somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

অনুপম হাসান
শৈশব আর কৈশোর কেটেছে রংপুরে; আইএ পাসের পর কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল. ও পিএইচডি. ডিগ্রি লাভ। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত আছি।

গল্প : ৩

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চন্দ্রালোকের রহস্যে কুসুমপুরের আত্মহত্যা

চাঁদের আলোয় পুরো গ্রামটিতে রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি হলে কুসুমপুরের কোনো কোনো বাড়ির উঠনে পুরুষদের বসে থাকতে দেখা যায়। তারা চাঁদের আলো উপভোগ করে। গাছের পাতা সরিয়ে চাঁদের আলো আসে, বাঁশ ঝাড়ের চিকন পাতার ফাঁক গলিয়ে তাদের উঠনে ঝরে পড়ে জ্যোৎস্না। তারা ঘোর লাগ জ্যোৎস্নায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ উঠন পার হয়ে সরু রাস্তায় উঠে আসে; কেউ-বা এসে দাঁড়ায় বিলের ধারে। বিলের পানিতে থৈথৈ জ্যোৎস্নায় ভেসে বেড়ায়। ঢেউয়ে ঢেউয়ে খেলা করে; হাসে-কাঁদে, লুটিয়ে পড়ে পায়ের কাছে। ভাদ্রের ভরা পূর্ণিমায় কুসুমপুরের যেসব পুরুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, তারা সবাই কী জ্যোৎস্নার শিল্পকৌশল দেখতে চেয়েছিল? নাকি নিজেরাই শিল্পী হওয়ার বাসনা পোষণ করেছিল মনে মনে? চাঁদের এ আলো কী তবে অনন্ত হবে, শিল্পকলায় ভরে যাবে কুসুমপুর।

চাঁদের আলো-আঁধারির রহস্য সরিয়ে আমরা তাদের মুখের দিকে তাকালে বিস্মিত না হয়ে পারি না। কারণ, কষ্টের কালিতে লেপ্টে আছে বাইরে বেরিয়ে আসা পুরুষদের মুখমণ্ডল। মুখই মনের মুকুর। তাদের কিসের দুঃখ তবে, কিসের বেদনা; তারা কিসের যন্ত্রণায় চন্দ্রালোচত মায়াবী রাতে ঘরে যুবতী স্ত্রীদের রেখে খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে আসে? তাদের কি খাদ্য কষ্ট, অর্থ-কষ্ট? কুসুমপুরর জমি-জিরাত সব উর্বরতা মিশিয়ে উৎপাদন করেছে। ধান লাগিয়ে প্রচুর ধান পেয়েছে কৃষকেরা। পাট লাগিয়েও পেয়েছে প্রচুর; তামাকও পেয়েছে। কোনো শস্যই কম দেয় নি, জমি। উৎপাদনের সময় কুসুমপুরের জমি-জিরাত কোনো কার্পণ্য করে নি। তাহলে তাদের খাদ্য কষ্ট না, তাহলে তাদের অর্থ কষ্ট না- তাহলে কিসের কষ্টে চন্দ্রালোকিত রাতে তাদের মুখের মালিন্য ফুটে উঠেছে?



কুসুমপুর গ্রামের উত্তরে মাইসা বিলে যখন চাঁদের আলোয় উল্লসিত মীন সন্তানেরা আনন্দ সাঁতার দেয়, লাফিয়ে ওঠে আকাশের দিকে; রুপালী দেহে চাঁদের কিরণ চকিতে স্পর্শ করলে চিকচিক করে ওঠে, দেখা যায় অনেক দূর থেকেও। তবে মীনেরাও উপভোগ করে চন্দ্রালোক।

পুরনো কড়ই গাছটার পেঁচারাও গল্প করে তাদের সঙ্গিনীর সাথে। শুধু কুসুমপুরের কতিপয় পুরুষ বুকে ব্যর্থতার কষ্ট নিয়ে একা বেরিয়ে এলে তাদের মনের গোপন কথাটি জানতে আমরা ৫ কিলোমিটার শহুরে পাকা রাস্তা থেকে নেমে ধবল সাদা মাটির রাস্তা দিয়ে পুব দিকে মিনিট পনের হাঁটা পথ অতিক্রম করলে বাম হাতের দিকে ভাসমান মাইসা বিলটি চোখে পড়ে। আমরা বুঝতে পারি কুসুমপুর আমাদের হাতের ডান পাশে।
গাছের নিচ দিয়ে, বাঁশ ঝোপের পাশ দিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে অপ্রশস্ত শাখা রাস্তায় ঢুকলে দৃশ্যমান হয়- দুই ধারে ঘরবাড়ি। এসব বাড়ির কোনো কোনো পুরুষকে আমরা চন্দ্রালোকিত ঘোরে নিজ বাড়ির উঠনে অথবা বিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে অথবা বাড়ির সামনে অর্থহীন পায়চারি করতে দেখেছি। গ্রামের মাটি স্পর্শ করলে আমাদের বুকে সাহস জন্মায়। আমরা ভাবি তাদের কষ্টের কথা, মুখের মলিনতার কারণ সম্বন্ধে সরাসরি প্রশ্ন করেই ইতিবৃত্ত জেনে নেব। আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়; রহমান মিয়াকে তার বাড়ির উঠনে পেয়ে তাকে বেদনার কথা, কষ্টের কারণ জিজ্ঞেস করলে, তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলে। আমরা হতাশ না হয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানার আগ্রহ ত্যাগ না করে, তাদের বেদনার কথা তাদের কষ্টের উৎস আবিষ্কারে মরিয়া হয়ে জবেদ মিয়ার বাড়িতে প্রবেশ করি। উঠন জুড়ে পায়চারি বন্ধ করে এগিয়ে এসে কোনো সৌজন্য বাক্য বিনিময় না করেই সরাসরি মুখে উপর দৃষ্টে ধরে রেখে জিজ্ঞেস করেন- পুরুষ মানুষ বিয়ে করে কেন?

জবেদ মিয়া দুই সন্তানের পিতা। স্ত্রী নয়না দুই সন্তানের জননী হলেও তার শরীরের বাঁধন এখনো অটুট আছে। আমাদের মুখ দিয়ে কথা সরে না, জবেদ মিয়ার প্রশ্ন শুনে! সত্যি তো মানুষ কেন বিয়ে করে? কেন?
সন্তান জন্ম দেয়া, বংশ রক্ষা করাই বিয়ের উদ্দেশ্য? আমরা নীরব থাকি। বিয়ের কারণ সম্বন্ধে আমরা কোনো যৌক্তিক উত্তর খুঁজে পাই না। আমরা ভাবতে বাধ্য হই- জবেদ মিয়ার মস্তিষ্কে বিভ্রান্তি আছে নিশ্চয়, অথবা সম্প্রতি তার মস্তিষ্কের বিভ্রাট ঘটেছে। চন্দ্রালোকে তার মুখের মলিনতার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে আমরা তার সাইকিয়াট্রির সমস্যা উপলব্ধি করি। এমন অবস্থায় বহুকাল পার হলেও জবেদ কখনো ডাক্তারের কাছে যায় নি; পরামর্শ গ্রহণ করে নি, চিকিৎসাও নেয় নি। তাহলে হয়তো জবেদের মানসিক এ সংকটের কারণ অন্যকিছু। হয়তো তাকে সাইকো থেরাপি দিতে পারলে সে সুস্থ হয়ে উঠবে।

আমরা কুসুমপুরের পুরুষদের বেদনার-কষ্টের অথবা তাদের বিষাদক্লিষ্টতার মূল কারণ উদ্ধার করতে না পেরে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ি এবং ফিরে আসার প্রস্তুতি নিলে সংবাদ আসে- আজাদ মিয়ার তিরিশ বছর বয়সী সুন্দরী স্ত্রী সেই চন্দ্রালোকিত রাতের মায়া ত্যাগ করে, পৃথিবীর রূপ-ঐশ্বর্যের সব মায়া ও ভোগের বাসনা ত্যাগ করে দেহান্তরিত হয়েছে। আনিছা আত্মহত্যা করেছে।
আনিছার আত্মহত্যার সংবাদে আমাদের মনে শিহরণ-চাঞ্চল্য দেখা দেয়, কৌতুহল বাড়ে। যদিও মৃত্যু বিষয়ক তথ্য পোস্টমোর্টেম করার কোনো ভাবনা বা ইচ্ছা কোনোটাই আমাদের ছিল না; তবু আনিছার মৃত্যুর খবর, তার বয়স, তার যুবতী দেহের সৌন্দর্য প্রভৃতি আমাদের মনে অনুসন্ধিৎসা জাগায়। কেননা আমরা আগে থেকে অবগত ছিলাম আজাদ-আনিছা দম্পতির কোনো সন্তানাদি নেই।
স্বামী-স্ত্রীর দুজনের সংসার। তারপরও কেন আনিছার মৃত্যুর ইচ্ছা হয়েছিল! মৃত্যুর মতো, আত্মহত্যা করার মতো বাহ্য কোনো কারণ দৃশ্যমান না হলে আমাদের আগ্রহ বাড়ে। তাহলে তাদের সংসারেও কী কুসুমপুরের অন্যান্য দম্পতির মতো সমস্যা ছিল? রহমান-জবেদ এবং আরো অন্যদের মতো তাদের সংসারেও হয়তো একই সমস্যা ছিল।
স্ত্রীর মৃত্যুজনিত শোকে হতবিহ্বল আজাদকে দেখে আমরা তেমন কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস অর্জন করতে ব্যর্থ হলে আনিছার মৃত্যু সংবাদ শুনে জড়ো হওয়া গ্রামের নারীদের নারীদের কথপোকথনের গুঞ্জন থেকে একটি বাক্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় : ‘আনিছা আর পেরে উঠছিল না।’

সন্তানের প্রত্যাশায় ব্যর্থ নারী কখনো কখনো পুরো জীবটাকেই ব্যর্থ মনে করে। আমাদের জানা ছিল, আজাদ মিয়া সন্তান জন্ম দিতে না পারার জন্য, তার বংশগতি রক্ষা করতে না পারার জন্য কখনো ভর্ৎসনা করে নি স্ত্রী আনিছাকে। কেননা, আজাদ মিয়া জানত, শুধু মেয়েদের কারণেই সন্তান হয় না- এমন বিশ্বাস ঠিক না। পুরুষের সমস্যার কারণেও যে সন্তানাদি হয় না, এসব কথা আজাদ জেনেছিল পত্রিকার ফিচার পড়ে। জীবিত আনিছা কখনো এ বিষয়ে কোনো ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নি; আসলে আজাদ চায় নি। কেননা পরীক্ষা করলেই একজনের দোষ বেরিয়ে পড়বে। সেটা আজাদ চায় নি; তারা স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো কাছে ছোট হোক!
আনিছার সন্তান হয় নি দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে, এটা একটা ঘটনা এবং সত্য। তবে এসব ঘটনার ভেতর তার মৃত্যুর কারণ নিহিত ছিল না; সেকথা আমরা বুঝতে পারি- নারীদের গুঞ্জন থেকে ভেসে আসা বাক্যটির বঙ্গানুবাদ করলে। ‘আর পারছিল না’- মৃত্যু বিষয়ক ঘটনার সাথে কথাটি জড়িয়ে থাকলেও বাক্যটির অনুপুঙ্খ পোস্টমোর্টেম করলে কুসুমপুর গ্রামের পুরুষদের মলিন বদনের রহস্য এবং আরো অন্যান্য বিষয় স্পষ্ট হয়।

আজাদ-আনিছার বিয়ের দশ বছর অতিক্রান্ত হলেও তাদের দাম্পত্য জীবনে বাহ্যত সুখ মনে হলেও আসলে তারা কখনোই ষুখী ছিল না। গ্রামের সাবাই জানে; বিশেষত গ্রামের প্রায় সব বিবাহিত নারীই জানে- আজাদের কাম-বাসনা ছিল প্রবল এবং বৈচিত্র্যপিয়াসী। দাম্পত্য জীবনের এসব গোপন কথা অন্যদের না জানার কথা; তারা এ দম্পতির অন্ধকার বিছানার খবরা-খবর অনুপুঙ্খ জানতে পেরেছিল আনিছার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী শামছুলের বউ শাহেদার নিকট থেকে। একমাত্র কুসুপুরের শাহেদাকেই আপন ভেবে এসব কথা খুলে বলেছিল আনিছা তার মৃত্যুর আগে। পরে শাহেদার মুখ থেকে কুসুমপুরের মোটা-পাতলা, কালো-ফর্সা, লম্বা-বেঁটে, যুবতী-বয়স্ক এবং বিবাহিত অন্যরা জেনেছিল। জানার পর, তারা বুঝতে পেরেছিল- তারাও প্রায় সকলেই আনিছার মতো একই ধরনের সমস্যায় ভুগছে। তাদের জীবনে ক্রমাগত সমস্যাগুলো বৃদ্ধি লাভ করেছে, কমে নি। কেউ কেউ দেখেছে, তাদের স্বামীরা কুসুমপুর গ্রামের সীমা পার হয়ে শহরে গেলে সেদিন রাতে বাড়ি ফেরে না। আর যখন বাড়ি ফিরে আসে তারা, তখন স্ত্রীরা বুঝতে পারে সব ঘটনা। তবু তারা কিছু বলে না। কুসুমপুরের নারীরা এসন ঘটনা তাদের নিয়তি বলে মেনে নেয়। কোনো প্রতিবাদ করে না।

কুসুমপুরের যুবতী মেয়েদের দেহে কামনা ছিল; তারাও স্বামী-সঙ্গ চেয়েছিল। কিন্তু তারা স্বামীদের সাথে আদিম যৌনকর্মটি উপভোগ করতে পারে নি প্রায় কেউ-ই। বিবাহিত জীবনে স্বামীকে দেহ দিতে হয়, এটা নিয়ম। এই নিয়ম তার মা, তার দাদী, তার মায়ের দাদী- বংশ পরম্পরায় পালন করেছে। স্বামীকে দেহ দান করেছে তারা সবাই। এতে করে তারা গর্ভবতী হয়েছে, সন্তান জন্ম দিয়েছে এবং সন্তান লালন-পালন করতে করতে তাদের শরীকে কোন্ ফাঁকে বার্ধক্য নেমে এসেছে, সেকথা তারা বুঝে উঠতে পারে নি। তারা জানে না- যে দেহটি তারা স্বামীদে দান করে, সেটা পক্ষান্তরে তাদের নিজেদের শরীর। তারা দান করে, কিন্তু উপভোগ করে না, করতে পারে না- যৌনকর্ম! দিনে পর দিন, মাস, বছর তারা নিজেদের দেহকে ভুলে থাকলে- এক সময় তাদের মনে হয় : তাদের স্বামীরা নিষ্ঠুর-তারা নিপীড়ন করতে তাদের উপর। নিপীড়ন সহ্য করাটাই সংসারের নিয়ম, সংসারের ধর্ম। আর তারা সংসার-ধর্ম পালন করতে গিয়ে, সংসার-ধর্ম রক্ষা করতে গিয়ে দৈহিক নির্যাতন সহ্য করে নিয়েছে নিয়তি ভেবে এবং এক সময় নিপীড়ন সহ্য করে নিয়েছে তাদের শরীর।

রাতে স্বামীর আহ্বানে সাড়া দেয় কুসুমপুরের বিবাহিত নারীরা- নিছক কর্তব্য ভেবে; অংশগ্রহণ করে আদিম কর্মে। সেই অংশগ্রহণে তাদের শরীর থাকলেও মানসিক সম্পৃক্ততা থাকে না। দেহটি মাত্র স্বামীর আদিমতার সামনে ছেড়ে দিয়ে হিমশীতল কামজগতে, বিছানায় নিথর পড়ে থাকে। স্বামী নিস্তেজ হয়ে পড়লে তাদের কর্তব্যকর্ম সমাপ্ত হয়- ফিরে তাকায় না নিজের দিকে, নিজের দেহের দিকে, নিজেদের আত্মতৃপ্তির কথা ভাবে না কেউ।

আজাদ মিয়া, রহমান মিয়া, জবেদ মিয়া অথবা আরো কেউ কেউ তাদের স্ত্রীর হিমশীতল কামক্রীড়ায় বিরক্ত হয় এবং প্রতিনিয়ত বিরক্ত হতে হতে নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে কেউ কেউ আদিম ক্রীড়ার মাঝপথেই বিরতি দেয়, বিছানা ত্যাগ করে, যদিও তাদের স্ত্রীরা কেউ কখনোই কর্তব্য পালনে অবহেলা করে না। স্বামী রাত্রিকালীন আদিম আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিছানায় যায় এবং যথারীতি নিথর দেহটি একখণ্ড পাথরের ন্যায় ফেলে রাখে।
এসব ঘটনা আমাদের মনে প্রশ্ন উদ্রেক করে, তাহলে কি কুসুমপুর গ্রামের বিবাহিত কোনো নারীর দেহেই কামনা নেই, উত্তেজনা-যৌনতা নেই। একথা আমরা পূর্বেই অবগত যে, কুসুমপুরের সকল নারীই কাম-ঔৎসুক্য অনুভব করে, স্বামী-সঙ্গও কামনা করে; কিন্তু দেহকে কামোপভোগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে না। কর্তব্য পালনের বিষয়টিই যুগ-পরম্পরায় তাদের রক্তধারায় প্রবাহিত। তারা সংকোচবোধ করে; দেহ মেলে ধরতে জানে না- আদিম যৌনক্রীড়ার সময়। তাদের বাৎসায়ন পড়া নেই। তারা কেউ বাৎসায়নের কামশাস্ত্রের অভিজ্ঞতা অর্জন করে নি। তাদের সংকোচ হয়। কারণ, দেহকে মেলে ধরে নটীরা। কামক্রীড়ায় পারদর্শী হয় খারাপ মেয়ে মানুষ।
তারা কিভাবে যৌনক্রীড়ায় দৈহিক কলাকৌশল প্রদর্শন করবে স্বামীর সামনে? তারা তো গৃহস্থঘরের কল্যাণীয়া। তারা তো নটী না, তারা বাজারের খারাপ মেয়ে মানুষও না। তারা বিবাহিত এবং গৃহস্থঘরের সুগৃহিণী লক্ষ্মী। তাছাড়া এদের প্রত্যেকোর ধর্মভীতি তাদের দেহকে আড়ষ্ট করে দেয়; দেহের চাঞ্চল্য নষ্ট করে দেয়। যদিও তারা জানে- বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষের যৌনকর্ম পাপ না, অন্যায় না; তথাপি একটা পাপ- একটা ভয় তাদের মনে গোপন কোণে বাস করে।

আজাদের স্ত্রী আনিছা একটু বেশি ধর্ম-পরায়ণ ছিল- একথা কুসুমপুরের সবাই জানে। ধর্ম-পরায়ণ যেমন ছিল, তেমনি সুন্দরীও ছিল। কুসুমপুরের যে কোনো নারীর চেয়ে তার যৌনাবেদনময়তা কম ছিল না। দৈহিক সৌন্দর্যেও আনিছা কুসুমপুরের সব নারীকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত। তার রূপের কারণেই গ্রামের বিত্তশালী ঘরের আবুল মিয়ার ছেলে আজাদের সাথে তার বিয়ে সম্ভব হয়েছিল- একথা কে না জানে!
আনিছার রূপ দেখে আজাদ যতোটা পাগল হয়েছিল এবং তাকে বিয়ে করেছিল; ঠিক ততোটাই হতাশ হয়েছিল সে বাসর রাতেই। অনেক চেষ্টা করে, অনেক আদর করে, অনেক বুঝিয়েও আনিছার দেহের উর্ধ্বাঙ্গ উন্মোচন করতে না পেরেই শেষাবধি অন্ধকার বিছানায় কোনো রকমে আজাদ একরাশ কাপড়-চোপড়ের অভ্যন্তরে আনিছার গোপনাঙ্গে উত্তেজনা প্রশমন করেছিল। এরপর থেকে অনেকবার, অনেক চেষ্টা করেও আবুল যখন আনিছার আবৃত্ত শরীরের গোপনাঙ্গে প্রবেশাধিকারের বেশি লাভ করতে ব্যর্থ হয়, তখন আজাদের রূপমোহ ঘুচে যায়। বিবাহিত জীবন ব্যর্থ মনে হয়; যৌনজীবন ব্যর্থ মনে হয়। সংসারও ব্যর্থ হয়ে ওঠে আজাদের কাছে। ক্রমে সংসারের প্রতিও আজাদের টান তিরোহিত হতে থাকে।

আনিছাকে বিছানায় আর ডাকে না আজাদ; মাসে দুই মাসে এক-আধবার তার শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে যেন আজাদ তার সকল ঘৃণা, জীবনে সমস্ত বিবমিষা উগড়ে দেয় আনিছার গোপনাঙ্গে। বছর না পেরোতেই সেটাও বন্ধ করে দেয় আজাদ। কারণ, তখন যে শহরের স্বাদ লাভ করতে শিখে নিয়েছিল। কুসুমপুরের সীমা পার হয়ে বাইরে শহরে রাত কাটাতে শিখেছিল। শহরে সাথে আজাদের মৈত্রী গড়ে উঠলে আনিছার সাথে ক্রমেই তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিছানায় দুজন, দুজনার মতো করে ঘুমিয়ে থাকে। শহরের সখ্য বৃদ্ধি পেলে দূরত্বটা আরো বাড়ে এবং একদিন আজাদ নিজের বিছানাটা আলাদা করে নেয়। এভাবে আজাদ-আনিছার দাম্পত্য কাটছিল। কিন্তু আনিছার মনে সন্তান আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলে সে উপায় খুঁজতে থাকে; সে মা হতে চায়। মাতৃত্বের অপার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সে মাঝে মাঝেই অন্ধকার সাঁতরে নিজের বিছানা ছেড়ে আজাদের বিছানায় উঠে পড়ে। অনুচ্চ স্বরে ডাকে তাকে; গায়ে ধাক্কা দেয়। কিন্তু ঘুম ভাঙে না আজাদের। হয়তো আজাদ জেগেই থাকে; ইচ্ছে করে সাড়া দেয় না আনিছার আহ্বানে।
সন্তান জন্ম দিতে না পারার ব্যর্থতা কতটা বড় হলে আনিছার মৃত্যু প্রয়োজন হয়েছিল? নাকি অন্ধকার রাতে আজাদের ঘুম ভাঙাতে না পারাটাকে জীবনের পরাজয় মনে হয়েছিল তার? এসব বিষয়ে সুসঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে আমরা ব্যর্থ হয়ে তার মৃত দেহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। এ সময় আমাদের সামনে কুসুমপুরের সকল পুরুষের মলিন মুখ একে একে ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে। আমাদের অস্বস্তি হতে থাকে...

সূত্র : জলিল আহমেদ সম্পাদিত প্রয়াসী ২৯ বর্ষ : ২১ সংখ্যা, দিনাজপুর : এপ্রিল ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৫৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যারা সৌদি আরবের সাথে ঈদ করেছে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে দগ্ধ করবেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৪:৪৬



সূরাঃ ৪ নিসা, আয়াত নং ১১৫ এর অনুবাদ-
১১৫। কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মু’মিনদের পথ ব্যতিত অন্যপথ অনুসরন করে, তবে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতে মুসলিমরা কি আসলেই নির্যাতিত?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০১ লা এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৫:৪৩

গুজব রটানো কত সহজ দেখেন! ফেসবুক থেকে নেয়া একসাথে সংযুক্ত এই ৩টি ভিডিও দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কীভাবে গুজব রটিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। এই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যা, তা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসলেই কি নির্বাচন হবে?

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ০১ লা এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:২৩

আপনারা যদি নির্বাচনের পর সংস্কার সত্যি করতে পারবেন তাহলে ৫৩ বছর পারেননি কেনো?

- উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান

এই যে কয়েকদিনের মধ্যে এই কথাগুলো উঠছে এর মানে হলো আপাতত নির্বাচন হচ্ছে না ভাই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনার মডেল মসজিদ প্রকল্প: ভণ্ডামির আরেক নমুনা

লিখেছেন নতুন নকিব, ০১ লা এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪

শেখ হাসিনার মডেল মসজিদ প্রকল্প: ভণ্ডামির আরেক নমুনা

রংপুর জেলা প্রশাসক অফিসের সামনে তৈরী মডেল মসজিদের ছবিটি উইকি থেকে নেওয়া।

বাংলাদেশে ইসলামের নামে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও বাস্তবে তার অনেকগুলোই... ...বাকিটুকু পড়ুন

AI-এর লগে গ্যাঁজাইলাম =p~

লিখেছেন জটিল ভাই, ০১ লা এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৪:১২

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)


(স্ক্রিনসট)

সামহোয়্যার ইন ব্লগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×