স্মৃতির অধ্যবসায়- সালভাদর দালি
টিভিতে আমরা সবাই কমবেশী আলিফ লায়লা দেখেছি, সেখানে দেখেছি চাওয়া মাত্রই আলাদিনের দৈত্য চোখের পলকে সবকিছু হাজির করছে। আচ্ছা বাস্তবে এটা কি সম্ভব?
হ্যাঁ সম্ভব!
যে যায়গায় হেঁটে যেতে আমাদের ৫ মিনিট লাগে দৌড়ে গেলে লাগে ২ মিনিট। গতি বাড়িয়ে আমরা সময় কমিয়ে আনছি। এখন ধরুন, ছবির হাটে বসে কোন প্রিয়জনের সাথে বসে থাকতে থাকতে প্রকৃতির রূপটা এমন হলো যে আপনি বুঝলেন প্রিয় মানুষটিকে প্রপোজ করার এখনই আদর্শ সময়। কিন্তু সমস্যা হলো জীবনের একটা গুরুত্বপুর্ণ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে একেবারে খালি হাতে প্রপোজ করাটা কেমন দেখায়! তাই ঠিক করলেন চট করে শাহবাগ মোড়ের থেকে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে আসা যাক। যেহেতু প্রিয় মানুষটিকে বেশী সময় একা বসিয়ে রাখা যায়না তাই চেষ্টা করবেন যত দ্রুত সম্ভব ফুল নিয়ে ফিরে আসার। দিলেন এক ভোঁ দৌড় এবং ১০ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসলেন। এখন আপনার কাছে যদি একটি সাইকেল থাকতো তাহলে এই যাতায়াতের সময় আরো কমিয়ে আনা যেতো, মটর সাইকেল থাকলে সময় লাগতো আরো কম। এবার ধরুন, আপনার কাছে এমন একটি অত্যাধুনিক যান আছে যার গতি অস্বাভাবিক রকম বেশী। এত বেশী যে ধরে নিন ছবির হাট থেকে ঘুরে আসতে আপনার সময় লাগে প্রায় শুন্য সেকেন্ড অথবা ধরুন এক সেকেন্ডের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ। এত দ্রুত সময়ের মধ্যে আপনি যদি ঘুরে আসতে পারেন তাহলে আপনার প্রিয় মানুষটি শুধু দেখবে ম্যাজিকের মতো আপনার হাতে গোলাপ গুচ্ছ চলে এসেছে। গতি দিয়ে অন্যদের সাপেক্ষে প্রায় স্থির সময়ে আপনি ফুলের দোকান থেকে ঘুরে এসেছেন। এভাবে গতি বাড়াতে বাড়াতে গতির একটা পর্যায় নিয়ে আসলেন যেখানে একেবারে শুন্য সময়ে চলে আসতে পারেন। ধরুন দশ হাজার কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে ছবির হাট থেকে শাহবাগ মোড় ঘুরে গেলে ঘড়ির কাটা সামান্যতমও ঘোরেনা, মানে সময় স্থির। এখন যদি সেই গতি বাড়িয়ে পনেরো হাজার কিলোমিটার/ঘন্টা করেন তাহলে কি হবে? সময় কি পিছিয়ে যাবে? এটাই সময়ের আপেক্ষিকতা! আইনস্টাইন যেখানে তাত্ত্বিক ভাবে দেখিয়েছেন যে আলোর গতির সাপেক্ষে বস্তুর গতি বাড়িয়ে কিভাবে সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে অতীত বা ভবিষ্যৎ ভ্রমণ সম্ভব। যেখানে বস্তুর গতি যত বাড়ে সময়ের গতি তত কমে যায় অর্থাৎ আপনার গতি যত বাড়বে আপনার হাতের ঘড়ির ডায়ালটাও তত ধীরে চলতে থাকবে, সময়ের গতি কমে যায়। বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখতে পারেন।
যাইহোক, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের খুঁটিনাটি ব্যাপার পদার্থবিজ্ঞানীদের ভাবার বা আলোচনার বিষয়। আমাদের সাধারণের দেখার বিষয় শুধু এই সময় পরিভ্রমণের তত্ত্ব আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সাথে কোনভাবে সম্পর্কিত কিনা!
হ্যাঁ, সময় পরিভ্রমণ তত্ত্ব আমাদের সামাজিক গঠন বা গতানুগতিক ধর্মীয় বিশ্বাসকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। আমি কে, আমার অস্তিত্ব কি, আমি কিভাবে আসলাম, কোথায় যাবো, জীবনের মানে কি অর্থাৎ সৃষ্টি ও জ্ঞান বিষয়ক মৌলিক জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে দর্শনের যে শাখা অধিবিদ্যা সেই অধিবিদ্যার উপর ভিত্তি করে দেখার চেষ্টা করি যে সময় পরিভ্রমণ অতীত ভবিষ্যতে যাতায়াতের তত্ত্ব আমাদের জীবনবোধ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভেতর কোন সমস্যা তৈরী করতে পারে কিনা? নাকি আদতে আমাদের জীবনবোধ এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে এটা সম্পর্কিতই নয়!
নিয়তি বা ভাগ্য বলে একটি কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি। বলি, ভাগ্যে ছিলো হয়েছে। আবার আমরা আমাদের নিজের কর্মের উপরও আস্থা রাখি। সহব্লগারদের সাথে ইন্টারেকশন বাড়ালে ব্লগে নিয়মিত হলে ভালো পোষ্ট দিলে আমার পোষ্টে বেশী ব্লগার আসবে এবং বেশী মন্তব্য হবে বেশী আলোচনা হবে। এখানে আমার কাজের উপর নির্ভর করবে আমার পোষ্টের ভবিষ্যৎ। ধরে নিলাম আইনস্টাইনের তত্ত্ব মতে তৈরী একটা সময় যান আমার রয়েছে। ব্লগে পোষ্ট দিয়েই সেই সময় যানে চড়ে রওনা দিলাম আট ঘন্টা ভবিষ্যতে। গিয়ে দেখলাম আপনার একটি মন্তব্য রয়েছে সেখানে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আপনি এখন মাত্র লেখাটি পড়ছেন। কি মন্তব্য করবেন নাকি কোন মন্তব্যই করবেন না সেটি তো পোষ্ট পড়া শেষ করে অন্যদের মন্তব্য দেখে তারপর সিদ্ধান্তে আসবেন। যে সময় আপনি মন্তব্য করার সিদ্ধান্তেই আসেননি সেই সময়ই আমি ভবিষ্যতে গিয়ে দেখি আপনার মন্তব্য! তার মানে কি তাহলে মন্তব্য করাটা আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করেনা? নিয়তি বা ভাগ্য আগেই ঠিক করে রেখেছিলো আপনার ভবিষ্যৎ? স্টিফেন হকিং এর গায়িকা ম্যাডোনাকে নিয়ে দেয়া উদাহরণটা একটু বদলিয়ে এভাবে বলি, এই যে আমি এখন লিখছি, আপনি এখন পোষ্ট পড়ছেন এগুলোর সবকিছুই কি শুধু প্রকৃতির নিয়ম মেনে হচ্ছে, যা আগের নির্ধারণ করা ছিলো? প্রকৃতি বা মহাবিশ্বের নিয়ম রক্ষা করছি শুধু যন্ত্রের মতো? আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু নেই? যেমন আমরা বলি অমুক দিন অমুক সময় সুর্যগ্রহন হবে, ঠিক তাই হয় একটি রুটিন মেনে। যেহেতু আপনি মন্তব্য করবেন নাকি না করবেন সে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই ভবিষ্যৎ ঘুরে এসে আমি জানি আপনি মন্তব্য করবেন তার মানেই দাঁড়ায়, একটি পুর্ব নির্ধারিত ভবিষ্যতের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি গ্রহ নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো, দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে! যেখানে আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু নেই! তাছাড়া আট ঘন্টা পর যদি পুর্ব নির্ধারিত ভাবেই আপনার মন্তব্য পেয়ে থাকি তাহলে আমারই বা কি দরকার সহব্লগারদের সাথে ইন্টারেকশন বাড়ানো বা যত্ন নিয়ে পোষ্ট লেখার!
এখন ধরুন নিয়তি বা ভাগ্য নিয়ে আমরা প্রকৃতির নিয়ম রক্ষা করছি মাত্র। তাহলে এইযে আমরা প্রচলিত ধর্মগুলো মানি যেখানে বলা আছে মানুষের ইচ্ছা স্বাধীন এবং তাঁর কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে স্বর্গ বা নরকে নিক্ষেপ করা হবে, এটা তো হওয়ার নয়। যেমন, প্রকৃতির নিয়মই ঠিক করে রেখেছিলো আজ আমি এই পোষ্ট দিবো, অতএব এই পোষ্টের বা এই পোষ্টের লেখার জন্য আমার তো কোন কৃতিত্ব নেই। আবার আপনি পড়বেন বা পড়ে মন্তব্য করবেন সেখানেও তো আপনার কোন ভূমিকা নেই। কারণ আমি আপনি জন্ম নেয়ার আগেই আইনস্টাইন টাইম মেশিনে চড়ে দেখে এসেছেন ৩১ আগস্ট তাঁর তত্ত্বের কিছু সমস্যা আলোচনার চেষ্টা হয়েছে সামহোয়্যারইন ব্লগে! সুতরাং আপেক্ষিক তত্ত্ব মেনে আমরা বলতে পারি, যা কিছু হচ্ছে বা হবে তার সবই আগের থেকেই ঠিক করা! প্রচলিত ধর্মগুলোতে যে স্বাধীন ইচ্ছার কথা বলা আছে সেটা ভুল!
আবার ধরুন, সময় যানে চড়ে আইনস্টাইন ২০১৪ সনের ১০ সেপ্টেম্বরে গিয়ে দেখলেন আমি আপনাকে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছি বলে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন পর্যন্ত আপনার সাথে আমার সেভাবে হয়তো পরিচয়ই হয়নি। ১০ সেপ্টেম্বরে আপনার নাক ফাটিয়ে দেয়ার অপরাধে আমার যে বিচার হবে সেখানে আমি বলতেই পারি যে, এটা একটা পুর্ব নির্ধারিত ব্যাপার ছিলো, এর জন্য আমি দোষী না। ঘটনাটি আমি জন্ম নেয়ার অনেক আগেই আইনস্টাইন এসে দেখে গেছেন। সুতরাং যেখানে আমি দোষী নই বিচার করার বা আমাকে জেল জরিমানা দেয়ার কোন অধিকারই কারো নেই।
তাহলে এবার কল্পনা করুন এমন একটি সমাজ যেখানে কাউকে কৃতকর্মের সাজা বা পুরষ্কার ভোগ করতে হয়না। যেহেতু তাত্ত্বিক ভাবে বলা যায় আপনার ভবিষ্যৎ পুর্ব নির্ধারিত তাই তত্ত্ব মেনে আপনি বেখেয়ালে রাস্তা হাঁটছেন বা হাঁটছেন রেললাইন ধরে। পুর্ব নির্ধাতি মৃত্যু থাকলে কেউ ঠেকাতে পারবেনা আর পুর্ব নির্ধারিত মৃত্যু না থাকলে রেল আসবেনা এমন একটা বিশ্বাসে। পুর্ব নির্ধারিতি বলে আপনাকে নাক ফাটিয়েও আমি হচ্ছিনা বিচারের মুখোমুখি অথবা আপনি আস্থা রাখতে পারছেন না প্রচলিত ধর্মগুলোর উপর। সবার আস্থা পুর্ব নির্ধারিত ভবিষ্যতের উপর। সেখানে প্রয়োজন হচ্ছেনা কোন আইন প্রণয়নের, সবকিছুর একটাই ব্যাক্ষা ভবিষ্যৎ নির্ধারিত ছিলো তাই হয়েছে। সেখানে নেই কোন ন্যায় অন্যায়ের ব্যাপার। তাহলে কেমন হবে সে সমাজ? বিজ্ঞানের বাস্তবতায় আমরা কি এমন একটি সমাজ মেনে নিবো যেখানে যে যা করবে তাই ঠিক! নাকি স্টিফেন হকিং এর মতো বলবেন, যদি ভবিষ্যৎ পুর্ব নির্ধারিতও থাকে তারপরও আমরা আমাদের সহজাত প্রবণতাতেই রাস্তা পেরুনোর সময় ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়েই পার হবো।
কিন্তু কথা হচ্ছে যখন একটা ধারণা সবার মধ্যে গেঁথে যাবে তখন সেটা আনমনেই মানুষের ভেতর প্রভাব ফেলবে। হতে পারে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান, হারাতে পারে কাজের অনুপ্রেরণা, হয়ে উঠতে পারে ধ্বংসাত্বক অথবা হতাশাগ্রস্থ। আমাদের ব্লগ প্রধান শ্রদ্ধেয় জানাপু ব্লগের খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দিতে পারেন, আমরাও বন্ধ করে দিতে পারি ব্লগ লেখা অথবা সম্মানিত মডারেটর অন্যমনস্ক শরৎ মডারেশন ফেলে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে ঢাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, যা হবার তা তো হবেই! ভবিষ্যৎ পুর্ব নির্ধারিত যে! এত দেখাদেখি লেখালেখি খোঁজ খবর নিলেই কি না নিলেই বা কি। বরং এটাই পুর্ব নির্ধারিত! কি বিচিত্র এক সমস্যা!!
আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে দর্শনের সমস্যার এটি মাত্র দিক নিয়ে সামান্য আলাপ করার চেষ্টা করলাম। যেহেতু আপেক্ষিক তত্ত্ব "অধিবিদ্যার" অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় "স্থান-কাল" এর সাথে সম্পুর্ণ সম্পর্কিত তাই আলোচনা সমালোচনার পরিধিও অনেক বড় এবং প্রচুর শাখা-প্রশাখা যুক্ত। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত পড়াশোনা অনেক অনেক কম। এরমধ্যে যতটুকু বুঝেছি তাতে ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, দর্শন এবং পদার্থ বিজ্ঞানের এই যে তর্ক বিতর্ক আলোচনা সমালোচনা। বিশেষ করে জীবন বোধ নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে আপেক্ষিক তত্ত্বের যে অবস্থান এখানে প্রধান চালকের ভূমিকায় রয়েছে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট । বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত বই ক্রিটিক অফ পিউর রিজন । খুব সম্ভব "বিশুদ্ধ বুদ্ধির সমীক্ষা" নামে এই বইয়ের একটি বাংলা অনুবাদ বাজারে পাওয়া যায়। বইটির ইংরেজী পিডিএফ সংস্করণ চাইলে এই লিংকে ক্লিক করুন।
তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান ও দর্শনের এই দ্বৈরথ কবে শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কিনা, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রায়োগিক দিক পাবে কিনা অথবা পেলেও তার ভবিষ্যৎ কি হবে, সমাজ গঠনের নতুন ভূমিকা কি হবে, নাকি বর্তমান সামাজিক নৈতিক কাঠামো জয়ী হয়ে আইনস্টাইনের সময়ের আপেক্ষিকতা তত্ত্বে পরিবর্তন আসবে তা আমরা কেউ জানিনা। আমরা শুধু এতটুকু জানি যে, আমরা এমন একটি সময়ে বসে এসব নিয়ে বিতর্ক করছি জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা হবে একটি মাইলফলক। ঘটবে এক যুগান্তকারী বিপ্লব। খুলে যাবে জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক অজানা দুয়ার। এবং সেই বিপ্লবের তার্কিক আলোচক কান্ট আইনস্টাইন থেকে শুরু করে আমি আপনি সবাই। অনিশ্চয়তা নিশ্চয়তায় আনতে যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির মতামত সমান গুরুত্বপুর্ণ। আর ভবিষ্যতই বলে দিবে জীবনটা কি শুধুই সিনেমার রীল বা ক্যাসেটের ফিতার মতো রিওউন্ড ফাস্ট ফরোয়ার্ডের খেলা নাকি অন্য কিছু!
** ছবিসুত্রঃ উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ২:১৭