মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অতীত অপরাধের বিচার হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শেষ হয়েছে, রায়ও কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এখন আর একটা বিচারের দাবি জোরেশোরে উচ্চারিত হওয়া দরকার। ’৭২-’৭৫ সময়কালে জাসদের অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধের বিচার। কী না করেছেন জাসদের ইনু ও পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকদাররা! হাজার হাজার মেধাবী তরুণের জীবন ধ্বংস থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তারা। জাসদ গণবাহিনী নামে যে আর্মস ব্যান্ড গড়ে তুলেছিল, তার কমান্ডার ছিলেন কর্নেল তাহের আর পলিটিক্যাল কমিশার ছিলেন হাসানুল হক ইনু। কেন বিচার হবে না ইনুর? গণবাহিনী কি মানুষ হত্যা করেনি? থানা লুট করেনি? অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে চায়নি?
একজন মানুষের পক্ষে কত ডিগ্রি কোণে উল্টে যাওয়া সম্ভব? ৬০, ৭০, ৮০, ৯০ ডিগ্রি? না। এদেশের রাজনীতিতে এমন মানুষও পাওয়া যাবে, যিনি পুরো ১৮০ ডিগ্রি কোণে উল্টে যেতে পারেন। এদেরই একজন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এই ইনু সাহেবরাই একদিন বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে জুতো বানাতে চেয়েছিলেন, আজ কিনা বলছেনÑ বঙ্গবন্ধু একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ! এই ইনু সাহেবরাই একদিন ঘোষণা দিয়ে শেখ মুজিবের কপাল থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন পল্টনের জনসভায়। আজ কিনা তিনি শেখ মুজিবুর রহমান নামটাই ভুলে গেছেন, এক নিঃশ্বাসে অন্তত দশবার উচ্চারণ করেন বঙ্গবন্ধু। হ্যাঁ, ৭ মার্চ জাতীয় সংসদে এভাবেই বক্তৃতা করেছেন হাসানুল হক ইনু। এখন যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, বঙ্গবন্ধুকে একটি সদ্যস্বাধীন দেশের পুনর্গঠনের কাজে সহায়তা না করে জাসদ সৃষ্টির মাধ্যমে হাজার হাজার মেধাবী তরুণকে কেন ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন তার বিরুদ্ধে, কী জবাব দেবেন তিনি? যদি বলি, বঙ্গবন্ধুর অকাল মৃত্যুর জন্য তিনি এবং তার সমগোত্রীয়রাই দায়ী, কারণ তারাই এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন যে, ঘাতকরা সাহস পেয়েছিল তাকে হত্যা করতে, তাহলে কী জবাব দেবেন তিনি? জবাব একটা আছে বটেÑ রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
দুঃখিত ইনু সাহেব, আপনার এ জবাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি আমরা। রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নেই মানছি; কিন্তু নৈতিকতার শেষ কথা অবশ্যই আছে। গতকাল বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে যখন আপনি জুতো বানাতে চেয়েছিলেন, তখন যেমন আপনি ছিলেন ক্ষমতালোভী এক অর্বাচীন, আজ যখন তাকে ইতিহাসের মহানায়ক বলছেন, তখনও আপনি একই পদার্থ। ক্ষমতার প্রতি লোভ আপনার স্থায়ী, ধ্র“ব ও চিরন্তন এক খায়েশ। বর্তমানে ক্ষমতার সামান্য শেয়ারে আপনার মন ভরছে না। আরও ক্ষমতা চাই আপনার। আর তাই এত বঙ্গবন্ধু বন্দনা। জাসদ যখন গঠন করেছিলেন, তখনও একই চিন্তা কাজ করেছিল আপনাদের মধ্যে। তোফায়েল-মণিরা সব নিয়ে গেল, উচ্ছিষ্ট খেয়ে লাভ কী? বরং একটা দল করি, বিশ্বজুড়ে তো একটা রেডিমেড জনপ্রিয় মতবাদ রয়েছেইÑ মার্কসবাদ। ব্যস, ওটাকে পিক করি, তারপর দল গঠন করে হটাই শেখ মুজিবকে। দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি যখন, মুজিবকেও হটাতে পারব। এরপর শুরু হল আপনাদের প্রক্রিয়া। মার্কসবাদের অসম্ভব সম্মোহনী ক্ষমতাকে কাজে লাগালেন। তরুণ-যুবকের হাতে তুলে দিলেন দাস ক্যাপিটাল, চে গুয়েভারার জীবনী, কার্লোস ম্যারিগালার শহরভিত্তিক গেরিলা অভিযানের কৌশল, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সব লোমহর্ষক কাহিনী, আরও কত কী! বাইবেলের চেয়ে আকর্ষণীয় সেসব বই মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবশ করে ফেলল তরুণ-যুব শ্রেণীকে। তারা উচ্চারণ করলÑ বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন! নির্দোষ, নিষ্পাপ সেই তরুণ-যুবককে অপকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলার সেই শুরু। নেতৃত্ব দিলেন আপনি, সিরাজুল আলম খান, আসম রব, মেজর জলিল, আরও অনেকে। কী আশ্চর্য, মেজর জলিল পরবর্তীকালে মার্কসবাদের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ইসলামী আদর্শে দীক্ষিত হলেন। মৃত্যুও হল তার পাকিস্তানে। আসম রব পরিচিতি পেলেন গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে। সিরাজুল আলম তার স্টান্ট-ভাণ্ডার নিঃশেষ করে এখন নিছকই একজন আড্ডাবাজ। আর আপনি? শুধুই একটা মন্ত্রিত্বের আশায়, শুধুই একটু শেখ হাসিনার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টায় হয়ে গেলেন একজন বনেদি আওয়ামী লীগারের চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার। হিন্দু ও আওয়ামী লীগার নাকি হওয়া যায় না (মান্না যেমন হতে পারেননি), হয়ে জš§াতে হয়। আপনার স্তুতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, আপনি এখনই হয়ে গেছেনÑ মোর ক্রিশ্চিয়ান দ্যান দ্য পোপ।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অতীত অপরাধের বিচার হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার শেষ হয়েছে, রায়ও কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এখন আর একটা বিচারের দাবি জোরেশোরে উচ্চারিত হওয়া দরকার। ১৯৭২-৭৫ সময়কালে জাসদের অসাংবিধানিক ও রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধের বিচার। কী না করেছেন জাসদের ইনু ও পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির সিরাজ শিকদাররা! হাজার হাজার মেধাবী তরুণের জীবন ধ্বংস থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন তারা। জাসদ গণবাহিনী নামে যে আর্মস ব্যান্ড গড়ে তুলেছিল, তার কমান্ডার ছিলেন কর্নেল তাহের আর পলিটিক্যাল কমিশনার ছিলেন হাসানুল হক ইনু। কেন বিচার হবে না ইনুর? গণবাহিনী কি মানুষ হত্যা করেনি? থানা লুট করেনি? অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে চায়নি? এরশাদের পতনের পর হাসানুল হক ইনু অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের অপরাধে এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর জাসদ ও গণবাহিনী যে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল, তা কি সাংবিধানিক পন্থা ছিল? তাহলে কেন ইনু সাহেবদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না? ইনু সাহেবদের ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় এতটাই উদ্ভট, হঠকারী আর অসাংবিধানিক ছিল যে, ’৭৫-এর ২৬ নভেম্বর তারা একদল অর্বাচীন তরুণকে পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে কিডন্যাপ করতে। উদ্দেশ্য ছিল, সমর সেনকে জিম্মি করে ক্ষমতায় যাওয়া। ওই অভিযানে ছয় যুবকের ৪ জন নিহত হয়েছিল ভারতীয় রক্ষীদের গুলিতে। ৬ যুবককে একটি আÍঘাতী অভিযানে পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার অভিযোগে অভিযান পরিকল্পনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না? খুব যায়।
সিরাজুল আলম খান মেইনস্ট্রিম রাজনীতি থেকে ক্ষান্ত হয়েছেন। ‘কাপালিক দাদা’ই যেখানে অফ হয়ে গেছেন, আপনি কেন হচ্ছেন না ইনু ভাই? যদি বলি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ঘটেনি, আপনাদের রাজনীতিরও মৃত্যু ঘটেছে, তাহলে কি ভুল বলা হবে? ’৭৫-এর ১৫ আগস্টেই রাজনীতি থেকে আপনাদের সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। একটু ব্যাখ্যা করি। বঙ্গবন্ধু খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন বলে সেই উদারতার ষোলআনা সুযোগ নিয়েছিলেন আপনারা। তাছাড়া স্বাধীনতা-পূর্ব ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছিলেন বলে তাকে ভালোভাবে চিনতেন আপনারা। বঙ্গবন্ধু কেন, কিভাবে অ্যাক্ট-রিঅ্যাক্ট করতেন, তা বুঝতেন বলে সেভাবে কর্মসূচি দিয়ে দেশটাকে সরগরম করে রাখতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার মতো উদার শাসক তো আর পাননি যে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন। উল্টাপাল্টা কিছু করে পার পাবেন না এখন। তাই কী দরকার রাজনীতি করার। অবশ্য এখন যেটা করছেন, সেটা তো আর মাথার রাজনীতি নয়, লেজের রাজনীতি।
অথচ কী অপার সুযোগ ছিল জাসদের। শুধুই দরকার ছিল সাংবিধানিক রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ও নিয়মতান্ত্রিকতার পথ ধরে মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আদায় করার। ইনু সাহেবরা সেটা তো করলেনই না, উল্টো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার অতি নিকৃষ্ট মনোবাসনায় একের পর এক দল ভাঙলেন। দলভাঙার প্রক্রিয়া এমন পৌনঃপুনিক হয়ে উঠল যে, মনে হল জাসদ নেতৃত্ব বিপ্লবের মার্কসীয় তত্ত্ব নয়, নিউক্লিয়ার তত্ত্ব প্রয়োগ করতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ ম্যাটারকে যত ছোট করা হবে, ততই তা শক্তিশালী হয়ে উঠবে। মজার ব্যাপার, প্রতিবার দল ভাঙার সময় জাসদ নেতারা সেটাকে দার্শনিক দ্বন্দ্ব, তাত্ত্বিক মতবিরোধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন এবং অনেক নির্বোধ কর্মী তা বিশ্বাসও করেছে। আসলে দল ভাঙার পেছনের উদ্দেশ্য ছিল, যার যার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অসংখ্যবার দল ভাঙার ফল হিসেবে হাসানুল হক ইনু এখন জাসদের সভাপতি। সিরাজুল আলমকে হটিয়েছেন, আসম রবকে হটিয়েছেন, হটিয়েছেন মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ আরও অনেককে। এখন তিনিই রাজা। তিনি দল ভাঙবেন না তো কে ভাঙবেন?
ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি জাসদকে ক্ষমতায় পাঠাননি। রাজনৈতিক ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে জাসদ যদি কোনভাবে ’৭০ দশকে ক্ষমতা দখল করতে পারত, তাহলে আজ রাজধানীতে যে বিএমডব্লিউ, লেক্সাস দেখতে পাই আমরা, সেখানে চলতো ঠেলাগাড়ি। অবশ্য ক্ষমতায় গেলে কতদিন তা ধরে রাখতে পারতেন জাসদ নেতৃত্ব, সেটাও একটা প্রশ্ন। কী অদ্ভুত কাণ্ড! একটি দল, যার অনুসারীদের বয়স ১৪ থেকে ৩০-এর মধ্যে, তারা কিনা স্বপ্ন দেখেছিল রাষ্ট্রক্ষমতার! ’৭২-৭৫ সময়কালে একমাত্র ড. আখলাকুর রহমান ছাড়া মধ্যবিত্তের শ্রদ্ধা পেতে পারে, এমন একজন মানুষও ছিলেন না। মেজর জলিল যদিওবা ছিলেন, তিনি রাজনীতিতে নবীন আর কর্নেল তাহের তো ছিলেন পর্দার আড়ালের নেতা। তাহলে কার মুখ দেখে জাসদকে ক্ষমতায় পাঠাতো জনতা? স্বপ্ন দেখারও একটা শৃংখলা থাকে, মানুষ এমন স্বপ্ন দেখে না, যা এতই উদ্ভট যে তার বাস্তবরূপ নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের শোচনীয় পতনের পর জাসদ নেতৃত্বের উচিত ছিল, মার্কসীয় তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার, একে কী করে যুগোপযোগী করা যায়, কীভাবে এর ত্র“টিগুলো সারিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে ভাবার। কিন্তু তা না করে ইনু সাহেবরা ক্ষমতায় যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা খুঁজছেন। অবশ্য নিজ দলের প্রতীক নিয়ে যখন নির্বাচনে জামানত পর্যন্ত থাকে না, তখন প্রতীক ধার করা ছাড়া উপায় কী? এক হিসাবে দেখা গেছে, বামপন্থীরা নিজ প্রতীকে সারাদেশে যে ভোট পায়, তা দিয়ে একটা নির্বাচনী এলাকায়ও জেতা যায় না। অতঃপর ইনু ভাই যে বঙ্গবন্ধু বন্দনায় মহাকাব্য রচনার মতো বক্তৃতা করেছেন, তাতে আমরা বিস্মিত হয়নি। ডাব পাকলে নারকেল হয় আর জাসদ পাকলে হয় আওয়ামী লীগ এ তত্ত্ব আমাদের জানা। তবে বঙ্গবন্ধু বন্দনার আগে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে ইনু ভাই ভালো করতেন।
সুত্র : যুগান্তর , ৯ মার্চ ২০১২
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক