বাবাকে নিয়ে লিখছি , কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। আমার শুরুটা সবসময়ই খারাপ হয়।
আমি ছোটবেলায় খেলার সাথী হিসেবে বাবাকেই পেয়েছি। বড়লোক পরিবার খেকে আসিনি , দামী খেলনা কখনোই কিনতে পারতাম না। সস্তার মধ্যে পুতির গুলি-ওয়ালা পিস্তল কেনা যেত , কিন্তু ছোটবেলার থেকে গুলি-পিস্তল নিয়ে খেললে নাকি বাচ্চাদের মধ্যে ক্রাইম করার ঝোক তৈরি হয় , এজন্য কোনোদিন ওসব দিয়ে খেলাও হয়নি। আমি ক্রিকেট খেলতাম , আমি সবসময় ব্যাটিং করতাম , বাবা বোলিং করতেন । জীবনে কোনোদিন বাবাকে ব্যাটিং করতে দিয়েছি মনে পড়ে না .. । বাবা খুব ভালো ক্যারম খেলতেন। বাবা আর একটা কাজ অবশ্য খুব ভালো করতেন , তা হল ক্যারম খেলার সময় গুটি চুরি করা। এই নিয়ে আমরা কত ঝগড়া করতাম , বাবা শুধু হাসত। বাবা আমার খেলাধুলা নিয়ে ও চেষ্টা কম করেননি , সেই কথা পরে একসময় বলব।
আমাকে নিয়ে বাবার হাজার স্বপ্ন। আমি কুলাঙ্গার পুত্র , তার একটা ও পূরন করতে পারিনি। স্বপ্ন নম্বর এক , তার ছেলে হবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। ১লা বৈশাখ , ১লা ফাল্গুন এইদিন গুলোতে মাঝরাত থেকে রমনা বটমূলের সামনে গিয়ে বসে থাকবে , রবীন্দ্র-নজরুল এর জন্ম-মৃত্যু-বিবাহবার্ষিকী হুবুহু মনে রাখবে , টিভি ওয়ালারা বছরে দুই-একদিন রবীন্দ্র-নজরুল নিয়ে পাড়াপাড়ি শুরু করলে টিভির সামনে বুদ হয়ে পড়ে থাকবে , আরও কত কি !! আমার সুশীল সমাজ নিয়ে বিশেষ এ্যালার্জি থাকার কারনে সেইগুলি করা হয়ে ওঠেনি।
ছোটবেলায় বাবা খুব চেষ্টা করেছিলেন আমাকে "সুশীল" বানানোর জন্য। আমি যখন খুব ছোট , পড়তে ও শিখিনি , তখন আমাকে কোলে নিয়ে বাবা রবীন্দ্রনাথের "দুই বিঘা জমি" আবৃত্তি করতেন। মনে ক্ষীন অাশা , ছেলে যদি শুনে-শুনে ও একটু আবৃত্তি শেখে । লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে , আমি "দুই বিঘা জমি" ঝাড়া মুখস্থ করে ফেললাম। এবং এমন সুরে আবৃত্তি করতে লাগলাম যে বাবা স্বীকার করলেন " ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ বেচে নেই , না হলে হয় নিজে মরে যেতেন , না হয় আমার ছেলেকে মেরে ফেলতেন "।
আমরা দুই ভাইবোন ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বাংলা বাবার কাছেই পড়তাম। বাবার কাছেই শিখেছি যে লেখা পড়ার আগে লেখক পরিচিতি পড়তে হয় , যে মানুষটা এতো কষ্ট করে লেখাটা লিখল তাকে না জেনে শুধুমাত্র নম্বর পাওয়ার জন্য তার গদ্যটা ব্যবহার করা অন্যায়। আমি ইন্টারমিডিয়েটে বাংলায় এ- পেয়েছিলাম দেখে বাবা মনে যার পর নাই কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি হয়ত কোনোদিন এক-আধটা স্কলারশিপ পেয়ে বাইরে চলে যাব , বিশেষ বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটলে হয়ত বড় এন্জিনিয়ার ও হয়ে যেতে পারি , তবে আমার বাংলায় এ- পাবার কষ্টটা বাবার চিরকালই থাকবে।
বাবা আমাদের ঐশ্বর্য দিতে পারেননি। ঐশ্বর্য তো খুবই দূরের কথা , বাংলায় "স্বচ্ছল পরিবার" বলতে যা বোঝায় আমরা ছিলাম তা থেকে ও কয়েক যোজন দূরে। বাবা যখন পেপারে ল্যাপটপ এর অ্যাড দেখে উচ্ছাসিত হয়ে বলেন "বাবা দেখতো , এই মডেল দিয়ে তোর হবে কিনা" , তখন আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি , উচ্ছাস দেখি। ওই বস্তু কিনে দেবার স্বামর্থ্য বাবার কোনোদিন ও হবে না জানি , কিন্তু তার বদলে যে অমূল্য রত্ন আমরা দুই ভাইবোন আমাদের জীবনে পেয়েছি , তা কি কম !!
মেয়েরা বাবার সাথে বেশী ঘনিস্ঠ থাকে , আমাদের পরিবার ও তার ব্যতিক্রম না। "বাবা , আমি তোমাকে ভালবাসি" , আমি জানিনা শতকরা কয়জন বাঙালী ছেলে এই কথা বলতে পারবে , আমি পারিনা। হয়ত বাবাকে আমি কোনোদিন ই এই কথা বলতে পারব না , কিন্তু ব্লগে তো লেখা যেতে পারে .......
বাবা আমি তোমাকে ভালবাসি।
বাবা আমি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৫৮