গতকালের সামুর পাতায় একটি পোষ্টে দেখলাম জানতে চাওয়া হয়েছে নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আমাদের ধারনা সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল'এর মতো কিনা ? বিশ্ব বিখ্যাত প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটল এর প্রতি পরম শ্রদ্ধা রেখেই বলছি নতুন প্রজন্ম নিয়ে তাঁদের ধারণা তাঁদের মতই মুল্যবান তবে নতুন প্রজন্ম নিয়ে আমাদেরো নিজস্ব কিছু ধারনা রয়েছে । নীচে প্রথমেই প্লেটো ও এরিস্টটলের ধারণা নিয়ে কিছু কথা বলে নতুন প্রজন্ম বিষয়ে আমার কিছু সমাজতাত্বিক ভাবনার কথা বলার প্রয়াস নিব ।
আমি প্রথমেই একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করতে চাই: "আমাদের তরুণদের কী হচ্ছে? তারা তাদের বড়দের অসম্মান করে, তারা তাদের পিতামাতার অবাধ্য হয়। তারা আইন উপেক্ষা করে। তারা বন্য ধারণায় উদ্দীপ্ত হয়ে রাস্তায় দাঙ্গা করে। তাদের নৈতিকতা ক্ষয় হচ্ছে তাদের কি হবে?" এই শব্দগুলি ২৪০০ বছরেরও বেশি আগে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো লিখেছিলেন।
বিখ্যাত আরেকজন গ্রীক দার্শনিক, অ্যারিস্টটল, তরুণদের সম্পর্কে অনেকটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছিলেন: "তরুণরা উচ্চতর ধারণা পোষণ করে, কারণ তারা এখনও জীবনের গতিধারায় নম্র হতে পারেনি বা এর প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতাগুলি শিখেনি; অধিকন্তু, তাদের আশাবাদী স্বভাব তাদের নিজেদেরকে সমান মনে করে। তারা সর্বদা উপকারী কাজের চেয়ে মহৎ কাজগুলি বেশী করতে চায়: তাদের জীবন যুক্তির চেয়ে নৈতিক অনুভূতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় - তাদের সমস্ত ভুলগুলি অত্যধিক এবং প্রবলভাবে কাজ করার দিকে থাকে -- তারা ভালবাসেও অনেক আবার ঘৃণাও করে বেশি, এবং অন্য সবকিছুর সাথে একই।"
আমি আজ এইভাবে শুরু করছি বয়স্ক প্রজন্মকে আশ্বস্ত করার জন্য যে প্রজন্মের ব্যবধানটি ২৪০০ বছর পরেও অনেকটা একই রকম দেখায় এবং একইভাবে এই তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে তারা তাদের তারুন্যকে সঠীকভাবে উপলব্দি করেনি, ফলে তারা তাদের তারুন্যকে আকর্ষণীয় এবং কঠিন উভয়ই করে তোলে। আমি তরুণ প্রজন্মের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করতে চাই ফরাসীরা নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছেন: vive le difference -- প্রজন্মের মধ্যে পার্থক্য দীর্ঘজীবী হোক।
তবে নতুন ও প্রবীন প্রজন্মের পার্থক্য কিভাবে কমানো যায় সেটাই ভাবনার বিষয় বটে ।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে প্রজন্মের মধ্যে পার্থক্য সবসময় একই রকম - যদিও প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল ধারণাকে তুলে ধলেছেন । উল্লেখ্য বাংলাদেশসহ আজকের বিশ্বে প্রায় অর্ধেক মানুষই তরুণ প্রজন্মের ।
যদিও, অ্যারিস্টটল বলেন, তারা খুব বেশি ভালবাসে এবং খুব বেশি ঘৃণা করে, আসলেই অনেক বিষয়ের প্রতিই তরুন প্রজন্মের অনেক ভালবাসা এবং তীব্র ঘৃণার প্রকাশ দেখা যায় । কিন্তু আসল প্রশ্ন হল: তারা কি ভালবাসে এবং কি ঘৃণা করে? আমি ধারণা করি যে তারা আমাদের তৈরি করা বিশ্বকে অত্যধিক ভালোবাসেনা, এবং আমি ধারণা করি তারা এমন কিছু জিনিস ঘৃণা করে যা ঘৃণার যোগ্য এবং সত্যিই সেগুলিকে অত্যধিক ঘৃণা করে যেমন: অকারণ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, মানুষের জন্য অসাম্যতাপুর্ণ পৃথিবী, সচ্ছলতার নামে দারিদ্র্যতা , সমাজ সেবা ও ধর্মের নামে ভণ্ডামি, কর্মের পরিবর্তে বাগ্মীতা, অর্জন ছাড়াই প্রতিশ্রুতি, খালি কথার কথা , আর নিরস ও নিস্ফল অনেক গুণাবলী তারা প্রায়শই প্রবীন প্রজন্মের মধ্যেও খুঁজে পায়। তারুণ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিরুৎসাহিতকর বিষয় হল যে প্রতিদিনই তারা বৃদ্ধ হচ্ছে এবং আজকের মতো দিনে তারা বয়সে পৌঁছেছে আমাদের অনেকের মত সফল ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার প্রবল প্রলোভন নিয়ে, অন্যায়ের সাথে আপস করে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের সন্তানদের কাছেই অনিচ্ছাকৃত ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে, কারণ অতীতে যুবাকালে বা তাদের যৌবনে তারা যে মহৎ কাজের স্বপ্ন দেখেছিল তার চেয়ে অদরকারী কাজই বেশী করেছে।
হয়তো তাদের যৌবনের জগৎ সত্য ও স্থায়ী হওয়ার জন্য ছিল খুবই উত্তম সময় । আদর্শবাদ, উদারতা এবং যৌবনের উন্মাদনা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিবর্তে, আমাদের বরং শোক করা উচিত যে যৌবন খুবই দ্রুতবেগে ভয়াবহ বয়োবৃদ্ধ জীবনের দিকে চলে যায়, যখন আমাদের উচিত ছিল ভালর প্রতি ভালবাসা এবং মন্দের প্রতি ঘৃনা করার কথা । মনে পরে আমাদের তরুনকালে কবি গুরুর মত বয়োজেষ্ঠ অনেকেই তেমন করে বলেন নি -
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
গত কয়েক মাসে, আমি বেশ কয়েকটি জনহীতকর কাজে অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি । অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন: "কি হচ্ছে এই প্রজন্মের? কেন অশান্তি, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ বিক্ষোভ দেশে দেশে ? কেন নব প্রজন্মের জন্য সমাজ সেবা ও শিক্ষার তরে এত পরিশ্রম এবং অর্থ ঢালা?" আমিও প্রশ্নকারীদের কাছে জানতে চেয়েছি আজকের তরুণদের অস্থিরতা, প্রতিবাদ, বিদ্রোহের কারণ কী বলে মনে হয় তাদের কাছে , যেমনটা অতীতের অনেক নব প্রজন্মের মতো আজকেও দেখা যাচ্ছে যথা গাজায় যুদ্ধ নিয়ে আমিরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে তরুন প্রজন্মের ছাত্রদের বিক্ষোভ ।
আমি মনে করি এর জন্য বেশ কিছু তাৎক্ষণিক কারণ আছে। প্রথমত, আজকের তরুণরা এমন একটি সমাজে বেড়ে উঠেছে যা বুদ্ধিমত্তাকে স্বীকৃতি দেয়, । তাদের চিন্তা করার, আলোচনা করার, সমালোচনা করার, পড়ার, ভ্রমণ করার, তুলনা করার, বিচার করার জন্য আগের থেকে অনেক বেশি সুযোগ রয়েছে - এটি এমন জিনিস যা দিয়ে ভাল শিক্ষা তৈরি হয় এবং এর পরিণতিও আছে।
বৈষম্যমুলক সমাজ জীবনের শুরুতে হয়তবা আজকের তরুনদের অনেকেই ভাবতে শিখেনি অবিভাজ্য জাতি , সবার জন্য স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার কাকে বলে । তারপর বৈষম্যমুলক শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়ে উঠা তরুনরা চিন্তা করতে শুরু করেছিল তাদের স্বপ্নের কিছু বিষয় অর্জনযোগ্য হলেও বেশীরভাগ জিনিষই তাদের অর্জন সীমা বা নাগালের বাইরে । তারা জানতে ও ভাবতে শিখেছে দেশের তরুন প্রজন্মের বেশীর ভাগই বিশেষ করে শিক্ষিত তরুনদের বেশীর ভাগই বেকারদের প্রতিনিধিত্ব করে । তারা নিন্মমানের সরকারী ও বেসরকারী স্কুল, কলেজ ,মাদ্রাসা, বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা এবং সামাজিক গতিশীলতার অভাব ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয় যা বৃত্তাকার এবং অনিবার্য। দেশের তরুন প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই বেড়ে উঠেছে চরম দারিদ্রতার মধ্য দিয়েই ।
যে চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তার অনেকটাই থেকে যায় তাদের কাছে অপুর্ণ , জাতি বিত্তবান আর বিত্তহীনদের মাঝে হয়ে যায় বিভক্ত ।
স্বাধীনতার মানে ধনী এবং বিত্তবান আশাবাদীদের কাছে এক জিনিস, আর দরিদ্র এবং আশাহীনদের কাছে অন্য জিনিস। ন্যায়বিচারও তেমনি।দেশে দারিদ্রতা কিছুটা কমলেও আয় বৈষম্য বেড়ে যায় অনেক ।
দেশের এই অবস্থা তাই হয়ে উঠে তরুনদের জন্য মোহ ভঙ্গের ভোর, যৌবনেও সেই মোহ ভঙ্গ থাকে বহমান কিংবা নতুন করে হয় তার আগমন।ফলে তরুনদের মধ্যে মাঝে মাঝে জেগে উঠে প্রতিবাদের ঝড় যেমনটি দেখা গিয়েছিল কোটা বিরোধি আন্দোলনের সময় । তবে অনেকেই হতাশায় হয়ে পড়ে নেশাগ্রস্ত ,আর কেওবা সমাজ বিরোধি কিংবা দুবৃত্তপনায় মত্য । নীতি বিবর্জিত ছাত্র বা যুব রাজনীতি হয়ে পরে অনেকের কাছে পরম আরাধ্য পেশা ।
এমতসময়ে নতুন ক্ষমতা কাঠামোয় তরুনদের মধ্য হতে নতুন নেতৃত্ব, সক্রিয় প্রতিবাদী শক্তির আবির্ভাব নতুন প্রজন্মের কাছে অসম্ভব হয়ে উঠে অসুস্থ অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে । নব প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য অংশই হারিয়ে যায় ক্ষণিকের অনৈতিক চাওয়া পাওয়ার কাছে । নাগরিক অধিকার হরনের কারণ দুর করে এবং সামাজিক পরিবর্তনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ হয়ে উঠে কঠিন থেকে কঠিনতর ।
নবপ্রজন্মের জন্য অবশ্য নতুন উন্মাদনাও তৈরী করা হয় সস্তায় মানব সম্পদ রপ্তানীর মাধ্যমে । এটা তরুনদের মধ্যে আশা, নিরাশা ও হতাশা সবকিছুই জন্ম দেয় একসাথে । কেও স্বামী, স্ত্রী পুত্র আত্মিয় স্বজন ছেড়ে হয় গৃহত্যগী , কেও ডুবে মরে ভুমধ্য সাগরে , কেওবা ভিটে মাটি বিক্রি বা বন্ধক রেখে বিবিধ কারণে দেশ ত্যাগ করতে না পেরে কিংবা অসময়ে আচমকা দেশে ফিরে হা পিত্যেস করে মরে । ইত্যাকার বিষয়ের জন্য কোন সে প্রজন্ম দায়ী , নবীন না প্রশাসনের সচিবালয়ের উচ্চ পর্যায়ের প্রবীন প্রজন্মের অদক্ষতা কিংবা দুরদৃষ্টিহীন কর্মকৌশল দায়ী , তা ভাবার জন্য সেই দার্শনিক আজ কোথায় !!
প্রবীণগন নব প্রজন্মের সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে ফলপ্রসু কিছু কর্মসুচী গ্রহন ও বাস্তবায়ন করেছেন এ কথা সত্য । তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে শিক্ষার্থীদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিনত করে নব প্রজন্মের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্থ কিংবা উন্নত মানের কর্ম পরিবেশ সৃস্টি না করে মেধাবীদেরকে দেশ ত্যাগে উতসাহিত করা ছাড়া নবপ্রজন্মের জন্য তারা কতটুকু করেছেন । হাজার দুয়েক বিসিএস ক্যাডার পদের জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ বেকার আর অর্ধ্য বেকারের সে কি কাকুতি ও পরিনতি তা
তো দেশবাসী দেখছেই । তরুন প্রজন্মের ভয়াবহ মানব বিপর্যয়ের আর কতটাই বা বাকি ।
আমি নবপ্রজন্মের সমস্যাটিকে হয়তবা অতি সরলীকৃত করেছি এবং সম্ভবত অল্পবয়সিদের মতো সমস্যাটিকে অতিরঞ্জিত করেছি, তবে নতুন প্রজন্মের সমস্যাগুলি কর্ম সংস্থানের সুযোগের অভাব, ন্যায়বিচার এবং নৈতিকতার একটি বাস্তব দিক যা আমাদের অনেককে আগে কখনও ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেনি । এই সমস্যাটি আমাদের শিক্ষাঙ্নের পরিবেশকেও বিষাক্ত করেছে, অন্যান্য অনেক ভালো ও মহৎ প্রয়াসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দৃশ্যকে ধাক্কা দিচ্ছে, আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ককে ( বিশেষ করে বিদেশে বিবিধ কারণে আটকে পরা নব প্রজন্ম ও প্রবাসী কর্মী সংক্রান্ত বিষয়াবলি) জটিল করে তুলেছে এবং অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে
আমাদের তরুণদেরকে গভীর ও স্থায়ী হতাশার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের নাটকের চূড়ান্ত এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ শিক্ষা ক্যাম্পাস গুলিতে বিক্ষোভ যা ঢাবি , চুয়েট বুয়েট সহ প্রায় সর্বত্রই ঘটতে দেখা যায় মাঝে মধ্যে । অর্থপূর্ণ নাগরিক অধিকার হরন জাতীয় কর্মকান্ডে দায়িত্বশীল প্রবীনদের পদক্ষেপের মুখে নিজেদেরকে কম বেশি অসহায় বোধ করে তাদেরকে উগ্র প্রতিবাদী কিংবা আরও খারাপ হতে দেখা গেছে । আজকের যুগে নবপ্রজন্মকে সমালোচনার ক্ষেত্র অনেকগুলি; তাদের নৈতিকতার অবক্ষয় , তাদের উদাসীনতা , লক্ষ্যহীনতা, লেখা পড়ায় অনিহা বা অসাধু পন্থা অবলম্বন ইত্যাদি । এই নব প্রজন্ম কীভাবে হঠাৎ করে এত সমালোচিত হলো, তার সমাজতাত্বিক সঠিক বিশ্লেষনের বড়ই অভাব । তার পরেও আইন ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত হয়েও সত্যিকার ভাবে কেন তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারছেনা তা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন । ঠিক এমনি একটি সময়ে নব প্রজন্ম নিয়ে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটটল ও প্লেটোর দার্শনিক তথ্য নব প্রজন্মের জন্য আরো অশনিসংকেত বয়ে আনছে কিনা সেটাই বিবেচনার বিষয় ।
আধিপত্যবাদী একটি সমাজে নতন প্রজন্ম যে এখন প্রতিবাদী হতে শুরু করেছে তা আর কেবল স্থানীয় নয়, জাতীয় এবং
আন্তর্জাতিক । এই সপ্তাহের লন্ডন, বার্লিন, টোকিও, নিউ ইয়র্কের সংবাদপত্রগুলি পাঠ করলে দেখা যাবে তাতে রয়েছে
নতুন প্রজন্ম ও ছাত্র বিক্ষোভের কথামালা।
ছবি সুত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
আমার কাছে মনে হয়, আমরা যখন তরুণ প্রজন্মের বিদ্রোহ/বিক্ষোভকে বিবেচনা করি তখন দেখা যায় সংস্লিষ্ট সমস্যাসমুহ দুর করার জন্য প্রয়োজনীয় গুণগুলি প্রবীন প্রজন্মের কাছ থেকে খুব কমই পা ওয়া যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় প্রয়োজন রয়েছে যুক্তিসঙ্গত আলোচনা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য তরুনদেরকে ক্রমাগতভাবে প্রেরণা যোগান দেয়া, যাতে তারা ভয়ংকর অসাম্য ও অবিচারের প্রতিকারের জন্য সর্বাত্বক প্রচেষ্টা নিতে পারে । সমাজকেও তার কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে, কারণ, স্পষ্টতই দেশে এখনো এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছেনা যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগের সৃষ্টি হয়, যা নব প্রজন্মের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ।
আশার কথা হচ্ছে আমরা নবপ্রজন্মকে সেরা আশাটি অর্জনে উদ্বুদ্ধ করছি। বহু বছর আগে, জাতিসংঘ মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র জারি করেছিল, কিন্তু এটি এখনও শুধুমাত্র একটি ঘোষণা, এখানে এবং বিশ্বের আরো কোটি কোটি মানুষের জন্য তা এখনো সত্যিকার ফল দিচ্ছেনা।
কোনো না কোনোভাবে, কোথাও না কোথাও , আমাদের তরুণদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে সমাজের গঠনমুলক কাজে/পরিবেশে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষম অংশ হিসেবে, যদি আমরা আদৌ তা চাই । আমি আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের পুরোটাই শিক্ষা ও সমাজসেবামুলক গবেষনার জগতে কাটিয়েছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে নবপ্রজন্মের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে একটি ভাল জায়গা যেখানে বর্তমানে নবপ্রজন্ম ভাল কাজে উৎসাহী হতে শিখছে ( অবশ্য ছাত্র নামধারী স্বার্থবাদী রাজনীতির কারণে অনেক জায়গায় তা দারুনভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে , তরুনদের মাঝে এ ধরনের অপ ছাত্র রাজনীতিটাও বন্ধ হওয়া প্রয়োজন )। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষক রাজনীতিও তারুণ্যের বিস্ফোরণটি বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা ক্রমাগতভাবে ব্যক্তি বা গুষ্ঠি স্বার্থে ব্যবহার করে চলেছে। আমাদের তরুন নব প্রজন্মকে ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহারের পরিবর্তে ফলপ্রসূভাবে ভাল কাজে জড়িত করার উপায়গুলি তৈরি করতে উদ্যোগী হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের সব সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র রাজনীতি এখন কাঠগড়ায়। সংগঠনগুলোর একশ্রেণির নেতাকর্মীর অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছাত্র রাজনীতিবিমুখ করছে। বিপরীতদিকে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্র ক্যাম্পাসগুলোয় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে সর্বকালেই। এ অবস্থায় শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে পথ হারানো ছাত্র রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশিষ্টজনরা।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনের সময় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলোচনা নতুন করে সামনে এসেছে।
তরুন নব প্রজন্মের প্রায়োগিক কাজের শিক্ষা ও প্রশিক্ষন মুলত পুর্ণতা পায় কলেজ ও বিশ্ব বিদ্যালয় সমুহে । বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ও শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয় এবং অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য আমরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কাঠামো তৈরি করে কাজ শুরু করতে পারি। ক্যাম্পাসে একটি বাস্তবমুখী তরুন সম্প্রদায় তৈরি করা যায় যেখানে ছাত্রদের একটি বাস্তব মৌলিক ভূমিকা থাকবে তা যেন আবার নকল না নয়৷ তারা এখন যে শিক্ষা পাচ্ছে তা নিয়ে যদি তারা অসন্তুষ্ট হয়, তাহলে তাদের কথা শোনার উপায় থাকা উচিত এবং অনুষদ ও প্রশাসনের দ্বারা তাদের ধারণাগুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। এর অর্থ এই নয় যে তাদের সমস্ত ধারণা ভাল বা তাদের সকল আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন সবসময় বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত । এবং এর অর্থ অবশ্যই এই নয় যে তাদের ধারণাগুলি সহিংসতার হুমকির মধ্যে দিয়ে বাধ্য করা উচিত। বরং একটি বাস্তব সংলাপ হওয়া উচিত যা নিজেই শিক্ষণীয়। ছাত্রদেরকেও শুনতে হবে যে আজ তাদের কাছে যা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে তা এখন থেকে দশ বছর পর বেশ অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। নব প্রজন্মের ছাত্রদের শুনতে হবে যে ভাল ধারনা এবং বাস্তব লক্ষ্য এবং সত্যিকারের মূল্যবোধ ব্যতীত কাজ হল শুধু মাত্র ফাকা বুলি , তরুণদের কাছে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে তা হল উচ্চমানের শিক্ষা যা পাওয়াটা্ই হতে হবে জরুরী ।
এটা লক্ষনীয় যে বেশ অনুপ্রাণিত তবে অধৈর্য তরুণ প্রজন্মের অ্যাক্টিভিস্টের ট্র্যাজেডি হল তারা প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সরঞ্জাম দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করতে অধৈর্য হয়ে নিজেকে সত্যিকারের কর্ম উপযোগিতা থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার মত গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে । হতাশাগ্রস্থ কিংবা আদর্শগত কারণে উগ্র পন্থা অবলম্বন , দারিদ্র্য এবং অসম্মানীয় কাজের সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা অনেকেই দেখেছি আমাদের উচ্চ প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের প্রতিভা নষ্ট করে, নিজেকে সপে দেয় সস্তা এবং ক্ষণস্থায়ী সন্তুষ্টির জন্য। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যেন কোন র্যাডিক্যাল প্রাপ্তি বা অধৈর্য, বুদ্ধিবৃত্তিকতা আমাদের অনেক সেরা মস্তিষ্ককে/প্রতিভাকে সত্যিকারের উপযোগিতা থেকে দূরে সরিয়ে না দেয় । তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে বিশ্বের সকল সংবেদনশীল সমস্যাগুলির অতি সরলীকরণ সমাধানের জন্য পথ চলা তাদের জন্য নয় , এটা অবশ্যই প্রবীন ও বিজ্ঞদের জন্যই অধিক যক্তিযুক্ত , নবীনদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহনই প্রয়োজন সর্বাজ্ঞে ।
উপরে বলা বিশিষ্টজনদের কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত, তবে , নব প্রজন্মের তারুণ্যের প্রতিরক্ষায়, আমাদের অবশ্যই তাদের পক্ষটিও দেখতে হবে। উপরে বলা কথাগুলি তারা মেনে নিতে পারে যদি অন্তত আমরা বয়োজেষ্ঠরা তাদের উদ্বেগগুলি ভাগ করে নিই, যা আমাদের কাছেও উদ্বেগের হওয়া উচিত এবং সেগুলি সম্পর্কে নিজেরা কিছু করাও উচিত। প্রবীনদেরকে তাদের মুখোমুখি হতে হবে এবং তাদের সাথে সাথে, তাদের শিক্ষার বা আকাঙ্খার বিষয়গুলির প্রাসঙ্গিকতার জন্য তাদের উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ভাবতে হবে কীভাবে আমরা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , গবেষনা ও কর্ম কাঠামোর উন্নতি করতে পারি যাতে তারা তাদের শিক্ষার সাথে বাস্তব জীবনের কর্মকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলতে পারে –তাদের পারিবারিক ,সামাজিক , স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের ভিতরে এবং বাইরে। আমাদেরকে তাদের সুন্দর জীবনের জন্য তাদের উদ্বেগকে ভাগ করে সহিংস এবং ধ্বংসাত্মক প্রতিবাদের বিকল্প কিছু দিতে হবে, এবং তাদের সাথে তাদের চলমান বিদ্যায়তনের একটি অর্থপূর্ণ ঐক্য তৈরি করে দিতে হবে , যাতে আমরা সকলে নব প্রজন্মের জন্য একটি সার্থক লক্ষ্য এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার জন্য একসাথে কাজ করতে পারি ।
আমি আত্মবিশ্বাসী যে এটি করা যেতে পারে যদি নব প্রজন্মকে দেয়ার জন্য প্রবীণদের হাতে সময় থাকে এবং তারা উভয়েই যদি একে অপরকে সম্মান করতে শিখতে পারে, এবং একে অপরের প্রতি আরও বেশি সহনশীলতা রাখতে পারে এবং প্রতিযোগিতামূলক ভূমিকার পরিবর্তে পরিপূরক ভূমিকায় আবতীর্ণ হতে পারে । তরুনদের উচিত হবে তাদের গুরুজনদের বিশ্বাস করা যে তারা যা করেছে তা দ্বারা যা কিছু শিখেছে তা সবই খারাপ নয়। শিক্ষা পাঠ্যসুচী , দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, শিক্ষানীতি , মানবাধিকার আইন, শ্রমনীতি , প্রভৃতি প্রবীণদের দ্বারা প্রণীত এবং চালু করা হয়েছিল, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রোগ্রামগুলি তরুণদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের জন্যই নতুন জীবন এবং উজ্জ্বল চেতনা প্রদান করেছিল। এই ধরনের আরও অনেক উন্নয়ন হতে পারে যার ফলে নতুন প্রজন্মের সকলেই আরো উন্নততর জীবনের সোপান তৈরীতে সক্ষমতা পাবে । তাদেরকে ২৪০০ বছর আগে মহামতি প্লেটো ও এরিসস্টলের বলা কথামালা গায়ে ধারণ করে হয়তবা আর পথ চলতে হবেনা তবে তাদের মুল্যবান ভাবনাগুলি নব প্রজন্মের জন্য সুস্থ ধারার পথ চলায় পাথেয় হয়ে থাকবে ।
আমাদের প্রাচীন দার্শনিক সক্রেটিশ , প্লেটো ও এরিস্টটলের প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলী ।
আমার আজকের ভাবনার মুল প্রতিপাদ্য বিষয় হল নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিশ্বকে পুনর্নির্মাণের জন্য মানুষের বহুবর্ষজীবী কাজে অবদান রাখতে পারে এবং তাদের তা করাও উচিত। বিশেষত যেহেতু তারা সংখ্যায় বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তাই বিশ্ব পুনর্নির্মাণের কাজটি যুবক বা বৃদ্ধ, কেউই একা করতে পারে না। আমরা প্রবীণরা মাঝে মাঝে তাদের প্ররোচনা, প্রতিবাদ বা বিদ্রোহে অস্থির হয়ে উঠতে পারি এবং তারা আমাদেরকে অসম্ভবভাবে ধীর মনে করতে পারে তবে আমরা মনে করি না যে আমরা তাদের সাহায্য ছাড়াই আগামীকাল সকালের মধ্যে সবকিছু পুনঃনির্মাণ করতে পারি। এটাও সত্য যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তবা খুব
সহজসাধ্য নয় এবং প্রজন্মের মধ্যে ব্যবধান কখনই সম্পূর্ণভাবে কমবেনা । তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই যে আরো অনেক কার্যকর সেতুবন্ধন রয়েছে, যা আজকের সাধারণ ব্যবহারের চেয়ে অন্তত আরও বেশি কার্যকর, এবং তা হলো ভালবাসা এবং হাসি। প্রকৃতপক্ষে, আমি প্রেম ভালবাসা এবং হাসির চেয়ে আজকের এই করুণ পৃথিবীকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আর কোন ভাল উপায় ভাবতে পারছিনা । অনেক তরুণ ভুলে গেছে কিভাবে হাসতে হয়, এবং অনেক বড়রাও ভুলে গেছে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। আমাদের জীবনের অন্ধকার ট্র্যাজেডি কখনো হাল্কা হবে না যদি না আমরা সবাই নিজেদেরকে আরও সহজে হাসাতে এবং একে অপরকে ভালবাসতে শিখাতে পারি। এটা অদ্ভুত শোনাতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি এটি প্রজন্মের ব্যবধান কমাতে অনেক সহায়ক হবে ।
এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।
ছবি সুত্র : কৃতজ্ঞতার সহিত গুগল অন্তরজালের পাবলিক ডমেইন থেকে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪