................ পর্ব ৪
ফিগার বিভ্রান্তি নিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনা...
মনজুরুল হকের '৩৬-২৪-৩৬' শীর্ষক গল্পটি পরিণামে ট্র্যাজিক হলেও এতে উপস্থাপিত ঘটনারাশি খুবই বিচ্ছিন্ন। গল্পের ঘটনা পরম্পরা এক সুতোঁয় গ্রথিত করতে গল্পকার ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, সিঁড়ি বেয়ে নামা মাংসল যে রমণীকে দিয়ে লেখক গল্পের সূচনা করেছেন তার সাথে ৩৬-২৪-৩৬ আদর্শ ফিগারের তরুণীটির ঝকঝকে নোয়াহ চালিয়ে চলে যাওয়ার সাথে তিন থাকওয়ালা মেদবহুল নারীটির ঈর্ষাজনিত একটা সম্পর্কের সেতু থাকলেও পাঁচ বাই সাড়ে চার ঝুপড়ির বাসিন্দা নারীটির জীবননাট্যের কোন সম্বন্ধসূত্র আবিষ্কার করা যায় না। তবে দুই ঠোলার (পুলিশের) কামপিপাসা নিবারণের চাতুরির সাথে গল্পের যে সম্বন্ধসূত্র তা ছিন্ন হয়ে যায় ঝুপড়িরর চিৎপাত শুয়ে থাকা লোকটির কার্যকারণহীন অব্যাখ্যেয় মৃতু্যর মধ্য দিয়ে। উপরন্তু ঝুপড়ির বাসিন্দা নারীটিকে দুই পুলিশের উপর্যুপরি ধর্ষণ এবং তারপর বিচার, জেল এবং নারীটির মৃতু্য এত দ্রুত সংঘটিত হয়েছে। ফলে এর একটির সাথে অন্যটির বিশেষত গল্পের সূচনায় নারীর যে ফিগার বর্ণনা করা হয়েছিল তার কোন কার্যকারণ সম্পর্কসূত্র তৈরি করা যায় না। ফলে গল্পটি সম্পূর্ণ অর্থেই ব্যর্থ হয়েছে বলা হলে অতু্যক্তি হয় না। রচনাটিকে কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাহার ছাড়া গল্প বলাটা কতটা যৌক্তিক তা 'অপরবাস্তব'-৪ এর সংকলকগণের নিকট থেকে ব্যাখ্যার দাবি উত্থাপন করাটা পাঠক হিসেবে খুব বেশি অসঙ্গত হবে বলে মনে হয় না।
সুখস্মৃতিময় দাম্পত্য জীবন...
সুবিদ আলি লেনের ঝুল বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে চায়ের পেয়ালা ঠাণ্ডা করে মৌমিতার মা। তারও আগে বিছানায় ঘুমের ঘোরে কাত হয়ে বাম পাশটি খালি দেখে একরাশ যে শূন্যতায় মৌমিতার মায়ের বুক বিষণ্নতায় ভরে যায় তা ফুটফুটে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা খুঁজে পায়। বুক ভেঙে যাওয়ার পরও মেয়েকে বলতে বাধ্য হয় মৌমিতার মা : 'এখন আমার হাতে খেয়ে নাও, বাপি এরে পরে তার হাতে খেও!' --পৃ.৬৭। যদিও মৌমিতার মা জানে তার বাবা আর কখনো কোনদিন মেয়েকে নিজ হাতে খাওয়াতে কিংবা আদর করতে আসবে না, তারপরও মিথ্যের মুখোশ চড়িয়ে বস্তুজাগতিক সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখার নিরন্তর প্রয়াস ও সংগ্রাম অব্যাহত রাখে মৌমিতার মা।
আবদুর রাজ্জাক শিপন 'আমার মৃতু্য পরবর্তী চিঠি' শীর্ষক গল্পে শিল্পিত সৌকর্যে এক সুখী দাম্পত্য জীবনের করুণ পরিণামের মধ্য দিয়ে স্বজন হারানোর কল্পিত এ কাহিনী নির্মাণে অসাধারণ গদ্যের মায়াজাল বিস্তার করেছেন। এ গল্পে কয়েকটি শব্দ 'উ' স্থলে 'ও' ধ্বনির দৃষ্টিকটূ বা অশুদ্ধ প্রয়োগ ছাড়া গদ্যের সাবলীলতা সুখপাঠ্য ও আকর্ষণীয়। যেমন-- 'প্রিয় হয়ে ওঠেছে' (উঠেছে) অথবা 'চোখ জ্বালা করে ওঠলে (উঠলে); এরকম কয়েক জায়গায় 'উ' স্থলে 'ও' ব্যবহার লেখকের অসাবধানার পরিচায়ক।
স্বামীর মৃতু্য পরবর্তী নিঃসঙ্গ স্ত্রীর (মৌমিতার মা) জাগতিক জীবনের দুঃসহ স্মৃতিচারণ চমৎকার সাযুজ্যে পরিবেশিত হলেও 'সুন্দরপুরের কৃষক রমিজ মিয়া' গল্পের কাহিনীবৃত্তে কতটা প্রয়োজনীয় তা পাঠক হিসেবে আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। তার চেয়ে বরং মৌমিতার মায়ের তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্নঘোর এবং মৌমিতার বাবার বিবাহপূর্ব প্রণয়কথায় অনন্যা নামের যে নারীর কথা গল্পে উপস্থাপিত হয়েছে তার প্রতি আকর্ষণ গল্প পাঠকের অধিক তৈরি হয়েছে। লেখক রাজ্জাক শিপনের এ গল্প পড়ে তাঁর গল্পের বয়নরীতির প্রশংসা না করা হলেও অবিচার করা হবে। আপনার গল্পের গদ্য সত্যিই নতুন এক মোহনীয় ঘোরের সৃষ্টি করে পাঠকের মনে। তবে গল্পে মৌমিতার বাবা-মায়ের নামটা থাকলে মন্দ হতো না।
রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং একটি পরিবার...
অনীক আন্দালীব লিখেছেন 'ভাঁজবিহীন সময়ের গল্প'। নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে একটি পরিবারের নিঃশব্দ বিপর্যয় এবং দুজন কিশোর-কিশোরীর জৈবনিক বিপর্যয় সমান্তরাল অর্থে চিত্রিত হয়েছে গল্পে। একটি মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী পরিবারে যেভাবে রাজনৈতিক ডামাডোলের চোরাস্রোত প্রবেশ করেছিল তা এরকম :
কিছুদিন পরে সে বুঝে যায় বাবা আর কখনও আসবে না। ধীরে ধীরে রাস্তার শেষের বাসাটা সে ভুলে যায়। জাতীয়তাবাদের পোস্টারের দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে সে এই বাসাতেই এখন ফিরে আসে, বসার ঘরে তার মা তার জন্য অপেক্ষা করে। --পৃ.৫৯
বাবা ফিরে না আসলেও কিন্তু জীবন থেমে থাকে নি; কিংবা থেমে থাকে না। ঘটে পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনও। কিশোর-কিশোরীদের ছেড়ে দেয়া বাসাটার বাহ্যিক পরিবর্তন না হলেও 'বসার ঘরের বিন্যাস, দেয়ালের চিত্রকর্ম, মেঝের কার্পেট' ইত্যাদি বদলে গেছে। পরিবর্তন এসেছে তাদের জীবনেও-- কিশোরী চাকরি পেয়েছে, প্রেমে পড়ে বিয়ের পর্বও সেরেছে; কিন্তু কিশোর বদলায় নি, এখনো সেইসব পুরনো স্মৃতির মাঝেই আবর্তিত তার মানসচেতনা। গল্পটির পারিবারিক বিপর্যয়ের সাথে রাজনৈতিক ঘটনার অনিবার্য সম্বন্ধসূত্র নির্মাণ করে অনীক আন্দালীব তীক্ষ্ণ সমাজবীক্ষণের পরিচয় দিয়েছেন। ধন্যবাদ গল্পের বিষয় নির্বাচনে এমন অভিনবত্ব আনয়নের জন্য। তবে পরিণামে গল্পের পরিবর্তিত বাস্তবতায় আন্দালীব সবকিছুর পরিবর্তন দৃশ্যমান করে তুললেও কিশোরকে তার বয়সের সীমা অতিক্রম করতে দেন নি। এটি গল্পের তথ্যগত ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত হয়। প্রসঙ্গত বলা দরকার-- কিশোরের বয়স নিয়ে প্রশ্ন উঠত না যদি গল্পকার কিশোরীকে পরিবর্তিত সময়ের সাথে বয়সী করে না তুলতেন। নিশ্চয় গল্পকার তথ্যগত এই বিভ্রাট বিবেচনা করে দেখবেন।
নিঃসন্তান নারীর মানসলোক...
নিঃসন্তান নীরাকে নিয়ে হাসান মাহবুব লিখেছেন 'প্লাস্টিকের ফুল আর খেলনা একতারা'। এ গল্পের শুরুতে গল্পকার অসাধারণ যে প্লট নির্মাণ করেছিলেন তা এরকম :
নীরা সুখ খোঁজে না এখন আর। সপ্তাহান্তে মাতাল স্বামীর গালির তোড়ে ভেসে যেতে পারে অনায়াসেই। অথবা রাত আকেটু বাড়লে নিস্পৃহ সঙ্গম অভ্যাসের পরে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়েও নিতে পারে মৃত সম্পর্কের চোখে।--পৃ.৬১
গল্পের এই সূচনায় এর শিল্পিত বিকাশ শত আশায় স্ফীত ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এমনটিক অলৌকিক ক্ষমতাবান কোন পুরুষের নিকট থেকে সংগৃহীত শুক্রাণু নীরার মধ্যে যে প্লাস্টিকের ফুল সংগ্রহের প্রতি আকৃষ্ট করে তাও গল্পটিকে একটি ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু পরিণামে যখন নীরা প্লাস্টিকের টবে পানি ঢালে আর তার স্বামী খেলনা একতারায় সুর তোলার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়, তখন আমাদের প্রত্যাশারা শতচ্ছিন্ন হয়ে কাতরাতে থাকে। লেখককে অনুরোধ করবো এমন সম্ভাবনাময় গল্পের প্লটটিকে হত্যা না করার।
পুরুষতন্ত্রে সমর্পন...
আশরাফ মাহমুদ 'মাটিফুল ও অন্ধ মুক্তির গান' শীর্ষক গল্পে গ্রামবাংলার পুরুষপ্রধান সমাজের চেতনাবৃত্তিকে দেশপ্রেমের সাথে সংশ্লিষ্ট করে যে ঘটনা উপস্থাপন করেছেন, তা অমিত সম্ভাবনায় বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ থাকলেও গল্পটির সর্বাঙ্গ সুন্দর হয় নি। রতনের স্ত্রী কুসুম বারবার কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ায় মনের দুঃখে রতন দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যার প্রয়াস চালিয়েও কেন শেষপর্যন্ত সে আত্মহত্যা করে নি-- তার সদুত্তর মেলে না গল্পে। কারণ, রতন আত্মহত্যা না করলেও তার স্ত্রী কুসুমের গর্ভ কিন্তু পুত্র সন্তান জন্ম দেয়ার মতো প্রত্যাশিত উঁচু ছিল না সেবারও। অথচ তারপরও লেখক জানিয়েছেন-- কুসুম একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে; অর্থাৎ লেখক অবচেতনেই পুরুষতন্ত্রের নিকট কুসুমকে সমর্পন করতে চেয়েছেন।
আশরাফ মাহমুদ গল্পে পুরুষতন্ত্রের সাথে নারীর সন্তান জন্ম দেয়ার কাহিনীতে অপ্রত্যাশিতভাবে যুক্ত করেছেন একটি বৃদ্ধ চরিত্র। যিনি একাত্তরে আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছেন। এমনকি নিজের বিবাহযোগ্য বোন লাইলীকে গ্রামের পুকুরের জলে লাশ হয়ে ভাসতে দেখেছে। এজন্য বৃদ্ধের ধারণা ঐ পুকুরের নীচ থেকে মাটি এনে নবজাতকের গায় মাখালে সেই সন্তান দেশপ্রেমিক হবে। বৃদ্ধের এমন ভাবনার যৌক্তিকতা নির্ধারণের লক্ষ্যেই কুসুমের নবজাতক পুত্রের গায় বৃদ্ধ সেই মাটি মাখানোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে বাধাগ্রস্ত হয় এবং দেখে-- তার হাতে মাটিফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণ। গল্পের পরিণাম এ জাতীয় অতিবাস্তবতায় ঘটায় গল্পটি নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি পড়ে শিল্পিত সাফল্যের সংকটে আক্রান্ত হয়।
একাত্তর মহাপতন ও ভোর...
একরামুল হক শামীম একাত্তরের একটি সত্য ঘটনা নিয়ে 'মহাপতনের ভোর' শীর্ষক গল্পে রাজাকার রজব আলীর অতীত অপরাধ এবং সমকালের মাতবরী দাপটের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সর্বাঙ্গ সুন্দর একটি গল্প উপহার দিয়েছেন। নয় অথবা দশ বছর বয়সী মেয়েরা রজব আলীকে ভয় পায়। শুধু পাড়া-প্রতিবেশীদের কিশোরী কন্যারা নয়, তার নিজের নাতনী সিন্থিও রজব আলীকে দেখলে ভয় পায়। কিন্তু রজব আলীকে কিশোরী কিংবা তরুণীরা কেন ভয় পায়? এর কারণ উদ্ঘাটন করাই ছিল গল্পকার একরামুল হক শামীমের মূল লক্ষ্য। লক্ষ্যের প্রতি গল্পকারের অবিচর নিষ্ঠার কল্যাণে পাঠক জানতে পারে রজব আলীর কুকীর্তির কথা :
রজব আলীর এখনো মনে আছে পাকিস্তানি মেজর-ক্যাপ্টেনরা তার বুদ্ধির খুব তারিফ করতো। বুদ্ধি করেই গ্রামের নব বিবাহিতা এক তরুণীকে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে তুলে দিতে পেরেছিলেন। মেয়েটির বিয়ের সময় উকিল বাপ হয়েছিলেন রজব আলী। কিন্তু তাতে কি? পাকিস্তানি বাহিনীর এক মেজর সুন্দরী মেয়েটাকে দেখে এক রাত সঙ্গে কাটানোর ইরাদা করেছে। [...] এদের ইরাদা পূরণ করতে না পারলে বেশুমার গুণাহ লেখা হবে আমল নামায়। --পৃ.৭৬
এভাবে একাত্তরে একজন তরুণীর সর্বনাশ করেছিল মাতবর রজব আলী। কিন্তু দেশজুড়ে এমন অনেক রজব আলীই একাত্তরে নারী নির্যাতনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তার কিছু হয়তো জানা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনাই হয়তো অপ্রকাশিত আছে। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে সেই রজব আলীরাই এখন মাতবরের আসনে অন্যকথায় শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত। এর চেয়ে আর কী দুর্ভাগ্য হতে পারে বাংলাদেশের নাগরিকদের! মূলত স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকারদের আস্ফালন এবঙ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিরব দাবি উত্থাপন করেছেন গল্পকার একরামুল হক শামীম 'মহাপতনের ভোর' শীর্ষক গল্পে। গল্পটির কাহিনী সরলরৈখিক এবং একটানা পরিণামের দিকে গতিশীল রেখেই গল্পকার তার উদ্দিষ্ট সাধন করেছেন। সার্বিক বিচারে গল্পটি সুখপাঠ্যও বটে।
..............ক্রমশ দেখুন