার্স কলেজে পড়তাম না তবে বন্ধুদের মুখ থেকে তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যেতাম। আমার অনেক বন্ধুরা এইচএসসি তে উনার পড়ানো বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছিল শুধুমাত্র উনার শিক্ষকতা ও কঠোর শাসন এবং চেষ্টার কারণে। বন্ধুদের অবস্থা দেখে কত দিন আমি নিজেই বই নিয়ে বসেছি, আর আফসোস করেছি উনার ছাত্রী আমি নই বলে। সে শিক্ষকের একমাত্র মেয়েকে তিনি স্কুল পাসের পর একটি স্বনামধন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছেন, ইংরেজি কোর্সের জন্যে। মেয়েটি আমার বান্ধবীর ছোটবোনের সহপাঠী। আমার বান্ধবীর কাছ থেকে জানলাম কিছুদিন আগে সেই স্বনামধন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ডিজে পার্টি ছিল। মেয়েটি বাসায় জানিয়েছে একটা ছোট গেট টু গেদার হবে, তারপর বাসা থেকে সালোয়ার-কামিজ পড়ে এসে আমার বান্ধবীদের বাসায় বই নেবার বাহানা করে এসে তার পোশাকের নীচে থাকা টি-শার্ট আর জিনস পড়ে চলে গেছে (যেখানে তাকে সালোয়ার-কামিজ বাদে অন্য পোশাক পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়না) আমি অবাক হয়ে ভাবি যে শিক্ষক নিজের হাতে হাজার হাজার ছেলে মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন, নিজের একমাত্র মেয়েকে সকল খারাপ কিছু থেকে মুক্ত রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তার সাথে আসলে কি হচ্ছে!!!
৩
মেয়েটি আমার ক্লাসমেটের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছিল কোন কারণ ছাড়াই। তারপর ৬ মাসের মাঝেই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে লন্ডনে। দিব্যি আছে এখন, পড়াশোনা করছে,খুব পাঙ্ক টাইপের এক ছেলের সাথে সম্পর্ক হয়েছে। মাঝে মাঝে ফেস বুকে তাদের ঝাপটা ঝাপটি করা ছবিও দিয়ে রাখে। আমার ক্লাসমেট যে কিনা পড়ালেখায় সব চেয়ে ভাল ছিল, সে তার ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে না পেরে দিনে দিনে আসক্ত হয়ে যায় মাদকে। পড়ালেখার নাম গন্ধ নেই। অনেক দিন হল তার খবর কেউ জানেনা। আমাকে সে বলেছিল - মেয়েদের চাইতে সিগারেট, এলকোহল অনেক বেশি বিশ্বস্ত, কারণ মেয়েরা ছেড়ে চলে যায়, সিগারেট এলকোহল সাথে থেকেই যায়”। হ্যাঁ, সম্পর্কগুলো মন কে ভেঙ্গে নষ্ট করে যায় কিন্তু তা আবার ঠিক করা সম্ভব, আর মাদক থেকেই যায় আজীবন এবং একটা মানুষ কে তিল তিল করে নিঃশেষ করে ফেলে। আমার কথা হল যে মানুষটি অন্যায় করেছে সে তো অনেক ভাল আছে। কিন্তু আমার ক্লাসমেট যে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করল তার কি হবে! তার পরিবারের কতই না স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে।
৪
ক্লাসিক্যাল নাচে উনি ছিলেন আমাদের চেয়ে দু বছরের সিনিয়র। উনার নাচের মুদ্রা দেখে আমি টাস্কি খেতাম আর ভাবতাম কবে এমন করে দক্ষ হব! কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই সেই আপুর সাথে দেখা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন, চোখ দুটা গর্তে চলে গেছে। চেনাই যায়না। জানতে পারলাম, তার ভালবাসার মানুষটি ছিল মাদকে আসক্ত। নিজের প্রেমিক কে মাদক ছাড়াতে গিয়ে উনি নিজেও মাদকে আসক্ত হয়ে গেছেন। অথচ উনার অনুপ্রেরণায় সেই প্রেমিক এখন অনেক সুস্থ এবং আজকাল এক ডাক্তার মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে। এই আপুটি তাকে ফোন করলে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করেন। আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম “আপু, আপনি না স্বপ্ন দেখতেন চারটা মেয়ে নিয়ে এই দেশের সব চেয়ে বড়, অন্যতম নাচের গ্রুপ বানাবেন। যারা বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের দেশের শিল্প তুলে ধরবে" !! আমি উনাকে ফ্যাকাসে একটা হাসি দিতে দেখেছি, লজ্জিত হতে দেখেছি। আমাকে আপু বলেছিলেন "আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চাই"। উনি এখন নিজের চিকিৎসা করাচ্ছেন।
৫
আজকাল যদি টিনএজারদের ফেসবুকের প্রো-ছবি একটু লক্ষ্য করে দেখেন তবে দেখবেন অনেকেই আজকাল শীষা নিয়ে ছবি দিচ্ছে। এইটা হল নিউ ফ্যাশন। ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর শীষা লাউঞ্জে লেগে থাকে সারাদিনই ভিড়। যারা শীষা খায়নি তাদের কে নাকি বলা হয় আনস্মার্ট। একটা ছেলে বা মেয়েকে মেধা,সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব দিয়ে নয় শীষা খেয়ে প্রমাণ করতে হবে সে স্মার্ট !!
অনেক আগে ছেলে মেয়েদেরকে একসাথে মিশতে দেওয়া হতনা, মেয়েরা ঘরের বাইরে বের হতে পারত না, সে সময় ফেসবুক, টুইটার, শীষা ছিল না, মানুষজন অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করত, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হত। এ সময়ে অনেক সহজে ঘরে বসেই নেট থেকে যে কোন কোর্স ম্যাটেরিয়াল পাওয়া যায়, অবাধে মিশতে পারে ছেলে মেয়েরা। আছে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার,কত কত ফার্স্ট ফুডের দোকান। তাতে কি? তাই বলে কি মূল্যবোধ, চরিত্র, দায়িত্ব, সততার সাথে আপোষ করা যায়? বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, সত্যজিৎ রায়, স্যর জগদীশ চন্দ্র বসুও কি এ সময়ে জন্ম গ্রহণ করলে বদলে যেতেন? না, আমার তা মনে হয়না।
এতসব রঙিন বায়স্কোপের মাঝেও কিছু মানুষ আছে যারা এখনো অটুট হয়ে আছে, যাদের কাছে জীবনে প্রেম করা, মাদকাসক্ত হওয়া ছাড়াও অনেক কিছু করার আছে। আছে অসাধ্য স্বপ্ন জয় করার অদম্য সাহস। তবে দুঃখ হল তারা সংখ্যায় অনেক কম। আর আনন্দের বিষয় হল এখনো পৃথিবীতে, এ দেশে সত্যিকারের মানুষ মিলিয়ে যায়নি, শেষ হয়ে যায়নি। তাই সব চেয়ে বড় আশার কথা হল- “জীবনটা মস্ত বড়। স্বপ্ন দেখার আর সত্যি করার ইচ্ছেগুলো এখনো বেঁচে আছে, স্বপ্ন পুরোনের দিন শেষ হয়ে যায়নি” ...
“এই সময়ে সেই সব মানুষেরা”-
নাটকের কিছু অংশের লিঙ্কঃ- পর্ব ১ পর্ব ৩
একটা মাদকবিরোধী লেখাইউফোরিক রাতে চারজন যুবক
কিছুদিন আগে পড়া মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দুইটি অভিনব ঘটনাঃ- একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে...
স্টুডিও থেকে যেভাবে মেয়েদের ছবি বিক্রি হয়