১.
শহর আলীর পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। এদিকটায় কেউ আর আসে না, পথ ভুল করেও না। চারপাশের মানুষগুলো জীবনের তাগিদে অহর্ণীশ ছুটে চলছে।কখনো নতুন জন্ম নেওয়া কোনো শিশুর আগমনী কান্নার সুর ভেসে আসে। কখনো বা আসে সদ্য কোনো মৃতের আত্নীয়ের বিরহ বিলাপ। শহর আলীর যেন কোনো ভাবান্তর নেই। কোনো কিছুই তাঁর মনকে আর ছুঁতে পারে না। নিজেকে জীবিত বা মৃত, কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করে না। ঘরের কোণে নিপুন হাতে জাল বুনে চলা মাকড়সাটাকে দেখে তাঁর সময় কেটে যায়। দলছুট ছুঁছোদের সাথে অর্থহীন কথা বলে রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয়। কান্দুপট্টির কোনো এক বকুলের পাতলা ঠোট, ভরাট বক্ষের ধূসর স্মৃতি তাঁকে আর উত্তেজিত করে না। পঁচা-গলা এক থালা পান্তা ভাত, কয়েক ফালি কাটা পিয়াজ, দুইটা কাঁচা মরিচ, কিছু লবন; দুই বেলা এটুকু হলেই চলে যায় তাঁর। খাওয়া শেষে পড়নের বহু দিনের আধোয়া ময়লা লুঙ্গিতে হাত-মুখ মুছে আবার শুয়ে পড়া, ভাঙা বেড়ার ফাঁক গলে ভুল করে ঢুকে পড়া কয়েকটা চড়ুইয়ের ইতঃস্তত উড়াউড়ি দেখা; এভাবেই তো ঠিকঠাক চলে যাচ্ছে জীবন।রোজ রাত্তিরে করিমনের ঘরে ওর ধর্ম ভাই, রফিক আসে। ছিটকিনি খোলার শব্দে প্রতি রাতেই ঘুম ভেঙে যায় শহর আলীর। ওদের ফিসফিসানি কথার আওয়াজ তাঁকে আর বিদ্রোহী করে তোলে না। ভোর রাত্তিরে রফিকের চলে যাওয়া, ঘুম জড়ানো কন্ঠে করিমনের বিদায় জানানো; সব কিছুই যেন স্বাভাবিক লাগে শহরের কাছে।
তিন বছর আগে পঙ্গু হয়ে যখন এই ঘরে ঠাঁই হয়েছিল তাঁর, একেবারেই আলাদা ছিল সে সময়টা। করিমন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে হাড়ভাঙা খাঁটুনি খেটে রাতে ফিরত ক্লান্ত হয়ে। নিজ হাতে খাইয়ে দিত শহরকে। নীরবে চোখের জল আঁচলে মুছে নিয়ে ভাত মাখাত। শহর চোকিতে শুয়ে শুয়ে চিন্তার বীজ বুনে যেত। কিভাবে সংসার চলবে, করিমনের কি হবে, ছেলেটাকে কিভাবে মানুষ করবে; কত চিন্তা! চিন্তা নামের গাছগুলো ক্রমশ বড় হত, ডালপালা বেড়ে যেত, পাল্লা দিয়ে বেড়ে যেত শহরের অস্থিরতা। এখন আর কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে ইচ্ছে করে না তাঁর। মানুষগুলো ক্রমশ বদলে যায়। চারপাশের চেনা পৃথিবীটা অচেনা আলোয় বড় অচেনা মনে হয়। বদলে যায় করিমনেরা। বদলাতে হয় শহর আলীদের।
২.
-আসমানে কী সোন্দর চাঁন ওঠছে!
শহর মনে মনে হিসাব করে, আজকে মনডায় কয় পূর্নিমা।
স্নিগ্ধ চাঁদের রুপালী আলো জানালার ফাঁক গলে শহর আলীর মুখে, বুকে, দুই হাতে এসে পড়ছে। সে এক মনে ভড়া চাঁদটার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। কেমন যেন একটা ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় শহরের মনে।
অনেক দিন হল ছেলেটাকে দেখেনা সে। আহারে! পোলাডা এতিমের লাহান এহা এহা থাহে। কিডা জানে কী খায়, কী পড়ে! অসহায়তা, অক্ষমতার জন্য নিজেকে শাপ-শাপান্ত করে শহর। ক্যান এমুন হয়া গেল সব?
-ও বাজান! বাজান!
চমকে ওঠে শহর। পিছন ফিরে তাঁকিয়ে দেখে করিমকে। এক বছরে অনেক বড় হয়ে গেছে ছেলেটা। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে ছেলেকে ডাকে,
-আয় বাপ! আমার কাছে আয়!
ছেলের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে ধরে শহর। অনেক দিন বাবাকে না দেখে করিমের শিশু মনও অস্থির হয়ে উঠেছিল। এক লাফে চোকিতে উঠে বাবার বুকে শরীর এলিয়ে দেয় করিম। দুই হাত দিয়ে বাবার শরীরটা শক্ত করে পেচিয়ে ধরতে চায়। শহর করিমের কপালে, গালে বার বার চুমু খেতে খেতে বলে,
-সোনা আমার! তুই আইছস!
শহরের দুই চোখে পানি চলে আসে। বাম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে। কান্নার মাঝে এত সুখ, এত আনন্দ! শহরের চোখে যেন আজ কান্নার বাঁধ ভেঙেছে।
-মানিক আমার! তুই আইছস আমার কাছে!
করিমও কেঁদে ফেলে, হয়ত কান্না সংক্রামক তাই,
-বাজান! ও বাজান!
শহরের গলা জড়িয়ে ধরে আরো জোড়ে কাঁদে করিম।
আবারও চোখের পানি মুছে শহর। একটু শুকনো হাসি হাসে,
-তরে এইহানে কেডা লইয়া আইলোরে বাপ?
-মা’র লগে আইছি।
-হ্যায় এহন কুনহানে?
-মায় মনে অয় হেই ঘরে আছে।
-ওহ!
চুপ হয়ে যায় শহর।একটা চাপা অভিমানে বুকটা ফুলে ওঠে তাঁর।শহরের ডানহাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে করিম জিজ্ঞেস করে,
-বাজান! আপনে এমুন কইরা শুকাইয়া কাড হয়া যাইতাছেন ক্যান?
-ওইডা কিছুনারে বাপ! আমি ভালাই আছি।
কথাগুলো বলে একটু দম নেয় শহর। অভিমানের সুরে বলে ওঠে,
-এদ্দিন পর তর বাজানের কথা মনে হইল?
-বাজান! আপনেরে দেহার লাইগা আমার মোনডা সপ সুমায়ই পুড়ে! মা’রে কত কই আপনের কথা! হ্যায় তো লইয়া আহে না।
শহর বিরবির করে বলে,
-ক্যান তরে এইহানে তর মা আইতে দেয় না, আমি ভালাই জানি রে বাপ!
করিমের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলায় শহর।
-তর লেহা-পড়া ক্যামুন চলতাছে?
-ছেপাড়া পেরাই শ্যাষ কইরা ফালাইছি বাজান।
-সত্যই?
-হ বাজান! করিম যেন একটু লজ্জা পেয়ে যায়।
-কুল হুয়াল্লাহর ছুড়াডা এট্টু হুনা তো বাপ?
করিম সুর করে সুরা পড়ে। কী চিকন, আর মিষ্টি পোলাডার গলা! মনে মনে খুব সন্তুষ্ট হয় শহর। চোখ বুজে ছেলের কুরআন তেলোয়াত শুনে।
করিমন দড়জার ওপাশে দাঁড়িয়ে বাপ-ছেলের মিলন দেখে, আঁচলে চোখের জল মুছে।
-ও করিম! অহন আয় বাজান! দুগগা ভাত খাইয়া ল। হের পর হারা রাইত বাজানের লগে গল্প করিস।
করিমনের কন্ঠ শুনে চোখের পাতা কেঁপে ওঠে শহরের।
-বউ! পোলাডা এদ্দিন পরে আইলো, থাহুক না আর খানিক?
-এহন থাইকা ও এইহানেই থাকবো। সামনে অনেক সুমায় পাইবেন অরে কাছে রাহনের।
শহর করমনের কথার পিঠে কি বলবে ভেবে পায় না।
-ক্যান? অয় আর হেপেজি পড়ব না?
-না, পড়ব না। গরীব মাইনষের ঘরে জন্ম নিছে, এত লেহা-পড়া কইরা কি অইব?
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে করিমন। জানালা গলে ফ্যালফ্যাল করে ভরা পূর্নিমার চাঁদটার দিকে তাঁকায় শহর। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তাঁর।
-বউ! দ্যাখছস কী সোন্দর চাঁন ওঠছে? দুইন্যাডা ভেস্তের লাহান লাগতাছে!
করিমন অবাক হয়, আঁচলে চোখ মুছে।
-আমারে এট্টু দরিয়ার পাড়ে লইয়া যাইবি? আমার খুব যাইতে মন চাইতাছে। বুকডা ভইরা এট্টু তাজা বাতাস টানতে ইচ্ছা করতাছে!
করিমনের কান্না আরও বেড়ে যায়। পাঁচ বছর বয়সী করিম বুঝে উঠতে পারে না, এখন তার কী করা উচিত। বড়দের অনেক কিছুই সে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না।
—————-
শহর করিমনের ঘাড়ে ভর দিয়ে হাঁটছে কীর্তিনাশার পাড় ধরে। চুপচাপ পিছুপিছু হাঁটছে করিম। চাঁদের আলোয় যেন ভিজে যাচ্ছে ওদের শরীর, ধুয়ে যাচ্ছে বুঝি সকল দুঃখ-কষ্টরাজি।
৩.
-শহর? শহর আলী বাড়িতে আছস?
দড়জার বাইরে থেকে ঘরের ভিতরে উঁকি দেয় শফি। হাতের মুঠোয় আলতো করে ধরে তাঁর রাখা চার বছর বয়সী মেয়ে, শরিফা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। শহর আলী বালিশে হেলান দিয়ে উঠে বসতে বসতে বলে,
-শফি তুই? ঘরের ভিতরে আয়?
অনেক দিন পর পুরোনো বন্ধু, শফিকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শহরের মুখ।
-গেরামে কবে আইলি?
-কাইলকা আইছি।
শফি কোলে করে মেয়েকে চোকির উপরে বসায়। নিজে এক পাশে বসতে বসতে বলে-
-তুই আছস ক্যামুন শহর?
শহর মৃদু হাসে।
-আমি তগো দুয়ায় ভালাই আছি।
ধীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে শহর।
-এই পরীর লাহান মাইয়াডা কি তর? কি নাম রাখছস?
মেয়ের প্রশংসা শুনে শফির বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। আনন্দ গোপন করার চেষ্টা করে মেয়েকে বলে,
-আম্মা, চাচারে সালাম করেন।
শরিফা শহরের পায়ে দুইবার হাত ছুঁয়ে শব্দ করে নিজের হাতে চুমু খায়।
-আল্লাহ বাঁচাইয়া রাহুক। আল্লাহ বাঁচাইয়া রাহুক।
ছোট মানুষটার ব্যবহার দেখে শহরের খুব ভালো লাগে।
-বাহ! তর মাইয়াডা তো খুব লক্কি!
শরিফার মাথায় হাত বুলায় শহর।
-কী নাম তুমার মা?
-শ-রি-ই-ফা
-খুব সোন্দর নাম মা!
শফি ঝেড়ে কাশে।
-ভাবীসাবরে তো দ্যাখতাছি না! তর পোলাডা কই?
-করিমন সহালেই কামে বাইর অইছে। করিম অর লগেই গ্যাছে।
-ওহ!
শফি কিছুক্ষন চুপ থাকে। মনে মনে কথা সাজায়।
শহর জিজ্ঞাসা করে,
-ঢাহায় তর ব্যবসা-পাতি ক্যামুন চলতাছে?
-ব্যপসা-পাতি তো ভালাই। তয় আর ভালা লাগে না। ভাবতাছি দ্যাশে মাছের ব্যপসা শুরু করুম।
-কস কি? ভালাইতো!
-হ! হের লাইগাই তো তর কাছে আইলাম।
শহর শব্দ করে হেসে ওঠে। শফি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
-কিরে শহর হাসস ক্যা? ভুল কিছু কয়া ফালাইছি নিকি রে?
শহর হাসি থামিয়ে মন মরা হয়ে যায়।
-আমি তো অচল মানুষ! তরে ক্যামনে সাহায্য করুম?
শফির গলা চড়ে যায়।
-হারাদিন বিছনায় হুইয়া থাকলে তো অচল হবিই। এট্টা পাও নাই, তয় কি অয়ছে? দুইডা হাত আছে না? আর মাইনষে কাম করে না?
শহর হা-করে শফির মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকে।
-হোন! আমার কাছে যে ট্যাহা আছে, তা দিয়া তিনডা টলার কিনন যাইবো। কাজিরহাটে এট্টা আড়ত খুলুম। তুই ক্যাশে বইবি। পেত্তেক টলার থাইকা মাছ বুইঝা লবি। আমি ঢাহায় চালান লইয়া যামু।
এটুকু বলে শফি একটু থামে।
-ছোডো বেলা থন তো তরে আমি চিনি শহর! তুই পারবি। ঠিকই পারবি।
তুই পারবি! কথাটা শহরের মনে দাগ কাটে। নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করে সে,
-কিরে শহর? পারবি না? তরে তো পাড়তেই অইবো। রাজী অয়া যা শহর! আর কয় দিন মাইনষের ঘাড়ে বুঝা হয়া থাকবি?
শহরের মনে জিদ চেপে বসে। দৃঢ় কন্ঠে শফিকে বলে,
-হ শফি, আমি পারুম! আমি পারুম!
শফি হাসে। খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর।
-তাইলে কথা ইডাই রইল শহর। যা লাভ লস অইবো চাইর ভাগের এক ভাগ তর।
-হেইডা নিয়া আমি ভাবি নারে শফি।
-তাও সব খোলাসা কইরা কওন ভালা। আর হোন! ব্যপসাডা এট্টু দাঁড়ায়া গেলে তরে ঢাহায় লইয়া নহল পাও লাগাইয়া আনুম। কত মানুষ বাঁচতাছে নহল পা লইয়া।
শহরের কানে বার বার অনুরিত হয় শফির কথাটা,
-কত মানুষ বাঁচতাছে নহল পা লইয়া, নহল পা লইয়া……
৪.
-রসুল নেপালগো টলারের মাছগুলা ঠিকমত গনছস তো?
-জ্বে চাচা।
-আইজকা কয়ডা মাছ উঠছেরে?
-চারশ ছয় চল্লিশটা হইছে, চল্লিশটার দাম ধইরা দেন।
শহর নেপালের দিকে তাঁকিয়ে হাসে-
-মাচ তো আইজকা ভালাই পাইছস রে নেপাল?
নেপাল বোকার মত হাসে।
-ব্যাক মা লক্কির ইচ্ছা জ্যাডা! কাইলকা রাইতে জাল পাতনের সুমায় মা মনে অয় খুশি ছিলেন।
শহর ক্যাশ থেকে টাকা গুনতে গুনতে বলে,
-তর পোলাডা ঠিকমত স্কুলে যায় রে?
-না জ্যাডা! কত মারি! হ্যার মায়ও মারে, তাও যায় না! জাইলার ব্যাটা জাইলা অইবো আর কি!
-অত মারনের কামডা কি? বুঝায়া শুনায়া কইলেই তো অয়? অরে আমার কাছে লইয়া আহিছ।
-জ্বে আচ্ছা!
-নে টাহাডা ভালা কইরা গুইনা ল। ব্যবাকটিরে ঠিক মত ভাগ কইরা দিস।
-জ্বে জ্যাডা!
নেপাল চলে যায়। নেপালের চলে যাওয়া পথের দিকে উদাস হয়ে তাঁকিয়ে থাকে শহর। পশ্চিম আকাশে আধখান সূর্য মাটির কাছাকাছি যাবো যাবো করছে। শহর আলী স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। বিরবির করে বলে,
-দ্যাকতে দ্যাকতে বার তেরডা বছর ক্যামনে চইলা গেলগা?
————–
এই ক’বছরে শফির মাছের ব্যবসটা ফুলে ফেপে উঠেছে। তিনটা ট্রলার থেকে আটটা ট্রলার হয়েছে। কাজিরহাটে একটা চালের আড়ত খুলেছে শফি। বয়স হয়ে গেছে। মাছের চালান নিয়া রোজ ঢাকায় যাওয়া আসা জানে আর কুলায় না শফির। তাঁর হয়ে এখন করিম মাছের চালান নিয়ে ঢাকায় যায়। ছেলেটাকে অনেক স্নেহ করে শফি। শক্ত সামর্থ্য শরীর। বাপের মতই দিন রাত পরিশ্রম করতে পারে। শফির কোনো ছেলে নাই, একটাই মেয়ে শরিফা। দেখতে দেখতে চোখের সামনেই বড় হয়ে গেল মেয়েটা। মেয়েটার দিকে তাঁকালেই নিজের পড়তি বয়সের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। একটা ভালো দেখে ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবে মেয়ের। কিন্তু কল্কি অবতারের এই যুগে ভালো ছেলে পাবে কোথায়? করিমকে খুব পছন্দ শফির। মাঝে মাঝে মনে করে শহরকে বলবে,
-ও শহর! তর পোলাডারে আমারে দিয়া দে!
কিন্তু সাহস হয় না শফির। পাছে কি আবার মনে করে বসে শহর। এমনিতেই অনেক ঋণী তাঁর কাছে। শফির আজকের এই বিষয়-আসয়ের পিছনে শহরের অবদানই সবচেয়ে বেশি। ব্যবসা শুরুর দিকে তাঁর আপন ভাই, মন্তাজ ব্যাপারী পদে পদে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। প্রথম কয়েক বছর লোকসান দেখে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চেয়েছিল শফি। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যবসাটা ধরে রেখেছিল শহর।
৫.
প্রতি বছর অগ্রহায়নের পনের তারিখ কাজিরহাটের অশথ তলায় মেলা বসে। মেলা চলে পনের দিন। এই পনের দিন এক মিনিটের জন্যও যেন ঘুমোয় না কাজিরহাট। রাতভর চলে যাত্রাপালা, সার্কাস আর পুতুল নাচের আসর। এই সময় কৃষকের গোলায় থাকে নতুন ধান, পকেটে কাঁচা টাকা। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। এটা ওটা কেনে। ছেলে বুড়ো সবার মুখেই হাসি লেগে থাকে। অগ্রহায়নের ত্রিশ তারিখ আজ। মেলা আজ ভাঙবে। তাই মানুষের ভীড় আর কোলাহল আজকে যেন একটু বেশিই।
-শরিফা মা তুই? এই ভর দুপুর বেলা কোনহান থে আইলি?
শরিফাকে দেখে মুখে হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ে শহরের।
-স্লামালাইকুম চাচা। বাড়িত থাইকা আইলাম।
-দাঁড়ায়া আছস ক্যা? আয় বয়।
শহর হাঁক ছেড়ে রসুলকে ডাকে।
-রসুল কই গেলিগা? বেঞ্চিডা এট্টু পুইছা দে। নাহ! কামের সুমায় কাউরে ঠিক মত পাওন যায় না।
বিরক্তি নিয়ে কথা শেষ করে শহর।
রসুল শরিফাকে দেখে দৌড়ে আসে।
-শরিফা বু! তুমি কুন সুম আইলা?
মাথায় বাঁধা গামছাটা খুলে বেঞ্চ মুছতে মুছতে বলে,
-বহ বু।
-নারে! আজকে বমুনা।
শরিফা করিমের খোঁজে এদিক ওদিক তাঁকায়।
-চাচা করিম ভাইজান কই? হ্যারে তো দ্যাকতাছি না?
-করিম তো সহালে চালান লইয়া ঢাহা গেল।
শরিফা মুখটা কালো করে ফেলে।
-হ্যায় তো আইজকা আমারে ম্যালা ঘুরাইয়া দ্যাহাইবো কইছিল।
-করিম আমারে কিছু তো কইলো না। তাইলে আমি রসুলরে পাডাইতাম।
কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করে শহর।
শরিফা চুপ করে বেঞ্চিতে বসে পড়ে।
-মারে! তুই মন খারাপ করিস না। তর মুখটা কালা দ্যাকলে আমার খুব অস্থির লাগে।
শহর কি করবে ভেবে পায় বা। অস্বস্তিবোধ করে।
-ওমা! তর বুইড়া পোলাডার লগে যাবি ম্যালায়?
শরিফা ফিক করে হেসে দেয়।
-চলেন চাচা। তয় ভাইজানের উচিত বিচার করন লাগবো কিন্তু?
শহর হাসে।
-আইচ্ছা ঠিক আছে।
——————–
-চাচা! ওই চুড়িগুলা খুব সোন্দর না?
-হ মা! তুই কিনবি।
-কিনুম।
-চলেক যাই।
দুই জন কাঁচের চুড়ির দোকানগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়।
শরিফা কয়েক গোছা চুড়ি দেখিয়ে দোকানী মহিলাকে পড়িয়ে দিতে বলে। শহর ভয় পায়। কাঁচের চুড়ি সাবধানে না পড়ালে ভেঙে আবার হাতে না রক্তারক্তি কান্ড হয়ে বসে। শহর দোকানীকে বলে,
-এই মাতারি! চুড়ি কিন্তুক সাবধানে পড়াইবা। দেইখো হাত জানি কাটে না।
দুই হাতে চুড়ি পড়ানো হলে, শরিফা বলে ওঠে,
-আমি চুড়ির সাথে মিলাইয়া টিপ কিনুম।
শহর হাসে।
-কেনেক মা।
শরিফা সবুজ টিপ পড়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নেয়। তারপর শহরের সামনে দুই হাত বাড়িয়ে ধরে বলে,
-চাচা, সব ঠিক আছে না?
-মা, তরে পরীর লাহান সোন্দর লাগতাছে!
শরিফা লজ্জা পায়।
-আপনে তো সব সুমায়ই আমারে পরীর লাহান সোন্দর কন?
-ঠিকইতো আছে। তুই তো আমাগো পরীই।
শহর ভাবে,
-মাইয়াডা চোহের সামনেই হটাৎ বড় হয়া গেল। ঐদিনকার ছোড শরিফা। গাঁয়ের রঙ এক্কেবারে কাঁচা সোনার লাহান হইছে। মুহে সারাক্ষন হাসি লাইগাই থাহে। ওরে এইবার বিয়া দ্যাওন লাগবো। কথাডা শফিরে কওন দরকার।
শফির কথা মনে হতেই বিরক্ত হয় শহর।
-সব কিছুতেই উদাস থাহস ভালা কথা, মাইয়াডার বয়স চইলা যাইতাছে এইডাও দেহস না?
শহর বিরবির করে বলে,
-ভালা ঘর দেইহা রাজপুত্রের লাহান পোলা আনুম তর লাইগা!
-চাচা চলেন যাই।
শরিফার ডাকে সম্বিয়ত ফিরে পায় শহর। শরিফা শহরের পাশে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে।
-মা, কিছু খাবি না?
শরিফা হাসে।
-বিপিন ঘোষের দোহানের জিলাপী খামু চাচা।
-চল যাই। যাওয়ার পথে তর বাপেরেও সাথে লইয়া যামুনে।
বি. দ্র. চতুরে বারোয়ারি উপন্যাসের অংশ হিসেবে অনেক আগে এটা লিখেছিলাম, শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটি আর এগোয় নি। কিছুটা সম্পাদনা করে তাই সামুতে শেয়ার করলাম