ইউরো ২০১২ প্রিভিউ পর্ব ২ – নেদারল্যান্ডস
ইউরো ২০১২ প্রিভিউ পর্ব ১ – জার্মানী
প্রিলিমিনারী স্কোয়াড এখনও সবাই দেয় নাই, অনেক দেশেই লীগের শেষ রাউন্ড চলছে তাই লীগ শেষ হলেই দেখা যাবে বাকি দেশগুলো একসাথে তাদের প্রিলিমিনারী স্কোয়াড বা হয়ত মুল ২৩ জনের স্কোয়াডই ঘোষনা করে দিবে। জার্মানী আর নেদারল্যান্ডস ছাড়া ইউক্রেন দিয়েছে তাদেরটা, সাথে ফ্রান্স আর গ্রীস অর্ধেক স্কোয়াড ঘোষনা করেছে মাত্র।
গ্রুপ বি থেকে জার্মানী আর নেদারল্যান্ডসের পর পর্তুগালের প্রিভিউ দিব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু এর মধ্যে এই ১০ তারিখে ক্রোয়েশিয়া তাদের প্রাথমিক স্কোয়াড ঘোষনা করে ফেলে। এই দলটাকে আমার বেশ ভাল লাগে তাদের গোল্ডেন জেনারেশনের জন্য - ডেভর সুকের, জোনিমির বোবান, গোরান ভ্লাওভিচ, রবার্ট আর্নি আর স্লাভেন বিলিচ বা এর একটু পরে রবার্ট প্রসিনেস্কি। নস্টালজিক হয়ে যাই মাঝে মাঝেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার খেলা মনে পড়লে, দুর্দান্ত একটা দল ছিল তারা। সেবার বিশ্বকাপে তৃতীয় হয়েছিল, সেমিতে ফ্রান্সের সাথে এক গোলে এগিয়েও ছিল তারা লিলিয়ান থুরামের অতিমানবীয় গোল শোধের আগ পর্যন্ত।
সেই গোল্ডেন জেনারেশন এখন আর নেই, বরং বলতে গেলে ক্রোয়েশিয়া থেকে নতুন সেরকম আর প্রতিভা উঠে আসছেও না। বর্তমান দলে ৩০ এর ঘরে বেশ কয়েকজন প্লেয়ার আছে যারা ইউরোপে দাপিয়ে খেলে যাচ্ছে, হয়ত এর পরের ইউরোতেই শেষ দেখা যাবে তাদের।
যাই হোক, ইউরোতে চলে যাই। নিচে এদের ইউরো ২০১২ এর অফিসিয়াল জার্সি। ইউনিক একটা জার্সি, আমার প্রিয় ডিজাইনের তালিকায় সবসময়ই উপরের দিকে থাকবে।
এই দলটার মাথা হল স্লাভেন বিলিচ, উইং নির্ভর খাটি ইউরোপিয়ান স্টাইলের আক্রমনাত্মক আর প্রচন্ড ইমোশনাল একজন কোচ। ডাগআউটে তাকে দেখলেই বোঝা যায় সেটা, প্লাস পয়েন্ট হল প্লেয়ারদের সাথে অনেক ফ্রেন্ডলী সম্পর্ক আর নিজ দেশে লোকাল ফুটবল লিজেন্ডের কাতারে তার নাম। অবশ্য এই ইউরোই তার শেষ দায়িত্ব ক্রোয়েশিয়ার হয়ে। বাছাইয়ে খুব একটা ভাল না করতে পারলেও ২০০৬ এর পর থেকে ক্রোয়েশিয়াকে যেভাবে আবার আন্তর্জাতিক ফুটবলে শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তুলছেন, ক্রোয়েশিয়া উইল মিস হিম।
বিলিচের প্রেফারড ফর্মেশন হল ইউরোপিয়ান স্টাইলের ৪-৪-২, তবে মিডফিল্ড ভার্সেটাইল বলে ৪-৩-৩ এই চলে আসতে পারে যেকোন সময়। তার দলটা দেখে নেই এবার (অনেকের নামের বাংলা উচ্চারন আর বানান ভুল থাকতে পারে)।
গোলকিপিং
খুব একটা বেশী অপশন নাই এখানে, অভিজ্ঞ ৩৩ বছরের স্টাইপে প্লেতিকোসাই থাকবে মুল দলে আর সেরা একাদশেও। ব্যাকআপ হিসেবে মোনাকোর দানিয়েল সুবাসিচ, গোরান ব্লাজেভিচ আর ইভান কেলাভার মধ্যে যেকোন দুইজন। এর মধ্যে একমাত্র সুবাসিচেরই জাতীর দলের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা আছে, তাও মাত্র ৩ ম্যাচে।
সেন্ট্রাল ডিফেন্স
এখানে দুই স্পটের একটাতে নিশ্চিতভাবেই জোসিপ সিমুনিচ থাকবে, বয়স ৩৪ হলেও অভিজ্ঞতাই এগিয়ে রাখবে তাকে। আরেকটা পজিশনে আমার পছন্দ ভাদরান কোর্লুকাকে, যদিও এই বছর লেভারকুশেনের হয়ে কেমন পার্ফরমেন্স জানা নাই। এই দুজনের মধ্যে থেকে একজনও স্টার্টিং ইলেভেনে না থাকলে চলে আসবে লিওর ডেজান লোভ্রেন অথবা ই ফ্রাঙ্কফুর্টের গর্ডন শিল্ডেনফেল্ড, এই দুইজন আবার যার যার ক্লাবের নিয়মিত স্টার্টার। এর মধ্যে লোভ্রেনকে দেখে রাখতে হবে, ক্রোয়েশিয়ান নিউ জেনারেশন ডিফেন্ডারদের একজন বলা হচ্ছে তাকে। যাই হোক, একেবারে খারাপ না লাইনআপ, শুধু কোর্লুকা ক্রাইসিস টাইমে ভুলভাল না করলেই হল।
রাইট আর লেফট উইং ব্যাক
রাইট ব্যাকে থাকবে ক্যাপ্টেন দারিও স্রনা, আর তার ব্যাকআপ হিসেবে হয়ত ডায়নামো জাগরেবের সাইম ভ্রালকো অথবা দোমাগোজ ভিডা। স্রনা একাই তার ডানদিকে কাপিয়ে দেয়ার জন্য যথেস্ট, প্রচুর ওভারল্যাপ করে, প্রচুর এনার্জি, খেলার মাঝে দেখলে ভুল হতে পারে রাইট ব্যাক না রাইট উইঙ্গার সে! তার শাখতার ডোনেস্ক তো বোধহয় এবার ডাবল জিতল ইউক্রেন লীগে।
লেফট ব্যাকেও মোটামুটি ধরে রাখা যায় বায়ার্নের ডানিয়েল প্রানিচ থাকবে, অথবা ইভান স্ট্রিনিচ। এদের মধ্যে প্রানিচের অভিজ্ঞতা আর ক্যারিয়ার বেশী সমৃদ্ধ, যদিও বায়ার্নের হয়ে এই সিজনে খুব একটা মাঠে নামা হয় নি বলে ম্যাচ ফিটনেসের ব্যাপারটা মাথায় থেকেই যায়। স্রনার মতই প্রানিচ কিন্তু মুলত উইঙ্গার-উইংব্যাক, তাই সেন্ট্রাল ডিফেন্সে সিমুনিচ-কোর্লুকাকে ওভারটাইম ডিউটি করতে হবে মাঠে।
কোচ স্লাভেন বিলিচ রিস্ক ফ্রি থাকতে চাইলে অবশ্য মনেহয় স্ট্রিনিকই খেলবে মুল দলে, আর প্রানিচ উঠে আসবে লেফট উইঙ্গারে।
সেন্ট্রাল মিডফিল্ড
এখানে প্রথম পছন্দ – স্পার্সের লুকা মডরিচ। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বা প্লেমেকার যেটাই বলি, এই ক্রোয়েশিয়া দলের বেশীরভাগ আক্রমন যে মডরিচ থেকেই আসবে ধরে রাখা যায়। দুর্দান্ত প্লেয়ার, ২ বছর ধরে এর পিছনে শুধু শুধু চেলসি ঘুরতেছে না। লুকার মত প্লেয়ার দলে থাকার বড় একটা প্লাস পয়েন্ট হল, এ যেমন ডীপ মিড থেকে অ্যাটাক তুলতে পারে তেমনি ডানে বা বাম সাইড থেকেও একইভাবে খেলা তুলতে পারে।
লুকা মডরিচ যদি সেন্ট্রাল মিডে না খেলে ডানে বা বামে খেলে, তাহলেও খুব একটা সমস্যায় পড়তে হবে না ক্রোয়েশিয়াকে। এর জায়গায় তখন কাভার দিতে পারবে সেভিয়ার ইভান রাকিতিচ। আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৩৯ ম্যাচে ৮ গোল – নিজ যোগ্যতাতেই টিমে চান্স পেতে পারে ইভান।
সেন্ট্রাল মিডে বাকি যে পজিশন থাকে সেটা হল ডার্টি জব ওরফে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড, সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারদের সামনে ফার্স্ট লেয়ার অফ প্রটেকশন দেয়া যার কাজ। এখানে খেলার সুযোগ আছে ডায়নামো কিয়িভের ওনজেন ভুকোজেভিচ অথবা জারাগোজার টমিস্লাভ ডুমোভিচের। এদের মধ্যে কে ভাল জানা নাই, এক ক্রোয়েশিয়ান পোলে দেখলাম দুজনের ভোটই কাছাকাছি (২১ আর ২৪), তাই বিলিচ যাকে ভাল মনে করে তাকেই খেলাক, সমস্যা নাই।
ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ড ট্যালেন্ট এখনো শেষ হয় নাই - সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে ডর্টমুন্ডের ইভান পেরিসিচ আর আরেকটু আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডে হামবুর্গের ইভো ইলিসেভিচ। পেরিসিচকে তো ক্রোয়েশিয়ার এমার্জিং মিডফিল্ড ট্যালেন্ট বলা হয়। এখন তো মনে হচ্ছে চাইলে ৫ জনের মিডফিল্ডও খেলাতে পারবে ক্রোয়েশিয়া, আর সেটাও দুর্দান্তই হবে!
রাইট আর লেফট মিডফিল্ড
রাইট মিডফিল্ড/উইঙ্গারে অটোমেটিক চয়েস হওয়ার কথা নিকো ক্রানকার (না ক্রানা?), কিন্তু নিশ্চিত করতে পারছি না কারন লীগের শেষ দিকে পাওয়া ইনজুরী আর লীগেও স্পার্সের হয়ে নিয়মিত মাঠে না খেলতে পারে। তবে অভিজ্ঞতা, ক্রিয়েটিভিটি আর গোল স্কোরিং রেকর্ড – সব মিলিয়ে ফিটনেস টেস্টে পাস করলেই ক্রানকা খেলবে মুল একাদশে।
লেফটে কে খেলবে? আগেই বলেছি কোচ বিলিচ রিস্ক ফ্রি থাকতে চাইলে ডানিয়েল প্রানিচ খেলতে পারে লেফট ফিডফিল্ড/উইঙ্গারে। অথবা, লুকা মডরিচ বা পেরিসিচের যে কেউ এই পজিশনটা নিতে পারে। মুল কথা, ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডাররা এতটাই ভার্সেটাইল যে কে কোথায় খেলবে সেটার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল কোন চারজন খেলবে।
স্ট্রাইকার
এখানে প্রথম পছন্দ এডুয়ার্ডো ডা সিলভা – আন্ডাররেটেড কিন্তু দুর্দান্ত স্ট্রাইকারদের লিস্টে যার নাম অনেক উপরের দিকেই থাকে, আর হ্যা, ব্রাজিলিয়ান। ৪৫ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২২ গোল যার সে তো থাকবেই, তবে ২০১০ এ শাখতার ডোনেস্কে চলে যাওয়ার পর এর খেলা আর দেখা হয় নাই। এডুয়ার্ডো নিজে গোল করলেও সাথে নিচে নেমে অ্যাটাক বিল্ডিংও করতে পারে, আর কিছু এডুয়ার্ডো ম্যাজিকের কথা আর্সেনাল ফ্যানরা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবে।
তবে দুঃখজনক ভাবে এডুয়ার্ডো বিখ্যাত মার্টিন টেইলরের কাছে তার ২০০৮ এর ইনজুরীর জন্য। আর্সেনে ওয়েঙ্গার এর পরে টেইলরের আজীবন ব্যান দাবী করেছিলেন মনে আছে, আর এই ইনজুরীর দৃশ্য এতোটাই ভায়োলেন্ট ছিল যে স্কাই স্পোর্টস ম্যাচ রিপ্লে বা পরেও সেই দৃশ্য আর দেখায় নাই। যাই হোক, আশা করব এর কাছ থেকে ভাল খেলা দেখব এবার। তাই ওই ছবি আমিও দিলাম না, নিজ দায়িত্বে ইউটিউব করে নিবেন।
এডুয়ার্ডোর সাথে আর যার পারফেক্ট পার্টনারশীপ করতে পারার কথা সে হল বায়ার্নের ইভিকা ওলিচ, যদিও লীগে মারিও গোমেজের ফর্মের জ্বালায় ২০টার বেশী ম্যাচ খেলতে পারে নাই এবার। ২০ ম্যাচে ২ গোল খুব একটা ভালও না, সামনের সিজন থেকে নাকি উলফসবার্গে যাচ্ছে।
এডুয়ার্ডো বা ওলিচ না খেলতে পারলে একাদশে চলে আসবে এভার্টনের নিকিচা জেলাভিচ আর ঊলফসবার্গের মারিও মানজুকিচ। দুজনের লীগ ফর্মই বেশ ভাল, জেলাভিচ সম্ভবত এভার্টনের টপ গোলস্কোরার এবার, আর মানজুকিচ উলভসের হয়ে ডাবল ফিগার গোল আর ৭টা অ্যাসিস্টের মালিক এই সিজনে। ইম্প্রেসিভ।
যাদের মিস করব
মিডফিল্ডার জার্কো লেকো, স্ট্রাইকারে ইভান ক্লাসনিক আর পেত্রিচ। ক্লাসনিককে দেখব আশা করেছিলাম, অবশ্য বুড়া হয়ে গেছে তো।
ইউরো ২০১২ প্রেডিকশন
এটা বলাটা ট্রিকি, কারন গ্রুপ সি তে এদের সাথে আছে স্পেন, ইতালী আর আয়ারল্যান্ড। ক্রোয়েশিয়ার যোগ্যতা আছে গ্রুপ পর্ব পার করে যাওয়ার, তবে নির্ভর করছে আসলে ইতালীর উপর। আমার মতে, ইতালী তার প্রথম ম্যাচে যদি স্পেনের সাথে ড্র করে তাহলে ক্রোয়েশিয়ার চান্স কম, আর যদি ইতালী হারে তাহলে ক্রোয়েশিয়ার ভাল সুযোগ থাকবে ইতালীকে টপকিয়ে গ্রুপ ক্রস করা। ইতালীকে কেন এরকম কাবজাব করে ক্রোয়েশিয়ার সাথে মিলিয়ে ফেললাম সেটার ব্যাখ্যা আমি ইতালী প্রিভিউ লেখার সময়ই দিব।
ইতালীর সাথে ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচটা ক্রিটিক্যাল হবে, দুই উইং ভালভাবে ব্যাবহার করতে পারলে ইতালীকে ঝামেলাতেও ফেলতে পারে। এটার ব্যাখ্যাও দিব ইতালী প্রিভিউ লেখার সময়। তবে আয়ারল্যান্ডের সাথে প্রথম ম্যাচটা জেতা উচিত এদের, ওটা মিস করলে ইতালী্র উপর আর নির্ভর করতে হবে না, নিজের যোগ্যতায় নিজে নিজেই গ্রুপ থেকে বাদ পরতে হবে।
ভাল কথা, ডেভর সুকের নাকি এই ইউরোর পর কোচিং এ আসতেছে শুনলাম। একটা ভিডিও শেয়ার করা যাকঃ
ভিডিও মুল লিঙ্ক