মা, ওমা, মা! রাত্রির নিরবতার বুক ছিঁড়ে ছড়িয়ে আসে একটি অবুঝ শিশুর আর্তনাদ, গতকাল দুপুরে কোদাল নিয়ে যে শিশুটি মায়ের কবর খুঁড়ে তাকে তুলতে গিয়েছিল, রাত দুপুরে সে তার মায়ের কোল খুঁজে না পেয়ে কান্না জুড়ে, মা-া া! সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর কান্ত শরীরে যে বোন ঘুমিয়ে ছিল, তার ঘুম টুটে যায়। তার ছোট ভাইটি কাঁদছে, বোনটি তাকে ষ্পর্শ করেনা। হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দেয়, সে জানে তার এই মর্মাহত ছোট ভাইটিকে এখন আদর করা মানে ওর দঃখটাকে আরো বাড়িয়ে দেওয়া। নিরুপায় হয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে প্রভুকে দোষারোপ করে, এমনটি কেন হলো বিধি! বুকে ভেতর মায়ের শোক, চোখের সামনে এই অবুঝ শিশুটির আর্তনাদ, শোকে শোকে বোনটির পাথুরে হওয়া। আমি দরজার পাপোশের উপর শুয়ে আছি, মা চলে যাবার পর এটাই আমার বিছানা। দরজা লাগাতে দেইনা কাউকে, আমি জানি আমার মা আসবেই।
শিশুটি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে, আমিতো কাঁদতে পারিনা, তাই আমার ঘুম আসেনা। আজ কতদিন দু'চোখের পাতা এক করতে পারিনা, মা যদি এসে চলে যায়! আমি তাকে আর যেতে দেবনা। আপা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি জানি আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাববে, আমি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছি, দরজা লাগিয়ে দিতে চাইবে। প্রতিদিনের মতো আজও তাকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হবে। আমার সজাগ উপস্থিতি জানাতে বলি,' আপা, মরে গেলে মানুষ খুব নিষ্ঠুর হয়ে যায়! দেখলেতো যে মা মাছুমকে ছাড়া একপলকও কোথাও থাকতে পারতো না, সেই মা-ই মাছুমের কান্না শুনে আসছেনা।' এবার আপা আর নিজেকে সামলাতে পারেনি, বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনতে থাকি আর ভাবি, তারা গোনা শেষ হলেই হয়তো মা আসবে।
আমার কোন কিছুই ভালো লাগেনা, মায়ের হাতের পানি ছাড়া আমার তৃষ্ণা মিটেনা। আপা জোর করে পুকুর ঘাটে নিয়ে গোসল করাতে চাইবে। মাথায় পানি ডাললে যেটুকু পানি ঠোঁটের স্পর্শে আসে, আমি ইচ্ছা করেই গিলে ফেলি, মরতে চাই আমি, কে যেন বলেছিল, মরলে তোর মায়ের সাথে দেখা হবে। আপা বলতো পুকুরের পানি খেলে মানুষ মরে যায়। আমার সকল চিন্তা মাকে ঘিরে, আপা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে খাবার গিলিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পারেনা। একদিন আপাকে বললাম,' আমার একটা জিনিসি খেতে খুব ইচ্ছে করে', আপা রাজ্যের আগ্রহ নিয়ে বললো, কী? আমি মায়ের মত ঘুমাতে চাই বলে বললাম, বিষ। একথা শুনে সে আমাকে অনেক মারলো, তারপর বুকে নিয়ে অনেক কাঁদলো। আমিও সেদিন কেঁদে ছিলাম, মায়ের মৃত্যুর দুইমাস পর এ আমার প্রথম কান্না, আমার শোকের পাথর গলে অশ্রুতে পরিনত হলো। আমার কান্না যেন আর থামতে চায়না, হঠাৎ হঠাৎ বুকের ভেতর বেদনার ঝড় উঠে, আমার মা যেন কোথাও কোন বিপদে পড়েছে, আসতে পারছেনা, আমি যেন তার আর্তনাদ শুনছি। মা যেন আমার জন্য কাঁদছে, আমার কাছে আসতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা।
এখন আর আমাকে পাপোশে ঘুমাতে দেওয়া হয়না। জানালা দিয়ে মায়ের পথ পানে চেয়ে থাকতে হয়। আমার ঘুম হয়না, মাঝে মাঝে মনে হয় দরজা বন্ধ দেখে মা ফিরে চলে যাচ্ছে। আমি দরজা খুলে মা-মা বলে দৌড়াতে থাকি, কিন্তু কোথাও তিনি নেই। মাকে ধরতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটে। এবার আমার ঘরের দরজায় তালা। ওদের তালার কারণে আমার মা আসতে পারেনা ঘরে। আমি প্রায় শুনি, মা আমাকে ডাকছে, বাইরে থেকে তালা দেওয়া, আমি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি মা চলে যাচ্ছে।
তারপর অনেক দিন মা আসেনি, আবার একদিন আসবে, এই বাস্তবকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে, আমাকে নিয়ে যেতে, সেদিন কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবেনা।