রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক ও নার্সদের ধর্মঘট বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হাসপাতাল এলাকায় চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর রোগী বা তাদের স্বজনদের হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
পাশাপাশি হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের ধর্মঘট বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না— তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিচালকসহ ২৩ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
গত রোববার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সদের ধমর্ঘট বন্ধসহ কয়েকটি বিষয়ে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ওই রিটের শুনানি নিয়ে সোমবার রুল জারি করেন আদালত।
আমি আশা রাখি এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখি আমাদের মাননীয় সচিব ও ডিজি মহোদয় সহ সকল বিবাদীগন অবশ্যই মাননীয় আদালতকে যথাযথ একটি সদুত্তর অতিসত্বর দেবেন।
আমি এই লেখায় বের করার চেষ্টা করব,
১. কেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা ধর্মঘট করেন, কারনগুলো আসলেই যৌক্তিক কি, না।
২. চিকিৎসক ধর্মঘটের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের ধর্মঘট আদৌ কতটা যৌক্তিক।
আমি আশা করি, আপনি আমার এই লেখাটি আমার মতই একটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে পড়বেন এবং আপনার গঠনমূলক মতামত দেবেন।
প্রথমত, কর্মক্ষেত্রে ধর্মঘট কি, কেন?
একজন শ্রমিক বা কর্মচারী তার কর্মক্ষেত্রে যে কোন প্রকার বৈষম্য বা অসদাচরণ এর স্বীকার হলে, তার সমাধানের জন্য কিছু পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। যখন আইনগত পথে সমস্যার সমাধান হয় না, তখনই তারা কর্মক্ষেত্রে অসহযোগিতা করার মাধ্যমে প্রতিবাদের পথে বেছে নেন, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘কর্মবিরতি বা ধর্মঘট’। বিশ্বের কোন প্রকার শ্রম আইনে আমার জানা মতে এই ধরনের প্রতিবাদ অবৈধ নয়।
এখন প্রশ্ন আসে, চিকিৎসকেরা কেন ধর্মঘট করেন?
এই প্রশ্ন আপনার মত আমারও!
চিকিৎসকেরা রোগী দেখবেন, চিকিৎসা দেবেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী দেবেন, তাদের কি প্রয়োজন ‘কর্মবিরতি’তে যাবার?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে বাস্তবতাটা একটু দেখি, আসুন।
ক। যুক্তরাজ্য:
"১৯৭৫ এর জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সকল কনসালটেন্ট তাদের “রুটিন ও ওভারটাইম” সার্ভিস বন্ধ রেখেছিলেন, সরকারের এমন একটি আইনের প্রতিবাদের, যেটি তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে ব্যহত করে।
একই বছরের নভেম্বর মাসে, জুনিয়র চিকিৎসকেরা সাপ্তাহিক কর্মঘন্টা কমানোর জন্য সকল প্রকার রুটিন সেবা থেকে কর্মবিরতিতে যায়। উল্লেখ্য এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলনের পর জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে EU Work Directive এর বাস্তবায়নের ফলে গোটা ইউরোপের মত যুক্তরাজ্যেও ডাক্তারদের নিয়মিত কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টায় এবং বেসিকের ৪০% ওভারটাইম সাপেক্ষে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালেই এটি বাস্তবায়িত হয়েছে। রয়েল কলেজ অফ সার্জারির কর্তাদের চেঁচামেচিও এটা বন্ধ করতে পারেনি। কারণ এখন পর্যন্ত কোন স্টাডিই পেশেন্ট সেফটি ও ট্রেনিং এর গুণগত মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রমাণ করেনি। বরং ডাক্তারদের জীবনযাত্রার মান(Quality of Life) এবং কাজ ও জীবনের সমন্বয় (Work-Life balance) অনেক বেড়ে যাবার কথা প্রতিটি স্টাডিই উচ্চকণ্ঠে বলছে।
২০১২ সালের ২১ জুন যুক্তরাজ্যের বেস্ট পেইড পাবলিক সার্ভেন্ট অর্থাৎ ডাক্তাররা পরিবর্তিত পেনশন স্কিমের প্রতিবাদে স্ট্রাইক করে। উল্লেখ্য যুক্তরাজ্যের প্রতিটি স্ট্রাইকই ছিল সর্বাত্মক এবং স্ট্রাইকের প্রস্তাব ব্রিটিশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাধারণ সভায় ব্যালটের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ভোটে পাশ হতে হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, বিবিসি গার্ডিয়ান বা টেলিগ্রাফ কারো প্রতিবেদনেই কিন্তু রোগীদের “জিম্মি” করা বা দুর্ভোগের ব্যাপারটাকে খুব ফলাও করে প্রচার করা হয় নি। বরং বারবার লেখা হয়েছে যে, ইমার্জেন্সি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার, ক্যান্সার-কেয়ার ইত্যাদি সেবা চালু ছিল।
২৩ এপ্রিল ২০১৪ তারিখ সকালে আয়ারল্যান্ডের ইন্টার্নসহ জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মঘণ্টা সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখার দাবীতে ধর্মঘট আহ্বান করেন। কর্তৃপক্ষ সে বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ইয়োরোপিয়ান ওয়র্ক ডিরেক্টিভ এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এর ব্যবস্থা গ্রহন করে আয়ারল্যান্ডে।
অতিসম্প্রতি, এই বছর জানুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যের সকল জুনিয়র চিকিৎসক কর্মবিরতিতে গিয়েছিলেন সরকার কর্তৃক কর্মঘন্টা বাড়ানোর প্রস্তাব, ওভারটাইমে পর্যাপ্ত পে না করা, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ না দেওয়া ও বেতন না বাড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। উল্লেখ্য, এই ধর্মঘটে যুক্তরাজ্যের মিডিয়া এবং সর্বস্তরের জনগন চিকিৎসকদের পক্ষেই ছিলেন! (যেটা বাংলাদেশে স্বপ্নেও ভাবা যায়না!!)"*
খ। যুক্তরাষ্ট্র :
"যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডাক্তাররা প্রথম ধর্মঘট আহ্বান করেন ১৯৬৬ সালের ২৮ জুন। এদিন নিউ ইয়র্ক সিটি হেলথ ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত প্রায় ১৫০০ ডাক্তার যাদের মধ্যে ডেন্টিস্ট ও অপ্টোমেট্রিস্টরাও ছিলেন, ১১৯ টি শিশু হাসপাতালে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করেন। তাঁদের দাবী ছিল বর্ধিত বেতন এবং কর্ম-নিরাপত্তা। এর মধ্যে ৫৫টি হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ ছিল এবং ৫৮ টি হাসপাতালে সীমাবদ্ধ সেবা বা শুধু ইমার্জেন্সি ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবা চালু ছিল। লক্ষ্যণীয়, এমন স্ট্রাইক বাংলাদেশে হলে হয়ত ডাক্তারদের গণহত্যা করা হত। বাংলাদেশে কখনোই কোন স্ট্রাইকে কোন পাবলিক হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়নি।"*
গ। কানাডা:
"১৯৬২ সালের ১জুলাই কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশে ডাক্তাররা নতুন স্বাস্থ্যবীমার প্রতিবাদে সর্বাত্মক ধর্মঘটে যান। এবং রোগীরা ক্লিনিকে গিয়ে দেখতে পানঃ
This sign was on the door of the Prince Albert Clinic to notify patients that the doctors were going on strike on July 1, 1962.
Saskatchewan Archives Board, George and Tillie Taylor"*
ঘ। ফ্রান্স:
"২০০২ সালের ২৩ জানুয়ারী ফ্রান্সের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসক কনসালটেশন ফি বাড়ানোর দাবীতে ধর্মঘট করেন। এরপর ২০০৫ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফ্রেঞ্চ এসোসিয়েশন অফ হসপিটাল ইমার্জেন্সি ডক্টরস এর নেতৃত্বে ফ্রান্সের পাবলিক এবং ইউনিভার্সিটি হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সিতে এক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাস্থ্য-প্রশাসক, নার্স এবং এম্বুলেন্স ড্রাইভাররাও যোগ দেন। আন্দোলনরত চিকিৎসকগণের দাবী শুধু উন্নত কর্ম পরিবেশ, অধিক স্টাফ, বেশি বেতন, বেশি শয্যার দাবীই তোলেন নি, বরং সমগ্র ইমার্জেন্সি এবং ‘আউট অফ আওয়ার’ কাজের পুনর্বিন্যাসের দাবী করেছেন। কাজের পরিবেশের উন্নতি ও কর্মঘণ্টা হ্রাস করার দাবীতে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বড়দিনের ছুটির সময় ফ্রান্সের তরুণ চিকিৎসকদের ইউনিয়ন একটি ধর্মঘট আহ্বান করে।
চিকিৎসকদের স্ট্রাইক হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বের সেরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশ ফ্রান্সেও!!
কি অমানবিক এরা তাই না?"*
ঙ। ভারত:
"এছাড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমরা যাদের প্রায় সব খারাপ দিকগুলো নকল করি, সেই ভারতে আকছার নানা পর্যায়ের চিকিৎসকদের ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। গত ২০১৪ এর মার্চ মাসে, ইউ,পি তে এক এম,এল,এর সাথে জুনিয়র ডাক্তারদের বিরোধের জের ধরে বিশাল এক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। কানপুরের GSVM Medical College এর জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে এ ধর্মঘট ডাকা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালের জুন মাসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে জটিল গ্রুপিং এর দরুণ ২ জন চিকিৎসকসহ মোট ৬ জনকে ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ৩ জন ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং তাদের নামও মামলায় ছিল না। স্রেফ ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে এদের বিরুদ্ধে বিনা অভিযোগে নির্মম নির্যাতন চালানো হয় এবং ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে আহত ছাত্রদের প্রিজন সেলে পাঠানো থেকে বিরত থাকে কারা-কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালে আবারো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বিনা দোষে সন্দেহভাজন হিসেবে মেধাবী চিকিৎসক আশিস কুমারকে প্রায় আড়াই মাস কারাবন্দী রাখা হয় এবং সে ৩১ তম বি,সি,এস এর লিখিত পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। এই গুরুতর ঘটনাদ্বয়ের ফলেও কিন্তু কোন ধর্মঘট হয়নি। প্রায় একই ধরণের ঘটনায় কিন্তু গোটা উত্তরপ্রদেশের মেডিকেল ছাত্ররা ও জুনিয়র চিকিৎসকরা উত্তাল হয়ে উঠেছিল গত মাসেই। কাজেই আমাদের ডাক্তার ও শিক্ষার্থীরা কিন্তু অনেক বেশি সহিষ্ণু, এমন গুরুতর অন্যায়ও কিন্তু তারা মেনে নিয়েছে।
গত বছর শেষের দিকেও বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবীতে আবারও ভারতের জুনিয়র চিকিৎসকরা ধর্মঘটে যায় এবং কর্তৃপক্ষ বেতন-ভাতা বাড়ানোর আশ্বাসে তারা কাজে ফিরে যায়।"*
এবার আসুন দেখি, বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা কেন ধর্মঘটে যান??
তাদের একমাত্র দাবী ছিল, “কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা”!
বিশ্বের নানা দেশের ডাক্তাররা নিজেরদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ধর্মঘটে যান, আর বাংলাদেশের ডাক্তাররা চেয়েছিলেন তাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেয়া হোক, তাদের ওপর যেসকল অন্যায় আক্রমন করা হয়েছে, সেগুলোর বিচার হোক।
আপনিই বলুন, এই দাবীটি কি খুব অযৌক্তিক মনে হয়??
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা না থাকলে আপনাকে ডাক্তার সেবা দেবেন কি করে?
যেখানে অন্য দেশের ডাক্তাররা নিজেদের লাভের জন্য কর্মবিরতিতে যান, সেখানে এদেশের ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে যান, আপনার জন্য নিরাপদ সেবার পরিবেশের দাবীতে!!
কি স্বার্থপর আমাদের ডাক্তারেরা, তাই না??
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার দাবীটা কি খুব অযৌক্তিক?
কেন কর্মক্ষেত্রে ডাক্তাররা আক্রান্ত হয়েছিলেন, জানেন আপনি?
বলবেন, “ভুল চিকিৎসায় রোগী মেরে ফেলেছিল বলে মার খেয়েছে, মামলা খেয়েছে!”
তাহলে এটাই বলতে হয়, পত্রিকা আর টিভিওয়ালারা আপনার ভালোই ব্রেইন ওয়াশ করেছে।
চিকিৎসক সংগঠন প্ল্যাটফর্ম এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিগত ৩ বছরে সারা দেশে মোট ১২০ জন চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। মানসিক নির্যাতনের হিসেব হাতে-কলমে গোনার বাইরে চলে গেছে বহু আগেই!
আক্রান্ত হয়েছেন ইন্টার্ণ চিকিৎসক থেকে শুরু করে সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত পর্যায়ের চিকিৎসক!!
শুধুমাত্র রোগীর লোকের দায়েরকৃত তথাকথিত “ভুল চিকিৎসা”র অভিযোগে থানায় মামলার প্রেক্ষিতে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। এমনকি অপারেশন থিয়েটার থেকেও গ্রেফতার করা হয়েছে চিকিৎসককে!!
প্ল্যাটফর্মের সমীক্ষায় উঠে এসেছে কেন চিকিৎসকদের ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটেছে। কারনগুলো দেখে আপনার নিজেরও হতভম্ব হয়ে যাবার কথা!
১. উচ্চতর চিকিৎসার জন্য অন্যত্র রেফার করা রোগীকে ভাল চিকিৎসার জন্য না নিয়ে গিয়ে রোগীকে সংশ্লিষ্ট সেবাকেন্দ্রে ফেলে রাখে রোগীর পক্ষ এবং সেখানে রোগীর মৃত্যুর পর চিকিৎসকের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়!!
২. রোগী পরিবহনের জন্য এম্বুলেন্স না থাকায়!! সরকার এম্বুলেন্স না দিলে ডাক্তার কি করবে? কোথাও কোথাও এম্বুলেন্স আছে, মেইনটেন্সের টাকা দেয়া হয় না, কোথাও ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া হয় নি, কোথাও কোথাও এম্বুলেন্সইই নষ্ট। এর দায়ও কি ডাক্তারদের নিতে হবে?? অনেকক্ষেত্রে এম্বুলেন্স অন্য রোগী পরিবহনে ব্যস্ত থাকার পরও ডাক্তারের ওপর চড়াও হয়েছে পাব্লিক!!
৩. আউটডোর এ সিরিয়াল ব্রেক করে ব্যক্তিগত-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রোগী দেখানোর চেষ্টা করায় ডাক্তার বাধা দেওয়াতে!!
যেখানে মেডিকেল এথিক্স এ আছে, ডাক্তার রোগীর সেবা দেবার ক্ষেত্রে রোগীর ব্যক্তিগত-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় আনতে পারবেন না, সেখানে ডাক্তারের ওপর এধরনের ক্ষেত্র থেকে চাপ প্রয়োগ কি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ নয়?? এই এথিক্স মেনে চলার কারনে ডাক্তার মার খেয়েছেন এই দেশে!!
৪. হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় বাসায় গিয়ে রোগী দেখতে রাজী না হওয়ায় মার খেয়েছেন এদেশের উপজেলা পর্যায়ের অনেক চিকিৎসক। আপনারা আমজনতা তো মাশাল্লাহ সব জান্তা। বলি, সরকারী একজন মেডিকেল অফিসারের সরকার নির্ধারিত কাজের ব্যাপারে আপনার কোন আইডিয়া আছে? নাই। সেতা তো জানার মুরোদই নাই। সরকারী কর্মঘন্টার সময় চিকিৎসক সকল সেবা দেবেন হাসপাতালে, আপনার বাড়িতে সেবা দেবার কোন নির্দেশনা নাই এবং এটি বিশ্বের কোথাও নেই। বরং আপনার বাসায় রোগী দেখতে গেলে সেই একই সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী যে সেবা বঞ্চিত হবে, তার দায় কে নেবে? সেই ডাক্তারের কাধেই এসে চাপবে, কেন সে সেখানে উপস্থিত ছিল না! কি যৌক্তিক আপনারা, তাই না??
৫. বহুল প্রচলিত অভিযোগ, ভুল চিকিৎসা করে বা ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগী মেরে ফেলেছে!! এই অভিযোগে কতজন চিকিৎসক যে নির্যাতিত হয়েছে, তার হিসেব নাই! ডাক্তারের সাথে যেন রোগীর আজন্ম শত্রুতা আছে, এদেশের মানুষের আচরন দেখলে সেটাই মনে হয়। আর ডাক্তারের ভুল ধরার জন্য তো ক্লাস ফাইভ পাশ করারও প্রয়োজন হয় না এদেশে! যেখানে হাইড্রোকর্টিসন অথবা এড্রেনালিনকে বলা হয় লাইফ সেভিং ড্রাগ, সেখানে ডাক্তার রোগী বাচাবার জন্য সেটি দেবার পরও রোগির মৃত্যুর দায় তাকেই নিতে হচ্ছে!! বাংলাদেশের সব রোগী মনে হয় যেন অমরত্বের সার্টিফিকেট নিয়ে দুনিয়ায় আসছে!!
৬. সরকারী নিয়ম না মেনে নির্ধারিত টিকেট না কেটে রোগী দেখাতে চাইলে চিকিৎসক রাজী না হওয়ায় মার খেয়েছেন এমন নজিরও আছে এদেশে!! বিনা কারনে সরকারী ঔষধ নিয়ে যেতে চাইলে চিকিৎসক দিতে রাজী না হওয়ায় নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন এদেশে! রাষ্ট্রীয় নিয়ম মানতে বলা, সম্পদের রক্ষণাবেক্ষন করার চেষ্টা করা কি অপরাধ এই দেশে??
৭. কলে পানি নাই কেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার নষ্ট কেন, টয়লেট অপরিষ্কার কেন, এজন্যেও মার খেয়েছেন চিকিৎসকেরা!!
৮. ভি আই পি কেবিন নাই কেন, কেবিনে এসি নাই কেন, এই কারনের জন্য মার খেয়েছেন চিকিৎসক!
৯. সরকারী কর্মঘন্টা চলাকালে রোগী বাদ দিয়ে অপরিচিত লোকের কাগজ সত্যায়িত করা হয়নি কেন, এজন্য নির্যাতিত হয়েছেন চিকিৎসক!
১০. মিথ্যা ও ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে রাজি হননি বলে মার খেয়েছেন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের চিকিৎসকেরা!
১১. কিছু কিছু জায়গায় চাঁদা দিতে রাজী হননি বলে মার খেয়েছেন চিকিৎসক!
কি যৌক্তিক সব কারন পাবলিকের, চিকিৎসকের ওপর হামলা করার জন্য, তাই না??
আর কি অযৌক্তিক সব কারন চিকিৎসকদের ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার আশা করার জন্য, তাই না??
অনেক সুশীল আছেন, এই কথাগুলোর প্রেক্ষিতে বলবেন, দেশে আইন-আদালত আছে, আপনারা তার কাছে যান।
গিয়েছি মশায়। বেশিরভাগ জায়গায়ই অপরাধী দিব্যি নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও কোথাও চিকিৎসককে বাধ্য করা হচ্ছে মিউচুয়াল করতে!
আর আপনাদের উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিকরা দিনের পর দিন যোগ্যতার ধারে কাছে না গিয়েও “ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু” টাইপ অপসাংবাদিকতা করে জনগনকে ক্রমাগত ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে।
অনেকগুলো স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে বার বার এধরনের আক্রমনের ঘটনা ঘটেই চলেছে, যেমন, ফুলপুর/কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইত্যাদি।
গত ২০১৪ সালে বারডেম, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, সেগুলোর একটিও আজো বাস্তবায়িত হয় নি!!
চিকিৎসকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তো কমেই নি, বরং দিনকে দিন বাড়ছে!!
এদেশের চিকিৎসকেরা ধর্মঘটে যান, রোগীকে জিম্মি করে না, তারা আঊটডোর সার্ভিসের মত রুটিন সার্ভিস বন্ধ রাখেন, কিন্তু একটিবারের জন্যও ইমার্জেন্সী এবং ইনডোর সার্ভিস বন্ধ রাখেন নি। ইন্টার্নরা ধর্মঘটে গেলে ইনডোর ও ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসারেরা সেবা দিয়েছেন, মেডিকেল অফিসারেরা ধর্মঘটে গেলে রেজিস্ট্রার-সহকারী অধ্যাপকেরা জরুরী সেবা দিয়েছেন। এদেশের চিকিৎসক ধর্মঘটের ইতিহাসে একটি দিনের জন্যও জরুরী ও অন্ত: বিভাগ সেবা এক মিনিটের জন্যও বন্ধ রাখা হয়নি। অথচ, পেপার-পত্রিকা পড়লে মনে হয়, ধর্মঘটের দিন কোন ডাক্তারই হাসপাতালে যায়নি!!
ধিক্কার জানাই এইসব অপ-সাংবাদিক আর তাদের হলুদ সাংবাদিকতাকে, যারা রোগীর সেন্টিমেন্টকে জিম্মি করে ব্যবসা করে।
"আমজনতা বাদ দিই, অধিকাংশ এমনকি অনেক সিনিয়র ডাক্তারেরই ধারণা নেই যে, ডাক্তার-নার্সদের ধর্মঘট বৈধ কিনা। অধিকাংশই মনে করেন এর সাথে মেডিকেল এথিক্স, হিপোক্রেটিক ওথ, WMA ডিক্লেয়ারেশনের বিরোধ আছে। আসলে এই দলিলগুলো অধিকাংশ ডাক্তারই পড়েন না। আমজনতা তো নয়ই। এই রিটটিও অজ্ঞতাপ্রসূত। মহামান্য আদালত যে জবাব চেয়েছেন তা খুবই সহজ। দেখা যাক কেন?
♣ চিকিৎসক ধর্মঘট কি অবৈধ, অনৈতিক বা বেআইনী?
– না। বে-আইনী হতে গেলে সে সংক্রান্ত আইন থাকতে হয়। এ ধরণের আইন গোটা বিশ্বে নজিরবিহীন। চিকিৎসকদের স্ট্রাইক অনৈতিকও নয়, কারণ তাঁরা কখনোই জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দেন না। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কখনো ইমার্জেন্সি, ICU, CCU বা ইনডোর থেকে একযোগে সব চিকিৎসক বের হয়ে আসেন নি। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র এই বিভাগগুলোই ইসেনশিয়াল বা অতি জরুরী সার্ভিসের পর্যায়ে পড়ে। বহির্বিভাগকে অতি জরুরী সেবার তালিকাভুক্তি প্রহসন রাজনৈতিক স্টান্টবাজি, অজ্ঞ আমলাতন্ত্র এবং তৈলমর্দনশিল্পী কতিপয় চিকিৎসক কর্তার উর্বর মস্তিষ্কের কারসাজি।
♣ হিপোক্রেটিক ওথ বা WMA ডিক্লেয়ারেশনে কোথাও বলা নেই যে, চিকিৎসকরা স্ট্রাইক করতে পারবেন না। বলা আছে রোগীর স্বার্থ আগে। চিকিৎসকরা যখন নিজেদের নিরাপত্তা ও উন্নত স্যালারি, কর্মঘণ্টা ও জীবনের দাবীতে ধর্মঘটে যান তখন সেটা রোগীদের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই। অনিরাপদ, অসন্তুষ্ট ও অবিশ্রান্ত চিকিৎসক রোগীর জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। সম্প্রতি ইংল্যান্ডে জুনিয়র ডাক্তারদের সর্বাত্মক ধর্মঘট যেখানে ইমার্জেন্সি, আই,সি,ইউ প্রভৃতি সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল- সেটি বিভিন্ন পোল অনুযায়ী ৬০% মানুষ সমর্থন করেছে।
♣ রোগীমাত্রকেই দেখতে চিকিৎসক বাধ্য নন। জীবন বিপন্ন নয় এমন যেকোন রোগীকেই চিকিৎসক নির্দিষ্ট কারণ সাপেক্ষে ফিরিয়ে দিতে পারেন। যেমনঃ
– রোগী বা তার আত্মীয় দুর্ব্যবহার করলে
– ফি তে অসন্তুষ্ট হলে
– রেফারাল ছাড়া অন্য ডাক্তারের কাছে গেলে
– বিষয় না মিললে।
চিকিৎসক যখন অনিরাপদ তখন সব অবিপন্ন রোগীকে ফিরিয়ে দিলেও মেডিকেল এথিক্স অনুযায়ী কোন অনৈতিক কাজ হয় না।
♣ বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশে জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ। কাজেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিরাপত্তার অভাবে কর্ম বর্জন করলে তাদের জোর করে কাজে ফেরানো অসাংবিধানিক। যদি এই অনুচ্ছেদ এর ২(খ) ধারা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন করে এটা আটকানো হয় তবে তা হবে অগণতান্ত্রিক এবং নিপীড়নমূলক।
♣ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে কেউ বাধ্য নয়। এটি চিকিৎসক নিজের ইচ্ছায় বন্ধ রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামে যে ঘটনা ঘটেছিল তার প্রেক্ষিতে একটা রিট হোয়া উচিত যদি পত্রিকায় প্রকাশিত পর্যবেক্ষণের কথা অফিশিয়ালি লেখা হয়ে থাকে। কারণ সেটা ভুল।
♣ অন্য পেশাগুলোর সাথে শপথ পার্থক্য গড়ে দিলেও তাতে কোথাও অধিকার আদায়ের গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করা হয় নি। চিকিৎসকদের স্ট্রাইকে কখনোই জীবনরক্ষাকারী বিভাগগুলো বন্ধ হয় না বলে সেটা অনৈতিক, অবৈধ বা বে-আইনী নয়। রিটটি ব্যবহারজীবী ও রিটকারীদের অজ্ঞতাপ্রসূত। বেতনবৃদ্ধি ও কর্মঘণ্টা কমানোর দাবীতে চিকিৎসকদের ধর্মঘট বিশ্বে একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। অথচ কোথাও এ ধরণের রিট হয় নি। অথচ নিরাপত্তার দাবীতে বাংলাদেশে চিকিৎসকদের বিচ্ছিন্ন এবং মূলত ইন্টার্নদের ধর্মঘটের বিরুদ্ধে অজ্ঞ সমালোচনা এবং এই রিট সন্দেহজনক এবং চিকিৎসকদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র।"*
এবার বিবেচনার ভার আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম।
এদেশের চিকিৎসকেরা কেন ধর্মঘটে যাবেন না, সেটার ব্যাখ্যা চেয়ে প্রশ্ন সেই তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের কাছে রেখে গেলাম।
আর মাননীয় আদালত, আশা করি আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।
আশা করছি, বিজ্ঞ আদালত অচিরেই এই রুল জারি করবেন, “কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকের ওপর অন্যায় হামলা কেন দ্রুত বিচার আইনে বিচার করা হবে না তার কারন দর্শানোর নোটিশ”।
আর এদেশের তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো “কর্মস্থলে চিকিৎসকের ওপর হামলা কেন অবৈধ হবে না” এই টাইপ কোন রিট উচ্চ আদালতে করবে না, আমরা জানি।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে চিকিৎসকদের, রিটটা আপনাদের করার দরকার নেই, সময়মত আমরাই করব ইনশাআল্লাহ্।
তথ্যসূত্র:
http://www.bbc.com/news/health-18270523
http://www.theguardian.com/commentisfree/2012/jun/04/doctors-striking-nhs-industrial-action
http://careers.bmj.com/careers/advice/view-article.html?id=20004322
http://www.thejournal.ie/junior-doctors-strike-action-2-1119030-Oct2013/
http://news.google.com/newspapers?nid=1955&dat=19660628&id=oLwhAAAAIBAJ&sjid=fJwFAAAAIBAJ&pg=3735
,7338391
http://www.historymuseum.ca/cmc/exhibitions/hist/medicare/medic-5h07e.shtml
http://www.historymuseum.ca/cmc/exhibitions/hist/medicare/medic-7h11e.shtml
http://www.telegraph.co.uk/news/worldnews/europe/france/1382588/Worlds-best-health-service-in-chaos-as-doctors-strike.html
http://www.bmj.com/content/330/7496/864.3
http://www.english.rfi.fr/france/20121224-young-doctors-france-go-holiday-strike
http://timesofindia.indiatimes.com/india/UP-doctors-call-off-strike-after-meeting-Mulayam/articleshow/31514438.cms
*তথ্য কৃতজ্ঞতা :
ডা. নির্ঝর আলয়(http://www.sachalayatan.com/nirjharaloy/52081)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:১৮