[ আমার বড় হবার প্রক্রিয়াটি ছিলো খুব রক্ষণশীল। একাধিকবার আমার পড়া বইয়ের বয়সসীমার জন্য বাসায় কঠিন ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তাই আমার যে সব লেখা একদম ঘুম-পাড়ানি গান না হতো, তাদের ঠাঁই হতো একটা পুরোনো ব্যাগে, নইলে একটা গোপন ফাইলে। তার মাঝে কীভাবে কীভাবে জানি ছোটবেলায় লেখা এই দীর্ঘকায় খণ্ডচিত্রটি জনসম্মুখে বের হয়ে গেল। লেখাটিতে কম বয়সী অস্থিরতা আর একটানে শেষ করে ফেলার একটা প্রবণতা আছে, সেটা আর পরিবর্তন করলাম না। ]
নিজের হাতে সন্তানকে মেরে ফেলার ঘটনা ক'জন মানুষ ঘটিয়েছে পৃথিবীতে? কিংবা ভালোবাসার মানুষটিকে মেরে ফেলার ঘটনা?
আমি আয়নার ভেতর নিজের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটা অভিব্যক্তিহীন শক্ত-সমর্থ চেহারা,ভাবলেশহীন চোখ, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি; খুনির চেহারা কি এমন সাধারণ হয়?
আমি আমার হাতদু'টা দেখি। একটু বেশি শক্ত,একটু অপবিত্র রকম খসখসে; কিন্তু কই, রক্তের দাগ তো লেগে নেই?
আমি যে খুব অপরাধবোধে ভুগি, তাও তো নয়। কখনো তো মনে হয় না, এমনটা না হলেও হতো। কিংবা একটা স্বাভাবিক জীবনের জন্য কখনো তো বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে নি! এখনো আমার ঘুমের কোন সমস্যা হয় না। হয়তো সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম আর অচিন্তনীয় মানসিক চাপের মধ্যে পার হয় বলেই আমার ঘুম হয় মৃত্যুর মতো গাঢ়, এতো বেশি গাঢ় যে আমার কোন স্বপ্ন আমার মনে থাকে না। শুধু টের পাই, কোন কোন দিন আমার ঘুমের সুযোগে রোকেয়া আমার কাছে আসে। আমার গভীর ঘুম আমার স্বপ্ন ভুলিয়ে দেয়, তাই আমি মনে রাখতে পারি না, রোকেয়া আমাকে কি বলে। সে কি আমার কাছে কোন অভিযোগ করতে আসে? তার কি সত্যি কোন অভিযোগ আছে? আমি কি তাকে মুক্তি দেই নি? ভালোবাসার মানুষটির প্রতি প্রচণ্ড জিঘাংসা থেকে বেঁচে গিয়ে সে কি সুখী হয় নি? আমার কেন জানি জানতেও ইচ্ছা করে না।
রোকেয়া কি আমাকে এখন চিনতে পারতো? ও আমাকে দেখেছে বড়-বড় দাড়িতে, জোব্বা-টুপি-পাগড়িতে। সে জানে, আমি হাঁটি একটু কাঁধ দুলিয়ে-দুলিয়ে। আমাকে ইলাস্টিক রাবারের মতো টানটান হয়ে কোট-প্যান্ট পরে হাঁটতে দেখলে সে কি ভাবতো?
রোকেয়াকে আমি প্রথম দেখেছিলাম আমাদের বিয়ের রাতে। কোন দিন আমি যে বিয়ে করবো, সে রকমটি কখনো মনে হয় নি। তবে তখন আমার না করারও কোন ইচ্ছা ছিলো না। বরং একটা কৌতূহল ছিলো, আনন্দ ছিলো,সংশয় ছিলো এবং একটা জীবনকে অনিশ্চিত করে ফেলার জন্য অপরাধবোধ ছিলো।
রোকেয়া ছিলো মাওলানা আফজালের ছোট মেয়ে। মাওলানা আফজাল তখন জ়েএমবির তিন নাম্বার মাথা। তার মেয়েকে বিয়ে করতে অবশ্যই যোগ্যতা থাকতে হবে, এবং সেই যোগ্যতা আমার ছিলো। মাওলানা আমাকে চিনতো একজন বিজ্ঞ আলেম হিসাবে,একজন তরুন বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে, একজন অসীম সাহসী জিহাদী হিসাবে। আমি জিহাদীদেরকে, তাদের আমীরদেরকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাদের আদর্শে ভুল থাকতে পারে, তাদের আত্মত্যাগ, সততার কোন তুলনা নেই। তারা যোগ্যকে মর্যাদা দেয়। মাওলানা তার মেয়ের কথা আমাকে বলার পর আমি আপত্তি করতে পারতাম, কিন্তু আমি তা করি নি। আমার এখনো মনে হয় না, আমার সে দিন আপত্তি করা দরকার ছিলো। আমি সে দিন আপত্তি করলে, মাওলানার বিশ্বাস নষ্ট করলে মাওলানা কখনো ধরা পড়তো না, জ়েএমবির আজকের এই লেজে গোবরে অবস্থা থাকতো না।
মাওলানা মৃত্যুর আগে জেনে যেতে পেরেছিলো যে আমি একজন গোয়েন্দা অফিসার। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে, তখন তার কেমন লেগেছিলো? একজন মানুষ কতটুকু ক্রোধ নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে? সেই ক্রোধের পাশে কি তার মেয়েটির কথা ভেবে দুঃখবোধের কোন জায়গা ফাঁকা ছিলো?
রোকেয়াকে আমি রোকেয়া ডাকতে পারি নি কোন দিন। আমাকে অনেক কিছু যেমন লুকিয়ে রাখতে হতো ওদের কাছে, অনেক স্বাভাবিক স্বভাব যেমন বদলে চলতে হতো, তেমনি আমার ওকে ডাকতে হতো রুকাইয়া নামে। রোকেয়াকে বিয়ের পর আমাকে নিয়ে ডিপার্টমেন্টে অনেক গুঞ্জন হয়েছে। যে মানুষ নিশ্চিত মৃত্যু জেনে বাঘের গুহায় পুপ্তচরবৃত্তি করতে যায়, তাকে নিয়ে উঁচু গলায় কিছু বলা যায় না বলেই গুঞ্জন। আমার কোন বন্ধুর কি সন্দেহ হয়েছিলো আমি আসলে জ়েএমবিরই গুপ্তচর ভেবে? আমার উপরও কি তদন্ত হয়েছিলো গোপনে? আমি জানি না। মাওলানা যেমন জানতে পারে নি, তার ঘাড়ের উপর বসে আমি কী করছি, আমার উপর তদন্ত হলেও আমার টের পাবার কথা নয়।
তবে আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমার জীবনের ঝুঁকি নেওয়াকে অপমান করে আমার ডিপার্টমেন্ট আমার উপর তদন্ত করে নি; নিতান্তই আবেগ থেকে আসা ভাবনা। এই আবেগগুলো রোকেয়া জন্ম দিয়ে গেছে। দুই বছর আগে হলে আমি ভাবতেও পারতাম না, আমার মাঝে এই জাতীয় অর্থহীন ন্যাকামী জন্মাতে পারে।
আমি কখনো কোন নারীর ভালোবাসা পাই নি। মায়ের না, বোনের না, প্রেমিকার না। আমি বড় হয়েছি সৎ মায়ের ঘরে, পরে ক্যাডেট কলেজে। রোকেয়া অতি দ্রুত আমাকে বেঁধে ফেলেছিলো। আমি প্রথমবারের মতো বুঝতে পেরেছিলাম ভালোবাসা জিনিসটা শুধু ন্যাকা-ন্যাকা ফালতু একটা ব্যপার না, এর মাঝে কতো কিছু যে থাকতে পারে! অপুত্রক মাওলানাও আমাকে পুত্রসম জ্ঞান করতো। একদিন কথায় কথায় সে আমাদের সন্তান কামনা করে বসেছিলো। আমি শুধু বিশ্বস্ত জিহাদীর মতো তার দোয়া চেয়েছিলাম। রোকেয়াকে আমি বুঝিয়েছিলাম,আমাদের লক্ষ্য পূরণ হওয়া পর্যন্ত আমি আন্য কিছু ভাবতে পারবো না। কোন এক বিচিত্র কারণে সব রকম কন্ট্রাসেপটিভকে জিহাদীরা ঘৃণার চোখে দেখতো। ব্যপারটার জন্য রোকেয়াকে আমার অনেক বুঝাতে হয়েছিলো। এবং তাকে আমার প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতে হতো,জোর করতে হতো। আমি নিজের উপর কিছু তুলে নেই নি, কারণ কোন কিছু ভাববার অবকাশ আমার ছিলো না। আমার জীবন তখন একটা সুতোর উপর ঝুলছিলো। জিহাদীরা ধরতে পারলে ধীরে-ধীরে চামড়া ছিলে মারবে, আর ডিপার্টমেন্টে আমি সন্দেহভাজন অফিসার।
শেষ পর্যন্ত আমি ডিপার্টমেন্টকে আমার দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে পেরেছিলাম। মাওলানা ধরা পড়লো, খুব অল্প দিনে জ়েএমবির মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিলো। আমি জানতাম, রোকেয়াকে আমার হারাতে হবে। তার আদর্শ অত্যন্ত প্রবল। একটা পরাজিত জীবন তার পক্ষে যাপন করা সম্ভব হবে না জানতাম। তবু আমি রোকেয়াকে জয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন আমার বুকে মুখ গুঁজে সে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলো,স্বামী ধর্মত্যাগী বিশ্বাসঘাতক হলে কি তাকেও চরম শাস্তি দিতে হবে? তখন আমি আমার ভালোবাসার রোকেয়াকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মৃত্যুর পরও রোকেয়া তাকিয়ে ছিলো। এই প্রথমবারের মতো আমি খোলা চোখের রোকেয়াকে চুমু খেয়েছিলাম। এরপর রোকেয়ার অনেক জিনিসপত্রের মাঝে আমি একটা কন্ট্রাসেপটিভ পিলের একদম নতুন প্যাকেট পেয়েছিলাম; গত দেড় মাসের ঝড়ে আমি রোকেয়াকে অনেক বিষয় মনে করিয়ে দেই নি, অনেক ব্যপারে জোর করি নি...
[কিছুদিন আগে একই শিরোনামে লেখকের ফেসবুক নোট হিসাবে প্রকাশিত]