সভ্যতার বিবর্তন যুগে যুগে মানুষের বিশ্বাস ও সামাজিক ধর্মীয় আচরণেও পরিবর্তন এনেছে। শুভ অশুভ উপাসনা থেকে প্রকৃতির উপাসনা, বহু দেবতার উপাসনা থেকে একেশ্বরবাদ। কিন্তু এখনও এমন কিছু সমাজ সভ্যতা রয়েছে যারা ধরে রেখেছে বা ধরে রাখতে চাইছে তাদের হাজার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। এমনই একটি জাতি হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির বান্দিয়াগারা উপত্যকার ডোগন । প্রায় আট লক্ষ জনগোষ্ঠীর এই জাতি এখনও উপাসনা করে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে তাদের গোত্রের মুখে মুখে চলা এক ধর্মের। যেখানে উপাসনা হয় আকাশের নিদ্রিষ্ট একটি তারাকে কেন্দ্র করে। আকাশে যার অবস্থান ক্যানিস মেজর নক্ষত্রমন্ডলে।
লুব্ধক তারা
তাদের ধর্ম বা সামাজিক আচরণের যে মুখোশ বা নাচের মুদ্রা এর প্রতিটির রয়েছে বিশেষ কিছু মানে। আর যার সবকিছুই চলে ক্যানিস মেজরে অবস্থিত আকাশের সেই উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধককে উদ্দেশ্য করে। বাৎসরিক উৎসব বাদেও ৬০ বছর পরপর তাদের প্রধান উৎসব সিগুই পালিত হয় সেই লুব্ধক নক্ষত্রের এক সঙ্গী তারা জোতির্বিজ্ঞানে যার নাম সিরিয়াস বি এর বর্ষপুর্তি উপলক্ষে। আধুনিক জোতির্বিজ্ঞানে অবশ্য সিরিয়াস বি ৫০ বছরে সিরিয়াসকে একবার প্রদক্ষিণ করে।
সিরিয়াস বি এর কক্ষপথ
অন্যান্য আফ্রিকান উপজাতিদের মতো ডোগনরাও সকলের কাছে ছিলো আরেকটি সাধারণ উপজাতিদের মতোই যতক্ষণনা পর্যন্ত জোতির্বিদরা সিরিয়াস বি নক্ষত্রটি আবিষ্কার করে। ডোগনরা সিরিয়াস বা লুব্ধক নক্ষত্রকে বলে সিগি টোলো। আর সিরিয়াস বি কে বলে পো টোলো।
পো টোলো এবং আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান
ডোগন লোককথা এবং ধর্মীয় ভিত্তিঃ
আমা যিনি থাকেন পো টোলো নামে এক সাদা এবং অত্যন্ত ভারী এক নক্ষত্রে। ২০ টি জিনিষ দিয়ে গড়া সেই নক্ষত্রের প্রতিটি জিনিষ এত ভারী যে তার সামান্যাংশ আমাদের পক্ষে তুলে আনা সম্ভব না। গড আমা তৈরী করেন নোমোকে এবং রাখেন এমা ইয়া টোলো নামের নক্ষত্রের নিয়ান টোলো গ্রহে। সেখান থেকে নোমো আসে পৃথিবীতে এবং মানুষকে শিক্ষা দেয় সভ্যতার কৃষি কাজ ও আগুনের ব্যবহারের। আর এভাবেই ডোগন ধর্মে নোমো হয়ে উঠে মানুষের শিক্ষা ও জলের দেবতা।
নোমো; মহান শিক্ষক ও পানির দেবতা
আধুনিক জোতির্বিজ্ঞানঃ
১৮৪৪ সালে জার্মান জোতির্বিদ ফ্রেডরিখ বাসিল লুব্ধকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সর্ব প্রথম এই সিদ্ধান্তে আসেন যে লুব্ধক বা সিরিয়াস নক্ষত্র আসলে বাইনারী বা ডাবল স্টার সিস্টেম । তার মানে সিরিয়াসকে ঘিরে আর কোন অবজেক্ট ঘুরছে। এখানে উল্লেখ্য আমাদের সুর্যের মতো গুটি কতক নক্ষত্র বাদে মহাকাশের অধিকাংশ তারাই এমন বাইনারী সিস্টেম। যদিও বর্তমানে অনেক বিজ্ঞানী মনে করে আমাদের সুর্যেরও কোন সঙ্গী থাকতে পারে এবং মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝের গ্রহাণুগুলো ধরে অনেকে মনে করেন সুর্যের সঙ্গী আছে বা ছিলো। যা আবার ব্যাবিলনীয়দের দশম গ্রহের গল্পকে বাস্তবতার পথ দেখায়। প্লুটোর বিচ্ছিন্ন গতিপথও বলে প্লুটো হয়তো অন্য কোন কিছু দ্বারা আকর্ষিত হচ্ছে বেশ জোরের সাথেই। যার কারণে প্লুটোর গতি সোলার সিস্টেমের সাথে ঠিক খাপ খাচ্ছেনা। আর প্লুটোর এই দুর্ভাগ্যই প্লুটোকে সৌর জগতের গ্রহগুলো থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ডোগনদের লোককথাও বলে আমাদের সুর্য আসলে পো টোলোর মতো দুটি বিশেষ নক্ষত্রের মিলিত রূপ। যাইহোক, আমরা সিরিয়াস বি তে ফিরে যাই। ১৮৬২তে আমেরিকান জোতির্বিদ আলভিন গ্রাহাম ক্লার্ক টেলিস্কোপের মাধ্যমে সর্ব প্রথম লুব্ধকের সঙ্গী নক্ষত্রকে প্রত্যক্ষণ করেন। এবং পরবর্তীতে ১৮৯৪ সালে সিরিয়াস বি জোতির্বিজ্ঞানে স্বীকৃতি পায়। এবং খুব সম্ভব (আমি নিশ্চিত নই) ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম প্রমাণিত হয় যে সিরিয়াস বি আসলে একটি শ্বেত বামুন নক্ষত্র যার আয়তন পৃথিবীর আয়তনের সমান প্রায় এবং ভর সুর্যের ভরের সমান। ডোগন ধর্ম বা ঐতিহ্যে অধুনা আবিষ্কৃত সিরিয়াস বি হচ্ছে তাদের উপাসনার নক্ষত্র পো টোলো।
পো টোলোর বিভিন্ন বস্তুর প্রতীক আঁকছেন ডোগন পুরোহিত বা হোগন
অঙ্কিত চিত্র
বিচিত্র এবং সম্পুর্ণ ব্যতিক্রমী মুখোশ তৈরীর জন্য বিখ্যাত ডোগন সম্প্রদায়ের কাছে গিয়েছেন অনেক পশ্চিমা নৃতাত্ত্বিক, ব্যবসায়ী, পর্যটক অনেকে। একই ধারাবাহিকতায় ১৯৩১ সালে সেখানে যান প্রখ্যাত ফরাসী নৃতাত্ত্বিক মার্শেল গ্রাউল ডোগনদের উপর গবেষণা করেন দীর্ঘ ১৬ বছর। এবং হোগনদের (ডোগন পুরোহিত) মুখে শোনা এবং আঁকা বিভিন্ন উপাখ্যান বিশ্লেষণ করে করে দেখেন এ ধর্মের উপাসনার মুখোশ এর পেছনে রয়েছে এর রহস্যময় মহাজাগতিক প্রজ্ঞা। মাত্র ৮০/৯০ বছর আগে আবিষ্কৃত সিরিয়াস বি নক্ষত্রই আসলে তাদের পো টোলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অল্প কিছুদিন আগে আবিষ্কার হওয়া এক নক্ষত্র যা খালি চোখে দেখা অসম্ভব সে নক্ষত্রের কথা ডোগনদের হাজার বছরের পুরোনো ধর্মে আসে কি করে? রহস্য আরো ঘনীভূত যখন জানা যায় সিরিয়াস বি আসলেই একটি শ্বেত বামুন। যার আয়তন পৃথিবীর প্রায় সমান হলেও তার ভর প্রায় সুর্যের ভরের সমান যা ডোগনদের সেই সাদা এবং অত্যন্ত ভারী নক্ষত্রের কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। কিন্তু কিভাবে? আদিম মানুষ প্রযুক্তিতে উন্নত ছিলো? আসলেই ভীনগ্রহ থেকে কেউ এসেছিলো যাদের থেকে জেনেছে? জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং জোতির্বিদ কার্ল স্যাগান অবশ্য ব্যাপারটির রহস্যময়তা অস্বীকার করেছেন। কার্ল স্যাগানের মতে হয়তো ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের মুখে গল্প শুনে শুনে তাদের ধর্মের পট পরিবর্তন করেছে। কেননা তাদের জানার ব্যাপারটি অনেকটাই খাপছাড়া। তারা বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের কথা জানে, শনি গ্রহের বলয়ের কথা জানে কিন্তু অন্য কিছু জানেনা। সিরিয়াস বি জানে অন্য তারাদের ব্যাপারে তাদের ধারণা খুবই কম। যে বিচ্ছিন্ন জ্ঞান ইউরোপীয় পরিব্রাজক দ্বারা শোনানো নতুন জোতির্বিদ্যার গল্পই হতে পারে।
কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থাকে। সিরিয়াস বি আবিষ্কৃত হয়েছে খুব বেশীদিন হয়নি। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় জনগোষ্ঠীর ধর্ম আচার ধর্মের পট কিছু ইউরোপিয়ান পরিব্রাজকদের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন ঘটবে, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সেটা কি আদৌ গ্রহন যোগ্যতা পায়! তাহলে কোথায় এই মহাজাগতিক প্রজ্ঞার উৎস? এই সেই নক্ষত্র প্রাচীন মিশরে যে তারা সভ্যতার গোড়া পত্তন করেছিলো যা তাদের দেবতা অসিরিস দেবী আইসিস ও শেয়াল দেবতা আনুবিসকে উপস্থাপন করে। এই সেই তারা ভারতীয় পুরাণে যে তারা প্রধান দেবতা শিবের অবতার রুদ্রাক্ষীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই সেই তারা যে তারা আকাশের সবচাইতে উজ্জ্বল তারা। যা আবার সুর্যের নিকট প্রতিবেশীও, সুর্য থেকে যার দুরত্ব মাত্র ৮ দশমিক ৬ আলোকবর্ষ। এই সেই দেবতা নোমো যার অর্ধেক অংশ মানুষের বাকী অর্ধেক অংশ মাছের। মিশর, ব্যাবিলন, গ্রীক থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত পুরাণে যে মৎস্য কন্যা এক বহুল পরিচিত নাম। অবশ্য ডোগনদের বলা তৃতীয় নক্ষত্র এমা ইয়া টোলো বা তার গ্রহ নিয়ান টোলোর সন্ধান আধুনিক বিজ্ঞান এখনও পায়নি।
সিরিয়াস কি আসলে তিন তারার সমন্বয়ে গঠিত?
ডোগনদের মহাজাগতিক প্রজ্ঞার মাঝে তাহলে কি সেই সত্য? জোতির্বিজ্ঞানে অনেক উন্নত আদিম সভ্যতার নিদর্শন? মহাকাশযানে চড়ে আসা ভিন গ্রহের প্রাণী বা এলিয়েন? নাকি রথে চড়ে বা ডানায় ভর করে আসা দেবতারা? নাকি নেহাতই এ এক কাকতালীয় ব্যাপার!
And that it is He who is the Lord of Sirius
(Al Quran, Surat an-najm:49)
সব শেষে ডোগনদের বিখ্যাত মুখোশ এবং কাঠশিল্পের ছবি।
আকাশে লুব্ধক বা সিরিয়াস নক্ষত্রে অবস্থান এবং প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তনে লুব্ধক নক্ষত্রের ভূমিকা জানতে-
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তনের ইতিহাস এবং একটি ধর্মের সম্ভাব্য বিবর্তন
----------
ছবিসুত্রঃ ইন্টারনেট
সকল লিংকঃ উইকিপিডিয়া