গার্মেন্টস শিল্পে নাশকতা এবং একটি কার্টুন
-আহমদ আশিকুল হামিদ
গার্মেন্ট শিল্পের নাশকতা নিয়ে সারাদেশের মানুষ যখন ক্ষোভ ও আতংকের মধ্যে, তখনই- গত ৪ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার ওপরে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, কাপড়ের বান্ডিলে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বান্ডিলের গায়ে লেখা ‘পোশাক শিল্প'। আগুন নেভানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কলসী থেকে পানি ঢালছেন। পরনে তার লাল পাড় সবুজ শাড়ি। বান্ডিলের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে সে আগুনে ঘি ঢালছেন বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন। ঘিয়ের বোতলের লেভেলে লেখা আছে ‘বাম/এনজিও'। মেননের বাম হাতে বাঁধা রয়েছে লাল পট্টি- বামপন্থীদের বিপ্লবের প্রতীক। কার্টুনের নিচে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম, ‘শ্রমিক উস্কানির নেপথ্যে কারা?' উত্তর জানার জন্য কার্টুনটিই অবশ্য যথেষ্ট।
এভাবে শুরু করার কারণ সম্পর্কে নিশ্চয়ই কথা বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। সম্প্রতি আবারও অশান্ত হয়ে উঠেছে গার্মেন্টস শিল্পখাত। শ্রমিকদের দাবি পূরণের জন্য ন্যূনতম বেতন তিন হাজার টাকা ধরে ২৯ জুলাই একটি নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকরা রাজপথে নেমে এসেছে। শ্রমিকরা বলেছে, তিন হাজার নয়, ন্যূনতম মাসিক মজুরি পাঁচ হাজার টাকা করতে হবে। এই ঘোষণার বাস্তবায়নও নভেম্বরের পরিবর্তে আগস্ট থেকেই দেখতে চায় তারা। কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছে। অসংখ্য প্রতিষ্ঠান এবং যানবাহন তাদের হামলার শিকার হয়েছে। গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে এমন প্রতিটি এলাকায় কয়েক কিলোমিটার জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে দুঃসহ যানজটের। শ্রমিকরা ভাংচুর করেছে, আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশও যথারীতি বেধড়ক লাঠি চার্জ করেছে এবং টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে। মাঝখান দিয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। প্রচন্ড যানজটেও নাকাল হয়েছে সাধারণ মানুষই।
ওদিকে গার্মেন্টস মালিকদের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার অংকে। কেউই উৎপাদন চালু রাখতে এবং চুক্তি অনুযায়ী বিদেশে রফতানি করতে পারেননি। অনেকের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এখানেও শেষ নয়, পরিস্থিতির অবনতি এত দ্রুত হয়েছে যে, মালিকরা তাদের গার্মেন্টস কারখানাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন। সবশেষে শ্রমিকদের একটি অংশ নতুন মজুরি কাঠামো মেনে নিয়েছে সত্য কিন্তু অন্য একটি অংশ এখনো তালবাহানা করছে। ফলে গার্মেন্টসে নাশকতার আশংকা সম্পূর্ণ কেটে যায়নি। বিশেষ করে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমযানের মধ্যে আবারও নাশকতা শুরু হতে পারে। এজন্যই গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সরকারের কাছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
গার্মেন্টস শিল্পে পরিচালিত এই নাশকতা সচেতন মানুষ মাত্রকেই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। কারণ, গার্মেন্টস কোনো সাধারণ শিল্পখাত নয়। এই খাত সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে খাতটি বছরে প্রায় ৬৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করতো। আয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীকালে বিশ্ব মন্দা এবং কেয়ারটেকার নামে ক্ষমতা দখলকারী সরকারের ঔদাসিন্য ও অযোগ্যতায় আয় কমে গেলেও গার্মেন্টসই এখনও রফতানি আয়ের প্রধান খাতের অবস্থানে রয়েছে। এই শিল্পে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের চাকরি হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী। এর মাধ্যমে শুধু বেকার সমস্যারই অনেকাংশে সমাধান হয়নি, একযোগে অন্য অনেক শিল্পেরও বিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের কারণে দেশে প্রসাধন শিল্পের অকল্পণীয় বিকাশ ঘটেছে, দেশীয় শাড়ি-কাপড়ের বাজার চাঙ্গা হয়েছে। টেক্সটাইল ও রঙসহ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পেরও বিকাশ ঘটে চলেছে যথেষ্ট পরিমাণে। ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভির প্রবল দাপটের মধ্যেও দেশের সিনেমা হলগুলো এবং সেই সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্প টিকে আছে প্রধানত গার্মেন্টস শ্রমিকদের কল্যাণে। অর্থাৎ গার্মেন্টস বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নানামুখী ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে। এজন্যই গার্মেন্টস শিল্পের সুষ্ঠু ও বাধাহীন বিকাশ নিশ্চিত করা দরকার। অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট এবং অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এখনও মাঝে-মধ্যেই আরো কারখানা বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তার ওপর বেতন-ভাতার নামে এভাবে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চলতে থাকলে গার্মেন্টস শিল্পকে টিকিয়ে রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কথা বাড়াতে হতো না, যদি এবারের আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নভাবে নেয়ার সুযোগ থাকতো। অন্যদিকে এ ধরনের কর্মকান্ড চলে আসছে ২০০৫ সাল থেকে। ঢাকা, না'গঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ দেশের সব অঞ্চলের গার্মেন্টস কারখানাই কোনো না কোনো সময়ে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকশ' কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মালিক সময়মতো অর্ডার সরবরাহ করতে পারেননি। বিজিএমইএ অভিযোগ করেছে, বিশেষ রাষ্ট্র ও বিদেশী শক্তির ষড়যন্ত্রে একটি মহল গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বস্তুত গত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছে। পর্যালোচনায় দেখা যাবে, ষড়যন্ত্র শুধু চলছেই না, বাস্তবায়নের চেষ্টাও ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এবারের শ্রমিক অসন্তোষের দিকেই লক্ষ্য করা যাক। কারণ হিসেবে মজুরি নির্ধারণের দাবিকে সামনে আনা হয়েছিল। পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি চায় শ্রমিকরা। অন্যদিকে ঘটনাপ্রবাহে প্রকৃত শ্রমিকদের পরিবর্তে শ্রমিক নামধারী সন্ত্রাসীদেরকেই বেশি তৎপর দেখা গেছে। হাজার হাজার শ্রমিক নামধারী ঢুকে পড়েছে কারখানাগুলোতে। তারা ঊর্ধতন অফিসারদের অফিসে ঢুকে যথেচ্ছভাবে ভাঙচুর চালিয়েছে। অফিসের কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ধরনের কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে- ওরা আসলে কারা? কারণ, প্রকৃত শ্রমিকরা কখনো অফিসারদের অফিস তছনছ করে না। তারা কাগজপত্রও পুড়িয়ে দিতে পারে না। কারণ, এসব কাগজপত্রে শ্রমিকদেরই বেতন-ভাতার হিসাব লেখা থাকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হামলাকারীরা শুধু বহিরাগত সন্ত্রাসী নয়, তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলগুলোর চিহ্নিত অনেকেও রয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ এবং বামপন্থী কয়েকটি দলই গার্মেন্টস শিল্পে নাশকতা চালাচ্ছে। সব মিলিয়ে সরকারকে দায়ী করার কারণ, বামপন্থীরা একদিকে আওয়ামী মহাজোটের শরিক, অন্যদিকে এনজিওদের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে বিদেশী এনজিওদের পক্ষে ভাড়া খাটার জন্য এই বামপন্থীদের অনস্বীকার্য পরিচিতি রয়েছে।
বস্তুত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিদেশীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য এবং পেছনে বামপন্থীসহ ক্ষমতাসীনদের দলীয় লোকজন রয়েছে বলেই নাশকতার জন্য একেক সময় একেক অজুহাত তৈরি করা হয়েছে। যেমন গত বছরের (২০০৯) জুন মাসে একবার গুজব রটিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, সাভারে ঢাকা ইপিজেড এলাকায় একজন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে। এই গুজব রটিয়ে শ্রমিক নামধারীরা ২৫টি গার্মেন্টস কারখানা, দুটি ব্যাংক ও তিনটি মার্কেটে ভাঙচুর চালিয়েছিল। চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কয়েক কিলোমিটার মহাসড়ক অবরোধ করে অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর করেছে তারা। অথচ পরে জানা গেছে, ওই নারী শ্রমিক মারা যায়নি, আহত হয়েছিল। তাছাড়া রাস্তায় ট্রাকের নিচে পড়ে কেউ মারা গেলে গার্মেন্টসেই হামলা চালানো হবে কেন? ট্রাকটি নিশ্চয়ই কোনো গার্মেন্ট মালিক নিজে চালাচ্ছিলেন না! এভাবেই ছোটখাটো, এমনকি অন্যায় এবং অযৌক্তিক বিভিন্ন দাবিতেও কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে কাজ বন্ধ করানো হচ্ছে। যথেচ্ছভাবে ভাঙচুর চালানো এবং সংঘর্ষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শ্রমিক নামধারীরা যখন-তখন সড়ক-মহাসড়কও বন্ধ করে দিচ্ছে। এসবের কোনো একটিকেও স্বাভাবিক শ্রমিক আন্দোলন বলা যায় না। একই কারণে গার্মেন্টস শিল্পে নাশকতার বিষয়টিকে প্রাধান্যে আনতে হয়েছে। কারণ আজকাল কথায় কথায় গার্মেন্টস কারখানায় কাজ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে- সেটা বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে কিংবা অন্য যে কোনো অজুহাতেই হোক না কেন।
গার্মেন্টস শিল্পে সংঘটিত এসব সহিংসতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে আলোচনা-পর্যালোচনা কম হয়নি। কিন্তু খুব কম সংখ্যকের চোখেই আসল কারণ ধরা পড়েছে। প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রথমে জানা গেছে গার্মেন্টস মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বিজিএমইএ'র বক্তব্যে। গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে ভাঙচুর ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএ অভিযোগ তুলেছে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে এবং সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই সকল ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো হয়েছে। বিজিএমইএ'র নেতারা বলেছেন, কিছু সংখ্যক দেশী-বিদেশী এনজিওর মাধ্যমে গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্রের কারণ সম্পর্কে তারা বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরে অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা এবং ক্রেতাদের কঠিন শর্তসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয়। এদেশী গার্মেন্টের চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। সব মিলিয়েই বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভিত্তি গড়ে তুলেছে এবং ভারতসহ প্রতিযোগী অনেক দেশের তুলনায় শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বিজিএমইএ নেতাদের মতে, এজন্যই ষড়যন্ত্র ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড শুরু করে স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিজিএমইএ নেতারা মনে করেন, ২০০৫ সালে কোটা প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না এবং এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে বলে যারা ধারণা করেছিল, তারাই চিহ্নিত কিছু বিদেশী শ্রমিক সংগঠন এবং এনজিওর মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর জন্য অর্থের যোগান দিচ্ছে। এদিকে তৎপর রয়েছে বিদেশী অর্থসাহায্যে পরিচালিত কিছু দেশী এনজিও। বামপন্থীদের মাধ্যমে এরা শুধু সেই সব এলাকাতেই তৎপরতা চালায়, যেসব এলাকায় গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। তারা মিথ্যা ও গুজবের আশ্রয় নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং আন্দোলনের নামে বিদ্রোহ করার ও শিল্প-কারখানায় ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানোর উস্কানি দেয়।
মূলত বিদেশীদের প্ররোচনায় কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও সেই একই জুন মাসে এসেই শুরু হয়েছে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড। চলেছে আগস্টের প্রথম ক'দিন পর্যন্ত। এবারের ঘটনাপ্রবাহেও পরিষ্কার হয়েছে, রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টসসহ সাধারণভাবে বাংলাদেশের পোশাক তথা বস্ত্র শিল্পের বিরুদ্ধে আসলেও গভীর ষড়যন্ত্র চলছে এবং ইতিমধ্যে সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের কার্যক্রম ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গুরুতর হলেও এমন অভিযোগের পেছনে শক্তিশালী কারণ রয়েছে। কারণটি হলো, মালিক পক্ষ অনেক আগে থেকে একদিকে সরকারকে সতর্ক করেছেন, অন্যদিকে সরকারের গঠন করে দেয়া মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে মজুরি কাঠামো ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছেন। সাধ্যের বাইরে গিয়ে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছেনও। কিন্তু তা সত্ত্বেও হঠাৎ করে কেন পরিস্থিতি অশান্ত ও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে তার কারণ বুঝতে পারেনি বিজিএমইএ। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থার মহাসচিব বলেছেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে গার্মেন্টস শিল্প যথেষ্ট পরিমাণে অর্ডার হারাবে। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপটে পণ্যের ক্রমাগত দরপতন এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে এমনিতেই এক কঠিন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। চাহিদামতো বিদ্যুৎ না পাওয়ায় বছরে ক্ষতি হচ্ছে ১৯৬২.৭২ কোটি টাকা। বিদেশী ক্রেতাদের বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী পণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য বিমানযোগে পাঠাতে গিয়ে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু কার্গো ভাড়াই গুণতে হয়েছে ১৩১১ কোটি টাকা। এসবের পর যদি হামলা ও ভাঙচুরের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যাহত করা হয় তাহলে কোনোভাবেই বাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
বিষয়টিকে হাল্কাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। ৩৫ লাখ শ্রমিকের চাকরি দেয়া এবং বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটানোসহ জাতীয় অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালনের কথা আগেই বলা হয়েছে। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান এই খাতের আয়কে সহজেই এক হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা সম্ভব। এজন্যই গার্মেন্টস শিল্পের সুষ্ঠু ও বাধাহীন বিকাশ নিশ্চিত করা দরকার। অন্যদিকে বাস্তব পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট এবং অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে এমনিতেই অনেক গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। গার্মেন্টস খাতে আয়ও কমছে আশংকাজনক হারে। তিন বছরের মধ্যে যেখানে ৯.২ বিলিয়ন ডলারের আয়কে দ্বিগুণেরও বেশি করে তোলার কথা ছিল সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আগের বছরের তুলনায় রফতানির অর্ডার ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। টাকার অংকে এর পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ করা দরকার, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে কিন্তু অনেক আগে থেকেই সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। এসব রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজার নষ্ট করার জন্য বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্র করা এবং অর্থ ঢালা হচ্ছে। এজন্য দেশের ভেতরে নিয়োজিত রয়েছে রাজনৈতিক কিছু দল ও গ্রুপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গার্মেন্টস বিরোধী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের নামধারী স্থানীয় কয়েকটি সংগঠনকে কাজে লাগানো হয়। এদের কেউই গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড সংগঠিত করার পেছনে সক্রিয় থাকে কিছু এনজিও। তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে। এসব এনজিওর তহবিলের উৎস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, তাদের কার্যক্রমও রহস্যঘেরা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন এনজিওগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। এসব সংগঠনই বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের ব্যাপারে জোর তৎপরতা চালিয়েছে এবং ওই সুবিধা বাতিল করিয়ে ছেড়েছে। এখন তারা গার্মেন্টস শিল্পকেই ধ্বংস করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।
সব মিলিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আসলেও ষড়যন্ত্র চলছে। নাশকতাও চালানো হচ্ছে একই লক্ষ্য নিয়ে। পরিস্থিতি শুধু আশংকাজনক নয়, ক্ষুব্ধ করে তোলার মতোও। সরকারের পক্ষে এমন অবস্থার দায়দায়িত্ব এড়ানো সম্ভব নয়। কারণ গার্মেন্টস মালিক ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, সরকার সামান্য উদ্যোগ নিলেও এভাবে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালানো সম্ভব হতো না। অন্যদিকে দুর্ভাগ্যজনক সন্দেহ নেই, কিন্তু সত্য হলো, ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানানো সত্ত্বেও সরকার গার্মেন্টস শিল্পকে রক্ষা করার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। শুধু তা-ই নয়, জুন-জুলাই মাসের সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বামপন্থী দলগুলোর সন্ত্রাসীদের অংশ নিতে ও নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। এটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। অভিযোগ উঠেছে, সরকার নিজেও কোনো বিশেষ দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের গার্মেন্টস ধ্বংসে ভূমিকা পালন করছে। বিশ্লেষণের এই দৃষ্টিকোণ থেকে দৈনিক ইত্তেফাকের কার্টুনটিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কেউ কেউ এমন ব্যাখ্যাও করতে পারেন যে, ভারতের স্বার্থে সবই করা হচ্ছে চমৎকার সমঝোতার মাধ্যমে। নাহলে কার্টুনে প্রধানমন্ত্রী এবং রাশেদ খান মেননকেই কেন বেছে নেয়া হবে?
Click This Link