“যে চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পাকিস্তানি সেনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, একদিন তিনি এলেন। সব কিছু জেনেও আমি তার পা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘কাকাবাবু, আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। ছোট্টবেলা থেকে আপনি আমাকে চেনেন। আপনার মেয়ে সুলতানার সঙ্গে আমি একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, স্কুলে পড়েছি। আমাকে দয়া করুন'।
উনি পা ঝাড়া দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
প্রথমে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে একজন বাঙালি। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেয়া হত না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন একটা মেয়ে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি বাড়ি যেতে পারিনি, রীরাঙ্গনা পূর্নবাসন কেন্দ্রে থেকে গেছি।
বাবাকে দেখবার জন্য, তাদের খবর নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে দেখি না যাঁকে অনুরোধ করা যায়। শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহি অফিসারকে বাবার ঠিকানা দিলাম। পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেনো খবর পেয়েই বাবা ছুটে আসবেন। কিন্তু না দিন গড়িয়ে সপ্তাহ গেল। খবর পেলাম বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে সে সব মেরামত করা নিয়ে বাবা ব্যস্ত, আসবেন কয়েক দিনের মধ্যে। শুধু উচ্চারণ করলাম,‘বাবা তুমিও’!
ইত্যবসরে আমার গর্ভপাত করানো হলো, কারণ এতদিনে বাস্তবতা বুঝে গেছি।
নিয়েলের ভালবাসা, স্নেহ, মমতা আমার অতীতকাল মুছে ফেললো। তারা ব্যানার্জী থেকে আমি হলাম মিসেস টি নিয়েলসন ।
স্বদেশে আমার সত্যিকার পরিচয় নেই, তারা ব্যানার্জী মরে গেছে ... আমি কোথায়? ওদের কাছে আমি ঘৃণ্য, নিন্দিত, মৃত।
দেশে সম্মান মর্যাদা যা পেয়েছি মিসেস টি নিয়েলসন আর টমাসের মা হিসাবে।
জন্ম দিলে জননী হওয়া যায় কিন্তু লালন পালন না করলে মা হওয়া যায় না। আমি জন্মেছিলাম সোনার বাঙলায়, লালিত হচ্ছি ডেনমার্কের ভূমিতে। তবুও সেই মাটিতেই হবে আমার শেষ শয্যা...।১
নারী জীবনের এই অসহনীয় ঘটনাগুলি প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটে তবে মুক্তি যুদ্ধের সময় তা আরও বেশি স্পষ্ট হয়েছে।যুদ্ধের সময় নারীদেরকে ক্যাম্পে কোন শাড়ী বা দোপাট্টা পরতে দেয়া হয়নি তার কারন নারীরা আত্নহত্যা করত। তালাশ এ মরিয়মের সাক্ষাতকার দাতা মরিয়মের কথা শুনে একটু অবাই হয়েছিলেন যে ‘মরিয়মের শরীরে নাকি শাড়ী ছিল কিন্তু সে আত্নহত্যা করেনি’২ অর্থ্যাৎ আমাদের সমাজকে সে অবাক করেছে কারন ঐ সময় অনেক নারী আত্নহত্যা করেছিল।কিন্তু সে? অথ্যাৎ সমাজের স্বভাবিক ভাবনা হচ্ছে বীরঙ্গনা নারী বেঁচে থাকবেনা।সে না মরলেও সমাজ তাকে মেরে ফেলবে।
ভাষা চৈতন্যকে প্রভাবিত করে।চৈতন্য ও ভাষা হচ্ছে পরস্পরের পূর্বশর্ত।অর্থ্যাৎ, চৈতন্যও (ভাষার মতনই) সামাজিক।ভাষার মাধ্যমেই যত ভব ভিন্ন চিন্তা বের হয়ে আসে ভেতর থেকে।ভাষা নারী এবং পুরুষের জন্য সমান নয়। ভাষাকে যদি একটা কাঠামোগত ব্যবস্থা হিসেবে গন্য করা হয় তাতে যেমন বৈষম্য বিরাজমান তেমনি একে যদি কাঠামোর বাইরের বাস্তবতার সাথে যুক্ত করা হয় সেক্ষেত্রেও বৈষম্যের বিষয়টি সমান সত্য। ভাষাগত এই বৈষম্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে।
সমাজে একজন পুরুষ ভিত্তিকাঠামো এবং সমাজের উপরি কাঠামো সব স্থানেই প্রধান হিসেবে বিচরণ করে সর্বত্র। পরিবারের প্রধান, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনের প্রধান, পুরুষের আছে ক্ষমতার জোর।শুধুমাত্র যে অবস্থানের ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের তুলনায় নিচে রাখা হয় তা না পুরুষের ভাষা ও নারীর ভাষাও ভিন্ন।ভাষার ভিন্ন ব্যবহার ভিন্ন চিন্তা নিয়ে সমাজের নারী ও পুরুষের বৈষম্য, এবং লিঙ্গ-বর্ন-ক্ষমতা ব্রবহার নিয়ে স্পষ্ট আলোকপাতের প্রয়াসেই এই প্রবন্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছি।
সমাজে নারী বিনির্মাণ: ভাষিক আধিপত্য, পরিবেশনের মুলমন্ত্র
সাধারনত, ব্যাপক অর্থে আমরা ভাষা বলতে যোগাযোগের একটি মাধ্যম বুঝি, যেটি সকল মনুষ্য জনগোষ্ঠী দ্বারা অনুশিলীত। মার্ক্সের ভাষায়, ভাষা, চৈতন্যের মত, এটি উদ্ভূত হয় প্রয়োজনে, অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগের তাগিদে। আর যোগাযোগের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ভাষা এবং তার সঠিক অর্থ উৎপাদন। সস্যুঘ বলেন, “ভাষা হচ্ছে একটি চিহ্ন ব্যবস্থা”(Language is a system of signs)উচ্চারিত শব্দ, ইমেজ, লিখিত শব্দ, চিত্রকলা, আলোকচিত্র ইত্যাদি ভাষার ভিতরে চিহ্ন হিসেবে কেবলমাত্র তখনই কাজ করে যখন সেগুলো চিন্তা প্রকাশ করে, কিংবা যোগাযোগ স্থাপন করে। যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সেগুলৌর হতে হবে প্রথানির্ভর ব্যবস্থার অংশ; কোন বস্তুও চিহ্ন হতে পারে, অর্থ সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, স্টুয়ার্ট হল তার একটি উদাহরনে বুঝিয়েছেন লাল, সবুজ, হলুদ রং এর বাতি দ্বারা রাস্তায় ‘থামুন’ ‘চলুন’ অর্থ প্রকাশ করে।৩
সাপির ১৯২০ দশকে একটি ধারণা বিস্তৃত করেন- ভাষা বাস্তবতার উপলব্ধিকে আকৃতি দান করে।‘সাফির-হুরফ হাইপোথিসিস’ প্রস্তাব করে যে, একটি ভাষার শব্দ ভান্ডার সেই সংস্কৃতির বোধগত বা কগনিটিভ বর্ণসমুহকে সংকেতাবদ্ধ করে(আমার উজ্জল-শ্যামলা মেয়ে পছন্দ, খুব বেশি ফর্সা ভাল লাগেনা)।অবার, ভাষার ব্যাকরণগত কাঠামো বোধগত বা কগনিটিভ বর্গ ও যৌক্তিক সম্পর্ক আত্নীকরন করে যা মানুষের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার উপলব্ধিকে সংগঠিত করে।(কিন্তু আপনি তো কালো, বাচ্চারা কালো হবে)। তবে এই ভাবনা ও বাস্তবতা সমাজভেদে ভিন্ন হয় এ কারনে এটি আপেক্ষিক।তাইতো সাপির-হুরফ হাইপোথিসিস মতে যে কোন নির্দ্রিষ্ট ভাষা কাঠামো সেই ভাষাভাষীদের ভাবনাকে প্রভাবিত করে।৪
পরিবেশনের মধ্যদিয়ে পরিবেশিত, নির্মিত সত্তার কিছু বাঁধা গৎকেই তুলে আনা হয়।গৎবাঁধা নির্মানের মধ্য দিয়ে সত্তার অনিবার্যকরন, সীমায়িতকরণ(reduction), স্বাভাবিকীকরন ঘটে থাকে। স্টুয়ার্ট হলের মতে গৎবাঁধা ধরন হলো ব্যাক্তি(বা বস্তু বা ঘটনা) সম্পর্কিত সরল, বিস্তৃত, স্মরণযোগ্য, সহজযোগ্য এবং ব্যাপক স্বীকৃত বৈশিষ্ট্যসমুহ, যার দ্বারা ঐ ব্যাক্তির সরল কিছুকে ব্যাখ্যা করা হয়।আবার গৎবাঁধা নির্মানের মধ্য দিয়ে যেমন নির্মিতকে শাশ্বত সত্তায় বেধে দেয়া হয় তেমনি, সামাজিকদেখাদেখির ক্ষেত্রে যখন বাঁধা গৎ একটু একটু করে বদলায় তখন পরিবেশনের ক্ষেত্রেও তার তার ঢেউ লাগে।৫
কতক গ্রামে নিম্নবিত্ত পরিবারে প্রচলিত আছে “ভাত ভাতারে৬ দেয়না গতরে দেয়”।
পরিবেশন বুঝতে গেলে মিশেল ফুকোর কিছু বিষয় আনা প্রয়োজন। ফুকোর মনোযোগ বদল ঘটেছিল ভাষা হতে ডিসকোর্স বিষয়ে, তিনি পরিবেশনের ব্যবস্থা হিসেবে ভাষাকে নয়, ডিসকোর্সকে দেখেছেন। ডিসকোর্স বলতে ফুকো বুঝিয়েছেন একসারি বক্তব্যকে যা একটা নির্দ্রিষ্ট ঐতিহাসিক মূহুর্তে কোনো একটা নির্দ্রিষ্ট বিষয় সম্পর্কে বলতে ভাষার যোগান দেয়-এ নির্দ্রিষ্টতা সম্বন্ধীয় জ্ঞান পরিবেশনের একটা পথ দেখায়।
মানুষ ভাষার মাধ্যমে শুধু তার মনের ভাব প্রকাশই করে না, অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। আবার এই ভাষার দ্বারাই সে তার সৃজনশীল ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত। দেশে দেশে ভাষার যেমন পার্থক্য দেখা যায়, তেমনি নারী-পুরুষেও ভাষাগত পার্থক্য বিদ্যমান। ভাষা মানুষের অর্থ-সমাজ-বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়। সমাজে আমরা যেভাবে নারীকে মূল্যায়ন করে থাকি, আমাদের ভাষাতেও তার প্রতিচ্ছবি পরিলক্ষিত হয়। নারীর জন্য অবলা, কোমল, নরম, লজ্জাবতী—এসব শব্দ তৈরি করা হয়, অন্যদিকে পুরুষকে পৌরুষত্বের বীরগাথায় বীর বা শক্তিমানের কাতারে রেখে নারীকে রাঁধুনি, গৃহিণী আখ্যা দিয়ে গৃহবন্দী করে রাখি আমরা—আমাদের বাংলা ভাষায়। আমাদের ভাষার ভাব, শব্দ, ধ্বনি, অর্থ প্রভৃতি গড়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্র ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দ্বারা। আমাদের সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পুরুষ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পুরুষ, আধিপত্য বিস্তার করে পুরুষ, উপভোগ করে পুরুষ, মালিকানা বা স্বত্ব পুরুষের—এ সমাজ পুরুষের ক্ষমতায়নকেই প্রাধান্য দেয়। নারী পায় শুধু অবহেলা-অমর্যাদা; তাই নারীর জন্য সমাজ যেন পৃথক ও দুর্বল ভাষাভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছে। আবার আমাদের সমাজে নারীর পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলেই তার ধ্বনিগত বা বাকস্বাধীনতাও নেই।৭
আবার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কোন পণ্যের বাজারজাত করনের প্রযোজনে বিজ্ঞাপনে বেশিরভাগ সময় নারীকে দেখা যায়। যখন দেখি আন্তর্জাতিক মানের দামি দামি গাড়ী গুলর প্রদর্শনী চলে তখন প্রতিটি গাড়ীর সাথে সুন্দরী নারীকে দেখা যায় তখন মনে হয় গাড়ী নয় যেন নারীটির শরীরটাই প্রদর্শন করা হচ্ছে। গাড়ীর পাশে যেন নারীকেই মানায়। নারী যেন একজন নারী নয় সে যেন পণ্য। সেখানে কিন্তু সাধারনত কোন পুরূষকে ইপস্থিত করা হয়না, যদি হয়ওবা সেই নারীটি যেন গাড়ীটির সাথে সাথে পুরুষটিরও বন্দনা করে।এখানে লিঙ্গীয় বৈষম্য অনেক বেশি কাজ করে এবং একে সামাজিক বাস্তবতা ও অবস্থানের সাথে যুক্ত করে দেখলেই কেবল নারীর জন্য পুরূষালী ব্যবস্থার অবদমনমূলক চেহারাটা ফুটে ওঠে।
“বেটা ছেলে, ছেলে মানুষ এবং মেয়ে ছেলে, মেয়ে মানুষ” এখানে শাব্দিক অর্থের৮ চেয়ে ভাবার্থ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে ‘বেটা’ দ্বারা পুরুষের সাহসকিতা বোঝাচ্ছে সেখানে ‘মেয়ে’ দ্বারা নারীর অসহায়ত্ব ও দূর্বলতা প্রকাশ করছে। ভাষার মূল কথাই হল এর বৈচিত্র্য, দেশ কাল-পাত্রভেদে ভাষার এ বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এই বৈচিত্র্য যেমন একটি ভাষার সাথে অন্য ভাষার, তেমনি একটি ভাষার এক অঞ্চলের সাথে আরেক অঞ্চলের, এক সামাজিক শ্রেণীর সাথে অন্য সামাজিক শ্রেণীর, এক লিঙ্গের সাথে অন্য লিঙ্গের। এগুলোকে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ভেদরূপ বলা হয়। এসব ভেদরূপগুলোর মধ্যে লিঙ্গ অন্যতম একটি প্রধান ভেদরূপ হিসেবে বিবেচিত। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভাষা নারী-পুরুষের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।
নারীর ভাষা পুরুষের চেয়ে পৃথক হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ দায়ী। প্রথমত শারীরিক ভিন্নতার কারণে নারী পুরুষের ভাষায় র্পাথক্য থাকার বিষয়টি অনেকটা বিশ্বজনীন। কেননা নারী পুরুষের বাক্-প্রত্যঙ্গের ভিন্নতার জন্য নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বরের মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। নারীরা যখন কথা বলে তখন তাদের কণ্ঠস্বর চিকন হয়। অন্যদিকে পুরুষের কন্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত মোটা।
নারীর মন মানসিকতা কোমল এবং নম্র থাকায় সমাজে তাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মনোভাব লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে আদেশ দেয়া এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ায় প্রবনতা বেশি থাকে। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির এই মানসিকতা নারীর ভাষাকে পুরুষ থেকে পৃথক করেছে।
নারী-পুরুষের ভাষাভেদ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সামাজিক বিধি নিষেধ। সামাজিক বিধি নিষেধের কারণে নারীরা সকল শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। কিন্তু পুরুষের দ্বারা সকল শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক সমাজ পুরুষ-শাসিত। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এর প্রভাব বেশি, বাঙালি সমাজে পুরুষদের কর্তা অর্থাৎ সমাজের মাথা ধরা হয়। এর প্রতিফলন ঘটছে শব্দ ও রূপমূলে। পুরুষশাসিত সমাজ ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নারী পুরুষের ভাষাভেদ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। শিক্ষার অভাব, ধর্মের প্রভাব, রক্ষণশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি কারণে নারী পিছিয়ে আছে। ভাষা যেমন ভাবপ্রকাশের মাধ্যম, তেমনি কখনো নির্যাতনের মাধ্যম হয়েও দাঁড়ায়। পুরুষ নারীকে নানাভাবে নির্যাতন করে থাকে, এমনকি শুধু ভাষা দিয়েও নির্যাতন করে থাকে। কবির ভাষায়—‘হাতে যদি না মারিত, শত মারিত ঠোঁটে’।
আজ নারীকে কেবল পেশিশক্তি দিয়েই নয়, ভাষাশক্তি দিয়েও অসম্মানিত এমনকি লাঞ্ছিতও করা হয়। পুরুষ তার পৌরুষত্বের প্রকাশ কেবল শারীরিক নির্যাতন দিয়েই নয়, ভাষাকে আশ্রয় করে মানসিক নির্যাতনও করে থাকে যা ‘ভারবাল এবিউজ’ বা মৌখিক নির্যাতন নামে পরিচিত। ‘ইভটিজিং’ নামে নারীকে ‘উত্ত্যক্ত’ করার এবং বিরক্ত করার পারিভাষিক শব্দ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। আমরা বাংলা ভাষায় পুরুষকে ‘উত্ত্যক্ত’ করতে দেখি, আর নারী ‘উত্ত্যক্ত’ হয়। বাংলা ভাষায় নারী কর্তৃক পুরুষকে বিরক্ত করার কোনো শব্দ নেই কিন্তু পুরুষ যে নারীকে বিরক্ত করে তার জন্য সমাজ তৈরি করেছে অসংখ্য শব্দ, খণ্ডবাক্য।
সম্ভবত বাংলাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা (ভারতীয় আর কয়েকটি ভাষা ছাড়া) যেখানে সীতার সতীত্ব পরীক্ষা থেকে নারীর জন্য জন্ম নিয়েছে সবচেয়ে অসম্মানকর শব্দ, শব্দসমূহ। অর্থাত্ আমাদের সমাজ সৃষ্টি করেছে ভাষায় এমন কিছু শব্দ যা নারীকে বেঁধে দিয়েছে লজ্জা আর অসম্মানের দড়িতে। পুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজে পুরুষ নারীর জন্য শুধু শব্দ তৈরিই করে না, তাকে মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিতও করে।
পুরুষ শুধু নারীকেই নয়, তার ভাষাও নিয়ন্ত্রিত করছে। শুধু কথাই বলে না, দেহভাষা বা অঙ্গভঙ্গি করে (সাইন ল্যাংগুয়েজ প্রয়োগ করে) কিছু একটা প্রকাশ করতে চায়। আমাদের সমাজে যেসব পুরুষ স্ত্রীর কথামতো চলে, তাদের বলে ‘স্ত্রৈণ’। এ শব্দটি প্রয়োগ হয় পুরুষের জন্য নেতিবাচক বা অসম্মানজনক হিসেবে। যেন নারীর কথা পুরুষের শুনতে মানা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহূত বেশ কিছু শব্দ আলোচনা করলে দেখতে পাব চেয়ারম্যান, সভাপতি, রাষ্ট্রপতি, মেম্বার, লিডার, ক্যাডার—এগুলো সব পুরুষবাচক শব্দ। এর কোনো স্ত্রীবাচক প্রতিশব্দ নেই। জেন্ডার বৈষম্য নিরোধকল্পে একালে আমরা ‘চেয়ারপারসন’, ‘সভাপ্রধান’ প্রয়োগ করে থাকি। এভাবেই একটি সমাজের সম্মিলিত চেষ্টায় তার ভাষার শব্দাবলিও বদলে দেওয়া সম্ভব। সম্ভব নারীকে সম্মানিত করা। বাংলা ভাষার গবেষক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলায় নারীর ভাষা’ প্রবন্ধে কিছু শব্দের উল্লেখ করেছেন যা থেকে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়—যেমন: অনাছিষ্টি, লক্ষ্মীছাড়া, আটকুঁড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কটুনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, বেহায়া, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, সোমত্ত, সোহাগ, সই ইত্যাদি। নারীর ক্ষেত্রে বাংলায় বিশেষ্য বাক্যাংশ এবং ক্রিয়া বাক্যাংশ প্রয়োগে কিছু স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন— বিশেষ্য বাক্যাংশ—কাঁচা বয়েস, কচি খুকি, কোলের ছেলে, চোখের বালি, দাঁতে বিষ, ননীর পুতুল, নাড়ির টান, পেটের ছেলে, মাথার দিব্যি, রাঙা বৌ, হাঁড়ির খবর, পাতা কুড়নী, ঝগড়াটে, সাতে পাঁচে না থাকা, সাত পাঁচ ভাবা ইত্যাদি।
ক্রিয়া বাক্যাংশ—ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা, বানের জলে ভেসে আসা, বিয়ের ফুল ফোটা, মুখে খই ফোটা, হাঁড়িতে স্থান দেয়া, কেঁদে হাট বসানো, সইপাতানো, পাকা চুলে সিঁদুর পরা, হাঁড়ি ঠেলা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, মাথা কোটা ইত্যাদি। বাংলা ভাষা ও নারী বিষয়ে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন জানান, ‘বাংলা ভাষার শব্দ প্রয়োগে ও সম্বোধনে নারীকে সম্মানিত তো নয়ই বরং হেয় করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় অজস্র শব্দ আছে, যা আবহমান কাল থেকে খুব অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
অভিধান খুললেই দেখা যাবে সেখানে পুরুষবাচক আর স্ত্রীবাচক শব্দের অর্থ উপস্থাপনার মধ্যে কত পার্থক্য। নারীর প্রতি মানবিক সম্মানবোধের ধারণাটি পর্যন্ত আমরা সমাজে স্থাপন করতে পারিনি। তাই জেন্ডার সমতার ভিত্তিতে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার মানসিকতাও আমাদের তৈরি হয়নি। তবে ক্ষীণ ধারায় হলেও চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে। তারা যদি বিষয়টিকে সচেতনভাবে আমাদের দেশের মানুষের সামনে নিয়ে আসে তবে পরিবর্তন দ্রুত হওয়া সম্ভব।’সুকুমার সেন বলেছিলেন—‘নারীর শব্দভান্ডার পুরুষের শব্দভান্ডার থেকে খুবই আলাদা। ৯
নারী পুরুষের তুলনায় অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে।’ শ্রেণীবিভক্ত সমাজে নারীকে ঘরে পুরুষের সেবায় আবদ্ধ করে রাখলে সেটাই স্বাভাবিক। তার কর্মজগত্ যেমন বৃদ্ধিতে পুরুষের উদ্যোগ-উত্সাহ কম, তেমনি নারীর শব্দের সীমানাও হয়ে পড়ে অনেক ছোট। নারীর যত ক্ষমতায়ন ঘটবে, উত্পাদন ও অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে, পুরুষের মতো বাইরের জগেক নিজের ভাবতে পারবে—আমাদের ভাষায় তত দ্রুত নারী-পুরুষের বৈষম্য কমে যাবে।
ভাষা যখন বৈষম্যময় আচরণ সম্পর্কে নীতিমালা কিংবা কার্যকারিতাকে ধারণ করে তখনই তাকে নারীবাদীরা যৌনবাদী ভাষা বলেন। যৌনবাদ শব্দটা বাংলায় ইদানীং ব্যবহৃত হলেও ইংরেজি ভাষায় ষাটের দশক হতে এর চল রয়েছে যা নারীর বিরুদ্ধে যায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চার সমালোচনামূলক বলাবলিকেই বোঝায়। এর সাথে প্রত্যয়গত এবং অর্থগত উভয়দিক দিয়েই বর্ণবাদের সম্পর্ক রয়েছে, মিল রয়েছে। ভাষার ভেতরকার সহস্র বছরের নারী দাসত্ব ঘোচেনি আজও।এক সময় নারী দাসত্বের রূপ বদল হয়েছে মাত্র। নারী শিশু জন্ম গ্রহন করলেই তাকে হয়ত মাটিতে জীবিত পুতে ফেলা হত অথবা পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হত। আবার ভারতে এক সময় আসল যে নারী শিশুকে জন্মের আগেই মেরে ফেলা হত।সমাজে নারী পুরুষের তুলনায় যে অধস্তন তা এই উদাহরণের মাধ্যমেও প্রমানিত।
এছাড়াও নারীর বাক্যরীতি অনেকটা রক্ষণশীল। নারীরা তাদের ভাব প্রকাশে রক্ষণশীল হয়ে থাকে এবং কম কথায় তারা তাদের ভাব প্রকাশ করে। বেশির ভাগ সময় ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকার কারণে তারা নতুন ভাষা গ্রহণ না করে পুরোনো ভাষা সংগঠনে পরে থাকে। যার ফলে নারীর ভাষায় পরিবর্তন দেখা যায় না। অন্যদিকে পুরুষেরা নতুন ভাষা সহজেই গ্রহণ করে এবং ভাষা পরিবর্তনে সহজে সাড়া দেয়। আর এ জন্যই নারীর ভাষা পুরুষের থেকে পৃথক হয়ে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধে নারী: অবদানের স্বীকৃতির স্বরূপ
পৃথিবীর ইতিহাসে এ যাবৎ দেশ, জাতি ও মানুষের মুক্তির জন্য যতগুলো যুদ্ধ লড়াই-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই নারীদের অংশগ্রহণ, অবদান, ত্যাগ ও দুর্ভোগ ছিল আলাদাভাবে আরেকটি ইতিহাস রচনার উপজীব্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ্য পুরুষের সাথে দুইলক্ষ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন হয় দেশটি। নারীরা পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা লাঞ্চিত হয়েছিল তার পাশাপাশি তারা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেছিল।
নারীর জীবনের সবথেকে যে জিনিসটি মূল্যবান বলে সমাজে প্রচলিত তা হচ্ছে নারীর সতীত্ত্ব। এই সতীত্ত্ব যদি নারীর চলে যায় তাহলে সে তার সবথেকে মূল্যবান সম্পদটিই হারালো।বাংলা একাডেমীর অভিধানে এভাবে অর্থগুলো করা; সতী: সাধ্বী, পবিত্রতা, স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে আসক্ত নয় এমন, হিন্দু পুরাণের দক্ষ কন্যা, শিবানী, স্বামীর মৃত্যুতে সহগামিনি স্ত্রী। সতিচ্ছেদ: কুমারী ঝিল্লি, যোনীমুখের পাতলা পর্দা। সতীত্ব: যৌন পবিত্রতা, সতী স্ত্রীর ধর্ম। সতী ধর্ম: স্বামীর প্রতি নারীর একনিষ্ঠতা বা যৌন পবিত্রতা। সতীপনা/ সতীগিরি: সতীত্বের ভুয়া গর্ব বা মিথ্যা ভড়ং।সতীত্ব তাহলে শুধুই নারীর বিষয়। সতীত্ব হলো যৌন পবিত্রতা, সোজা বাংলায় বললে একগামীতা, যা কেবল নারীর জন্যই অভিধানসিদ্ধ। কেননা পুরুষের জন্য সতীত্বের সমার্থক শব্দ আমি অন্তত ডিকশনারীতে খুঁজে পাইনি।
ধর্ষণ শব্দের অর্থ করা আছে পীড়ন, অত্যাচার, নির্যাতন। বলাৎকার, বলপূর্বক গ্রহণ। ধর্ষণী নামে একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যার অর্থ অসতী নারী। ধর্ষিত শব্দের অর্থ করা আছে উৎপীড়িত, অত্যাচারীত, পরাভূত, পরাজিত, অপমানিত, তিরস্কৃত আর ধর্ষিতা শব্দের অর্থ বলাৎকৃতা, বলপূর্বক সতীস্ব নষ্ট করা হয়েছে এমন। আবারও সেই একইভাবে দেখুন পাঠক, ধর্ষণ শব্দের অর্থ হিসেবে পীড়ন অত্যাচার নির্যাতন ও বলপূর্বক গ্রহণের কথা বলা থাকলেও ধর্ষণী নামের একটি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যার মানে করা আছে অসতী নারী। তারমানে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক ভাষার জগতে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে কাউকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে তার সতীত্ব চলে যায়। ওদিকে আরেকটি শব্দ পেলাম ধর্ষণীয় যার অর্থ ধর্ষণযোগ্য, ধর্ষণসাধ্য, নির্যাতন বা দলন করতে পারা যায় এমন। তারমানে ধর্ষণযোগ্য কিংবা ধর্ষণসাধ্য বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব যদি থাকে তাহলে আমাদের এটা মেনে নিতে হয় যে, খোদ অভিধান ধর্ষণকে অনুমোদন করে! ধর্ষণযোগ্য কিংবা ধর্ষণসাধ্য কোনোকিছুর অস্তিত্ব রেখে। হায়রে সতীত্ব! হায়! এখানে ধর্ষিত শব্দের অর্থ হিসেবে কোথাও সতীত্বের প্রশ্নটি না তোলা হলেও ধর্ষিতা বলতে সেই মেয়েটির কথাই বলা হয়েছে যার সতীত্ব হরণ করা হয়েছে বলপূর্বক। তারমানে নারীর সতীত্ব তার নিজের কাছে না, সতীত্ব বন্দী পুরুষতান্তিক ক্ষমতার সাথে। জোর করেও কাউকে ধর্ষণ করবে পুরুষ আর নাম দেবে অসতী। নারীকে গ্রহণ করতে হবে সেই উপাধি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় দুইলক্ষ নারী ধর্ষিত হয়েছিল পাক আর্মির হাতে।কতক নারীকে নিয়ে গন ধর্ষনের খেলা খেলে তাকে নৃসংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যদি মেরে ফেলত তাহলে তার জন্য ছিল আরও যন্ত্রনার সব উপহার।
পৃথিবীর সকল মুক্তিযুদ্ধ, লড়াই-সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরার মত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তো আমার নেই-ই, এই উপমহাদেশের এ ধরনের সকল ইতিহাস তুলে ধরার অভিজ্ঞতা এবং অবকাশও এখানে নেই। এই ছোট্ট পরিসরে আমরা যদি কেবল আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আলোকে উল্লিখিত দিকটির প্রতি আলোকপাত করি তাহলেই বা কি দেখতে পাই?
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যেকটি বই পড়েছি তার মধ্যে “আমি বীরঙ্গনা বলছি,” “তালাশ,” ও “নারীর একাত্তর” বই তিনটি পড়ে মনে হয়েছে যে মেয়েগুলোর সাক্ষাৎকার এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে তারা এতটাই নিগৃহিত হয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা যে তারা অনেকেই নিজেদেরকে জীবিত রাখতে চাইনি কিন্তু পরিস্থিতি তাদেরকে মরতেও দেয়নি আবার অনেকেই যুদ্ধের আগের পরিচয় যুদ্ধের পরে বহন করেনি সমাজের ভয়ে। অনেকেই মরনের কথা মুখেও আনেনি কারন তারা তো ইচ্ছ করে দোষ করেনি।অনেকেই সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে।অনেকেই পাকিস্তানি হানাদারদের মনের থোরাক জাগিয়েছে নিরবে দেশের জন্য, তার ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে।কত নারী যে তাদের অত্যাচারে মারা গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথে অনেক নারী পাকিস্তানিদের সাথে চলে গেছে ও দেশে কারন তারা জানতো এ সমাজ তাদেরকে মেনে নিতে চাইবেনা, ঘৃনা করবে, ছুড়ে ফেলে দিবে ডাস্টবিনে।আবার অনেকেই বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় পাকিস্তানে চলে যায়, সেখানে কাজ করে এবং অনেক দিন পর দেশে আসে দেশ দেখার জন্য আবার চলে যায়।এদের মধ্যে ছিল “মেহের” যে কিনা একজন সেনাকে বিয়ে করে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল যুদ্ধের পরে।সে যে জোযানের দ্বারা প্রতিটা দিন নির্যাতনের স্বীকার হত তাকেই মুক্তিবাহিনির কাছ তেকে বাঁচিয়ে তার সাথে পাকিস্তানে যায়। ওখানে গিয়ে স্ত্রীর অধিকার পায় ঠিকই কিন্তু তার একটি স্বতীন ছিল যে জানতনা মেহেরজানের কথা।সন্তানের মা হন তিনি কিন্তু তার বাবা তাকে দেখভাল করতনা ঠিকমত।মেহের নিজ দেশের টানে এক প্রতিনিধির সাথে দেশে ঘুরতে আসে কিন্তু তার পরিবার তাকে তাদের সমাজে গ্রহন করে নেইনি তাছাড়া সে থাকেওনি।
এমনি আরও অনেক মেয়ে ছিল যাদেরকে পরিবার গ্রহনই করেনি। আবার অনেক মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চাইনি। যুদ্ধের আগে বিয়ের পাকা কথা-বার্তা হয়ে থাকলেও সেই বিয়ে আর হয়নি কারন সে ধর্ষিতা। এমনই একজন বিরঙ্গনা নারী ‘রানী’। তার বিয়ে হবার কথা ছিল ‘আতার’ নামে একটি ছেলের সাথে কিন্তু সে ছেলে তাকে বিয়ে করেতে অসীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে তার বিয়ে হয় অন্য ছেলের সাথে কিন্তু বিয়ে প্রথম রাতেই তার স্বামী তাকে বীরাঙ্গনা বলে ডেকেছিল, এতে রানী লজ্জায় মাতা উচু করেতে পারেনি।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবর রহমান নির্যাতিতা নারীদেরকে বীরঙ্গনা উপাধি দিয়েছিলেন। যাদের পরিবার তাদেরকে গ্রহন করেনি তাদের জন্য একটি বীরঙ্গনা পূর্নবাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন। কিন্তু এখানেও নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে সেটি হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধা বলতে কেন আজ আমরা শুধু পুরুষকেই বুঝি?যে নারী গুলো ধর্ষিত হল তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধার উপাধি না দিয়ে কেন বিরঙ্গনা উপাধি দেয়া হল? রীরঙ্গনা উপাধি দিয়ে নির্যাতিতা নারীদেরকে আরও নির্যাতন করা হয়েছে বলে মনে হয় কারন সতীত্ত হারা নারীদেরকে মুক্তিযোদ্ধ ছেলেরাই বিয়ে করতে রাজি হয়নি আর সমাজ তাদেরকে করূনার চোখে দেখে।অন্য দিকে একজন মুক্তিযোদ্ধার কত সম্মান, কত খ্যাতি!বর্তমান সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য অনেক কিছুই ১০০ হাত সামনে এগিয়ে থাকে আর অন্য দিকে বীরাঙ্গনা নারী নিজের বীরঙ্গনা পরিচয় দিতেই লজ্জা পাই কারন করুণা পাবার ভয়। তাছাড়া একজন মুক্তিযোদ্ধা কারো বাবা, ভাই, স্বামী কিন্তু বীরঙ্গনা নারীকে ডাকা হয় “বীরঙ্গনা বোন” অথবা “বীরঙ্গনা মা” কিন্তু কখনও কি দেখেছি “বীরঙ্গনা স্ত্রী” বলতে কাউকে?
একাত্তরের ধর্ষিতাদেরকে গর্ভপাত করানো হত কিন্তু তারা কিছুতেই গর্ভপাতে রাজি হতনা।অনেকেই আত্নহত্যা করেছে, সমাজকে তারা তাদের মুকটি দেখাতে চাইনি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন পিতৃপরিচয় যাদের নেই তাদের সবাইকে পাঠিয়ে দেন পকিস্তানে, ওরা এদের দায়িত্ব নিবে। মানুষের সন্তান মানুষের মতো বড়ো হোক। তাছাড়া ওই দুষিত রক্ত আমি এদেশে রাখতে চাই না।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যে সকল সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার একদম প্রথম অংশে কয়েক মিনিট দেখা গেছে যুদ্ধের পূর্বে দেশের অবস্থা এবং একটি অথবা দুটি পরিবারের পরিচিতি। ঠিক তার পরেই শুরু হয় দেশকে নিয়ে, দেশের হালচাল নিয়ে বেশ অস্থিরতা চারিদিকে।হঠাৎ শেখ মুজিবের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সামনে ভাষণ-স্বাধীনতার ডাক, শুরু হয় যুদ্ধ। পাকিস্তানি আর্মিরা গনহত্যা, লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষন চালাতে থাকে একাধারে। এক পর্যায়ে দেশের সচেতন মানুষ আর থেমে থাকেনা- শুরু হয় যুদ্ধ।
১৯৬০, ১৯৭০ দশকে নারীবাদীদের জন্য নারীর রেপ্রিজেন্টেশন ছিল দুর্ভাবনার ও বিবেচনা-বিশ্লেষণের একটি কেন্দ্রীয় জায়গা। সে সময় বিষয়টিকে বোঝা হত এভাবে; সাধারনত, মিডিয়াতে প্রচারিত নারীর ইমেজ “অবাস্তব,” এগুলোর সঙ্গে নারীর বাস্তব জীবনের, তার সংগ্রামের ও আকাঙ্ক্ষার কোন মিল নাই, এই ইমেজসমুহ নারীর আত্ন-পরিচিতিবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাদের সামাজিক ভূমিকাকে পরিসীমিত করে।১০
এমনি একটি চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’ এই চলচ্চিত্রটিতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়, দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট, দুটি ভিন্ন সামাজিক অবস্থান উপস্থাপিত হয়েছে পাশাপাশি। পরিণত বয়সের ভাস্কর নিভৃতে শহরে বসে শিল্প চর্চা করছেন, আবার তিনি পুরনো ডায়েরির পাতা খুললেই পুরনো সময়ে ফিরে যান। ফিরে যান, বাংলাদেশের ইতিহাসের উত্তাল সময়ে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়। ‘সারাহ’ নামের একজন যুদ্ধশিশু মায়ের সন্ধানে এসে আবিস্কার করে অতীতকে। ‘মেহেরকে’ সে দাঁড় করিয়ে দেয় অতীতের সামনে। মেহেরের খালাতো বোন নীলার গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু সারাহকে অতীতের ঘটনা খুলে বলেন মেহের। এই বলার মধ্য দিয়েই মেহের তার অতীতকে আবার দেখে। একাত্তরের উত্তাল সময়ে বাবা-মার সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিংবা কাত হয়ে সে ডায়েরি লেখে, ডায়েরির পাতায় তুলে রাখে যুদ্ধাক্রান্ত সময়ের স্মৃতি। একসময় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত খালাতো বোন নীলা হাজির হন। নীলা আত্মগ্লানিতে না ভুগে প্রতিশোধের উপায় খোঁজে। যুদ্ধের উত্তাল সময়ে মেহের গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা থেকে তাকে বাঁচায় পলাতক এক পাকিস্তানী সৈন্য। আহত সৈন্যটির প্রতি মেহের দূর্বল হয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষের সৈন্য হওয়া সত্ত্বেও ওয়াসিমকে শুশ্রূষা করে ভালো করে তোলে মেহের। ওয়াসিমের প্রেমে পড়ে যায় মেহের। কিন্তু শত্রুপক্ষের একজন সেনাকে ভালোবাসার অপরাধে পরিবার থেকে কথা শুনতে হয় মেহেরকে, বাবার মার সহ্য হয় তাকে, সমাজ তাকে ঘৃনা করে। এক রাতের আঁধারে ওয়াসিমকে নৌকায় উঠিয়ে বিদায় জানায় মেহের। কিন্তু সে ভালোবাসার বিচ্ছেদে আক্রান্ত।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ঘেটে দেথো গেছে যে যুদ্ধে নার-নারী সবাই একসাথে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সিনেমা গুলোতেও দেখা যায় কিন্তু সিনেমা শেষ হবার আগেও তাদের গেরিলা বাহিনি নিয়ে কোন মাতামাতি দেখা যাইনি। কোন সীকৃতি নেই। ‘গেরিলা’ কিংবা ‘ওরা এগারজন’ সিনেমায় তার প্রমান মেলে।
সিনেমাটির কাহিনি নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা তৈরি হয়, নানা জনে নানা কথা বলে।সমাজ সিনেমার মধ্যে পাকিস্তানি সৈনিকের সাথে এদেশের মেয়ের প্রেম মেনে নিতে পারেনি।কারন যারা শত্রু তাদেরকে বন্ধুর সারীতে দেখেতে আমার সমাজ একদমই রাজিনা। সিনেমার কাহিনিটি অবাস্তব। অন্যদিকে ‘গেরিলা’ সিনেমাটিতে বিলকিচের স্বামী নিখোজ। বিলকিচ গোপনে বন্ধুদের সাথে গেরিলা বাহিনিতে কাজ করে মাঝে মাঝে স্বামীর খোজ নেই বিভিন্ন স্থানে। এক পর্যায়ে রাজাকাররা তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদেরকে মেরে ফেলে।কিন্তু বিলকিচ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।ভাইয়ের বাড়ি লালমনিরহাঠে যাই কিন্তু সেখানে পাই বাবা ও ভাই খোকনের লাশ। তখন সে ধরা পড়ে মিলিটারিদের হাতে। পাক সৈনিক তার উপর নির্যাতন করতে থাকে, এবং যৌন আচরনমূলক কথা বলতে থাকে।যখন ধর্ষণের চেষ্টা করে বিলকিচকে তখন বিচক্ষণ বিলকিচ লুকিয়ে রাখা একটি গ্রেনেড ফাটিয়ে নিজে আত্ন-হত্যা করে এবং পাকিস্তানি ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়। আর এখানেই সিনেমা শেষ করা হয়েছে। উল্লিখিত ঘটনাটি সবার কাছে বাস্তব মনে হয়েছে তার কারন আমাদের সমাজ অসহায় নারীকে সবসময়ই মেরে ফেলে, সে যে বেচে আছে এটাই তার কাছে অবাস্তব। বিলকিচ একজন পাকিস্তানি ক্যাম্পে আটককৃত নারী সে যদি বেচে ফিরত তাহলে সমাজ তাকে বাহবা দেবার থেকে বেশি ঘৃনা করত। তাছাড়া তার স্বামী নেই, প্রচলিত সিনেমা গুলিতে একটি ধারা সবসময় রাখা হয় সেটি হচ্ছে নায়ক ছাড়া নায়িকা বাচেনা, স্বামী ছাড়া স্ত্রী বেচে থাকতে পারেনা।আর তখনই সিনেমা বাস্তবধর্মী মনে হয়।
নারীবাদীরা নিজেদের প্রম্নের উত্তর থোজার চেষ্টা করেন প্রশ্নটি ছিল– কেন সিনেমাকে বাস্তবধর্মী মনে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোজেন তারা মার্ক্সবাদী তাত্বিক লুই আলথুসারের তত্বের সাহায্যে। নারীবাদীরা বলেন, সিনেমা দেখে এটিকে বাস্তব মনে হবার কারন যত না সেটির বাস্তব, বহির্জগৎ তুলে-ধরার-সামর্থ্য, তার চাইতে বড় কারন হচ্ছে জগৎ সম্বন্ধে আমাদের কমন সেন্সের সঙ্গে সিনেমার খাপ খেয়ে যাওয়া।নারীবাদীরা বলেছেন যে, সাধারনভাবে আমরা যখন কোন ভাল সিনেমা সম্বন্ধে বলি যে এটি একেবারে বাস্তবের আয়নার মত, আসল ঘটনা হচ্ছে এই সিনেমাটি (আপনার/আমার) মতাদর্শিক “maps of meanings”- এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।১১
শেষ বক্তব্য
নোম চমস্কির উপর ভর করে বলি। প্রতিটি মানুষ অসীম সংখ্যক নতুন নতুন বাক্য তৈরীতে সক্ষম। ভাষা মানুষের আচরণের অন্তর্গত নয় বরং তা মানুষের সহজাত সক্ষমতা, তার অন্তর্জাত। চমস্কি মানবসত্তার একেবারে শাসের ভেতর জারি থাকা ভাষা-ক্ষমতার উপরে ভর করে বের করেছেন বাক্যের ডীপ স্ট্রাকচার, অনুমান সব ভাষার ক্ষেতেই এই স্ট্রাকচার এক। এখান থেকেই সম্ভাবনা তৈরী হয় মনুষ্য-ভাষার একেবারে অভিন্ন সূত্রটি আবিস্কার করে ফেলা। প্রাচ্যে আছেন আমাদের কলিম খান। বাক্য নয়, চমস্কিকে সাথে নিয়েই উনি চলে গেছেন আরও দূরে। খুঁজে বের করেছেন ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি। শব্দের বৈচিত্র্যময় অথর্; আর প্রতিকের সাথে সেই অর্থের সম্পর্কসূত্র। এরা সবাই নতুন ভাষা নির্মাণে আমাদের সাথে থাকবেন। সাথে থাকবে উপনিবেশিকতা-মুক্ত, শ্রেণীগত-আধিপত্যমুক্ত ভাষার দাবিতে যারা লড়াইয়ে আছেন সেই তারাও। চমস্কি ভাষাকে সম্পৃক্ত করেছেন মানবীয়তার সাথে। যাবতীয় কেন্দ্রিতূত আধিপত্যের বাইরে এসে ভাষা মানবীয়তার গান করুক। লৈঙ্গিক আধিপত্য-সহ যাবতীয় আধিপত্যের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ভাষা যতার্থই হয়ে উঠুক স্বাধীনতা!
গ্রন্থের হদিস
১ ”আমি বীরঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইবরাহিম, ১৯৯৮
২ তালাশ, শাহীন আকতার
৩ রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী, নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ-২০০৩
৪ রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী, নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ- ২০০৩
৫ সাদাফ নূরে ইসলাম এবং সাঈদ ফেরদৌস
৬ গ্রামের নিম্নবিত্তরা স্বামীকে ভাতার বলে থাকে।
৭ ভাষা ও নারী: পুরুষের ভাষিক অবরোধ, সৌরভ সিকদার, সামহয়ার ব্লগ
৮ ভাষা ও নারী: পুরুষের ভাষিক অবরোধ, সৌরভ সিকদার, সামহয়ার ব্লগ
৯ ভাষা ও নারী: পুরুষের ভাষিক অবরোধ, সৌরভ সিকদার, সামহয়ার ব্লগ
১০ রেহনুমা আহমেদ ও মানস চৌধুরী, নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ-২০০৩
১১ রেহনুমা আহমেদ, রেপ্রিজেন্টেশন(এ বাস্তবতা) কিছু পরিসর, কিছু প্রসঙ্গ, কাউন্টর ফটো, সংখ্যা ১, ২০০৪ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১:২৮