১৯৭১ সালের সাত মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন, মূলত সেই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। বাকি ছিল কাগজে-কলমে স্বাধীনতা এবং অন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু সাত মার্চের ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন :
যদি একটিও গুলী চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো-- পানিতে মারবো। হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি, আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। [...] আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। (বজ্রকণ্ঠ, রমনা রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ই মার্চ, ১৯৭১)
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মধ্য দিয়েই মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কার্যত শাসনতান্ত্রিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। দূরদর্শী রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন এই ঘোষণার পর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাঁকে এবং তাঁর সহকর্মীদের হত্যাও করতে পারে। একথার সত্যতা বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে নিজ মুখেই উচ্চারণ করেন :
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাঁদের বলেছিলাম, বাংলা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। বাংলা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। (বজ্রকণ্ঠ, ১০ জানুয়ারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণ)
বঙ্গবন্ধু সাত মার্চের পরে বাঙালি জাতির সামনে আর কোনো নির্দেশনা দিতে পারবেন কিনা এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। এজন্যই তিনি সাত মার্চের ভাষণেই বাংলার জনগণকে যুদ্ধের সময় তাদের করণীয় সম্বন্ধে সম্যক ধারণাও দিয়েছিলেন। এই বিবেচনায়, সাত মার্চের ভাষণ শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই ছিল না, একই সাথে এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঔপনেবিশক পাকিস্তানীদের কিভাবে বাংলার নিরস্ত্র নিরীহ মানুষজন মোকাবেলা করবে সেই দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। প্রসঙ্গত এখানে বলা দরকার, তিনি যুদ্ধের কৌশলও ঐতিহাসিক এই ভাষণে বাঙালিকে অবহিত করেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত বাঙলির করণীয় সম্বন্ধেও বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ উল্লেখ করেন : ‘প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। শৃঙ্খলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না।’ একথার মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট দিক্নির্দেশনা প্রদান করেছেন বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত হলে চলবে না, বরং ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সাত মার্চ রেসকোর্স মাঠে ভাষণ দেয়ার পর সত্যিকার অর্থেই আর দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কোনো দিক্নির্দেশনা প্রদানের সুযোগ পান নি। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতেই গ্রেফতার করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এবং তারা ঘুমন্ত বাঙালির জাতির ওপর অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নারকীয় হত্যযজ্ঞ শুরু করে। অর্থাৎ সাত মার্চের পর ১৮ দিনব্যাপী পাকিস্তানীরা আলোচনার নাম করে সময়ক্ষেপণ করেছে এবং জেনোসাইডের লক্ষ্যে পূর্বপাকিস্তানে অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধি করেছে। যখন তাদের সৈন্যবাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছে তখন সহসাই আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্বপাকিস্তান ত্যাগ করেছে। এরপর পাকবাহিনীর নারকীয় বর্বরতা শুরু হয়েছে রাতের অন্ধকারে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের নির্দেশনা অনুযায়ী বাঙালি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছে পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার বিরুদ্ধে। এরপর দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্যে উপনীত হয়েছে, জেনারেল নিয়াজী ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় মেনে নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার ২০ দিন পর বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বিমান বন্দরে অবতরণ করেই স্বাধীন বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে বলেন :
গত ৭ই মার্চ এই ঘোড়দৌড় ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন; এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙ্গালীও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে, এমন কোন শক্তি নেই। (বজ্রকণ্ঠ, পূর্বোক্ত)
বাঙালিকে সত্যিই আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দাবিয়ে রাখতে পারে নি। এ দেশের সোনার ছেলেরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করেছে প্রশিক্ষিত হানাদার বাহিনীকে। নয় মাস যুদ্ধের পর পাকহানাদার বাহিনী পরাজয় মেনে নেয়। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহান এই নেতা বাংলার জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন :
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ করনি।” কিন্তু আজ আর কবিগুরুর সে কথা বাংলার মানুষের বেলায় খাটেনা। বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে, তারা বীরের জাতি, তারা নিজেদের অধিকার অর্জন করে মানুষের মত বাঁচতে জানে। ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক ভাইয়েরা আমার, আপনারা কত অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন, গেরিলা হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন, রক্ত দিয়েছেন দেশমাতার মুক্তির জন্য। আপনাদের এ-রক্তদান বৃথা যাবে না। (বজ্রকণ্ঠ, পূর্বোক্ত)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিকে শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত করে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরেই তাই বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন :
নেতা হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি, আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তা হলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো মেরামত করতে হবে। আপনারা নিজেরাই সেসব রাস্তা মেরামত করতে শুরু করে দিন। যাঁর যা কাজ, ঠিক মত করে যান। কর্মচারীদের বলছি, আপনারা ঘুষ খাবেন না। এই দেশে আর কোন দুর্নীতি চলতে দেৎয়া হবে না। (বজ্রকণ্ঠ, পূর্বোক্ত)
বঙ্গবন্ধু বাংলা এবং বাঙালি এতোটাই ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার তাঁকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের শান্তিপূর্ণ সম্পর্কে প্রস্তাব দিলে তিনি তা সরাসরি নাকোচ করে দিয়ে বলেন, তিনি বাংলাদেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারবেন না। আর দেশে ফিরে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানকে জানিয়ে দেন :
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচারে গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্দ্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তজার্তিক ট্রাইবুনাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি। (বজ্রকণ্ঠ, পূর্বোক্ত)
অথচ আজ অনেকেই বলেন, বঙ্গবন্ধু নাকি যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ঐ দিনের ভাষণে স্পষ্টভাষায় জাতির উদ্দেশ্যে বলেন : ‘[...] যেসব লোক পাকিস্তানী সৈন্যদের সমর্থন করেছে, আমাদের লোকদের হত্যা করতে সাহায্য করেছে তাদের ক্ষমা করা হবে না। সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দেয়া হবে।’ (বজ্রকণ্ঠ, পূর্বোক্ত) সাধারণ ক্ষমা দূরে থাক, তিনি যেমন পাকিস্তানী বাহিনীকে সহায়তাদানকারীদের বিচারের কথা বলেছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনের আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের কাছে। এমন বাস্তবতায় দেশে এখন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য জননেত্রী কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। বিগত ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করেছে। মহাজোট সরকার ইতোমধ্যেই তিন বছর অতিক্রম করে চতুর্থ বছরে পা দিয়েছে। ইতোমধ্যে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার কাজ সম্পন্ন করে মহাজোট সরকার তাদের একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করেছে। বাকি রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বর্তমান মহাজোট সরকারের কাছে একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের একটিই প্রত্যাশা-- যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী অঙ্গীকারনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশ-জাতিকে কলঙ্কের দায়ভার থেকে অব্যহতি দেবে তারা। বর্তমানে রাজনৈতিক বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারকে অবশ্যই সাবধানী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, নতুন প্রজন্ম মহাজোট সরকারকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে জাতিকে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদান করে দেশের সকল নাগরিককে এক সুঁতোয় ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে। সুতরাং কোনো অবস্থায়ই বর্তমান সরকার তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন থেকে পিছপা হবে না। সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদকালের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিাচারকাজ সম্পন্ন করে জাতিকে চার দশকব্যাপী বয়ে বেড়ানো কলঙ্কের হাত থেকে অতিসত্বর মুক্তির ব্যবস্থা করবে।