সকাল ৬:৪৫ এর এলার্ম। ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে এলার্ম বন্ধ করে দেয় মন্টু। কালকে রাতে ঘুমিয়েছে সাড়ে চারটায় , সারাদিন খাটুনির পর দুই ঘন্টার ঘুমে কিছুই হয় না , তারপর ও উঠতে হবে। সামান্য দেরী হয়ে গেলে ইউনিভার্সিটির বাসটা মিস হয়ে যাবে। তখন আবার অন্য বাসে যেতে হবে। পুরো এগারো টাকার ধাক্কা।
তাড়াতাড়ি উঠেই মাকে ডাকতে যায় সে। খাটে মা আর মিলি শোয়া। মন্টু নিচে শোয়। ওদের একটাই ঘর। ঢাকা শহরে আঠারশো টাকা ভাড়ায় এর চেয়ে বেশী কিছু আশা করা যায় না। মিলির ফর্সা পা টা অনেকখানি বের হয়ে গেছে। মন্টু সালোয়ারটা যতদূর সম্ভব নামিয়ে দেবার চেষ্টা করে। মিলির বয়স ১৩। এই বয়সী মেয়েদেরকে আলাদা ঘর দিতে হয়। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে দু-বেলা খেয়ে বাঁচার জন্যই যেখানে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় সেখানে বোনকে আলাদা ঘর দেয়া তো কল্পনারও অতীত।
তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে আধা-ছেড়া ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাস ধরতে যায়। ভাগ্য ভালো , আজকে বাসে সিট পাওয়া গেছে। এইসময়টা ওর অনেক ভালো লাগে। মর্নিং শিফটের বাচ্চারা ইয়া মোটা একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বাবা-মার হাত ধরে ক্লাস করতে যায়। এইসময়টা মন্টুর বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা কোনোদিন ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে পারেননি। বাস ড্রাইভার ছিলেন। ঢাকা-চট্রগ্রাম রুটে গাড়ি চালাতেন। আজকে বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো ওদেরকে এতো কষ্ট করতে হত না। গত ঈদে মিলিকে কাপড় দিতে পারেনি দেখে বেচারী অনেক কেঁদেছে। কি করবে , বাচ্চা মানুষ তো। বাবা বেঁচে থাকলে মিলিকে ঈদের দিন নতুন কাপড়ের জন্য কাঁদতে হত না। সামান্য কয়টা টাকার জন্য মাকে হাসপাতালে নার্সের চাকরিটা করতে হত না। বই কেনার টাকা জোগাড় করার জন্য মন্টুকে দিনের পর দিন দুপুরের খাবার না খেয়ে টাকা বাঁচাতে হত না।
বাবার শেষ দিনগুলোর কথা মন্টুর বেশী মনে পড়ে। ক্যান্সার নাকি বড়লোকদের রোগ। এই কথাটা মিথ্যে প্রমান করে মন্টুর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লো। ডাক্তার বলে দিয়েছেন সময় আর বেশী নেই। তারপর ও মায়ের মন মানে না। দেশের জায়গা-জমি সব বিক্রি করে নিয়ে আসলেন স্বামীকে বাঁচানোর জন্য। সেই টাকা ও একদিন ফুরিয়ে গেলো। মা একদিন মন্টুকে এসে কাচুমাচু হয়ে বললেন
: মন্টু বাবা , একটা কথা শুনবি।
: কি মা ?
: তোর বাবার চিকিৎসার টাকা তো শেষ হয়ে গেলো। একটা বিকল্প ব্যবস্থা যে করতে হয় রে বাপধন।
: কি করবা ?
: কত লোকে বাসে-বাসে সাহায্য চায়। তুই কি যাবি একবার ? তুই বললে আমি ব্যবস্থা করে দেই ?
মন্টু অপলক দৃষ্টিতে মার দিকে তাকিয়ে থাকে। মা মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। লজ্জায় ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না। মন্টুর খুব মায়া লাগে। তারপর বলে "পারবো মা"।
মা হটাৎ করে কেঁপে ওঠেন। ছেলেকে বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তারপর ছেলেকে নিয়ে কম্পিউটার কম্পোস করার দোকানে যান। লেখার প্রিন্টআউট বের করেন। তাতে লেখা ...
"আমার নাম মন্টু মিয়া। আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বাবা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত । তার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। এতো টাকা আমার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব না। কোনো সুহৃদয় ব্যাক্তি যদি সামান্য সাহায্য করেন তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।"
এই লেখা বুকের সাথে ঝুলিয়ে মন্টু দিনের পর দিন বাসে বাসে ঝুলেছে। কেউ কেউ টাকা দিতো। আবার কেউ কেউ গাঁজাখোর , হোরোইনখোর বলে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতো। মোট পনেরশো টাকার মতো জমেছিলো। তারপর একদিন বাবা মারা গেলেন। মন্টুর ভিক্ষা করা টাকা দিয়ে তার দাফন-কাফন করা হয়। তাও আজ থেকে আট বছর আগের কথা। তবুও কেন জানি দিনটার কথা মনে পড়লে চোখে পানি এসে যায়।
আটটা বাজে ক্লাস। তাড়াতাড়ি ক্লাসে ঢোকে মন্টু। আজকে প্রতীতি আসে নি। এই মেয়েটার জন্য মন্টু একধরনের আকর্ষন অনুভব করে। ভালবাসা কিনা স্বীকার করতে নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। মেয়েটা অনেক পয়সাওয়ালা , নিজেদের গাড়িতে করে আসে। গায়ের রংটা অবশ্য কালো , তবে চেহারা অসম্ভব রকমের সুন্দর। সুন্দর মেয়েদের যত ধরনের অহংকার থাকে এবং যত ভাবে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারে , এই মেয়ে তার কোনোটাই বাদ দেয়নি। মন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলে "ইশশ , আমি ও যদি কোনোদিন ..." ।
ক্লাস শেষে টিউশনি করতে যায়। টিউশনি শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে যায়। বাসায় ফেরার পথে বাসে চেয়ারের সাথে একটা হ্যাচকা টান লাগে। ডানহাত বেয়ে রক্ত পড়ছে। মন্টুর ওইদিকে কোনো খেয়াল নেই। ওর সবচেয়ে বেশী কষ্ট লাগছে যে শার্টটার একটা হাতা ছিড়ে গেছে। ওর একটাই শার্ট , এইটা ও যদি ছিড়ে যায় তাহলে কালকে থেকে বাইরে বেরুবে কিভাবে।
বাস থেকে নেমে মন্টু তৌফিকের বাসায় যায়। তৌফিক ঠিক ওর বন্ধু না , কলেজে একসাথে পড়ত। মন্টুকে দেখে তৌফিক যার-পর-নাই বিরক্ত হল। সেই বিরক্তি ঢাকার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে বললো "কেন এসেছিস ?"
মন্টু কাচুমাচু করে বলে
: না মানে , এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম , ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে যাই।
: আসল কথা বল। কি দরকার , টাকা ?
: না মানে , কয়দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি , তোর কোন ভালো শার্ট যদি থাকে , কয়েকদিনের জন্য ...
: তা ঢাকার বাইরে যাবি কোথায় ? পিকনিক-টিকনিক নাকি ?
মন্টুর আরো বিব্রত হয়। পিকনিক করার সামর্থ যে ওর নেই তা তৌফিক নিজে ও জানে। গরীবের মধ্যে সে গরীব , ছোটলোকের মধ্যে আরো বেশী ছোটলোক। এইকথা তৌফিক ও অনেক ভালভাবে জানে ...
: না মানে এমনি কয়েকদিনের জন্য লাগতো।
: আচ্ছা দাড়া।
তৌফিক কাবার্ড থেকে পুরোনো একটা শার্ট বের করে দেয়। কুচকানো ময়লা পুরোনো একটা শার্ট।
: কবে ফেরত দিবি ?
: এই দিন পনের পরেই।
: হুমম। সাবধানে রাখিস কিন্তু। বৃষ্টির দিন। বৃষ্টির ফোটা যেন না পড়ে , তিলা পড়ে যাবে।
: আচ্ছা , ঠিক আছে।
শার্টটা নিয়ে মন্টু বাসায় ফেরে। ওকে আসতে দেখেই মিলি ছুটে আসে
: দাদা , দাদা , তোমার কাছে টাকা আছে ?
: না তো , কেন রে ?
: থাকলে এক কেজী চাল নিয়ে আসতো , আজকে রাতে আবার রুটি খেতে হবে। রোজ রোজ রুটি ভালো লাগে !!
মন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আদরের ছোটবোনটার রাতের ভাত খাবার সামান্য আবদারটুকু পূরণ না করতে পারার অক্ষমতা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে থাকে। কি করবে ? আল্লাহ মানুষের মতো হাত-পা দিয়েছেন , কিন্তু যাপন করার জন্য মানুষের জীবন দেননি। ওরা যে জীবনটা যাপন করে তা আর যাই হোক অন্তত মানুষের জীবন না , এই কথাটা এই ১৩ বছরের বাচ্চা মেয়েটিকে কে বোঝাবে।
রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। মন্টুর জন্য তোষক নেই , কাঁথা বিছিয়ে তারই উপর শোয়। এইসময়টাতে প্রতীতির কথা মনে পড়ে সবচেয়ে বেশী। কোনো একদিন যদি এমন আসে যেদিন ও আর প্রতীতি একসাথে থাকবে , দুটো পরীর মতো ফুটফুটে বাচ্চা , একটা মোটামুটি বাড়ি আর একটা কল্পনাতীত সুখের জীবন। মুহুর্তের জন্য বাবাকে হারানোর বেদনা , ছোটবোনকে ভাত না খেতে দিতে পারার ব্যর্থতা , দিনের পর দিন দুপুরে ক্ষুধার জ্বালায় বেসিনের পানি খাওয়ার কষ্ট ... সবকিছু ভুলে যায়। আরেকটি সাধারন দিন শেষ হয় , শুরু হয় আরেকটি সাধারন দিনের শুরু।
কীট : শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:০০