..................পর্ব ৬
একটি কল্পকাহিনী...
জায়েদুর আলম 'ফিনিক্স পাখির ডিম' শীর্ষক গল্পটির প্লট পরিকল্পনা করেছেন জর্জ অরওয়েল-এর 'এনিম্যাল ফার্ম' উপন্যাসের সাদৃশ্যে। তবে এখানে গল্পকার জর্জ অরওয়েলের 'এনিম্যাল ফার্ম-এর সমান্তরালে ঘটনায় প্রতীকী ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারেন নি। তিনি মূলত গৃহপালিত মোরগ-মুরগীদের যাপিত জীবনের নির্মম পরিণামের কথা পাঠকের সামনে শিল্পিত সৌকর্যে উপস্থাপন করেছেন। কুক্কুরের বংশধর টুক্কুর জন্মকালীন সংশয় এবং কুক্কুর ও তার স্ত্রীকে সমাজচ্যুত করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে গল্পের কাহিনী যে চূড়ান্ত মাত্রা স্পর্শ করতে চেয়েছিল কিংবা লেখকের তা করার সুযোগ ছিল-- তা শেষপর্যন্ত সার্থক হয়ে উঠতে পারে নি, টুক্কুর ফিনিক্স পাখি হয়ে না জন্মালে। টক্কুরের জন্মের পর গল্প সরাসরি চূড়ান্ত পরিণামের দিকে এগিয়ে গেছে। এবং ফার্ম মালিক ভোজের আয়োজন করে যখন অন্যান্য বয়স্ক মোরগ-মুরগীর সাথে টুক্কুরের জন্মদাতা কুক্কুরকেও হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় টুক্কুর বিগত দিনগুলোতে কসরত করে উড়বার যে ক্ষমতা অর্জন করেছিল, সেই শক্তি দিয়ে পিতাকে রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। বরং টুক্কুরের ব্যর্থ চেষ্টায় সে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিহত হয়েছে। ফিনিক্স হওয়ার ব্যর্থ প্রয়াসে 'তার গালকে আগুন ধরে গেলো। পালক পোড়া গন্ধ বের হলো। প্রচণ্ড তাপ লাগছে টুক্কুরের। চামড়া পুড়ছে। আর কতক্ষণ লাগবে তার সত্যিকারের পাখি হতে?' --পৃ.৯৪
ফিনিক্স পাখি হওয়ার টুক্কুরের এই ব্যর্থ প্রয়াসের মাধ্যমে গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু পাঠকের মনে টুক্কুরের এই ব্যর্থ প্রয়াস সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। কারণ, লেখক জেনেশুনেও কেন গৃহপালিত মোরগকে ফিনিক্স পাখি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন? রূপকথার এই পাখি হতে পারলেই কি টুক্কুর রক্ষা করতে পারবে নিজেকে কিংবা তার পরিবারকে ঘাতক ফার্ম মালিকের হাত থেকে? কারণ, মানুষ নামের প্রাণীর হাত থেকে হিংস্র বন্য বৃহদাকায় হস্তি পর্যন্ত রেহাই পায় নি, সেখানে কুক্কুরকে রক্ষার জন্য তার সন্তান টুক্কুরের ফিনিক্স হওয়ার সংকল্প কতটা যৌক্তিক? এসব প্রশ্ন সত্ত্বেও সরলরেখায় বর্ণিত প্রথাগত গল্প ধারার মধ্যে জায়দুল আলমের গল্পটি পাঠকের মনে ভিন্ন স্বাদের যোগান দিয়েছে।
গঞ্জিকা সেবনের পর...
'গাঁজার নাও পাহাড়া দিয়ে যায়'-- এ জাতীয় একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে; যতদূর মনে পড়ে সম্ভবত এ লাইনটি কোন এক গানেও ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাইয়ার রচিত 'পোয়াতি বিলাই' গল্পের মূল ঘটনা উঠতি বয়সের কয়েকজন বেকার গঞ্জিকাসেবী প্রেমিকদের নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। এই যুবকেরা কুমোর ঘরের মেয়ে শোভার তৈরি গাঁজার কল্কিতে গাঁজা সেবন করে শোভার প্রেমে হাবুডুবু খায়, আকুপাকু করে, কিন্তু মনের কথাটি কেউ-ই খুলে বলার সাহস পায় না শোভার সামনে। তবে গঞ্জিকাসেবী গল্পের নায়ক শেষাবধি একদিন দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে মনের গোপন কথাটি প্রকাশ করে দেয় শোভার নিকট। কিন্তু শোভা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার (নায়কের) মুরোদহীনতা বা প্রেমিক হিসেবে অযোগ্যতার কথা। প্রেমিক এসময় জিজ্ঞেস করে যোগ্যতা প্রমাণের ব্যাপারে সফল হলে তার ডাকে সাড়া দেবে তো শোভা? কিন্তু শোভা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় : 'তা তোমাগো কোন কাইলেও অইবো না আর ডাকবারও পারবা না;' --পৃ.৯৭। এরপর নায়ক গঞ্জিকাসেবী দল ত্যাগ করে বছরব্যাপী শোভাদের বাড়িমুখো হয় না, 'মুরোদ' অর্জনের প্রয়াসে। যদিও গল্পকার জানিয়েছেন বছরান্তে নায়ক তার প্রেমিকা শোভাকে ডাকার যোগ্যতা অর্জন করে, তথাপি শোভার সাথে তার মিলন সম্ভব হয় নি। কেননা ততদিনে শোভার বিয়ে হয়ে যায় অন্য পুরুষের সাথে। গল্প এখানে শেষ হলেও খুব একটা আপত্তি উঠত না, কিন্তু গল্পকার এরপরও আমাদেরকে টেনে নিয়ে যান আরো কিছু দূর। ফলে আমরা জানতে পারি শোভা গর্ভধারণ করে পিত্রালয়ে এলে দেখা হয়-- মুরোদহীনতার চ্যালেঞ্জ জয়ী নায়কের সাথে। তবে গল্পকার এই পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে অবচেতনেই পুরুষবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এজন্যই শোভাকে ডাকার মুরোদ অর্জনের পর নায়ক নিজেও আর আকর্ষণ বোধ করে নি শোভার প্রতি। তাতে অবশ্য শোভার কিছুই যায়-আসে না, কারণ তার অনেক আগেই তার বিয়ে হয়ে গেছে। এই যে প্রণয়ের অসফল পরিণাম এতে বিরহযন্ত্রণা নেই, আছে একধরণের সম্পর্কহীন শিথিল আচরণ :
একটা পোয়াতি বিলাই আইসা আমার সামনে খারায়। আমি তার সাথে ভালোমন্দ কথা কই। আমি চইলা আসি-- আসার সময় পিছন ফিইরা চাই। আমার পেছনে ফিইরা চাইতে আর ভয় করে না। দেখি পোয়াতি বিলাই খারাইয়া রইছে। --পৃ.৯৭
নায়ক-নায়িকার এই ব্যর্থ প্রণয় এবং যাপিত জীবনের বাস্তবতায় গল্প সমাপ্ত হলে পাঠকের সমনে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে--
এক. সংসার জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে নারীর নিশ্চিতভাবে আর্থিক নিরাপত্তার সুখী জীবনের প্রত্যশা;
দুই. পুরুষতান্ত্রিক অহংকারে একসময়ের প্রত্যাশিত নারীকে অবলীলায় নায়ক 'পোয়াতি বিলাই' হিসেবে তুচ্চজ্ঞান করে এগিয়ে গেছে;
অর্থাৎ শোভা যখন নিরাপদ সংসার জীবনের জন্য গল্প কথকের মাঝে যোগ্যতা খুঁজেছে তখন সে ছিল গঞ্জিকাসেবী, ফলে সে যোগ্যতা ছিল না নায়কের। এবং পরবর্তী পর্যায় দ্বিধাহীন পদক্ষেপে শোভা গিয়ে উঠেছে অন্য পুরুষের সংসারে। কিন্তু গল্পের নায়ক যখন শোভার প্রত্যাশিত যোগ্যতা অর্জন করে, তখন তাদের মিলনের মাঝে দাঁড়িয়ে যায় সমাজের দুর্ভেদ্য দেয়াল।
আল্লাইয়ারের এ গল্পের বিষয় নির্বাচন সমকালীন যুবসমাজের পুরুষবাদী ভাবনার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। বিষয়বস্তুর বিবেচনায় গল্পটিকে অসাধারণ না বলে উপায় নেই, তবে এর আখ্যানভাগ যেভাবে শুরু হয়েছিল তা আরো বৃহৎ কলেবরে বিস্তারের দাবি রাখে। এ দাবির শর্ত থাকা সত্ত্বেও 'পোয়াতি বিলাই' গল্পটিক সার্থক হিসেবে গণ্য না করার কোন কারণ নেই। তাছাড়া গল্পকারের দক্ষ আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগের নিপুণতার সত্যিই প্রশংসার্হ্য।
একজন মিলনের মৃত্যুর পর...
বর্তমান সময়ে সংঘটিত অনেক ঘটনার মধ্য থেকে সীমান্ত আহমেদ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য ছাত্র মিলনের করুণ জীবন পরিণাম নিয়ে রচনা করেছেন ঝরঝরে গল্প 'মিলনের বড় হবার স্বপ্ন ছিল'। গল্পটি পরিণামে বেদনাদায়ক। পরীক্ষার রেজাল্ট আনতে যাওয়ার সময় যে মিলনের মনে হাজারো স্বপ্ন ডানা মেলেছিল তা কর্তৃপক্ষের একটি ভুল তথ্য বিবরণীর কারণে দপ করে নিভে গেলে--- 'জোছনাবিলাসী মিলনের যে মনে থাকার কথা নিবিড় শুভ্র অসল আনন্দে তার জায়গায় তা ছেয়ে গেছে তীব্র বিষণ্নতায়।' --পৃ.৯৯। এরপরও আবেগী কিশোর মিলন হয়তো বিষণ্নতার মেঘ সরিয়ে বেরিয়ে আসতে পারত, কিন্তু এজন্য দরকার ছিল তার পারিবারিক সহায়তা। এর পরিবর্তে মিলনের ভাগ্যে জোটে পরিবার থেকে ধিক্কার; ফলে অনিবার্যভাবে আবেগী মিলন জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে এবং তার গৃহত্যাগের তিন দিন পর পিতৃমাতৃহীন কিশোর মিলনের মৃত দেহ পুকুরে জলে ভেসে থাকতে দেখা যায়। পরবর্তী পর্যায় গল্পকার মিলনের বন্ধুদের মাধ্যমে তার সাফল্যের সংবাদ পরিবেশন করিয়েছেন। তার বন্ধুরা মিলনের চাচার বাসায় গিয়ে পরীক্ষার ফলাফল পুনঃনির্ধারণের প্রতিবেদন দেখালে পরিবারের ভ্রান্তির পরিণাম থেকে বেরিয়ে আসার উপায় থাকে না। জানা যায়, মিলন ফেল তো দূরের কথা বরং জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাস করেছে। কর্তৃপক্ষের সংশোধিত ফলাফল প্রকাশের আগেই তরতাজা মিলনের আত্মহত্যা সংঘটিত হওয়ায় সেই রেজাল্ট প্রকৃতপ্রস্তাবে মূল্যহীন ও দুঃখময় হয়ে পড়ে।
সীমান্ত আহমেদের একরৈখিক গল্পটি খুব সাদামাটা ও সাধারণ হলেও মিলনের আকাল মৃত্যুর বেদনা থেকে পাঠক অব্যহতি পায় না। কারণ, জাতীয় ঘটনা চারপাশে হরহামেশা সংঘটিত হচ্ছে। সমকালে তরুণ তরুণীদের এই প্রবণতা লাঘবের ব্যাপারে পরিবারে এবং বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি সীমান্ত আহমেদের গল্পে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
......................................................................................................