পরশ পাথর পাওয়ার কাহিনী কোন স্বপ্ন বা গল্প নয়, এটা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি জলজ্যান্ত সত্য ঘটনা,পরশ পাথরটি পেয়ে হারানোটাও ছিল আরো মর্মান্তিক ।পরিবারের বয়স্ক লোকজন ছাড়া কাছের দুনিয়ার আর কেও এ কাহিনী এখনো জানেনা। পরিবারের গুরুজনরা নীজেরাও এ কাহিনী কাওকে বলেননি আর আমাকেও বলেছিলেন একাহিনী যেন কাওকে না বলি। এর কারণ হিসাবে বলেছিলেন হারানো পাথরতো আর খুঁজে পাবনা তবে মুল্যবান পরশ পাথরটি শ্পর্শ করার ফলে এর কিছু সুফল আমি পেতে পারি।এটাও বলেছিলেন কারো কাছে বললে আমার কথা কেও বিশ্বাসতো করবেইনা বরং হাসি মস্করা ও বিদ্রুপ করবে। এর ফলে আমার জীবনে নাকি ভয়ংকর ভয়ংকর অনেক বিপদ ঘটতে পারে । প্রথম বিপদটাই নাকি আসবে বন্ধু বান্ধবদের নিকট হতে বিবিধ ধরনের বিদ্রুপ তথা বুলিয়িং এর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পেরে স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে থেকে নীজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারি। কি ভয়ংকর কথা, সেই বয়সে সোনা দানার মুল্য কতটুকু তা জানতামনা ,তাই এর প্রতি কোন আকর্ষন ছিলনা। তবে পরশ পাথর প্রাপ্তির কথা কাওকে বললে স্কুলের লেখা পড়া ছেড়ে দেওয়ার বিপদের কথাটি মনের ভিতর গেথে যায়। ছোট কালে ছড়ার বইয়ে ও গুরুজনদের কাছ হতে শুনে এসেছি,লেখাপড়া করে যে গাড়ী ঘোড়া চড়ে সে। তাই যে তথাকথিত পরশ পাথর পেয়েও হারিয়েছি আর হারানো পাথরটি দেখতে সুন্দর হলেও যার গুনাগুণের কোন বিষয়ই আমি চাক্ষুষ দেখিনি, সেই পাথরের কথা বন্ধুদের কাছে বলে নীজের বিপদ ডেকে না আনার জন্য গুরুজনদের সাবাধান বাণী এতদিন যতন করে মেনেই চলেছি।
এবার জীবনঘাতি করুনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হসপাতালের কেবিনে অসহায়ের মত নাকে মুখে অক্সিজেনর মুখোষ পরে অন্তিমের পানে ধাবিত হওয়ার সময় দেহ মনে চরম যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছে। করুনা ভাইরাসের ছোবলের যে কি যন্ত্রনা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেও বুঝবেনা । করুনা ভাইরাসের ছোবল যন্ত্রনা অনুভুত হত মাথার চুলের গোড়া হতে শুরু করে পায়ের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত । শ্বাস কষ্টে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে বিরামহীন কাশি , প্রতিটি কাশির সাথে গলায়,বুকে ও তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা, মনে হত এই বুঝি জীবন গেল,ডাক্তার নার্স এসে ইনজেকশন দিয়ে ব্যথা ও কাশীর প্রকোপ বন্ধ করে যাওয়ার পরে ঘুমে একটু চোখ বন্ধ হলেও কিছুক্ষনেই মধ্যেই আবার কাশীশুরু হয়ে তিব্র মাথা ব্যাথা নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যেত । মনে হতো বুকের ভিতর যেন কাশীর একটি সফট ওয়ার ইন্সষ্টল হয়ে আছে যার মুল কাজ হলো ঘুমানোর সাথে সাথেই যেন অটোমেটিক্যলী কাশি শুরু হয়ে যায় । শরীরের এমন কোন অঙ্গ প্রতঙ্গ নেই যেখানে প্রচন্ড ব্যথা হতোনা। জ্বরের ফলে মুখে নেই খাওয়ার রুচী ,নাওয়া খাওয়া ঘুম বন্ধ, প্রাতক্রিয়া কি জিনিষ তা ভুলেই গিয়েছিলাম ।
আত্মীয় স্বজনসহ কোন ভিজিটরস আসতে পারছেনা কাছে। স্বাস্থসেবীগন মুখোশ পরে কিছুক্ষন পরে পরে এসে ব্লাড প্রেসার , হার্টবিট ও অক্সিজেন প্রেসার লেভেল চেক করে যাচ্ছেন । ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁদের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কেমন দেখলেন জিজ্ঞেস করলে সংক্ষিপ্ত জবাব কন্ডিশন স্টেবল ,নো চেঞ্জ। আশা নিরাসার কোন বাণী নেই তাদের চোখে মুখে। ব্যথা যন্ত্রনায় মাঝে মাঝে বেহুশ, মাঝে মাঝে হুশ এ নিয়েই হাসপাতাল বেডে শুয়ে কাট ছিল দিন। মাঝে মধ্যে ব্যথার প্রকোপ একটু কমে হুশ আসলে বাল্যকাল হতে শুরু করে হালনাগাদ জীবনের অনেক স্মৃতিকথাই মনের পর্দায় উঠত ভেসে। সে সময় অনেক কাহিনীর ভীরে ভুলে যাওয়া পরশ পাথর প্রাপ্তি প্রক্রিয়া ও তার পরবর্তী মর্মষ্পর্শী ঘটনার কিছু স্মৃতিকথা মনে পড়ত । কেবলি মনে হত, যা হয় তা হবে, হায়াত না থাকলে মরেইতো যাব, তবে আর কেন মুরুব্বীদের সাবধানবাণী মেনে নিয়ে মুখ বন্ধ করে চলা? তাছাড়া দাদা দাদী মা বাবা প্রয়াত হওয়ার পর এখন আমিই পরিবারের বয়োজেষ্ট, বাহ্যত জবাবদিহীতার তেমন দায় নেই। তা ছাড়া লেখাপড়া যৎসামান্য যাই করেছি, গাড়ী ঘোড়া চড়েছি তার থেকে ঢের বেশী । তাই মনে হয়েছিল কি আর হবে , এবার সুযোগ পেলে জীবনে ঘটে যাওয়া একটি বেদনা বিদুর ঘটনার সাক্ষী পরশ পাথর প্রাপ্তির কাহিনীটা জীবনের শেষ ট্রেনটা ধরার আগে সকলের কাছে বলেই যাব। তাছাড়া জীবনের দীর্ঘ চলার পথে কত রুপের পরশ পাথরতুল্য জিনিষ/বিষয়ের সাথেই না পরিচিত হয়েছি। সেসব প্রেক্ষিতেই ভাবছি লাল রঙের একটি পরশ পাথর প্রাপ্তির কাহিনীর সাথে বিবিধ ধরনের পরশ পাথরের কাহিনী নিয়ে এই নিরানন্দ ও ভয়ংকর করুনার দিনগুলিতে সরস/নিরস কিছু আলোচনা সামুর পাতায় পর্বাকারে রেখে যাব। সে ভাবনা হতেই লেখাটির অবতারনা। লেখাটি যদি একজন পাঠকের কাছেও ভাল লাগে তাহলেও লেখাটি স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
লাল রঙের গোলাকার পরশ পাথরটি প্রাপ্তির প্রক্রিয়ার শুরু সেই বাল্যকালে ছোট একটি মাটির ঘর বানাতে গিয়ে ।আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর বার্ষীক লিখিত পরীক্ষা শেষ করেছি। আমাদের মডেল প্রাইমারী স্কুলে সেসময় একটি সৃজনী পরীক্ষা হতো। তখন অবশ্য এই পরীক্ষাটির নাম ছিল ‘হাতের কাজের পরীক্ষা’। এই পরিক্ষার জন্য ঘরে বসে যে কোন একটি সৌখিন কারু কাজ করে নিদৃষ্ট দিনে স্কুলে নিয়ে যেতে হতো । মাটির পতুল,কাঠের পুতুল ,কাগজের ফুল,কাঠের ছোট নৌকা,বাশের ঝুরী , পাটের দরির শিকে, নকশী করা হাত পাখা মোট কথা বাড়ীতে বসে নীজ হাতে করা সৌখিন যে কোন উদ্ভাবনীমুলক সৃজনশীল কাজই ছিল এই পরীক্ষার বিষয় বস্তু । এই সৃজনী পরীক্ষার জন্য কি তৈরী করা যায় সেটা ভাবতে ভাবতেই একদিন পার হয়ে গেল । অনেক ভেবে অবশেষে ছোট একটি মাটির ঘর বানাব বলে মনস্থ করলাম । আমাদের এলাকায় সেসময় খুব সুন্দর সুন্দর মাটির ঘর তৈরী হতো। মাটির ঘরগুলি ছিল খুবই মজবুত এবং বলতে গেলে এয়ার কন্ডিশন্ড ,শীতকলে ঘরের ভিতরে গরম এবং গ্রীস্মকালে ঘরের ভিতরটা থাকত শীতল ।
মাটির ঘরের দেয়ালগুলি বিশেষভাবে তৈরী শক্ত মাটির ফাউন্ডেশনের উপর দাঁড় করানো এবং দেয়ালের পুরুত্ব ছিল প্রায় ১৮ থেকে ২৪ ইঞ্চির মত । ঘরের ভিতরটাকে ঠান্ডা রাখার জন্য অনেকেই শনের(খরকুটা জাতীয় শক্ত উদ্ভিদ) ছাউনী কিংবা কুমারের হাতে তৈরী পোড়ামাটির টালী দিয়ে ঘরের চালের ছাউনী দিতেন । অনেকে নীজেরাই মাটির ঘর তৈরী করতেন । যাদের সমার্থ ছিল তারা দক্ষ কারিগরের দ্বারা মাটির ঘর তৈরী করতেন । আমাদের বাড়ীতে সে সময় একটি বেশ বড় মাটির ঘর তৈরী করা হয়েছিল দক্ষ কারিগরের হাত দিয়ে । সে সময় আমি খুবই মনযোগ দিয়ে দেখেছি কারিগরেরা কিভাবে ঘরের জন্য মাটি তৈরী করে এবং তৈরী মাটিকে কিভাবে ছোট ছোট কাদামাটির ঢেলার মত করে একটির উপর আরেকটি বসিয়ে দেয়াল তৈরী করে। ঘর তৈরীর জন্য কারিগরেরা প্রথমেই সন্ধান করত ঘরের জন্য নির্ধারিত জায়গার আশে পাশে এটেল মাটি পাওয়া যায় কিনা । তারপর সে মাটিকে পঁচিয়ে ছানা করার জন্য ঘরের কাছে প্রায় ২০ফুটX১০ফুট আকারের ছোট একটি খাদ/গর্ত তেরী করত । তারপর সেই খাদে এটেল মাটি ভরে পরিমান মত পানি মিশিয়ে তার উপরে কারিগরের কয়েকজন যোগালী দিনমান লাফালাফি করে কিংবা গরু/মহিষ জুরে দিয়ে কাদামাটির ছানা তৈরী করত ।
কাদামাটির ছানাকে ভালমত পঁচানোর জন্য দিন পনের সময় দিয়ে পরে কারিগর এসে কাদামাটি হাতে নিয়ে টিপে টিপে পরখ করে দেখতো সেটা মাটির ঘরের দেয়াল তুলার উপযুক্ত হয়েছে কিনা । তিনি যখন বুঝতেন মাটি উপযোগী হয়েছে তখন দলের অন্যান্য যোগালীদেরকে নিয়ে এসে ঘরের দেয়াল তোলার কাজে লেগে পরতেন । ঘরের দেয়াল তোলার কাজটিও সপন্ন হতো ধাপে ধাপে । প্রথমে মালিকের চাহিদা মত ঘরের আকারের মাপ জোক অনুযায়ি দেয়ালের ফা্উন্ডেশনের জন্য প্রায় ২/৩ ফুট গভীর গর্ত করা হত। ঘরের নীচের মাটির কোয়ালিটি ভাল না হলে ফাউন্ডেশনের জন্য তৈরী গর্ত ভরাট করা হতো বিশেষভাবে তৈরী পঁচনো কাদামাটি দিয়ে। কাদামাটি দিয়ে ভুমি লেভেল পর্যন্ত মাটি ভরাটের পর দিন পনের সময় দেয়া হতো ফাউন্ডেশনের মাটি শুকানোর জন্য। শীতমৌসুমের শেষের দিক হতে শুরু করে বর্ষাকাল আসার পুর্ব সময়টিই ছিল মাটির ঘর তৈরীর উপযুক্ত সময় । সেই ছোটকালে ঘটা কাহিনীর কোন ছবি নেই বলে অবস্থাটি দেখানোর জন্য মাটির গর্ত/খাদ তৈরী,মহিষ দিয়ে মারিয়ে কাদামাটি তৈরী ও দেয়াল উঠানো দৃশ্যের একটি ধার করা ছবি নীচে তুলে দেয়া হলো ।
ছবি -১: মাটিতে গর্ত/খাদ তৈরী,মহিষ দিয়ে কাদামাটি তৈরী এবং দেয়াল উঠানোর দৃশ্য
ভুমি লেভেল থেকে প্রায় ১৮ ইঞ্চি হতে ২৪ ইঞ্চি পুরু দেয়াল উপরের দিকে উঠনো হতো ধাপে ধাপে । দেয়ালের জন্য পঁচানো মাটি বসানোর কাজটিও ছিল বেশ টেকনিক্যাল।খাদে পঁচানো কাদামাটির ছানা বেশ আঠালো হয়ে যেত । ঘরের দেয়াল তৈরীর জন্য করিগরের সাথে কয়েকজন যোগালীর একটি দল থাকত।।একজন যোগালী কোদাল দিয়ে কেটে মাটি উঠাত ।কোদালের এক কোপে প্রায় ৫ কেজি সমান একতাল মাটি উঠে আসত । মাটি কাটার সময় যোগালীগন খাদ হতে ঘর পর্যন্ত লাইন করে দাঁড়িয়ে যেত । খাদ থেকে কোদালী কর্মী মাটি কাটার পরে অন্য আর একজন নরম মাটির ডেলাটি হাতে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পরের যোগালির দিকে। সে ঐ নরম মাটির ডেলা দুহাতে আলতো করে ধরে বিশেষ ভঙ্গিমায় ছুড়ে দিত পরের জনের দিকে। সে আবার নরম মাটির ঢেলাটি লুফে নিয়ে ছুড়ে দিত পরের জনের দিকে। মাটির ঢেলাটি ছন্দময় তালে এমনতর ভাবে লুফালুফি খেলতে খেলতে মহুর্তেই পৌঁছে যেতো শেষ প্রান্তে থাকা কারিগরের হাতে। কারিগর দেয়াল তোলার জায়গায় দাঁড়িয়ে মাটির ঢেলাটি মাথার উপর তুলে জোড়ালো ভাবে একটি হু শব্দ করে দেয়ালে বসিয়ে দিত খুব শক্ত করে। দুর হতে দেখে মনে হতো দেয়ালে মাটি বসানো যেন একটি ছন্দময় মাটির ঢেলার লুফালুফি খেলা। খানিক বিরতি/বিশ্রাম নিয়ে এভাবে মাটি ফেলে ফেলে দেয়াল তুলার কাজ এগিয়ে যেত । খাদে যে পরিমান পঁচানো মাটির ছানা তৈরী করা হত তা দিয়ে প্রায় দুই হতে তিনফুট উচু দেয়াল তোলা যেতো। দেয়ালটি ঠিকমত খাড়াখাড়িভাবে উপরের দিকে উঠছে কিনা তা একটি লম্বা মোটা সুতার মুখে পাথর বেধে উপর হতে নীচে ফেলে পরখ করে দেখা হতো, ঠিক যেমন এখনকার রাজমিস্ত্রিগন ইটের দেয়াল সুজাসুজি উপরের দিকে উঠছে কিনা পরীক্ষা করে দেখেন।
দেয়ালটিকে ৩/৪টি ধাপে উপরের দিকে উঠানো হতো । তাই পরবর্তী প্রতিটি ধাপেই একই নিয়মে মাটি পঁচানো থেকে শুরু করে মাটি ফেলে দেয়াল তোলা হতো। দেয়ালের দুই পাশে বের হয়ে থাকা এবরো থেবরো মাটিকে সাইজমত রাখার জন্য আরো কিছু টেকনিক্যাল কাজ করা হতো । যথা দেয়ালের মাটি নরম থাকা সময়কালীনই চাপাতি সাইজের বড় একটি ভোজালী বা ধান কাটার জন্য কাচির মত দেখতে বড় সাইজের কাচি দিয়ে দেয়ালের দুদিকের এবরো থেবরো মাটি ছেটে ফেলা হতো। দেয়াল তুলার কারিগর ঘরের মালিকের সাথে পরামর্শ করে মাপ আনুযায়ী দরজা জানালা ও ভেনটিলেটরের জন্য জায়গা বাদ রেখে কাদামাটি বসাত। নির্ধারিত মাপ অনুযায়ী দরজা ,জানালা ও ভেনটিলেটর পর্যন্ত দেয়াল উঠে গেলে কাঠের মোটা তক্তা দিয়ে বিম বসানো হতো । ঘরে সিলিং বসানো ও ছাউনীর টানা দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো পুরাতন তাল গাছের ফালি, এটা এমনই শক্ত যেন অব্যয় অক্ষয়।
মাটির ঘরের জন্য কোন পিলার দিতে হতোনা । মাটির ঘরের জন্য দেয়াল তুলে সিলিং ও চালার জন্য টানা বা ধনে বসানো পর্যন্তই ছিল মাটির ঘরের দেয়াল তুলার কারিগরের কাজ । তারপর ঘরের চালা বা ছাউনী তৈরী ও স্থাপন , দরজা জানালা তৈরী ও ফিট করার কাজটি সম্পন্ন করত সুতার তথা কাঠ মিস্ত্রীগন । তবে দরজা জানালা ও ঘরের চাল(ছাদ) বসানোর কাজ শেষ হলে দেয়ালের ফিনিসিং কাজের জন্য বিশেষভাবে দক্ষ আরেক দল কারিগর নিয়োগ করা হত । তারা মাটির সহিত তুষ মিশিয়ে দেয়ালে লেপ দেয়ার উপযোগী মাটি তৈরী করত । দেয়ালের এবরো থেবরো মাটি হাতুরী ,বাটাল .ছেনী ও শাবল দিয়ে ছেটে ফেলা হত । তারপর দেয়ালের গায়ে তুশমিশ্রিত মাটি দিয়ে খুব যত্ন করে মসৃন একটি প্রলেপ দেয়া হত । বৃষ্টির হাত হতে দেয়ালকে রক্ষার জন্য নীচের অংশে অনেকেই আলকাতরার প্রলেপ দিতেন, পারলে ঘরের দক্ষিন পুর্ব দুদিকে বারন্দা দিয়ে দেয়ালকে বৃষ্টির হাত হতে রক্ষা করাসহ ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হত। অনেকে শুকনো দেয়ালে ফুল, পাখী, লতা পাতার বাহারী নক্সা তৈরী করাতেন।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের এই প্রান্তে এসে যখন ছোট বেলার মাটির ঘর তৈরীর স্মৃতিচারন করছি তখন জীবন চলার পথে চারিদিকে দেখা ও জানা কিছু কথামালা প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসছে লেখার ভিতরে । পথের পাচালীর মত সে সব কথা বাদই বা দেই কি করে। তাই মনে হল লিখে যাই থাকনা আরো কিছু কথা ও ছবি কাগজের পাতা ভরে । এগুলিতো কোন কালে রূপান্তরিত হলেও হতে পারে পরশ পাথরে ।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, মাটির ঘরে অনেকেই নকশা তৈরী করার কাজ করে । মাত্র মাস চারেক আগে চ্যানেল আই অন লাইন নিউজ পর্টালে দেখেছিলাম ‘মাটির ঘরে জীবনের রঙ’ সেখানে বলা হয়েছে তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত যশোহর জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকইল গ্রামে ঐতিহ্যগতভাবেই প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িতে টিকে আছে মাটির ঘর।
ছবি -২ : শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামের পৈত্রিক বাড়ির পাশে ইলা মিত্র
আলোচনার এ পর্যায়ে তেভাগার মত একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের বিষয়ে দুএকটি কথা না বলে সামনে যাই কি করে । বাংলার গ্রামীণ সমাজে বৃটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষীরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক-তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। বৃটিশ শাসন আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষীদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় 'সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি'। ১৯৪০ সালে কৃষক প্রজাদরদী ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় 'ফাউন্ড কমিশন’।
ছবি - ৩ : অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ( পাকিস্তানের প্রকৃত স্থপতি এবং লাহোর প্রস্তাবের ঘোষক)
এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষীদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। চল্লিশের দশকে এসব আন্দোলনেও ইলা মিত্র নেতৃত্ব দেন। তিনভাগের দুইভাগ ফসল কৃষকের এই দাবি নিয়ে বেগবান হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে দিনাজপুরে কমরেড হাজী দানেশের প্রচেষ্টায় সূচিত হয় এক যুগান্তকারী তেভাগা আন্দোলন। চল্লিশের দশকের এই আন্দোলনে ইলা মিত্রও নেতৃত্ব দেন । জনদরদী এ সকল নেতা নেত্রীদের প্রতি রইল হৃদয় নিংরানো শ্রদ্ধাঞ্জলী।
যাহোক, নক্সা করা মাটির ঘরের পুর্ব কথায় ফিরে আসি। টিকাইল গ্রামের প্রতিটি মাটির ঘরের দেয়ালগুলো অসাধারণ আল্পনায় চিত্রিত। ফুল, লতা-পাতা, গাছ, নদী, নৌকা, পাখি, আকাশ, মানুষ – কী নেই তাদের আলপনার উপাদানে।
ছবি-৪ : অসাধারণ আল্পনায় চিত্রিত টিকাইইল গ্রমের একটি মাটির ঘর
বংশ পরম্পরায় বাড়ির দেয়ালে আল্পনা আঁকার এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন ওই গ্রামের নারীরা।ঘরের কাজের ফাঁকে তারা রঙিন করে তুলেছেন গোটা একটি জনপদ।
ছবি -৫ : মাটির ঘরে রং-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা নকশার কারিগর টিকোইল গ্রামের নারীরা
আমরা সকলেই জানি অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের গ্রামেগঞ্জে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মাটির ঘরের প্রচলন ছিল। গ্রামের মানুষের কাছে মাটির ঘর ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক । গ্রামের বিত্তশালীরা অনেক অর্থ ব্যয় করে মজবুত দোতলা মাটির ঘর তৈরি করতেন।জীবনের প্রথমভাগে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা প্রতিষ্ঠানের গবেষনা সহযোগী হিসাবে কর্মসুত্রে একটি ভিলেজ স্টাডি কর্মসুচীর আওতায় দিনাজপুর,রংপুর, নওগা, রাজশাহী ,বগুড়া, ও যশোহরের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গিয়ে কাজ করার সময় অনেক সুন্দর সুন্দর মজবুত মাটির ঘর চোখে পড়েছে। কথা প্রসঙ্গে মাটির বাড়ির মালিকগন বলেছেন ছোটখাট ভূমিকম্পেও নাকি তাদের মাটির ঘরের খুব বেশি ক্ষতি হয় না । কোন কোন মাটির ঘর এক থেকে দেড়শ’ বছরেরও বেশী পুরানো। উল্লেখ্য বিশেষভাবে তৈরী এটেল কাদামাটিকে অভিনব কৌশলে দেয়ালে বসানোর ফলে দেয়ালের মাটি এমনই শক্ত হয় যে এর মধ্যে গায়ের জুড়ে খন্তা, কোরাল, শাবল চালালেও সামান্যতম পরিমান মাটি কাটা পরেনা ।শক্ত দেয়ালের মাটিতে উই পোকা কিংবা ইদুর দাঁত বসাতে পারেনা।দেশর উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহী ,বগুরা, রংপুর ও দিনাজপুরে প্রায় শত বছরেরো বেশী পুর্বে তৈরী অনেক মাটির ঘর এখনো আছে বহাল তবিয়তে।
ছবি-৬ রাজশাহী অঞ্চলের একটি মাটির ঘর
বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমন বিবরণী হতে জানা যায় অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের গ্রামগঞ্জে মাটির বাড়ির প্রচলন ছিল। এখনো রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠে বাড্ডা হয়ে সাঁতার কূল ইউনিয়ন পেরোলেই বেরাইদ ইউনিয়নের বেরাইদ গ্রামে দেখা যাবে শত শত পরিবারের লোকজন বাস করেন মাটির ঘরে। মাটির ঘরগুলোর বেশির ভাগই শত বছরের পুরনো। এত বছরে ছোটখাটো ভূমিকম্প অনেকবার হয়েছে। তবে ঘরগুলোর কোনো ক্ষতি হয়নি, যদিউ রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে অনেক ঘরেরই দেয়ালের বহিরাঙ্গন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত আছে বলে দেখা যায় ।অর্থের অভাবে গ্রামবাসী মাটির ঘরে থাকেন এমন নয়। গ্রামের অনেক সচ্ছল পরিবারও পাকা ভবনের পাশেই মাটির ঘরেই আছেন সুখে-শান্তিতে।
ছবি-৭ : পাকা দালানের পাশেই বেরাইদের মাটির ঘরের ছবি
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে গ্রাম বাংলায় অনেক অবস্থা সম্পন্ন মানুষই টিনের ঘরে বসবাস করতেন এবং এখনো করেন । স্বাধীনতা পুর্বকলীন সময়ে গ্রামীন এলাকায় সিদেল চোরের বেশ উপদ্রব ছিল। যেসব ঘরে টিনের বেড়ার নীচে কমপক্ষে এক ফুট ইটের গাথুনী ছিলনা সেসব ঘরে সিদেল চোরেরা খুব সহজেই সিধ কেটে ঢুকে যেতে পারতো । সিদেল চোরদের হাত হতে নিরাপদ থাকার জন্য অনেকই মাটির ঘর তৈরীর জন্য ঝুকে পরতেন।
ছবি-৮ : টিনের ঘরের বেড়ার নীচে সিদেল চোরের কাটা সিদ (সুত্র: গুগলের ছবি জগতের পাবলিক ডোমেইন )
আবহমান বাংলার ক্লাসিক চোর হলো সিদেল চোর। নাটক, সিনেমা গল্পে আমরা এদের উপস্থিতি দেখতে পাই। সারা গায়ে তেল মেখে হাতে খুন্তি নিয়ে ঘরের বেড়ার নিচের মাটি সরিয়ে এক শিল্প করে এই চোরেরা চুরি করে। অবস্থাসম্পন্ন লোকদের বাসাবাড়ী শক্ত মাটির দেয়ালের কিংবা ইটের দেয়ালের পাকা ঘর হয়ে যাবার ফলে আজকাল এই চোরদের ঘরের সিদ কেটে চুরির ঘটনা তেমন ঘটে না। তবে ডারউইন সাহেবের বিবর্তন তত্ব অনুসরণ করে সিধেল চোরেরা অবশ্য এখন বিবর্তিত হয়ে গেছে। বিবর্তনের ব্যপারটি বিবিধ ধরনের, তবে বড় আকারের বিবর্তন ঘটে গেছে তেল মারামারির ব্যাপারটায়। আগের সিদেল চোররা নিজেদের গায়ে তেল মাখত গর্তে ঢুকা, বের হওয়া, ধরা পড়লে পিছলে বের হয়ে যাবার জন্য আর এখনকার চোরেরা বিবর্তনের ফলে তেল মারে অন্যকে, যেন চুরির রাস্তা সুন্দর, মসৃন আর বাধাবিহীন থাকে। আগে যারা সিদেল চোর ধরার দায়িত্বে ছিল তাদের অনেকেই বিবর্তিত হয়ে বড় মাপের বর্ণচোরা সিদেল চোরে পরিনত হয়েছে। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড ও জনকল্যান এই ধরনের চোরের কারণে হচ্ছে বাধাগ্রস্ত ।
আজকের এই আধুনিকায়নের যুগে সৌখিন মাটির ঘরের প্রচলন কমে গেলেও গ্রাম বাংলায় দরিদ্র জনগোষ্টির অনেক মানুষই এখনো অতি সাধারন মানের খর কোটার ছাউনী দেয়া জীর্ণ শীর্ণ মাটির ঘরেই বসবাস করছেন। স্যাঁত স্যাঁতে ঘরের মেঝে, আলো বাতাশ চলাচলের জন্য নেই কোন জানালা, হালকা ভাঙ্গাচুরা মাটির দেয়াল, নেই কোন বৃষ্টির পানিরোধক প্রলেপ বা বারান্দা, একটুখানি বৃষ্টি হলেই ঘরের ভিতর গড়িয়ে পরে পানি, ফি বছর তাদের ঘরের দেয়াল বা খর কোটার ছাউনি মেরামত/পরিবর্তন করতে হয় । অস্বাস্থকর ছোট একটি ঘরে গাদাগাদি করে পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ প্রায় ৪/৫ জন বসবাস করে,অভাব অনটনের সাথে অস্বাস্থ্যকর ঘরে বসবাস করে রোগ শোক তাদের নিত্য দিনের সাথী। এত কিছুর পরেও তাদের ইমিউনিটি সিসটেম সম্ভবত খুবই সবল ,তাইতো এই মহামারী করুনা ভাইরাসের কালে তাদের আক্রান্ত হওয়ার খবর তেমন একটা এখনো সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়না।রেডিও টিভি ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে করোনাক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সমস্ত খবর ভেসে আসে তাতে দেখা যায় মন্ত্রী মিনিষ্টার, শিল্পপতি ও তাদের পিতামাতা স্ত্রী সন্তানাদি, বড় বড় সরকারী আমলা, সামরিক বেসামরিক বাহিনীর লোকজন, চিকিৎসক,অধ্যাপক, সাংবাদিক ও স্বাস্থ সেবক/সমাজকর্মীর সংখাই বেশী(এর মধ্যে অবশ্য অনেকেই করোনাক্রান্ত রোগীদের সেবাকার্যে নিয়োজিত ছিলেন, এ সমস্ত করোনাক্রান্ত ও মৃত সকলের জন্য রইল সহমর্মীতা ও শ্রদ্ধাঞ্জলী।
ছবি-৯ : খর কোটার ছাউনী দেয়া গ্রাম বাংলার একটি জীর্ণ শির্ণ মাটির ঘর
যাহোক, সৌখীন মাটির দোতলাই হোক আর পর্ন কুটীরই হোক, ঐতিহ্যময়ী মাটির ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আদিম আবাসন রীতির নানা প্রাকৃতিক সুবিধা, যা ইট বা টিনের তৈরি আবাসনের তুলনায় অবশ্যই উত্তম। কালো মাটির ঘরেই লুকিয়ে আছে শ্যামল সুখের ধরা। হয়তবা এ কথাটি মনে করেই কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ তার পুজা গানে বলেছেন-
এই-যে কালো মাটির বাসা শ্যামল সুখের ধরা--
এইখানেতে আঁধার-আলোয় স্বপন-মাঝে চরা ॥
এরই গোপন হৃদয় 'পরে ব্যথার স্বর্গ বিরাজ করে
দু:খে-আলো-করা ।।
পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ তথা মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদীদের মৃতদেহ মাটির ঘর কবরেই দাফন করা হয়। মাটির ঘরই তার শেষ আশ্রয়স্থল । যে ঈমানদারীর সহিত ভাল আমল করে যেতে পারবে তার চীর নিদ্রার জন্য শয়ন কক্ষের মাটির ঘরটি ততই সুন্দর ও ভাল থাকবে ,সেরকম মাটির ঘরেই তখন মনে হবে স্বর্গ বিরাজ করে ।
ছবি - ১০ : চীর শয়নের জন্য মাটি কেটে একটি কবর তৈরীর ছবি (সুত্র গুগলের পাবলিক ডোমেইন হতে )
সামু ব্লগ বাড়ীটিকে কিভাবে আরো সুন্দর ও উন্নত করা যায় তা নিয়ে আমরা সকলেই বেশ সচেতন। সামু ব্লগবাড়ীকে সুন্দর ও উন্নত করার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপুর্ণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেকারণে এতদসংক্রান্ত গুরুত্বপুর্ণ পোষ্টগুলি বিশেষ নির্বাচিত পাতায় কিংবা স্টিকি হয়ে ঝুলে ঝুলে থাকে বেশ কিছুদিন। এ জন্য সামুকে সাধূবাদ জানাই । অন্যদিকে আমাদের দেশের ঐতিহ্যময় মাটির বাড়ীঘর যে হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে সে বিষয়ে সামুর ব্লগার সহ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষনের লক্ষে আলোচনার সুযোগটি অবারিত রাখার জন্যও সামুর প্রতি কৃতজ্ঞতার সীমা নেই ।তবে কথা উঠতে পারে বর্তমানে জীবনঘাতি করুনাভাইরাসের কারণে জনজীবন যেখানে বিপর্যস্ত সেখানে এই জরাজীর্ণ সাধারণ মাটির ঘর নিয়ে ভাবনার সময় কোথায় । একথায় যুক্তি আছে, তবে মহামারী করোনার হাত হতে হয়ত আমরা রক্ষা পাব অচীরেই, অপেক্ষায় আছি শুধু একটি পরশ পাথর প্রাপ্তি তথা কার্যকরী করোনা ভেকসিন আবিস্কারের দিকে। এই পরশ পাথর সন্ধানের বিষয়টিও বিস্তারিতভাবে উঠে আসবে এ লেখাটির কোন এক পর্বে। কিন্তু ইতোমধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলে যে হারে ইটের তৈরী ঘরবাড়ী তৈরী হচ্ছে ও সেই ইটের যোগান দেয়ার জন্য যত্র তত্র অপরিকল্পিত ভাবে ইটভাটা গড়ে উঠছে তার ভয়াবহ পরিনতির কথা ভেবে আতংকিত না হয়ে পারা যায় না ।
ছবি- ১১ : গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠা পরিবেশ দুশনকারী ইটভাটা
ইট পোড়ানোর জন্য বিপুল পরিমান পাকৃতিক গাছপালা জ্বালানী হিসাবে ব্যাবহারের ফলে বিপুল পরিমান জৈব পাকৃতিক সম্পদের অপচয়ের পাশাপাশি ইটভাটার কালো ধোয়ায় এলাকার জীববৈচিত্র বিপন্ন হওয়াসহ জনস্বাস্থের জন্য সুদুর প্রসারী স্থায়ী ক্ষতির পরিমান বহুলাংশে বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই ইটভাটার কালো ধোয়ার প্রভাবে গ্রামীন এলাকার আম কাঠালসহ বিভিন্ন গাছের ফলন কমে যাচ্ছে।
শুধু গ্রমাঞ্চলইবা কেন শহড়াঞ্চলের উপকন্ঠে থাকা ইটভাটাগুলিও পরিবেশ ও জনস্বাস্থের উপর মারাত্বক বিপর্যয় সৃস্টি করে চলেছে ক্রমাগতভাবে ।
ছবি- ১২ : শহড়াঞ্চলে গড়ে উঠা পরিবেশ দুশনকারী ইটভাটা
এখানেই শেষ নয়, আমরা সকলেই জানি বর্তমানে ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপকরণ হলো ‘ইট’। ইট মানেই ইটভাটায় পুড়িয়ে প্রস্তুত করা নির্মাণসামগ্রী। বাংলাদেশে সনাতনী ও আধুনিক অটোমেটিক ইটের কারখানাসহ সব জায়গাতেই কৃষিজমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে উর্বর মাটি ব্যবহারে কৃষি জমি নষ্টের পাশাপাশি জ্বালানি কাঠের ব্যবহারে বন উজাড় এবং কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহারেও জাতীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশ প্রতিবছর শতকরা এক ভাগ কৃষি জমি হারাচ্ছে, যার দ্বিতীয় প্রধান কারণ, ইটের কাঁচামাল ও ইটের ভাটা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর কমবেশি দুই হাজার পাঁচশ কোটি ইট তৈরি হচ্ছে। এই ইট তৈরিতে প্রতি বছর ১৮ হাজার হেক্টর কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে ( এখানে অবশ্য কথা উঠতে পারে মাটির ঘরের জন্যওতো ফসলের মাটি ব্যবহার হবে। এক্ষেত্রে বলা যায় মাটির ঘরের জন্য কৃষকের বাড়ীর পাশে গর্ত করে যে মাটি তুলে নেয়া হবে সে সকল গর্ত বা খাদে কৃষক/ভুমি মালিক মাছের চাষ করতে পারে । অন্যথায় খুব কম সময়ের মধ্যেই এইসব ছোট গর্ত বৃস্টি ধোয়া মাটি বা গৃহস্থালী আর্জনায় ভরে যাবে)। তাই মাটির ঘরের জন্য ব্যবহৃত উর্বর ফসলী জমির মাটি ক্ষয়ের তুলনায় ইটভাটার ক্ষতির পরিমান অনেক বেশী । অপর দিকে প্রায় ৮০ লাখ টন কাঠ ও কয়লা পুড়ছে ইটভাটার জন্য যা থেকে পরিবেশে আনুমানিক ২ কোটি টন কার্বন নির্গত হচ্ছে।পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সমীক্ষায় দেখা যায় রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের উপকরনের শতকরা ৫৮ ভাগই আসে ঢাকা শহরের আশপাশের প্রায় ১২০০ ইটের ভাটা থেকে, যা শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিবছর কমবেশি ১২৫০ জন শিশুর মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হয়(সুত্র : Click This Link) ।
এমতাবস্থায় নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ইটকে কোনো বিবেচনাতেই ভালো উপকরণ বলা যায় না।ইটের বিকল্প হিসাবে ইদানিং কংক্রিট ব্লকের দিকে জোকে পরার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে । সিমেন্ট, বালু ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ৪/৫ মিলি মিটার সাইজের পাথরের কণা বা ডাস্ট সমন্বয়ে কংক্রিটের ব্লক তৈরি করা হচ্ছে ।ম্যানুয়েল, মেকানিক্যাল বা হাইড্রোলিক মেশিন ব্যবহার করে এই ব্লক তৈরি করা যায়। পরিবেশ বান্ধব পাকা ঘর বিশেষ করে বহুতল বাড়ী ঘর/ভবন নির্মানের জন্য এই কংক্রিটের ব্লক একটি বিকল্প হতে পারে । তবে সম্পুর্ণ দেশীয় উকরণ মাটি ও গাছ পালা দিয়ে যেখানে গ্রামীন বাংলায় সুলভে মাটির ঘর নির্মান করা যায় সেখানে কংক্রিটের ব্লক ব্যাবহার যথেষ্ট ব্যয় বহুল হবে।গ্রামীন দরিদ্র জনগন এটা এফর্ড করতে পারবেনা ।
ছবি-১৩: কংক্রিটের ব্লক তৈরী করে এমন একটি প্লান্টের ছবি
বিবিধ কারণে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি বাড়িঘর এদেশ হতে ক্রমেই বিলীন হতেছে । মাটির তৈরি ঘর নির্মাণের কারিগর যারা র্দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তারা নতুন ঘর নির্মাণ না হওয়ায় যেমনি নিরুৎসাহিত হচ্ছেন, তেমনি নতুন কারিগরও গড়ে উঠছে না। তাই ইদানিং দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা যথা ব্রাক (BRAC) এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া দুএকটি এনজিও সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে দৃষ্টিনন্দন কিছু মাটির ঘর তৈরীতে সহায়তা করছেন । সরকারী পর্যায়ে কি করা হয়ছে ও কি করা যেতো কিংবা এখনোবা কি করা যায় সে বিষয়গুলি একটু পরেই এ পোষ্টের লেখায় উঠে আসবে । ইত্যবসরে বেসরকারী পর্যায়ে কি করা হচ্ছে তার কিছু দৃশ্য দেখে নেয়া যাক ।
ছবি- ১৪: মাটির তৈরী দীপশিখার মেটি স্কুল : স্থপতি আনা হারিঙ্গার একটি অনন্য সৃষ্টি
ছবি-১৫: বাঁশের খুটিতে টানা দেয়া মাটির তৈরী দীপশিখার মেটি স্কুলের একটি নান্দনিক দৃশ্য
দীপশিখা মেটি স্কুলটি দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নের রুদ্রাপুর গ্রামে অবস্থিত। ২০০৫ সালে রুদ্রাপুর গ্রামে মেটির মাটির স্কুলঘর নির্মাণ শুরু হয়। জার্মানির এক দাতাসংস্থা একাজে অর্থায়ন করে। অস্ট্রিয়ার লিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী ও দীপশিখা প্রকল্পের কর্মীরা ইমারতটি নির্মাণের সাথে যুক্ত ছিলেন। জার্মান স্থপতি অ্যানা হেরিঙ্গার ও এইকে রোওয়ার্গ এই ইমারতটির নকশা করেন। ইমারতটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি, খড়, বালু , বাঁশ, দড়ি, খড়, কাঠ, টিন, রড, ইট ও সিমেন্ট। মাটি ও খড় মেশানো কাদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর দেয়াল । মাটির তৈরি স্কুলঘরের এই দোতলা ভবনটির আয়তন ৮,০০০ বর্গফুট, নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। প্রতি বর্গফুটে খরচ হয়েছে ২১২ টাকা ।২০০৭ সালে বিদ্যালয়টির ভবন আগা খান ফাউন্ডেশনের সেরা স্থাপত্য পুরস্কার ও এর স্থপতি কারি স্টোন নকশা পুরস্কার জিতেছেন।
এছাড়াও ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ আর্কিটেকচারের ৮ জন শিক্ষার্থী সেসাথে অস্ট্রিয়ার লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য শিল্পকলা বিভাগের ৫ জন শিক্ষার্থী দীপশিখা প্লকল্পের আওতায় দিনাজপুরের মেটি মাটির স্কুলের উন্নতমানের মাটির ঘর নির্মানের কারিগরী কলাকৌশলের ধারাবাহিকতায় ওখানকার প্রত্যন্ত গ্রাম রুদ্রাপুরে স্থানীয় কারিগরদের সাথে যৌথভাবে টেকসই আধুনিক স্থাপত্য ডিজাইনের পারিবারিক মাটির ঘরও নির্মান করেছেন। উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক, কারিগরী ও আর্থিক সহায়তা পেলে উন্নত মানের দৃষ্টি নন্দন দোতলা মাটির ঘর যে নির্মান করা যায় তারও একটি সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অস্ট্রিয়ার লিনজ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীগন । উন্নতমানের মাটির ঘর তৈরীতে তাঁদের উদ্ভাবিত মডেলটি সারা দেশে সম্প্রসারিত করা যায় । নীচে তাঁদের তৈরীকৃত একটি পারিবারিক দোতলা মাটির ঘরের ছবি দেখনো হল।
ছবি-১৬:ব্র্যাক ও লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সহযোগীতায় নির্মিত একটি দোতলা পারিবারিক মাটির ঘর
ছবি-১৭ : ব্র্যাকের সহায়তায় নির্মিত দোতলা মাটির ঘরের একটি ছবি (সুত্র : গুগল ইমেজের পাবলিক ডোমেইন
মাটির ঘরের উন্নয়নে বৈদেশিক কিছু কর্মসুচীর উদাহরন
এখানে প্রসঙ্গক্রমে গ্রামীন চীনে উন্নত মানের মাটির ঘর নির্মাণ (Building with Earth) প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কিছু তথ্য চিত্র কথা তুলে ধরা হলো । চীনের গ্রামাঞ্চলের লোকেরা কয়েক হাজার বছর ধরে মাটির ঘরে বাস করে আসছে । দেশটিতে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলে কংক্রিট এবং ইটের নকশার কৌশলের কাছে ট্রেডিশনাল ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরের মান্দাতা আমলের ট্রেডিশনাল নির্মাণ কৌশল বিদুরিত হয়ে বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছিল । মাটির ঘরগুলি গ্রামীণ দারিদ্র্যের প্রতীক হয়ে উঠে এবং মাটির ঘর তৈরীর কারিগর সম্প্রদায়ের দক্ষতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। যেমনটা বাংলাদেশেও ঘটছে ।
ছবি- ১৮: চীনে বিলপ্তপ্রায় ঐতিহ্যমন্ডিত মাটির ঘরের একটি ছবি
এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষনে বিলুপ্তপ্রায় মাটির গৃহকে পুলরুজ্জীবিত করার জন্য Wu Zhi Qiao Charitable Foundation (WZQCF) নামে একটি চাইনীজ সংগঠন এগিয়ে আসে।তারা Building with Earth নামক একটি প্রকল্পের আওতায় মাটির ঘর তৈরীর কাজে নিয়োজিত স্থানীয় কারিগরদেরকে ব্যয় শাস্রয়ী টেকসই ও ভুমিকম্প প্রতিরোধি আকর্ষনীয় মাটির ঘর নির্মানের বিষয়ে প্রশিক্ষন দিয়ে দক্ষ কারিগর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষন কর্মসুচী বাস্তবায়ন করে ।
চীনের গ্যানসু প্রদেশের মাঞ্চা ভিলেজে ২০১১ সালে একটি মাটির ঘরের ভিলেজ সেন্টার তৈরিসহ ৩২ টি প্রোটোটাইপ মাটির ঘরের বাড়ী নির্মাণের মাধ্যমে প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় । প্রকল্পটির আওতায় স্থানীয় কারিগরদেরকে শক্ত টিকসই ও দৃষ্টিনন্দন মাটির ঘর নির্মাণ কৌশল গুলির উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ।
ছবি-১৯: চীনে গ্রামীন মাটির ঘর নির্মানকারী কারিগরদেরকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষন দেয়ার দৃশ্য
ছবি -২০ : চীনের মাঞ্চায় ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে নতুন মাটির ঘরবাড়ি তৈরি করে তাদের অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দেযার দৃশ্য
ছবি-২১ : প্রকল্পের আওতায় মাটির তৈরী ভবনে ভিলেজ সেন্টার তৈরীর দৃশ্য
দারিদ্রের প্রতীক আর নয়, মাটির ঘরগুলি তাদের সমস্যা সমাধানের অংশ হয়ে উঠছে।
মাঞ্চা গ্রামে শুরু হওয়া প্রকল্পের সাফল্যের মডেলটি অল্প সময়ের মধ্যেই চীনের আরো ১৭ টি প্রদেশের ২৩ টি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে।
প্রকল্পটির তার সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৯ সনে world-habitat-award অর্জন করে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে গৃহহীন পরিবারসমূহকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে “আশ্রয়ণ” নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিন (০৩) টি ফেইজে আশ্রয়ণ প্রকল্প (৯১৯৭ - ২০০২), আশ্রয়ণ প্রকল্প (ফেইজ – ২) (২০০২ - ২০১০), আশ্রয়ণ – ২ প্রকল্প (২০১০ - ২০১৯) মোট ২,৯৮,২৪৯টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়, তন্মধ্যে আশ্রয়ণ – ২ প্রকল্পের মাধ্যমে ১,৯২,৩৩৬টি পরিবার পুনর্বাসন করা হয়েছে। বর্ণিত প্রকল্পের সাফল্য ও ধারাবাহিকতায় ২০১০-২০১৯ (সংশোধিত) মেয়াদে ২.৫০ লক্ষ ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সুত্র : http://www.ashrayanpmo.gov.bd/
গৃহহীন পরিবারদের জন্য নিন্মের ছবির মত গৃহ তৈরী কেরে দেয়া হয়েছে । চিত্র দুটিতে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে তাদের জন্য যে গৃহ নির্মান করে দেয়া হয়েছে তা মুলত ইটের তৈরী পাকা ঘর ও টিনের ঘর। একথা অবশ্য অস্বীকার করার উপাই নেই যে উপকূলীয় বাসিন্দাদের কাছে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগের কারনে নির্বাসনই যখন খোলা আকাশের নীচে বাধের উপর পুর্ণবাসন, তখন তাদের জন্য ইটের তৈরী মজবুত গৃহ নির্মানের বিকল্প নেই ।
ছবি-২২ : নির্বাসনই যাদের পুর্ণবাসন
এমতাবস্থায় আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় গৃহহীনদের জন্য ইটের গৃহ কিংবা টিনের ঘর নির্মান অবশ্যই প্রসংসার যোগ্য ।
ছবি -২৩ : আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় গৃহহীনদের জন্য প্রকল্প
তবে প্রকল্পটি প্রনয়নের সময়ে প্রকল্পের পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিবিদগন যদি দেশে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরকে নতুন প্রাণ দেয়ার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা এনজিওদের প্রচেষ্টায় যেভাবে পরিবেশ বান্ধব দেশীয় উককরণ দিয়ে টিকসই দৃষ্টিনন্দন মাটির ঘর নির্মানের মডেল তৈরী করা হয়েছে তা একটু আমলে নিয়ে যথাযথ পর্যবেক্ষন, পরিক্ষন ও মুল্যায়ন করে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশের সম্ভাবনাময় স্থান সমুহে( বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে)কিছু টিকসই মাটির ঘর তৈরী করে গৃহায়নের ব্যবস্থা করতেন তাহলে সরকারীভাবে বিলুপ্তপ্রায় মাটির ঘর কে শুধু পূণরুজ্জীবিতই নয় এর বিকাশও করতে পারতেন তরান্বিত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রায় ৩৩ বছর আগে তৈরী নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার চেরাগপুর ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামে রয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে নির্মিত ১০৮ কক্ষের বিশাল একটি মাটির বাড়ী । বিশাল এই বাড়িটির দৈর্ঘ্য ৩০০ ফুট এবং প্রস্থ ১০০ ফুট।পায়ে হেঁটে একবার বাড়ির চার ধারে ঘুরে আসতে সময় লাগে ৭-৮ মিনিট।
"প্রতিদিন দুর-দূরান্ত থেকে এ বাড়িটি দেখার জন্য লোকের সমাগম ঘটে।এখানে ক্লিক করে ১০৮ কক্ষের মাটির তৈরী বাড়ীটিদেখে আসতে পারেন ।
ছবি-২৪ : ১০৮ কক্ষের মাটির তৈরী বাড়ী
এরকম বাড়ীর আদলেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীনদের জন্য উন্নত মানের টিকসই ও ব্যয়সাস্রয়ী পরিবেশ বান্ধব মাটির ঘর নির্মান করে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরকে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারতো।যাহোক, কি আর করা ,খনার বিখ্যাত বচনের কথাই মনে পরে গতস্য শোচনা নাস্তি .অর্থাত যা চলে গেছে তার জন্য অনুশোচনা করতে নেই। তবে তাই বলে কি আর হয়, দেখা যায় আশ্রয়ন প্রকল্প চলমান আছে এখনো। গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ তরিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কতৃক ৩ হাজার ৯৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ ব্যয় আশ্রয়ন-৩ (১ম সংশোধিত) চুড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে( Click This Link )। প্রকল্পটির উপর সাংবাদিকদেরকে ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানাধীন চর ঈশ্বর ইউনিয়নের ভাসানচরে এক লাখ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মায়ানমারের নাগরিকদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বনায়ন করা এবং দ্বীপটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা।ইতোমধ্যে প্রকল্টির আওতায় ভাষান চরে এক লাখ রোহিঙ্গা উদ্ধাস্তুকে আশ্রয় দানের জন্য নিন্মের দৃশ্যের মত পুর্ত নির্মান কাজ করা হয়েছে । একথা সত্য যে সামুদ্রিক ঝড় জঞ্ঝা জলোচ্ছাস ঘুর্ণীঝরের ঝুকির মুখে থাকা ভাষান চরের মত জায়গায় এরকম পাকা ঘর নির্মানের বিকল্প নেই। তবে মাটির ঘর উযযোগী উপযুক্ত স্থানে আশ্রয়ন প্রকল্প -৩ এর আওতায় কিছু সুন্দর সুন্দর মাটির ঘর তৈরীর সুযোগ একটা আমরা হারিয়েছি!
ছবি-২৫ : ভাষান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্র
ধারনা করি দেশের বিভিন্ন স্থানে লক্ষ লক্ষ গৃহহীনদেরকে গৃহদান করার জন্য আশ্রয়ন প্রকল্প- ৪, আশ্রয়ন প্রকল্প- ৫ ইত্যাকার নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়তবা চলতেই থাকবে ।তাই অতীতে বার বার আমরা সুযোগ হারালেও ভবিষ্যতের আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রিয়ার লিনজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ব্র্যাক ও দীপশিখার মত এনজিও সংগঠনের মাটির ঘর প্রকল্প, এবং বিদেশী যথা চীনের মাটির ঘর পুনরুজ্জীবন তথা Building with Earth এর মত প্রকল্প/ কর্মসুচীর সফল অভিজ্ঞতার আলোকে আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকারী পর্যায়ে ব্যয়সাস্রয়ী ও পরিবেশ বান্ধব মাটির ঘর নির্মানের কর্মসুচী নেয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন সমাজের হতদরিদ্র, তৃণমুল , ঝরঝঞ্জা ও নদীভাঙ্গন কবলিত গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহায়নের সুযোগ সৃস্টি হতে পারে অপরদিকে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরকে পুণরুজ্জীবিত করা যেতে পারে ।
সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ ও ব্যক্তি পর্যায়ে মাটির ঘরকে পুরুজ্জীবিত করার লক্ষে কতিপয় প্রস্তাবনা
সরকারী উদ্যোগ
মোট ২৪ পৃষ্ঠায় লিখিত জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা ২০১৬ এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে সমসাময়িক গবেষণা ও প্রকাশনা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের নগর এলাকায় ২০১৫ সাল নাগাদ ১ কোটি ইউনিট গৃহের প্রয়োজন হবে এবং পরবর্তীতে প্রতি বছরে অন্তত ১০ লাখ ইউনিট করে নতুন গৃহ নির্মাণের প্রয়োজন পড়বে । সে হিসাবে ২০২০ এসে দেশে প্রায় ১.৫০ কোটি ইউনিট গৃহের প্রয়োজন আর এর সিংহভাগই প্রয়োজন হবে শহড়াঞ্চলে। শহড়াঞ্চলে যে আর কোন কালেই কাঁচা মাটির ঘর তৈরী হবেনা সেকথা হলফ করে বলা যায়। হেলে পড়ুক ,ধ্বসে পড়ুক কিংবা আগুনে পুড়ে মরুক তারপরেও অবস্থা দৃষ্টে দেখা যায় শহড়াঞ্চলে এমনকি সেখানকার ২/১কাঠা জমির উপরেও আকাশচুম্বী পাকা দালান কোঠা নির্মানকে কেও কোনমতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবেনা।তাই ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরকে কার্যকরীভাবে পুণরুজ্জীবিত করতে হলে দৃষ্টি দিতে হবে গ্রামীণ এলাকার দিকেই ।
জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা ২০১৬ তে বর্ণিত তথ্য মতে দেশের শতকরা ৭২ ভাগ লোক গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন এবং মোট গৃহের শতকরা ৮১ ভাগ গ্রামে অবস্থিত । গ্রামীণ জনগণ সাধারণত নিজেদের উদ্যোগে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে আসছেন । প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এলাকায় কিছু ঘরবাড়ি ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ এবং উপকরণাদি সাহায্য হিসেবে বিতরন করার মাধ্যমেই সরকারি উদ্যোগ সীমাবদ্ধ রয়েছে । জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা ২০১৬ পুস্তিকায় দেখা যায় নীতিমালার সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে শহড়াঞ্চলের গৃহায়ন সংক্রান্ত কথামালা । জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা অবশ্য গ্রামীণ এলাকায় শুধু করা হবে করা হবে মর্মে গতবাধা কিছু কথামালা রয়েছে। গ্রামীন গৃহায়নের বিষয়ে গতবাধা কথামালার মধ্যে বিশেষ প্রনিধানযোগ্য চুম্বক কথাগুলি নিন্মরূপ:
ধারা ৪.৫.১: গ্রামীণ জনগণের জন্য উপযুক্ত নির্মাণ উপকরণ সহজলভ্য করা হবে একইসাথে পরিবেশ সংরক্ষণে অবাধ বৃক্ষ নিধন ইট-ভাটার জ্বালানি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ধারা ৪.৫.২ : দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে পরিবেশ বান্ধব ও ব্যয় সাশ্রয়ী মজবুত ও উপযোগী নির্মাণ পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ধারা ৪.৫.৪ : সকল এলাকায় ও সর্বস্তরের বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং দুর্গত জনগণ যাতে প্রাথমিক নির্মাণসামগ্রী ও ইমারত নিজেরাই অনেকাংশে তৈরি করতে পারে সেজন্য কারিগরি দিক নির্দেশিকা মুলক পুস্তিকা ও উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক কর্মশালার ব্যবস্থা করা হবে।
ধারা ৪.৫.৭ : গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষি ও শিল্প খাতের বর্জ্যকে লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নির্মাণ উপকরণ তৈরি ও তা ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে।
ধারা ৪.৮.৫: গ্রামীণ জনগণের গৃহ নির্মাণ, মেরামত, পরিবর্তন, পরিবর্ধন , প্রয়োজনে বিনাসুদে ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
ধারা ৪.১১.৯: ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্রকারের গৃহ নির্মাণ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড বি এন বি সি ( BNBC) এর যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করাসহ গৃহায়ন নীতিমালা, ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ইত্যাদি প্রয়োগের জন্য আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হবে।
এমতাবস্থায় গ্রামীণ এলাকায় মাটির ঘর পুনরুজ্জীবনের জন্য সরকারকে নতুন করে কিছুই আর ভাবতে হবেনা,শুধু নীতিমালায় বর্ণিত ‘হবে’ কথাগুলিকে কঠোরভাবে আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন করতে হবে । তাহলে মাটির ঘরকে পুনরুজ্জীবনের জন্য যা করার তা বেসরকারী পর্যায়ে ব্যক্তি উদ্যোগেই করা সম্ভব হবে।
খ) বেসরকারী ও ব্যক্তি উদ্যোগ
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেই মাটির ঘরের প্রচলন বেশী।ইদানিং শহরাঞ্চলে বসবাসকারী দেশের বিত্তশালী এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রায় কোটি খানেক প্রবাসী বঙ্গসম্তান শিকরের টানে গ্রামাঞ্চলে তাঁদের পৈত্রিক নিবাসে বেশ সৌখীন বাড়ীঘর নির্মান করছেন ।তাঁদেরকে ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর নির্মানে আগ্রহী করার জন্য যদি জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা ২০১৬ এর আলোকে যথোপযুক্ত কর্মসুচী গ্রহণ ও প্রনোদনা দেয়া যায় তাহলে তাঁরা নিন্মের বর্ণনা ও ছবি অনুযায়ী প্রেজটিজিয়াস ও সৌখীন মাটির ঘর নির্মানে উৎসাহী হবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
এটা অনস্বীকর্য যে আমাদের দেশের সামর্থবান বেশিরভাগ মানুষই সকলপ্রকার আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটি বিলাসবহুল আবাস খুঁজছেন, । ধীরে ধীরে এই প্রবণতা অফ-গ্রিডের জীবনযাত্রার (off the grid” refers to living autonomously without reliance on a utility for power) দিকে ধাবিত হচ্ছে। টেকসই জীবনযাত্রার দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাঁরা শক্তি-দক্ষ (energy-efficient ও ব্যয়সাস্রয়ী বিকল্পগুলি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিবেন এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে তাঁরা নান্দনিকভাবে আনন্দদায়ক এবং ব্যয়সাস্রয়ী বিভিন্ন ধরনের মাটির ঘর নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথেই ভেবে দেখবেন বলে আশা করা যায়।
মাটির ঘরের পুনরুজ্জীবনের জন্য বেসরকারী পর্যায়ে বাস্তবায়ন যোগ্য কিছু পদ্ধতি
১) সনাতনী কাদামাটির ঘর : এ বিষয়ে পোষ্টে বর্ণীত বিবরণ ও ছবিতে দেখানো কাদামাটির ঘরের মডেলের আদলে মাটির গৃহ নির্মানের জন্য অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে ।
২) নিন্মের বিবরন ও ছবিতে দেখানো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুসৃত পদ্ধতি যথা কব- হাউস( Cob –House ) , পিটানো মাটির (Rammed earth) ঘর , চাপানু মাটির ব্লকের ঘর compressed earth block (CEB), মাটিশ্রয় কাঠামোর ঘর (earth sheltered house) প্রভৃতি ধরনের মাটির ঘর নির্মান করা যেতে পারে । নীচে এদের সচিত্র কিছু বিবরণ দেয়া হল :
কব- হাউস ( Cob –House ) জাতীয় মাটির ঘর
কব- হাউজগুলি মাটি, বালি এবং খড়ের মিশ্রণে তৈরী ।একারণে ইট বালু এবং কংক্রিটের সংমিশ্রনে তৈরী ঘরের তুলনায় কব-হাউজগুলি অনেক বেশী পরিবেশ বান্ধব ঘর ।কব-হাউজের স্থায়িত্বতা প্রসঙ্গে কারো মনে যদি কোন সন্দেহ থাকে, তবে তার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে ইজরাইলে খননকৃত পুরার্কিত্তির মধ্যে প্রায় ১০০০০ বছর আগেকার গৃহের একটি সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে এখনও কব-হাউজে ব্যবহারের মত মাটির উপাদানগুলির অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে।
ছবি-২৬: A 10,000-year-old house uncovered outside of Jerusalem
কব-হাউজ নির্মাণ পর্ব ও এর কিছু সুন্দর মডেল দেখার আগে, আসুন এটির নির্মাণের সুবিধাগুলি একবার দেখে নিই।
কব- হাউজ নির্মানের সুবিধা সমুহ
১) গৃহ নির্মান ব্যয় কম
২) স্বাস্থ্যকর গৃহাভ্যন্তর
৩) এনার্জি ইফিসিয়েন্ট
৪) দীর্ঘ স্থায়ী এবং ভুমিকম্প প্রতিরোধক
৫) সয়ংক্রীয় শীতাতপ ক্ষমতা সম্পন্ন
৬) উই পোকা, ঘুন ও ফায়ার প্রুফ
৭) শব্দ নিরোধক
ছবি-২৭ : একটি কব-হাউজ এর নির্মাণ পর্ব
ছবি-২৮ : যুক্তরাজ্যের ঈষ্ট ডেভনে অবস্থিত একটি গ্রান্ড ডিজাইন কব-হাউজের ছবি
ছবি-২৯ : পরিবেশ বান্ধব ও টিকসই একটি ছোট কব-হাউজ এর ছবি
বি-৩০ : একটি কব-হাইজের বসার ঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইন
ছবি -৩১ : একটি কব-হাইজের শয়ন কক্ষের ইন্টেরিয়র ডিজাইন
ছবি- ৩২ : একটি কব-হাইজের রান্নাঘরের ইন্টেরিয়র ডিজাইন
উল্লেখ্য যে জার্মানির মতো অত্যাধুনিক একটি দেশের মানুষজনও খর কুটা দিয়ে তৈরি ঘরে বসবাস শুরু করেছে। মাটি, কাদা, খড় এর মত সহজলভ্য উপকরণ কাজে লাগিয়ে আধুনিক বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে জার্মানিতে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতেই এই বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ছবি-৩৩ : জার্মানিতে খর কুটা ও মাটির তৈরী বাড়ি
ছবি-৩৪ : মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাদ বিশিষ্ট দোতলা বাড়ি
পিটানু মাটির (Rammed earth) ঘর
পিটানু মাটি, যা পর্তুগিজ ভাষায় তাইপা , স্পেনীয় ভাষায় টপিয়াল বা টপিয়া, ফরাসি ভাষায় পিসা (ডি টেরি) এবং চীনা ভাষায় হংটি নামে পরিচিত, প্রাকৃতিক কাঁচামাল ব্যবহার করে ভিত্তি, মেঝে এবং দেয়াল নির্মাণের কৌশল । পাকৃতিক উপকরণ যথা মাটি , খড়ি, চুন বা পাথরের নুড়ি প্রভৃতি উপকরন এতে ব্যবহৃত হয় । এটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি যা টেকসই বিল্ডিং পদ্ধতি হিসাবে সম্প্রতি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
পিটানু মাটির ব্লক তৈরির সময় মাটির ভিজা মিশ্রণটির মধ্যে বালি, নুড়ি, কাদামাটি এবং স্ট্যাবিলাইজার (চুন ) উপযুক্ত অনুপাতে মিশানো হয় ।ব্লকগুলি তৈরীর সময় নিন্মরূপভাবে ফ্রেম বা ছাঁচ ব্যবহার করা হয় ।
বি- ৩৫ : ভিত্তির উপর দাঁড়ানো ফ্রেম বা ছাঁচের ভিতর পিটানু মাটির দেয়াল তোলার সনাতনী মডেলের দৃশ্য
ছবি- ৩৬ : ভিয়েতনামের সাবট্রপিক্যল জলবায়ুতে একটি সাধারণ পিটানু মাটির ব্লকের বাড়ি তৈরির কৌশল
ছবি-৩৭: পিটনু মাটির ব্লকে তৈরী চীনের মহাপ্রাচীরের একটি অংশের ছবি ছবি
ছবি- ৩৮ : পিটানু মাটিরতৈরী ব্লকে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার Osoyoos এ Nk'Mip Desert সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির দেয়ালের ছবি
ছবি- ৩৯ : স্পেনের প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় নির্মিত একটি পিটানু মাটির ঘর( Rammed Earth House)
পিটানু মাটির তৈরী এই আধুনিক ডিজাইনের ঘরটি স্প্যানের প্রত্যন্ত এলাকার একটি গ্রাম আয়ার্বেতে অবস্থিত। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই অঞ্চলের লোকজনের গ্রামীণ এলাকা হতে শহড়ে অভিবাসনের ফলে ঐlতিহ্যবাহী সনাতনী মাটির ঘরের স্থাপত্য কৌশল অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ঘরটি ঐ অঞ্চলের সম্প্রদায়ের আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য নির্মান করা হয় ।গৃহটি ঐ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিক স্থাপত্য শৈলীর সাথে যুক্ত টেকসই ইমারত সম্পর্কে কৌতূহল জাগ্রত করার চেষ্টা করে। প্রকল্পটি পুরাতন স্থানীয় মাটির বিল্ডিংগুলির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন , নান্দনিক ডিজাইন এবং স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের দিকে অনুপ্রাণিত করেছে।
চাপানু মাটির ব্লক compressed earth block (CEB)
চাপযুক্ত আর্থ ব্লক বা সংকীর্ণ মাটি ব্লক নামে পরিচিত বিল্ডিং উপাদানটি প্রাথমিকভাবে ভিজা মাটি থেকে তৈরি হয় , যাকে পরে উচ্চ চাপে সংকোচিত হয়ে ব্লকে পরিনত হয় । সংকুচিত আর্থ ব্লকগুলি মোটামুটি শুকনো অজৈব সাবসয়েল, যা প্রসারণহীন কাদামাটি এবং নির্মান সমষ্টির(বালু, নুড়ি, চূর্ণ পাথর, ছোট ছোট দানাযুক্ত কণার খনিজ উপাদান) উপযুক্ত মিশ্রণকে একটি যান্ত্রিক প্রেস ব্যবহার করে মাটির ব্লকে পরিনত করা হয় । ব্লকগুলিকে যদি কোনও রাসায়নিক বাইন্ডার যেমন পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের সাথে মিশিয়ে স্থিতিশীলতা দেয়া হয় তবে তাদেরকে সংকোচিত স্থিতিশীল আর্থ ব্লক (সিএসইবি) বা স্থিতিশীল আর্থ ব্লক (এসইবি) বলা হয়।
এধরনের কমপ্রেসড আর্থ ব্লকের সাহয্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই গৃহ নির্মান চলছে। আমাদের দেশেও কংক্রিট মাটির ব্লকের প্রচলন শুরু হয়েছে, যা এই পোষ্টের উপরের অংশে চিত্রসহকারে বর্ণিত হয়ছে।
ছবি –৪০ : টেক্সাসের মিডল্যান্ডে একটি সিইবি প্রকল্পের আওতায় কমপ্রেসড মাটির ব্লকে নির্মানাধীন একটি ঘরের ছবি
মাটিশ্রয়ী কাঠামোর ঘর (earth sheltered house)
এটি এমন একটি ঘর বা পুরা একটি বাড়ী যা মাটির দেয়ালের বিপরীতে মাটির ছাদের নীচে বা পুরোপুরি ভূগর্ভে সমাধিস্থ হয়। মাটির আবরন তাপীয় ভর হিসাবে কাজ করে, অন্দরের বায়ু তাপমাত্রা বজায় রাখা সহজ করে এবং গরম বা শীতল করার জন্য শক্তির ব্যয় হ্রাস করে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, বিশেষত পরিবেশবাদীদের মধ্যে মাটির নীচে আশ্রয় কাঠামোর ঘর তুলনামূলকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এ ধরনের ঘর মানুষের নীজ আশ্রয়স্থল হিসাবে মাটির উপরে ঘর তৈরীর কৌশল না শেখা পর্যন্ত প্রাচীন কাল হতেই এধরনের মাটিশ্রয়ী কাঠামোর ঘরেই তথা গুহাবসী হয়ে বসবাস করে আসছিল । ইদানিং আনবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ সমুহে যেরকম যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে তাতে মনে হয় আমাদেরকে এমনতর গুহাবাসীই হতে হবে! তাই এধরনের মাটিশ্রয়ী ঘর তৈরীর প্রেকটিস শুরু করে দেয়াই মনে হয় ভাল।
ছবি-৪১ : পোষ্টের প্রচ্ছদে দেখানো বাড়ীটি সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত একটি earth sheltered house
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে দেশের বিত্তশালী অনেকেই গ্রামীন এলাকায় প্রাসাদোপম ইট বালু সিমেন্ট রডের সংমিশ্রনে বিদেশী দামী উপাদানে সৌখীন দৃষ্টিনন্দন বাড়ী তৈরী করছেন ।
এখানে ক্লিক করে দেখতে পারেন বগুড়ার-নিভৃত-গ্রামে-বহু-কোটি-টাকার-শ্বেতপাথরের প্রাসাদোপম একটি বাড়ী
ছবি- ৪২ : সিলেটে তিন শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি বাড়ী
উল্লেখ্য, 'কাজি ক্যাসল' নামে এই বাড়ীটির স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী মাহতাবুর রহমান বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড আল-হারামাইন পারফিউমস গ্রুপ অব কম্পানিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।নীজ দেশে এমন একটি দৃষ্টি নন্দন বাড়ী তৈরীর জন্য এই সফল ব্যবসায়ীর প্রতি রইল সাধুবাদ। এইসমস্ত বিত্তশালী লোকজন যদি নীচের চিত্রের মত অথবা অন্য কোন ডিজাইনের মাটির ঘর তৈরী করেন তাহলে দেশের বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর পুণরুজ্জিত হতে পারে অনায়াসেই।
ছবি ৪৩:সুইস স্থপতি Peter Vetsch প্রণীত ডিজাইনে সুইজারল্যান্ডের ডিয়েটিকন সিটি উপকন্ঠে আর্থ হাউস এস্টেট ল্যাটেনস্ট্রেস
পরিশেষে বলতে চাই দেশের ঐতিহ্যমন্ডিত মাটির ঘর প্রসঙ্গে পোষ্টে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি ও সম্ভাবনার বিষয়গুলিকে আমলে নিয়ে এখন সময় এসেছে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যমন্ডিত মাটির ঘরকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে যথোপযুক্তভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দানসহ, প্রয়োজনীয় কারিগরী ও আর্থিক সহায়তা দেয়া। আর এ লক্ষ্যে প্রয়োজন বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘরকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যে সকল আধুনিক নির্মাণ কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির ঘরকে ব্যয়সাস্রয়ী, টিকসই, দৃষ্টিনন্দন, বিলাসী ও পরিবেশ বান্ধব গৃহায়ন ব্যবস্থায় পর্যবেসিত করেছে তা নিবীরভাবে পর্যবেক্ষন,পরিবিক্ষন ও মুল্যায়ন করে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে যথোপযুক্ত কর্মসুচী গ্রহন করা। দেশ বাচাও,দেশের ফসলের মাটি বাঁচাও,পরিবেশ বাচাও, মানুষ বাচাও, ঐতিহ্য বাচাও, এটাই হোক আজকের দিনের দৃঢ় প্রত্যাশা। কামনা করি সর্বক্ষেত্রে সোনা ফলানো মাটিই হোক এদেশের পরশ পাথর।
এতক্ষন সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটির পরের পর্বে আমার পরশ পাথর প্রাপ্তির পরবর্তী পর্যায়গুলি দেখার জন্য আমন্ত্রন রইল
ছবি সুত্র :কৃতজ্ঞতার সহিত পাবলিক ডোমেইনে থাকা গুগল ছবি সম্ভার
প্রাসঙ্গিক কথা ও ছবি সুত্রগুলির লিংক পোষ্টের যথাস্থানে দেয়া হয়েছে ।