somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হরির উপরে হরি হরিকে দেখে হরি হরিতে পালায় : বাংলা ভাষা হতে সমগোত্রীয় ও সমউচ্চারলমূলক বর্ণ লিপি কমানো প্রসঙ্গ

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এই লেখাটি লিখতে বসে স্বীকার করে নিচ্ছি বিষয়টি খটমটে ও বেদম তাত্বিক সে তুলনায় লেখাটিতে প্রয়োজনীয় তথ্য ও যুক্তিও তেমন নেই বরং বুঝে নিতে চাইছি বাংলা ভাষায় বর্তমান পর্যায়ে কিছু বর্ণ সংস্কার করা যায় কিনা । এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যমুলক কথাবার্তা তো লাগেই । ফলে কিঞ্চিতকর যে তথ্য যুক্ত হয়েছে তা এ লেখায় কিছুটা ধরতে পারে ভিন্ন অবয়ব , যা অনেকের মতের সাথে একেবারেই হয়তবা অমিল হবে তবে শান্তনা এই যে , নীজের কতেক এলোমেলো অপরিপক্য ধারণাকে কিছু পাঠকের সাথে শেয়ারতো করতে পারলাম ।

আমরা সকলেই জানি এই অঞ্চলের প্রায় ২৮ কোটি মানুষ ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো বাংগালী সহ মোট প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা হওয়ায় বাংলা আজ বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানের অধিকারী । বাংলাদেশ ( আমার সোনার বাংলা.... ) , ভারত ( জন গণ মন-- ) ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত (শ্রীলংকা মাতা,... নম নম নম মাতা---) , এবং ভারতের জাতীয় স্তোত্র এই বাংলা ভাষার শব্দাবলী নিয়েই রচিত ।

অনেক মানদন্ডেই বাংলা ভাষা বিশ্বের সেরা ভাষাদের একটি । এখানে ইংরেজীর মত but ( বাট) আর put (পুট) এর মত কোন অবৈজ্ঞানিকতা নেই , to এর পরে too বলতে গিয়ে বাংলা ভাষা শ্রুতার গায়ে থুতু ছিটানোর মত অবস্থায় যায়না , আরবীর মত কোন কোন শব্দের উচ্চারণ করতে গিয়ে মুখের আকৃতির পরিবর্তন করতে হয়না । পৃথিবীর সকল ভাষা মহান আল্লাহরই সৃষ্টি তাই কোনো ভাষাকেই এখানে অবজ্ঞা করা হচ্ছেনা কোন মতেই । মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ আল কোরানের ভাষা আরবীতে হওয়ায় প্রত্যেক মুসলমানের জন্য শুদ্ধ ভাবে আরবী উচ্চারণ একান্ত উচিত বলে গন্য । তবে এটা অনস্বিকার্য যে আরবী ভাষায় উচ্চারণে দেখা যায় অনেক কঠীন নিয়ম যথা জিহবার গোড়া তার বরাবর উপরের তালুর সঙ্গে লাগিয়ে-ক্বাফ-ق , . জিহবার গোড়া হতে একটু আগ বাড়িয়ে তার বরাবর ওপরের তালুর সঙ্গে লাগিয়ে-কাফ -ك , জিহবার মধ্যখান তার বরাবর উপরের তালুর সঙ্গে লাগিয়ে-ইয়া, শিন, জিমঃ ي-ش-ج . . জিহবার গোড়ার কিনারা সামনের উপরের একপাশের দাঁতের গোড়ার সঙ্গে লাগিয়ে-দোয়াদঃ ض . ইত্যাদি । সে তুলনায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা ভাষার বর্ণ ও শব্দ উচ্চারণ করা যায় সাবলিল ভাবে, একই স্কেলে , এখানেই বাংলার স্বকীয়তা । এমন শ্রুতি মধুর কথ্যভাষা দুনিয়াতে খুব কমই আছে । এছাড়াও এই ভাষায় একই শব্দ কতনা না অর্থ প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা যায় তার কোন ইয়ত্যা নাই । উদাহরণ স্বরূপ একই শব্দ একই বানান একই ধ্বনি একই উচ্চারণের ‘হরি’ শব্দটি একটি বাক্যে কত না অর্থ ধরতে পারে তা দেখানো হল নীচে :

হরির উপরে হরি , হরিকে দেখে হরি হরিতে পালায় , হরির কৃপায় হরি হতে হরি ফুল নেয় হরি ।
এখানে হরি= জল/পানি, হরি = ব্যঙগ ( সরিসৃপ হিসাবে), হরি = সাপ ( সরিসৃপ হিসাবে),হরি= ভগমানের একটি নাম, হরি= একটি মেয়ের নাম, এবং হরি = হরন করা
তার মানে হল জলের উপরে পদ্ম পাতায় থাকা একটি ব্যঙগ সাপকে দেখে পানিতে পালাল, আর সেই ফাকে ভগমান হরির কৃপায় হরি নামের একটি মেয়ে পানি হতে পদ্ম ফুলটি নিল হরি ।

ভাষা নিয়ে কিছু বুনিয়াদি ধারণার পর্যালোচনা দিয়েই শুরু করা যাক কাংখিত লক্ষ্যে আলোচনা । মানুষ সসীম শব্দ নিয়ে অসীম বাক্য বানাতে পারে এবং এই অসীমতায় পৌঁছানোর জন্য মানবিক স্বভাবই যথেষ্ট কেননা মানুষের জৈবিকতায় এমন অসীম বাক্য বানানোর ক্ষমতা সহজাত । আর আমরা সবাই যদি স্বভাবতই অসীম বাক্য বানাতে পারঙ্গম হই তাহলে আর অসুবিধা কোথায় ? ভাষা নিয়েই বা গুলমাল কিসের ? তবে গোলমাল কিছুটা আছে আর সেটা হল ভাষার অসংখ্য বৈচিত্রতা এবং কি রকমের মুল্য আরোপ করা হচ্ছে তার উপর । জৈবিক স্বাভাবিক ভাষা বানানোর প্রক্রিয়াকে প্রখ্যাত ভাষাবিদ আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানের জনক হিসাবে অভিহিত নোয়াম চমস্কি ( ২০১২) তাঁর The science of language গ্রন্থে বলেছেন অভ্যন্তরীন বা ভেতরের ভাষা ( সংক্ষেপে অভা ) আর এই অবাধ বৈচিত্রকে বলেন বাহ্যিক ভাষা ( বাভা) ।
নোয়াম চমস্কি ( জন্ম ১৯২৮- আমিরিকান ভাষাবিদ )


আবার দেখা যায় ভাষার বিপুল বৈচিত্র, এক ভাষা থেকে আর এক ভাষা আলাদা কেননা প্রতেক ভাষাগোষ্ঠির ব্যবহৃত ভাষার কাঁচামালগুলো আলাদা । এই যে H2O বস্তুটাকে আমরা নানান নামে ডাকছি যেমন একোয়া, ওয়াটার , পানি, জল , আব ইত্যাদি অন্যদিকে গাছ বস্তুটাকে ডাকছি বৃক্ষ, পেড়, গাছ , টপডড, নগজম, এটা ঘটছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন কাঁচামাল চিহ্ন ব্যহারের দরুন । খেয়াল রাখতে হবে নাম আর নামী , চিহ্ন আর চিহ্নিতের ( signifier and signified) দিকে ।


সম্পর্কটা নেহায়েত অবাদ কিংবা যা ইচ্ছা তাই । আমরা সবাই মিলে চুক্তি করে আজ থেকে গাছ বস্তুটাকে ‘X ‘ বা ‘ স্ত্রীঘাঞ্চু’ বলে যদি ডাকি , তাহলে আমাদের মধ্যে কথা বার্তা চলবে, একের মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করতে পারব ।

এই কাঁচামাল ভাষার বাইরের উপাদান, এই অবাদ /যাচ্ছেতাই উপাদানের ভিন্নতার জন্যই বিশ্ব জুড়ে ভাষার এত ভেদ- বিভেদ । একে বলা যায় বাভা । কিন্তু এই ভেদের বাইরে অভেদ একটা আছে । এসব বাইরের কাঁচামাল চিহ্নের সংখ্যা সীমিত ( তা সেই চিহ্নের সংখ্যা ১০ কিংবা ১০হাজার কিংবা ১০ লাখ বা যাই হোক না কেন ) এই সীমিত কাঁচামাল ( মুলত ধ্বনি আর শব্দ ) নিয়ে আমরা মানুষেরা অসীম বাক্য বানাতে পারি । একটি বাচ্চার দিকেই তাকাই না কেন, সে যখন কথা বলতে শেখে , তখন তার এই বাইরের জড়ো হওয়া সামান্য উপাদান দিয়ে এমন বাক্য বানায়, এমন বাক্য বোঝে যা আগে সে শুনেনি – কি করে বানায় সে ? তার বায়োলজির ভেতরেই আছে বাক্য বানানোর ছাঁচ । চমস্কি এই ছাচের নাম দিয়েছেন Language Acquisition Device ( LAD) এটা দিয়েই মানুষ সিমিত অবাধ শব্দ-ধ্বনির কাঁচামাল আর অল্প কয়েকটা সুত্র দিয়ে অসীম বাক্য বানায় । এই বাক্য সৃস্টির বৈশিষ্ট সমস্ত মানুষের জাতি –ধর্ম –বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে আছে । তাই ভাষা ভাল –খারাপ-উন্নত-অবনত , গরীব- বড়লোক , শুদ্ধ -অশুদ্ধ হয়না ।

ভাষাতাত্বিকের কাজ হলো বাক্য বিশ্লেষন করে মানুষের বায়োলজির ভিতরে থাকা এই ছাঁচটাকে ভাল করে বুঝে নেয়া , মানে মনের মধ্যে নিরবধি যে বাক্য তৈরী হয় সেই বাক্যের ভিতরে গিয়ে মনের অন্দরে ঢুকে পড়া, কাঁচামালের জঙ্গল পেরিয়ে আকারকে বুঝে নেয়া । এই বিশ্বজনিন ভাষিক আকারকে বলা যায় অভা । বাভায় যদি থাকে যাচ্ছেতাই উপাদান /কাঁচামাল , তাহলে অভায় আছে সার্বজনিন আকার ।
তাহলে অভা আর বাভার তফাতটা দাঁড়ালো এই :



এবার ভাষার ব্যকরণ চাই –খাটি বাংলা ব্যকরণ । কেননা যে সব ব্যকরণ চালু আছে তা সংস্কৃত ব্যকরণের ছকে সাজানো । অটোনমাস বাংলা ব্যকরণের দাবীটা এখন চলছে বেশ জোড়েসুরে । গ্রামার আর ব্যকরণের মধ্যে তফাত রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্রী। বাংলাদেশের খুলনায় জন্মগহণকারী এই বিশিষ্ট ভাষাবিদ ১৯২১ -২৪ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ।
হরপ্রসাদ শাস্রী ( জন্ম ১৮৫৩ - মৃত্যু ১৯৩১)



হরপ্রসাদ শাস্রীর মতে ব্যকরণ বিশ্লেনাত্বক শাস্র , গ্রামারের কাজ শুদ্ধ-অশুদ্ধের প্রেসক্রিপসন দেয়া । বিজ্ঞ ভাষাবিদেরা এই প্রেসক্রিপন দিতে থাকুন । আমরা তাদের প্রেসক্রিপশন মেনে চলব । তবে এই ফাকে তাঁদের সমীপে জানাতে চাই বাংলা ভাষার টাইপিং গতি ও গণহারে বানান ভুলের কিছু সমস্যার কথা সাথে এগুলির হাত হতে নিস্কৃতির জন্য আমাদের কিছু এলোমেলো সাধারণ চিন্তা ভাবনার কথা । কাজ কিছু না হোক, আমাদের মত সাধারণ মানুষ যাদের ভাষা জ্ঞান নিতান্তই সীমিত তাদের ভাবনাটুকু তো তাদের দৃষ্টি গোচর হবে । ভুল হলে শুধরে দিলে মেনে নিব তা নতশীরে।

বাংলা ভাষার অনেক গুণের পরেও শুধু যুক্ত বর্ণ ও সমউচ্চারণ সম্পন্ন বর্ণ লিপিগুলি হতেই কিছুটা ঝামেলা , তাই এই মহুর্তে এদিকটায় দৃষ্টি দেয়া আশু কর্তব্য বলেই মনে হয় ।

আমরা সকলেই জানি এই ডিজিটাল যুগে কালি কলম দিয়ে হাতে লেখার চেয়ে কমপিউটারে বা অন্য ডিভাইসে লেখা হয়ে থাকে বেশী । এই যে, যা কিছু লেখা লিখি করি তার সবইতো কমপিউটারে, হাতে লেখা হয়না এক অক্ষরও। বাংলায় লিখতে গিয়ে শব্দের স্পীড মিনিটে ২০ টার বেশী করা খুবই কঠীন হয়ে পরে । তবে টাইপিং এ এক্সপার্ট হয়ে গেছেন যারা তাদের কথা আলাদা তারা ব্যতিত্রম, শ্রদ্ধা জানাই তাদের তরে ।

উচ্চ শিক্ষার সকল স্তরেই দেশে দেশে এখন লেখা লিখি , এসাইনমেন্ট , রচনা বা থিসিস সবই অন লাইনে চলে , বাংলাদেশেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটা শুরু হয়েছে । তাই কলম কালিতে হাতে বাংলা লিখন এখন অনেকটা কমে গেছে । আমার নীজেরইতো বলতে গেলে হাতে বাংলা লেখা এখন হয়না একেবারেই ।

এখন সমস্যার কথায় আসা যাক , একে তো ফন্টের সমস্যা , তার উপরে কি বোর্ড সমস্য। বাংলায় কোন কোন অক্ষর লিখতে গেলে কমপিউটারের ইংরেজী কি বোর্ডে কিছু বর্ণ যথা ‘ক্ষ’ অক্ষরটা লেখতে গেলে কমপক্ষে চারবার যথা J+G+ shift key +N ( এই টারটা চাবিতে চাপতে হবে , এটা অভ্র কি বোর্ডের কথা ) ,আর সংযুক্ত অন্য অক্ষর যথা ঙ্ক, ঙ্গ, জ্ঞ, ঞ্চ, ঞ্ছ,ঞ্জ,ষ্ণ, ণ্ড , এবং হ্ম, টাইপের সমস্যা সেতো কারো অজানা নয় ।

কষ্ট করে যদিও বাংলা টাইপের স্পীড কিছুটা বাড়ানো যায় কিন্তু বানান প্রমাদ সেতো থেকেই যায় পদে পদে । বাংলা স্পেলিং চেকার সফট ওয়ারের বড়ই অভাব । এর অভাবে ইংরেজীর মত ভুল চিহ্নিত ও অটো কারেকশনের সুযোগ খুবই সীমিত । প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রুফ রিডিং এর জন্য বিশেষ পারদর্শী লোকজন থাকলেও অন লাইন বা ডিজিটাল লেখায় লেখকের পক্ষে একা প্রুফ রিডিং করাটা বেশ কঠিন ও সময় সাপেক্ষ ব্যপার । টেকনিকেল কারণে বানান প্রমাদের শিকাড় প্রায় সকলেই, কম আর বেশি এই যা তফাত ।

সন্দেহ নাই ভাল বাংলা spelling checker সফট ওয়ারের জন্য অনেক কম্পিউটার বিজ্ঞানীরাই কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে । SNLTR কতৃক উদ্ভাবিত UNICODE কমপ্লাইএন্ট spelling checker টি অনলাইনে কিছু বাংলা শব্দের জন্য MSOffice Open Office এ বব্যহার করা যায় । spelling checker উদ্ভাবনের বিষয়ে কম্পিউটার সাইন্সের ছাত্ররাও পিছিয়ে নেই । ব্র্যাক বিশ্ব বিদ্যালয়ের বি এস সি ইন কমপিউটার সাইন্সের একজন ছাত্রের একটি থিসিস যথা Encoding for Bangla alphabet and its application to spelling checker , transliteration and cross language information retrieval তার একটি উদাহরণ। এ বিষয়ে অনেক বিশষজ্ঞই যথা হক এবং কায়কোবাদ ( (২০০২) ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক মমিত খানসহ ( ২০০৪) অনেকেই ভাল ভাল কাজ করছেন , তাদের সকলের প্রতি সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল । এনকোডিং করার জন্য তারা যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করছেন তার একটু নমুনা নুশাদ উজ্জামান( ২০১৪) এর থিসিস হতে তুলে ধরা হল নীচে আলোচনার প্রয়োজনে ।



এখানে একটি ব্যপার লক্ষনীয়, তা হল বাংলা শব্দকে এনকোডিং এর জন্য তারা ইংরেজী বর্ণকে যেভাবে ব্যবহার করছেন ঠিক সে রকমভাবে ( ইংরেজীর মত একই বর্ণকে দুইবার লিখে ) দ্বিত্ব ভাবে প্রয়োগ করে সমউচ্চারণমুলক বর্ণ সংখ্যাকে কমানোর কাজে লাগানো যেতে পারে যেমন In = ভিতর Inn = সরাইখানা , To = প্রতি Too = আরো ইত্যাদি ,অবশ্য এর ফলে শব্দের প্রচলিত phonetic sound এ কিছুটা সমস্যার সৃস্টি হবে , তবে ভাল কিছু পেতে হলে একটু ছাড় দেয়ার বিষয়তো বিবেচনা করাই যেতে পারে ।

কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা International Phonetic Alphabet (IPA) আদলে ভুল বানান গুলিকে ধ্বনি তাত্বিক ম্যাপিং করে কারেকসনেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । তবে ধ্বনিতাত্বিক ম্যাপিং এর বিষয়ে বর্ণ সংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়ে গেছে যা কাটিয়ে উঠা এখনো বেশ কষ্টকর বলে প্রায় সকলেই বলছেন । আমরা এই বিশ্বায়নের যুগে ধ্বনির উচ্চারনকে সঠিকভাবে প্রকাশের জন্য যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার না করি তাহলে অনেক ধরনের অসুবিধার মুখেই পড়ব । এই অসুবিধার হাত হতে উত্তরণের জন্য সম উচ্চারণমুলক বর্ণ একটি বিরাট ফেকটর তাতে কোন সন্দেহ নেই । মনের সঠিক ভাব প্রকাশ ও উচ্চারণকে শ্রুতি মধুর করার জন্য ধ্বনির প্রয়োজনীয়তা অনস্বিকার্য । তবে লেখার গতি সে সাথে তা শুদ্ধ করে লেখার প্রয়োজনটাও গুরুত্বের সাথে নিতে হবে ।

বানান নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে এ ব্লগের একজন সন্মানীত ব্লগার খাইরুন নাহার বিনতে খলিল খুব সুন্দর করে বলেছেন সাধারণ মানুষের মুখের কথাকেই লেখার ভাষায় আনতে হবে । তিনি বাংলা ভাষায় চলতি গদ্যের রূপকার প্রমথ চৌধুরীর কথা উল্লেখ করে বলেছেন “ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।”

প্রমথ চৌধুরী ( জন্ম: আগস্ট ৭, ১৮৬৮ - মৃত্যুঃ সেপ্টেম্বর ২, ১৯৪৬)) )



উল্লেখ্য বাংলাদেশের পাবনায় জন্মগ্রহনকারী এই খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর তিরোধানের কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯৪৭ সনের দিকে বাংলাভাষী অঞ্চলে স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২% । তাই দেশের বিপুল সংখক নিরক্ষর মানুষ ধ্বনি তত্ব অনুসরন করে শুদ্ধ বাংলায় যে কথা বলতেন না তা বলাই যায় বরং বিভিন্ন ধরনের কথ্য আঞ্চলিক ভাষারই ছিল ছড়াছড়ি। তারা যে সব কথ্য ভাষায় ও উচ্চারণে কথা বলতেন তার সকলই কি তখন লেখ্য ভাষায় কলমে লেখা হত ? বরং সমাজের যে অল্প কয়জন শুদ্ধ উচ্চারনে কথা বলতেন তাই কলমে লেখ্য ভাষায় স্থান পেতো এবং সে সমস্ত লেখা দেশের সংখ্যা গরিষ্ট সাধারন নিরক্ষর মানুষকে মেনে নিতে হত , তার মানে তাদের মুখে প্রকারান্তরে কালিই ছিটিয়ে দেয়া হত । তাই প্রমথ চৌধুরী দু:খ করেই বলেছিলেন এই মুল্যবান কথাটা । বাংলা ভাষার এই বরেন্য ব্যক্তিত্বকে তাই জানাই অকৃত্তিম শ্রদ্ধা । সে সময় দেশের সংখ্যা গরিষ্ট মানুষের কথ্য ভাষা বা উচ্চারণ ভঙ্গিতে বলা কথা লেখ্য ভাষায় স্থান পায়নি অথচ উচিত ছিল দেশের সিংহ ভাগ মানুষের visual speech sounds কে আমলে নিয়ে লেখ্য ভাষার রূপায়ন । বাংলার কথ্য ও লেখ্য ভাষার সে টানা পোড়নের দিনে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর পালন করেছেন এক বলিষ্ট ভুমিকা ।

রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর ( (৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১)



"ক্ষণিকায় ' তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃত বাংলা ভাষা ও প্রাকৃত বাংলার ছন্দ ব্যবহার করেছেন । প্রাকৃত ভাষা বলতে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে লোকমুখে প্রচলিত স্বাভাবিক ভাষাগুলিকে বোঝায় । তিনি বলেছেন প্রাকৃত ভাষার শক্তি, বেগ ও সৌন্দর্য স্পষ্ট করিয়া বুঝি। দেখিলাম এ ভাষা পাড়াগাঁয়ের টাট্টু ঘোড়ার মতো কেবলমাত্র গ্রাম্য-ভাবের বাহন নয়, ইহার গতিশক্তি ও বাহনশক্তি পুঁথির লিখ্য ভাষার চেয়ে অনেক বেশি ।
ক্ষণিকায় তিনি লিখেন
কাব্য যেমন কবি যেন
তেমন নাহি হয় গো।
বুদ্ধি যেন একটু থাকে,
স্নানাহারের নিয়ম রাখে,
সহজ লোকের মতোই যেন
সরল গদ্য কয় গো।

তিনি আরো বলেন "এই তো আমরা পণ্ডিতের ভয়ে সতর্ক হইয়া চলি কিন্তু পণ্ডিত যখন পুঁথির লিখ্য বাংলা বানাইয়াছিলেন আমাদের কিছুমাত্র খাতির করেন নাই। বাংলা গদ্য-পুঁথিতে যখন তাঁরা "যাইয়াছি' "যাইল' কথা চালাইয়া দিলেন তখন তাঁরা ক্ষণকালের জন্যও চিন্তা করেন নাই যে, এই ক্রিয়াপদটি একেবারে বাংলাই নয়। যা ধাতু বাংলায় কেবলমাত্র বর্তমান কালেই চলে; যথা, যাই, যাও, যায়। আর, "যাইতে' শব্দের যোগে যে-সকল ক্রিয়াপদ নিষ্পন্ন হয় তাহাতেও চলে; যেমন, "যাচ্চি' "যাচ্ছিল' ইত্যাদি। কিন্তু "যেল' "যেয়েছি' "যেয়েছিলুম' পণ্ডিতদের ঘরেও চলে না। এ স্থলে আমরা বলি "গেল' "গিয়েছি' "গিয়েছিলুম'। তার পরে পণ্ডিতেরা "এবং' বলিয়া এক অদ্ভুত অব্যয় শব্দ বাংলার স্কন্ধে চাপাইয়াছেন এখন তাহাকে ঝাড়িয়া ফেলা দায়। অথচ সংস্কৃত বাক্যরীতির সঙ্গে এই শব্দ ব্যবহারের যে মিল আছে তাও তো দেখি না। বরঞ্চ সংস্কৃত "অপর' শব্দের আত্মজ যে "আর' শব্দ সাধারণে ব্যবহার করিয়া থাকে তাহা শুদ্ধরীতিসংগত। বাংলায় "ও' বলিয়া একটা অব্যয় শব্দ আছে তাহা সংস্কৃত অপি শব্দের বাংলা রূপ। ইহা ইংরেজি 'and' শব্দের প্রতিশব্দ নহে, too শব্দের প্রতিশব্দ। আমরা বলি আমিও যাব তুমিও যাবে--কিন্তু কখনো বলি না "আমি ও তুমি যাব' "।

বাংলাভাষা পরিচয় (১৯৩৮) গ্রন্থে তিনি একাধিকবার বলেছেন, বাংলা হচ্ছে ভঙ্গিপ্রধান ভাষা এবং এই ভঙ্গির পরিচয়ই তিনি ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব এই তিন দিক থেকে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। তিনি যত সহজ সরল ভাবে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের প্রবাহমান অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করেছেন তা আর কারো লেখায় তেমন উঠে আসেনি , সে জন্যই তার লেখা , গান গল্প কবিতা পেয়েছিল ব্যপকতা সর্বজন মহলে ।

কঠীন সংস্কৃত ছকে গড়া ব্যকরনের যাতাকলে পড়ে বাংলা ভাষা যখন অতিষ্ঠ সে সময়ে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব চর্চার গতি পরিবর্তিত হয় ড: মুহম্মদ শহীদুল্লার মত কিছু দেশ বরেন্য বাংলা ভাষাবিদের প্রয়াসে ।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ( জন্ম ১৮৮৫- মৃত্যু ১৯৬৯ )



ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Journal of the Department of Letters (Vol. III, ১৯২০)-এ ‘Outlines of an Historical Grammar of the Bengali Language’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ব্যকরণ রচনার আদর্শ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। The Origin and Development of the Bengali Language' '(ODBL, ১৯২৬) নামক অদ্বিতীয় গবেষণা গ্রন্থে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলা ভাষার উপাদানগুলো চিহ্নিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। এ ছাড়াও বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত( ১৯৫৮) গ্রন্থের মাধ্যমে বাঙালির মাতৃভাষা চর্চার যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী ভাষাচর্চার সৌধ । সেই ভাষাচর্চার পথ ধরে আমাদের ভাষাবিদেরা যদি একটু চেষ্টা করতেন তাহলে বাংলাভাষায় ব্যবহৃত বর্ণের উন্নতির একটি রাস্তাও তারা বের করতে পারতেন বলে বিশ্বাস ।

কিন্তু এর বিপরীতে আমরা দেখলাম পরবর্তীতে সাংগঠনিক ( সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা যথা বাংলা উন্নয়ন বোর্ড) ভাষাবিজ্ঞানের ধারা ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় ঐতিহাসিক ব্যকরণ চর্চার ধারা প্রায় ক্ষীণ এবং অবসিত হয়ে উঠে । ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে রোমান বর্ণমালা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে প্রখ্যাত ভাষাবিদ মুনীর চৌধুরী এর তীব্র প্রতিবাদ করেন । শুধু তাই নয় তিনি ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বাংলা টাইপরাইটারের জন্য উন্নতমানের কী-বোর্ড উদ্ভাবন করেন, যার নাম মুনীর অপ্টিমা। An Illustrated Brochure on Bengali Typewriter (1965) শীর্ষক পুস্তিকায় তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন এবং এই নতুন টাইপরাইটার নির্মাণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকবার পূর্ব জার্মানিতে যান। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলা ভাষার ম্যানুয়েল টাইপিং গতি পায় । এই ভাষার মাসে তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ।

আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী ( জন্ম১৯২৫ - মৃত্যু ১৯৭১ )



বাংলা ভাষার ব্যকরণ ও বর্ণমালার উন্নয়নে সীমান্তের ওপারেও হয়েছে কাজ অনেক এর মধ্যে ভাষা বিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর কথা উল্লেখ না করলেই নয় ।তাঁর দি অরিজিন এন্ড ডেভেলপম্যান্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থখানির মাধ্যমে তিনি প্রচলিত ব্যকরণ কাঠামো ভেঙ্গে সেখানে প্রবেশ করিয়েছেন আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি সংস্কৃত ব্যকরণের নিয়মগুলি নির্বিচারে গ্রহণ না করে ইতিহাস ও উপযোগিতার সূত্রে সেগুলিকে গ্রহণ-বর্জন করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার জন্য কোনো নিয়ম প্রতিষ্ঠা ও আরোপ করা নয়, বরং ভাষার অন্তর্নিহিত নিয়ম আবিষ্কার ও তার বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা । তাঁর এই দৃষ্টি ভঙ্গীটা গ্রহণ করে ভাষায় বর্ণ সংস্কারের বিষয়টা বিবেচনা করা যায় । তাছাড়াও এ লেখাটির শুরুতে অভা ও বভা নিয়ে যে তাত্বিক কথা বলা হয়েছে তাও আমলে নিয়ে প্রয়োজনে একই বস্তুর নতুন শব্দ তৈরী বা উপযুক্ত পদ্ধতিতে বর্ণের সংস্কার করা যায় ।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ( ( জন্ম ১৮৯০— মৃত্যু ১৯৭৭ )



এপার ওপার দুপারের বাংলা লিখ্য ভাষার দিকে তাকিয়ে কি দেখছি আমরা । দেশের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক মানুষের কথ্য ভাষার বিভিন্নতা দেখা যায় যথা রাজধানী ঢাকা সিটির পুরাতন অংশের মানুষের কথ্য ভাষা ও উচ্চারণ , ঢাকার দক্ষীনের বিক্রমপুর অঞ্চল , ময়মন সিংহের উত্তরের জামালপুর , পুরা সিলেট বিভাগ , নোয়াখালীসহ পুরা চিটাগাং ডিভিসনের কোটি কোটি মানুষের প্রবাহমান ভাষার উচ্চারণ ও ভঙ্গীমা, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের কোটি কোটি মানুষের কথ্যভাষার উচ্চারণ প্রভৃতি কি লিখ্য ভাষায় উঠে আসছে আমাদের পুথি পুস্তক কিংবা ছাত্র ছাত্রীদের জন্য প্রণীত টেক্সট বুকে ।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের কথ্য ভাষার সঙ্গে মান্য চলিত বাংলার খুব সামান্যই মিল রয়েছে। তবে অধিকাংশ বাঙালি নিজেদের মধ্যে ভাব আদান প্রদানের সময় মান্য চলিত বাংলা সহ একাধিক উপভাষায় কথা বলতে সক্ষম বলে মনে করা হলেও অনেক ভাষাবিদ তা স্বীকার করেন না ফলে তা লিখ্য ভাষাতেও আসছেনা ।

তাই অতি দু:খের সাথে লক্ষ করা যায় যে, দেশের বর্তমান লিখ্য ভাষায় সাধারণ গণমানুষের মুখের কথ্য ভাষার উচ্চারণ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি । ফলে সাধারণ মানূষের কথ্য ভাষার উচ্চারণ ও ধ্বনি লিখ্য ভাষার মধ্যে প্রয়োগের বিষয়ে শত বছর ধরে শুধু বিরাট একটি দুরত্বই সৃস্টি হয়েছে । তাইতো দেখা যায় বাসে লিখা থাকে “ বদ্র ব্যবহারে ভংসের পরিচয়,’ টা্ইপের হাজার হাজার ভুল বানান যা অনবরত চলছে আমাদের সমাজের /দেশের অনেকের লিখনীতে। রাতের নগরে রঙিন আলোর খেলায় সাইনবোর্ড, দেয়াল লিখনে একটু মনোযোগ দিলেই ভড়কে যেতে হয় হাজারো ভুল বানান দেখে। শুধু সাইনবোর্ডের ভুলই নয়, রাজনীতিকদের বানানের ওপর 'অগাধ জ্ঞান' দেখে তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। দেয়ালে চোখ পড়লে প্রায়ই দেখা যায় 'জাতীর পিতা । ব্যানারে কি ভয়াবহ বানান! প্রায়ই লেখা থাকে 'দূরশ্বাষনের', 'বিরোদ্ধে', 'কণ্ঠ সুর', 'স্বইরাচারী', 'বিক্ষুভ' ইত্যাদি ভুল।সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বানানের অবস্থাটা আরো করুণ। 'সুপ্রীম কোর্ট', 'আপীল'. 'রেজিষ্ট্রার', 'সরকারী', 'লিঁয়াজো' ইত্যাদি (প্রমিত বানান হবে : সুপ্রিম কোর্ট, আপিল, রেজিস্ট্রার, সরকারি, লিয়াজোঁ) সরকারি প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো লেখা রয়েছে বর্জিতব্য 'সরকারী' বানানটি। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ঢুকতেই ভুল বানানটি শিখে ফেলে।

এখন বলা যায় এ অবস্থার হাত হতে উত্তরনের জন্য দেশের মানুষকে শিক্ষিত হতে হবে । ভাল কথা তবে তাই হোক , কিন্ত আমরা গভীর হতাশার সাথে লক্ষ্য করছি যে আমাদের শিক্ষিত সমাজের লেখাতেও ঘটে যাচ্ছে অনেক ভুল । এই সামুর পাতাতেই দেখা যায় অনেকের লেখা কবিতা , গল্প ও সাহিত্য কর্মে ধরা পরছে অনেক ভুল ( আআমার নীজের লেখাতেও অনেক বানান ভুল থাকে সে জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ), অনেকেই বেশ বিরক্ত হয়ে সেই ভুল টুকু অনিচ্ছা সত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধরিয়েও দিচ্ছেন । ভাল উদ্যোগ তাতে সন্দেহ নাই , তবে উভয়েই এতে কিছুটা হচ্ছেন বিব্রত, প্রযুক্তিগত সমস্যা ও সমউচ্চারণের বর্ণাধিক্যও যে এর জন্য দায়ী তাকি ভাবছেন কেও !!! আর বেশীর ভাগ ভূলগুলিই দেখা যায় প্রায় সমউচ্চারণ মুলক শব্দ প্রয়োগের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে । যারা এরকম ভূল করছেন তারা যে ধ্বনি আর উচ্চারণ সম্পর্কে অনবিজ্ঞ তাতো বলা যাবেনা , তাঁরা সকলেই সমাজের উচ্চ শিক্ষিত, অবশ্য বলা হয়ে থাকে সচেতনতার অভাব , তবে এই ঠুনকো যুক্তি আর কাহাতক !!! তাই দেখা যায় বড় ধরণের কোন সমস্যা রয়েছে লিখ্য ভাষার শব্দের মধ্যে বর্ণ প্রয়োগে । সচেতনভাবে হোক বা অসচেতন ভাবেই হোক এতে বহুবিধ ধরণের ভুল হয়েই যাচ্ছে প্রতি নিয়ত , সমউচ্চারণমুলক বর্ণের কারণে একটি শব্দ লেখার জন্য টাইপ করতে গিয়ে কি ধরনের ভুল হচ্ছে তার কিছুটা নমুনা দেখা যাক নীচে :



ঈশ্বরচন্ত্র বিদ্যাসাগর একাডেমিশিয়ান ভাষাবিদ হিসাবে লিখে গেছেন ব্যকরণ এবং বাংলা লিপিকে সংস্কার করে যুক্তিবহ করেছেন , তবে যখন তিনি নীজের একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন তখন অনুভব করলেন বাস্তবে মুদ্রনের জন্য লিপি ব্যবহার করতে গেলে সমস্যাগুলি কি কি । তাই কতেক ক্ষত্রে বাংলা লিপির আরো কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেন , তবে তা তিনি নীজে পুরণ করে যেতে পারেননি ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ – ২৯ জুলাই ১৮৯১)



পরবর্তীতে মুদ্রনশিল্পের জন্য বাংলা লিপির কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে ভারতের আনন্দ বাজার প্রকাশনীর উদ্যোগে অর্থাৎ যারা মুদ্রনে ব্যবহার করেছেন বাংলা লিপিকে । একাডেমিশিয়ানরা ভাব প্রকাশ ও ধ্বনির সমস্যার কথা ভেবে সংরক্ষশীল মনোভাবই করেছেন ধারণ যুগের পর যুগ ধরে । এখনো ভাষাবিদদের চেয়ে মুদ্রন ও বাংলা ভাষার ওয়ার্ড প্রসেসিং নিয়ে কাজ করা কমপিউটার সাইনন্সের বিজ্ঞানীরা বাংলা লিপিকে সহজভাবে লেখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস ভাবে । কিন্তু কঠীন ব্যকরণের রক্ষনশীলতার চাপে পরে তাঁরা সমউচ্চারণ মুলক বর্ণগুলির ব্যপারে আছেন সমস্যার সাগরে । তাই উচ্চারণ ও ভাবভঙ্গী ঠিক রেখে দেশের সিংহভাগ সাধারণ মানুষের হাতে লিখ্য ভাষায় লিখনকালে সচরাচর ঘটে যাওয়া ভুল গুলিকে গভীর ভাবে স্টাডি করে তাদের মুখে উচ্চারিত কথ্যভাষার ধ্বনিকে যথাসম্ভব আমলে নিয়ে বর্ণ সংস্কারের বিষয়ে মনযোগ দিলে এ মহুর্তে বেশী ভাল হবে বলে মনে হয় ।

উল্লেখ্য, একটি ভাষার শুধু গুটি কয়েক বর্ণ নয়, পুরো বর্ণমালা সংস্কার করে দিলেও মানুষের মনের ভাব প্রকাশের জন্য লিখ্য ভাষায় বিশেষ কোন ক্ষতি করেনা বলেই দেখা যায় । উদাহরণ ১৯২৬ সনে তুরস্কে অটোমান টার্কিশ ভাষার বর্ণ লিপি কামাল পাশা কতৃক ইংরেজী এলফেবেটে রূপান্তর , ভারতে সংস্কৃত বর্ণমালা হতে হিন্দি বর্ণে রূপান্তর , পাকিস্থানে পারসী অক্ষরে উর্দু ভাষার লিপীতে রূপান্তর । তাই বাংলা বর্ণলিপি হতে দুই/ চার / দশটা সমস্যা সৃস্টিকারী সমউচ্চারণ মুলক শব্দকে একিভুত করে বর্ণ সংখ্যা কমানোর বিষয়টি সকলেই গুরুত্বের সহিত চিন্তা করতে পারেন । আগে তো পরিবর্তনের বিষয়ে জাতীয় এক্যমত হোক তার পরে দেখা যাবে বাক্ প্রবাহ পরিবর্তন না করে লিখিত ভাষায় বর্ণের সংস্কার কি ভাবে করা সম্ভব হবে ।

সংস্কুত ভাষা অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের কথ্যভাষা বা দেবতাদের মুখের ভাষা ছিল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই । তার পরেও এই সংস্কৃত ভাষাতেই লিখেছেন ১৬০০ বছর আগে মহাকবি কালীদাস তাঁর অমর সব রচনাবলী । এর পর থেকে সংস্কৃতেই লেখা হয়েছে মহাভারত, রামায়নসহ অসংখ্য সাহিত্য কির্তী । রামায়ণের কিস্কিন্ধাকা, মেঘদূত, জয়দেব ও বৈষ্ণব গীতিকা থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সংস্কৃত । ধ্রপদী সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যে বীণাতন্ত্রে সূক্ষ্মতম ও স্বর্গীয়তম ঝংকার প্রাচীন ভারতবর্ষে অনুরণিত হয়েছিল, সেই স্বর্ণ-বীণা ছিলেন মহাকবি কালিদাস।

মহাকবি কালিদাস ( তাঁর জন্মের সময় নিয়ে রয়েছ বিভিন্ন মতবাদ। তবে গবেষকদের মতে, তার জন্ম হয়েছিল চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি। )



সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার কাব্য ও নাটকের ঐতিহ্যশালী ধারা দুটি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক কারিগরি, দার্শনিক ও হিন্দু শাস্ত্রীয় রচনায় ছিল তা সমৃদ্ধ। কিন্তু সাধারন মানুষের কথ্যভাষা সংস্কৃতের লিখ্য ভাষা না হওয়ায় তদোপরি এব সংরক্ষনশীলতার কারণে এটা এগিয়ে গেছে মরনের পানে । কথ্য সংস্কৃত সংক্রান্ত একাধিক সমাজ ভাষা বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায়, কথ্য সংস্কৃত সীমাবদ্ধ এবং এর বিবর্তন ঘটে নাই । তাই এই মডার্ন ডিজিটাল যুগে বাংলা বর্ণ যদি তাল মিলিয়ে বিবর্তিত না হতে পারে তবে তা বিলীন হয়ে যাবে কম্পিউটারে বহুল ব্যবহৃত ভাষা ইংরেজীর অবয়বে ।

এখন আমাদের সকলকেই বাংলায় লিখতে গিয়ে কম্পিউটারে ইংরেজী কি বোর্ডে আঙ্গুলের ঝড় তুলতে হয় , যদিও অনেক কি বোর্ডে ইংরেজীর পাশে বাংলা অক্ষরটি লিখা রয়েছে । এর পরেও যদি সন্মানীত বিজ্ঞ বাংলা ভাষাবিদেরা এই অশনি সংকেত না বুঝতে পারেন তাহলে একদিন হয়তবা সংস্কৃতের মতই পস্তাতে হবে !

আরো বলা যায় প্রায় সমউচ্চারণমুলক শব্দগুলি শুধু যে বানান বিভ্রাটকেই প্রভাবান্বিত করছে তা নয় । এটাকে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনা কর্মে প্রয়োগ করতে গিয়েও আমরা পিছিয়ে পরছি বিশ্বের নামী দামী ভাষার কাছে । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় উচ্চ শিক্ষায় বিশেষ করে পোস্ট গ্রাজুয়েট পর্যায়ে কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ এর প্রয়োজনে তথ্য সংগ্রহের জন্য এখন উত্তরকারীর সন্মতি সাপেক্ষে ভয়েজ রেকর্ডিং করা হয়ে থাকে । সেসব রেকর্ডিং হতে NVivo কম্পিউটার সফটওয়ার ব্যবহার করে সরাসরি ট্রানসক্রাইব করে রিপোর্ট আকারে বের করা যায় । এর ফলে একদিকে যেমন গবেষনার ব্যয় ও সময় সংক্ষেপ করা যায় অপর দিকে গবেষনায় তথ্যের নির্ভর যোগ্যতার প্রমানও দেয়া যায় যেখানে যেমন লাগে । বিশেষ করে সুপারভাইজার এবং থিসিস বা গবেষনা কর্ম প্রেজেনটেশন সময়ে উত্তরদাতার ভয়েজ শ্রুতাকে শুনিয়ে । এই কাজটা ইংরেজী কিংবা অন্য সব সমৃদ্ধ ভাষায় করা যায় সহজে । কিন্ত এক্ষেত্রে বাংলায় ট্রানসক্রাইব করার প্রয়াস বাধাগ্রস্থ বিবিধ কারণে, বিশেষ করে সমউচ্চারণ মুলক শব্দ থাকায় একে এনকোডিং করে ট্রানসক্রাইব করা কঠিনই বটে । গুগলেও স্পীচ টু রাইটেও একই সমস্যা দেখা দেয়। ফলে আমরা এ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে আছি অনেক যোজন দুরে । কথায় বলি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে , অপর দিকে ধ্বনি ও ভাবের প্রকাশ অক্ষুন্য রাখার জন্যও একে নিয়ন্ত্রন করতে হয় শক্ত হাতে, তা না হলে ভাবের সাথে ভাষা তার শ্রুতিমাধুর্যটাও হারাবে , এও একটি বিরাট সমস্যা বটে, অবশ্য এর প্রয়োজনটাও আছে, তবে এ ধরণের অসুবিধার হাত হতে উত্তরণের প্রয়াসটাওতো নিতে হবে এখন হতেই । বাংলা ভাষাকে করতে হবে প্রয়োগ উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনার সকল স্তরে , একে করতে হবে বিশ্বজনিন একটি সহজ ও সমৃদ্ধ ভাষা হিসাবে ,এর রাইটিং গতিও বাড়াতে হবে উল্লেখযোগ্য ভাবে ।

শব্দের মধ্যে বর্ণটাই বড় কথা নয় বস্তুটাই বড় কথা, একে যে ধবনি বা উচ্চারণেই বলা হোক কেন সে আছে তাই থাকবে, পুর্বে উল্লেখিত নোয়াম নমস্কি এর ভাষাতাত্বিক তত্বটি অবলম্বন করে একে সচিত্রভাবে নীচে ব্যখ্যা সহকারে দেখানো হল :

বিণা কে বিণা আর বিনা যেভাবেই লেখা হোক না কেন, সে তার নীজ পরিচয় নিয়েই থাকবে , সে নীজে উচ্চারিত হতে পারেনা তাকে উচ্চারণ করানো হয় , তাই তার নামের স্বাতন্ত্রতা রক্ষার জন্য , লিপির মধ্যে ধ্বনির কোন প্রয়োজন নাই তার কাছে । প্রয়োজন তার আইডেনটিটির । বীণা ও বিনা নামে দুটি সমউচ্চারণ মুলক শব্দ আছে বাংলা ভাষাতে , তাই দন্তন্য- ন এবং মূর্ধন্য-ণ -এর প্রভাব কাটানোর জন্য সকলে চুক্তি করে এর স্বাতন্ত্রতা ( identity) রক্ষা হয় এমন নামে পরিবর্তন করে কিংবা অন্য কোন ভাবে দন্তন্য- ন এবং মূর্ধন্য-ণ এর বিভেদটা কাটানো যেতে পারে ।



বালা বর্ণমালায় মূর্ধন্য এবং গন্ত্য ন’এ ভেদাভেদ – তত্ব নিয়ে বেশ বড় ধরণের একটা বিভীষিকা যে আছে তা বলাই বাহুল্য । একে নিয়ে স্বয়ং রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন :

বাংলা বর্ণমালায় আর-একটা বিভীষিকা আছে , মূর্ধন্য এবং দতন্ত্য ন’এ ভেদাভেদ-তত্ব । বানানে ওদের ভেদ, ব্যবহারে ওরা অভিন্ন। মূর্ধন্য ণ’এর আসল উচ্চারণ বাঙালির জানা নেই । কেউ কেউ বলেন , ওটা মুলত দ্রাবিড়ি। ওড়িয়া ভাষায় এর প্রভাব দেখা যায় । ড়’এ চন্দ্রবিন্দুর মতো ওর উচ্চারণ । খাঁড়া চাঁড়াল ভাঁড়ার প্রভৃতি শব্দে ওর পরিচয় পাওয়া যায়।–( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , বাংলাভাষা –পরিচয়) ।

তাই অনেকেই বলেন ব্যবহারে অভিন্ন হলে শুধু দন্ত্য-ন বনাম মূর্ধন্য-ণ-র লড়াই জিইয়ে রেখে লাভ কি ? দুটোর উচ্চারণ যখন এক তাহলে দুটোর বানানটিও কি এক করে ফেলা যায় না ?

সন্দেহ নেই এমনটা করা গেলে বানানটা অনেক সহজ হতো । তবে বলা হয়ে থাকে মূর্ধন্য-ণ-এর একটি আলাদা সৌন্দর্য আছে যেমনটি আছে দন্ত,ন-এর বেলাতেও । আর তৎসম শব্দে ব্যকরণগত বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তো রয়েছেই । এ প্রসঙ্গে বলা যায় শুধুমাত্র তৎসম (যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে অবিকৃত অবস্থায় এসেছে) শব্দে কিছু সুনির্দিষ্ট বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছের পরে মূর্ধন্য-ণ বসবে এটাই নাকি ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম । অনেকেই বলে থাকেন বাংলা ব্যবকরণ বই হতে এই বিধানটা শিখে নিলে এই মূর্ধন্য-ণ ব্যবহারে কোন অসুবিধা হয়না । কিন্তু কথা হল এখন ৩০ কোটি বাংলাভাষী মানুষের পক্ষে শতকরা কতজন এই ব্যকরণ বই থেকে এই বিধান শিখে বিশাল বাংলা শব্দ ভান্ডারের মধ্যে তৎসম আর তদ্ভব শব্দ খুঁজে নিয়ে এই বিধান পালন করবে । তার চেয়ে কি ভাল হয়না একটি বিশেষজ্ঞ ভাষাবিদ কমিটি/কমিশন গঠন করে বাংলা ভাষায় যে গুটি কয়েক শব্দে মূর্ধন্য়-ণ রয়েছে তা খুঁজে বের করে তার মধ্য থেকে মূর্ধন্য-ণ কে সরিয়ে নতুন কোন বর্ণ পরিচয়ে ভাষায় প্রয়োগ করে বর্ণ মালায় একটি সংস্কার আনতে পারে অতি সহজে ।

একটি ভাষার লিপি সংস্কারে বহু বছর সময় লাগে । এখন না হয় শুরু করা গেল পরিক্ষামুলকভাবে শুধু মাত্র একটি বর্ণ মূর্ধন্য-ণ দিয়ে । এর ফলাফলটা ভাল হলে আরো দুএকটি বর্ণ যথা ঞ ও ঙ কে ধরা যেতে পারে পরে । যাহোক, এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আরো অনেক বড় পরিসর প্রয়োজন হবে ।

এখানে উল্লেখ করা যায় ইংরেজি ভাষার যেমন ক্রমশ পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি মাঝে মাঝে তার বানান সংস্কারও ঘটেছে। যদিও সুদীর্ঘ কালের সাহিত্যিক ব্যবহারে ইংরেজি ভাষা পাকা হয়ে উঠেছে। । ইংরেজের দেশে ভাষার সংস্কারে বাধা যেমন দূরব্যাপী, তেমনি লাগে প্রবল সাহস। তার পরেও আমেরিকায় ইংরেজি ভাষার বানানে যে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে তাতে কম স্পর্ধা প্রকাশ পায় নি। মার্কিন দেশীয় বানানে through শব্দ থেকে তিনটে বেকার অক্ষর বর্জন করে বর্ণবিন্যাসে পাগলামির যে উপশম করা হয়েছে সেরকম সাহস কি আমাদের আছে ?

এ প্রসঙ্গে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর যতার্থই বলেছেন
আমাদের দেশের পূর্বতন আদর্শ খুব বিশুদ্ধ। বানানের এমন খাঁটি নিয়ম পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় আছে বলে জানি নে। সংস্কৃত ভাষা খুব সূক্ষ্ম বিচার করে উচ্চারণের প্রতি বানানের সদ্‌ব্যবহার রক্ষা করেছেন। একেই বলা যায় honesty, যথার্থ সাধুতা। বাংলা সাধুভাষাকে honest ভাষা বলা চলে না, মাতৃভাষাকে সে প্রবঞ্চনা করেছে।

রবিন্দ্রনাথ তার বানান বিধি প্রবন্ধের উপসংহারে বলেছেন বানানের বিধিপালনে আপাতত হয়তো মোটের উপরে আমরা "বাধ্যতামূলক' নীতি অনুসরণ করে একান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে যোগ দেব। কিন্তু এই দ্বিধাগ্রস্ত মধ্যপথে ব্যাপারটা থামবে না। অচিরে এমন সাহসিকের সমাগম হবে যাঁরা নিঃসংকোচে বানানকে সহজ করে দিয়ে সম্পূর্ণ ভাবেই কথ্য উচ্চারণের সত্যতা রক্ষা করবেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা বানানের বিকৃতি

তবে শুধু বর্ণের সংস্কার নয় এ বিষয়ে আরো একটি বিষয়ে ভাষাবিদদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষন করছি । ইদানিং দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে’ বাংলা ভাষায় চলছে ব্যপক পরিবর্তনের ছোঁয়া। প্রযুক্তির প্রভাবে ভাষা যেন দিন দিন ভাঙা-গড়ার এক খরস্রোতা নদী। কিন্তু এই নদী কোন পথে প্রবাহিত হবে, ভাঙবে কোন কূল আর গড়বেই বা কাকে দেখা যাক না কিছু তার নমুনা ।
বেশী দুরে যাবনা বিভিন্ন ব্লগেই বিশেষ করে মন্তব্যের ঘরে দেখা যায় লেখা আছে একটা ফাটাফাটি পোষ্ট দেখলাম। সেইরাম ব্যাপুক বিনুদুন পাইলাম ।

দৈনিক প্রথম আলোতে এ বিষয়েরে উপরে একটি লেখায় দেখলাম ফেসবুকের নিন্মরূপ একটি স্ট্যাটাস তুলে দিয়েছেন:
‘কাইলকা পরীক্ষা, কিছুই পড়িনাইক্যা । হে আল্লাহ আমাকে তুইল্যা নাও, নয়তো উপ্রে থেইক্যা দড়ি ফেলাও আমি উইঠ্যা যাই । পরীক্ষার আগের রাতে এই ছিল রনির ( ছদ্মনাম) স্ট্যাটাস।

শব্দের বিকৃত বানান ও উচ্চারণ ও কম যাচ্ছেনা ফেসবুক সহ বিভিন্ন ব্লগের লিখায় । যেমন- বেসম্ভব (অসম্ভব), নাইচ (নাইস)কিন্যা (কিনে) গেসে (গেছে) দ্যাশ (দেশ)। এ রকম অসংখ্য বিকৃত ব্যবহার চলছে সব সময়ই । যদি ও বলা হয়ে থাকে এগুলি রম্য কথা । তবে এগুলির ব্যপক প্রচলন হয়ে গেলে শব্দের বানানের কি গতি হবে তা ভাবতেও শিহরিত হতে হয় ।

এছাড়া বাক্য বা শব্দগুচ্ছ একত্র ও সংক্ষিপ্ত করার প্রবণতাও কমনা এই ব্লগের বিভিন্ন পোষ্টের লেখা ও কমেন্টের ঘরে পাওয়া গুটি কয়েক শব্দ তুলে ধরা হল — ভাল্লাগসে (ভালো লেগেছে), মুঞ্চায় (মন চায়) মাইরালা (মেরে ফেলো, কেম্নে ( কেমনে ) ইত্যাদি ।

বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে বহুভাষিক পরিস্থিতিও তৈরি করা হচ্ছে যেমন — মাগার, টাস্কিভূত, , সম্ভাবিলিটি, প্রভৃতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত শব্দ।

ইন্টারনেটে ভাষার ব্যবহার এমনই বহুমাত্রিকতা পাচ্ছে যে পাশ্চাত্যে এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়েছে। ইউরোপের ভাষাবিজ্ঞানীরা ‘ইনটারনেট লিঙ্গুইস্টিক্স’ (আন্তর্জালিক ভাষাবিজ্ঞান) নামে নতুন এক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তারা মনে করেন, একাডেমিক শৃঙ্খলায় একটি নতুন বিষয়ের সংযোজন করা খুব সহজ নয়, তবে ইন্টারনেটের আবির্ভাব ভাষাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে ইন্টারনেটের ভাষা নিয়ে গবেষণা একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমাদের বাংলা একাডেমী ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনসটিটি্‌উট কি করছে তা জানার জন্য তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ভিজিট করে যা দেখা গেল তার অবস্থা এই স্ক্রীন শটে একটু দেখা যেতে পারে , এক কথায় তা বেশ হতাশা জনক ।তাদের গবেষনার পেইজে গেলে দেথা যায় একদম ফাকা কিছু নেই তাতে ।



আর বাংলা একাডেমি , তাদের কর্মকান্ড পুরস্কার বিতরণী, বই মেলা আয়োজন, সেখানে সুধী জনের আলোচনা ও মিলন মেলা , এবং কিছু পুস্তক প্রকাশনার মধ্যেই মুলত সীমিত। ২০১৭ সনের অমর একুশে ২০১৭ তে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত পুস্তক তালিকায় ১০১ টা বই এর নাম দেখা যায় । এর মধ্যে অনীল চৌধুরী সম্পাদিত আধুনিক বাংলা অভিধান পরিবর্তীত ও পরিমার্জিত সংস্করণ ছাড়া ভাষা নিয়ে মৌলিক গবেষনামুলক কোন পুস্তকের নজির দেখা যায়নি এখনো । দৈনিক কোন আপডেটও তাদের ওয়েব সাইটে নেই । সে তুলনায় আমাদের সামুর সন্মানীত ব্লগার আরজু পানির এবং অতঃপর হৃদয় ব্লগে নিয়মিতভাবে কিছুটা হলেও সামু ব্লগারদের প্রকাশিত বই এর নিয়মিত আপডেট দেখা যাচ্ছে, সামু কতৃপক্ষও পোষ্ট দুটোকে পর্যায়ক্রমে স্টিকি পোস্ট করে পাঠকের জন্য দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন , এটা নি:সন্দেহে একটি প্রসংসনীয় কর্মকান্ড ।

একথা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলা ব্যকরণ স্কূলের বাচ্চাদের কাছে একটি ভীতিকর বিষয়, একে ছোটদের নিকট আকর্ষনীয় করার জন্য বাংলা একাডেমী ও স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড তেমন কোন উদ্যোগ না নিলে ও একটি দৃষ্টি নন্দন ও ছোটদের উপযোগী ছড়ায়-ছন্দে বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা পুস্তক হয়েছে প্রকাশ ২০১৭তে যা ছোট বড় সকলের প্রসংসা কুড়িয়েছে । শিশুরা ফুল, পাখি, সুর, ছন্দে আগ্রহী। তাই তাদের সহজবোধ্য পাঠের বিষয় বিবেচনা করে ব্যকরণের পাঠকে ছন্দোবদ্ধ রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে হয়েছে ফরহাদ ইলাহীর লেখা ‘ছড়ায়-ছন্দে ছোটদের বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’তে। সাধুবাদ জানাই লেখককে ।



সর্বশেষে ভাষার এ মাসে কামনা করি বাংলা যেন হতে পারে সমৃদ্ধশালী সর্বদিক দিয়ে; ধ্বনির মিষ্টতা , শব্দের শ্রুতিমধুরতা, লিখার গতিময়তা, শিক্ষার সহজতা, বানানের নির্ভুলতা, বর্ণ সংযুক্তির প্রাঞ্জলতা, ব্যকরণের সরলতা ইত্যাকার গুনাবলী নিয়ে । সকলের মুখেই যেন শুনতে পাই বাংলার মত সহজ সুন্দর ভাষা দুনিয়াতে আর নেই দ্বিতীয়টা , আমরা যেন বলতে পারি বাংলা আমাদের ভাষা, আমাদের অহংকার ।


বাংলা একাডেমি ভবনের সামনে অবস্থিত মোদের গর্ব ভাস্কর্য

ভাষার মাসে মোদের গর্ব অমর ভাষা শহীদদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ।

পোষ্ট টি ভাষা শহীদদের প্রতি উৎসর্গীত


তথ্য সুত্র :
রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর , বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব কথা

Naushad UzZaman and Mumit Khan ( 2004) “A Bangla Phonetic Encoding for
Better Spelling Suggestion”, Proc. 7th International Conference on Computer and
Information Technology, Dhaka, December, 2004.

Noam Chomsky ( 2012), The science of language ( 2012), Cambridge University Press. Cambridge

Tamjidul .M and Kaykobad. H.M (2002) “Use of Phonetic Similarity for
Bangla Spell Checker”, Page 182 – 185, Proc. 5th International, Conference on
Computer and Information Technology, Dhaka,

ড: সঞ্জীব ভট্রাচার্জ ও উত্তম দত্ত ( ২০০১),ভাষা ও ভাষা আন্দোলন , কলিকাতা

উইকিডিডিয়া : বাংলা বানান নিয়ম Click This Link

ছবি সুত্র : গুগল অন্তরজাল

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২১ ভোর ৫:২৩
৫৬টি মন্তব্য ৫৩টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×