somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

★*★কস্তুরি★*★

০৯ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সেন্ট্রাল ফিল্ড'। পড়ন্ত বিকেল। মাঠে খেলা চলছে। আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট সামনেই। তারই অনুশীলন চলছে।
মাঠ লাগোয়া রাস্তার পাশে কয়েকটি প্রাইভেট কার। বিভিন্ন রং এর। সাদা গাড়িটির সাথেই এক ভদ্রলোক। মধ্যবয়সের। নিজের মেয়েকে নিয়ে বৈকালিক ভ্রমনে বের হয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের-ই শিক্ষক। নতুন এসেছেন। ছ'বছরের ফুটফুটে মেয়েটি বাবাকে ছাড়িয়ে দৌড়ে বেশ আগে চলে গেছে। বাবা দাড়িয়ে আছেন। মেয়ে কিছুদূর এগিয়ে ফিরে বাবাকে দেখলো।

দূরে দাড়িয়ে অন্য আর এক বাবা। এই বাবা-মেয়ের আনন্দঘন মুহুর্তগুলি উপভোগ করছে। ওর নাম পরেশ। এখানকারই 'এনলিস্টেড সুইপার 'সে।
মোবাইলে কল আসাতে প্রফেসর ভদ্রলোক কিছু সময়ের জন্য মেয়েকে বিস্মৃত হন। চোখ মেয়ের দিকে থাকলেও মন অন্য কোথায়ও।
গত পরশু পরেশের একমাত্র মেয়েটি মারা গেছে। ওর শেষকৃত্য শেষ করে দুদিন এদিক সেদিক ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। স্যারের ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখে নিজের মৃত মেয়ের শোক আরো গভীরভাবে হৃদয়ে অনুভব করে সে।

মেয়েটি ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। হঠাৎ একটি ইটের টুকরায় পা হড়কে সে রাস্তায় পড়ে যায়। ব্যথা পায়। চীৎকার করে কান্না শুরু করতেই পরেশ দ্রুত এগিয়ে বাবুটিকে উঠায়। কান্না থামছে না দেখে নিজের কোলে তুলে নেয়। হাঁটুর কাছটিতে ছড়ে গেছে। রক্ত ঝরছে।
ইতোমধ্যে মেয়ের কান্নার শব্দ শুনে প্রফেসর সাহেব এগিয়ে আসেন। পরেশের কোলে নিজের মেয়েকে দেখে ভ্রুযুগল কুঁচকে উঠে। পরেশকেও চিনতে পারেন। কাছে আসেন। মেয়ের কান্না-সুইপারের কোলে মেয়ে- হাঁটু থেকে ঝরে পড়া রক্ত- এসব কিছু দেখে কিছু না বুঝেই পরেশের গালে চড় লাগিয়ে দেন। বেশ জোরেই মারেন। শব্দ হয়। গালে ছাপ বসে যায়। পথচলতি মানুষের দৃষ্টি কাড়ে।

মেয়ে বাবার আচমকা ব্যবহারে কান্না থামিয়ে ফোঁপাতে থাকে। পরেশ স্যারের মেয়েকে স্যারের কোলে দিয়ে দেয় নিরবে। তিনিও আর কথা বলেন না। নিজের কালো মন নিয়ে সাদা গাড়ির দিকে আগাতে যান। পরেশ তাকে থামায়। জিজ্ঞেস করে,
' আমি কি করলাম স্যার! মারলেন যে?'
প্রফেসর সাহেব থামেন। ঘুরে দাঁড়ান। উত্তর দেন,
- তোর এই নোংরা শরীর নিয়ে কোন সাহসে আমার মেয়েকে কোলে নিয়েছিস?
ছোট যে জটলাটি সৃষ্টি হয়েছে, ওদের একজন ফোঁড়ন কাটে,
' ঠিক কাজ করছেন স্যার। ব্যাটা মেথরের সাহস কতো '

সবাই যার যার মতো চলে যায়। বিমুঢ় পরেশ - মেয়ে হারানো শোকাতুর এক বাবা- এই পৃথিবীর মানুষদের হৃদয়হীনতায় বড্ড কষ্ট পায়।

একমাস পর ...

মেথরপট্টির সরু গলির মাথায়- বড় রাস্তার মুখে, একটা সাদা গাড়ি এসে থামে। এখনো পড়ন্ত বিকেল। সেই প্রফেসর ভদ্রলোক একা হেঁটে আসছেন। পরেশের খোঁজ করেন সামনে একজনকে পেয়ে। সে অদূরে শুকরের খামার দেখিয়ে দেয়।
স্যারকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পরেশ হাতের সিগ্রেট নেভায়। পরেশের স্যার ওর সামনে এসে ওর দু'হাত চেপে ধরে বলেন-
' আমার মেয়েকে তুমি বাচাও পরেশ। '

হতবাক পরেশ। কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ভদ্রলোক ওকে সব কিছু জানান। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ওনার ফুটফুটে মেয়েটি আক্রান্ত। রক্তের প্রয়োজন। খুবই দুর্লভ গ্রুপের রক্ত ওর শরীরে। কোটিতে একজনেরও থাকে না। এমনই দুর্লভ।
পরেশ সেই কোটি মানুষের একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্টাফের ব্যক্তিগত নথিতে অন্য তথ্যের পাশাপাশি রক্তের গ্রুপও উল্লেখ থাকে। কোথাও রক্তের সন্ধান না পেয়ে উদভ্রান্ত প্রফেসর যখন সব আশাই প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন- ভার্সিটির মেডিকেল অফিসারের ফোন আসে। তিনিই পরেশের কথা জানান।
একমুহুর্ত একজন প্রফেসর থমকে যান। পরেশ - একজন মেথর- তার রক্ত! নিমিষে একজন বাবা প্রফেসরের ভিতর জন্ম নেয়। তাকে নরম করে দেয়। কিন্তু তখনও তার ভিতরে একজন মানুষ সত্তার জন্ম হয় না।

এই পড়ন্ত বিকেলে পরেশের আর এক পড়ন্ত বিকেলের কথা মনে পড়ে। সেই বিকেলে সে ছিল এক পড়ন্ত মানুষ। আর আজ ওর স্যার এক পড়ন্ত মানুষ!
মানুষ?
নাহ! পরেশ ভাবে মানুষ না। একজন পড়ন্ত উচুতলার কালোমনা। প্রচন্ড এক ঘৃণায় এক দলা থুথু ফেলতে গিয়েও একজন নিচুতলার মানুষ- এক মেথর নিজের ঘৃণাকে আমূল গিলে ফেলে। ওর হৃদয়ের গভীর থেকে একজন বাবার চোখ দিয়ে সে তার সামনে আর এক অসহায় বাবাকে দেখতে পায়। যে ওর সামনে এই মুহুর্তে সব কিছু করার জন্য প্রস্তুত।
পরেশকে চমকে দিয়ে প্রফেসর ভদ্রলোক হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন-
'তুমি যা চাও আমার কাছ থেকে সব নিয়ে নাও। তবুও চলো আমার সাথে। আমার মেয়েটা মারা যাচ্ছে...'

পরেশ একবার ভাবে বলে, ' আমার নোংরা শরীরের নোংরা রক্ত নিতে আপনার ঘৃণা লাগবে না স্যার?' কিন্তু বাবারা কখনো আর একজন বাবাকে নিচু হতে দিতে চান না।
সে ওর স্যারের দু'হাত চেপে ধরে বলে-
' আপনার চোখের পানি আপনার মনের গন্ধ দূর করছে স্যার। আপনি মানুষ হতে পারছেন!'
নি:শব্দে পরেশের দুগাল বেয়ে দু:খগুলো ঝরে পড়ে। এই জল এক বাবার হৃদয়ের মমতা। বাবাদের রুপ সবসময়েই এক। সেখানে কোনো প্রফেসর বা মেথর নাই।
সবাই বাবা।

দুজন বাবা এক পড়ন্ত বিকালে হৃদয়ের সুগন্ধি মেখে পাশাপাশি পথে হেঁটে চলেন। ফেলে আসা মেথরপট্টির পংকিল পথটি কেমন এক সুগন্ধ নিজের বউউকে জড়িয়ে রাখে। এইমাত্র দুজন মানুষ হেটে গএএছে অর বুক মাড়িয়ে। রেখে গেছে কস্তুরি! হরিণের মৃগনাভির মত, মানুষের হৃদয়ে এটি ছড়িয়ে থাকে, যখন নাম সর্বস্ব মানুষ আসল মানুষে পরিণত হয়।

দুজন মানুষের ভেতর একজন এই কিছুক্ষণ আগে মানুষে পরিণত হয়েছেন- অনুভবে তীব্র যন্ত্রণার দ্বারা নিজেকে শুদ্ধ করে করে।অন্যজন আগেই মানুষ হয়েছিলেন।

দুজন 'মানুষের' ফেলে আসা পথটি প্রচন্ড সৌরভে দীর্ঘক্ষণ উদ্বেলিত থাকে- যখন ঘ্রাণ মিইয়ে যায়, অপেক্ষায় থাকে আরো কিছু 'মানুষ' কখন ওর বুক মাড়িয়ে যায়।।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:২১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাষ্ট্রদূত নিয়োগ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তুঘলকি কান্ড !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৪৪

৫ই নভেম্বর অন্তবর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে। চারিদিকে আলোচনা চলছে এই সরকারের সময়ে কোন মন্ত্রণালয় কেমন পারফরম্যান্স করেছে তা নিয়ে। আলোচনা হচ্ছে অতি গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ে।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকানরা ভীষণ কনজারভেটিভ

লিখেছেন মুনতাসির, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২৬

আমেরিকা নিয়ে মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই—এটা প্রথমেই বলে ফেলা ভালো। আমি শুধু আমার অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমেরিকা তথা উত্তর আমেরিকাতে আমার যাওয়া হয়েছে বেশ কিছুবার। সবগুলো ভ্রমণ যোগ করলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

ট্রাম্প হচ্ছে একজন আপাদমস্তক বিজনেসম্যান। কমলা হ্যা্রিস যেহেতু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত তাই ইন্ডিয়ান ভোটার টানার জন্য সে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে টেনে জাস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্রগ্রামে যৌথবাহিনীর ওপর ইসকনের এসিড হামলা সাত পুলিশ আহত।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৩

এসিড নিক্ষেপে আহত পুলিশ সদস্য



চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর ইসকন সমর্থকদের হামলা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭


INTERNATIONAL SOCIETY FOR KRISHNA CONSCIOUSNESS যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ISKCON এর বাংলা অর্থ হল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। যে সংঘের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×