একঃ
আজিমপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে লোকাল বাসে উঠেছি। এয়ারপোর্ট যাবো। এক আত্নীয় সৌদি আরব থেকে আসবে। তাকে রিসিভ করে একটা গাড়ি ঠিক করে দিতে হবে। বাসে উঠেই দেখি সব সিটে যাত্রি বসা। আমি বাসের রড ধরে দাড়িয়ে আছি। সাইন্সল্যাবে এসে দুইজন যাত্রি নেমে গেল। আমি জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। একটু পর ল্যাব এইডের সামনে থেকে বোরকা আর হিজাব পরা একজন মহিলা যাত্রি উঠে আমার পাশের খালি সিটে এসে বসেছে। আমি খুব সংকুচিত আরো একটু ওপাশে চেপে বসেছি। বাস খুব ধীর গতিতে চলছে। একটু পর পর আমার মোবাইলে কল আসছে;
-ভাই এই মাত্র প্লেন ল্যান্ড করছে, এই মাত্র ইমিগ্রেশনে লাইনে, এখনো লাগেজ আসেনই ইত্যাদি ইত্যাদি।
বত্রিশ নাম্বারের সামনে আসতেই মহিলা বলে উঠেছে;
- ভাইয়া একটু চেপে বসেন, আমার গায়ে লাগতেছে।
আমি দেখলাম ওপাশে আর চাপার যায়গা নাই তারপরও বাম হাত তুলে সামনের সিটের উপর রেখে আরো চেপে বসেছি। এবার সংসদ ভবনের মোড়টার সিগনালে বাস থামলো। মহিলা আবারো বলছে;
-ভাইয়া চেপে বসেন।
আমি মহা বিব্রত হয়ে সিট ছেড়ে দিয়ে রড ধরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবছি; পর্দানশিন মহিলাদের পাশে লোকাল বাসে চড়া আসলেই ভয়াবহ।
দুইঃ
গত আঠারো বছর যাবৎ নিজের সংসার আর বাপের সংসার সমানে চালাইতেছে খলিল ভাই। সোংসারে বড় পোলা হওয়ার কারনে ভাই-বোনের লেখা পড়া করানো, চাকরি বাকরি দেয়া, বিয়েশাদি সব একহাতের কামাই দিয়ে করেছে। এজন্য তাকে প্রচন্ড খাটতে হয়েছে লাইফে। আমি খুব কাছ থেকে দেখছি সেই খাটুনি। বোনদের ভালো ঘর দেখে বিয়ে দেয়ার পর প্রতিবছর ইদে কোরবানিতে জামইদের নতুন কাপড় আর ভাগনা ভাগনিদের নতুন জামাকাপড় দিয়ে আসছে। জৈষ্ঠ্য মাসে আম কাঠাল বোনদের শশুড় বাড়ি পাঠাতে হয়েছে। ছোট ভাইদের পড়ালেখা করিয়ে শেষ পর্যন্ত চাকরির ব্যবস্থাও করেছে।
খলিল ভাই গত কাল আফসোস করে জিগ্যেস করছে আমাকে? -ভাই ভালবাসা, দ্বায়-দায়িত্ব কি সব একতরফা দুনিয়ায়?
আমি কইলাম ঘটনা কি? খলিল ভাই? খলিল ভাই কইলোঃ ভাই আমার ছেলে-মেয়েদের বয়স দশ বারো বছর। কোন ভাই বোন আমার ছেলে মেয়েদের কোন ইদে কোরবানিতে একটা সুতাও কোন দিন দেয়নি। তাছাড়া গত প্রায় এক বছর আমার মোবাইলে একটা কল দিয়ে কেউ একটু খোজ খবরও নেয়নি।
আমি কিছুই কইতে পারিনাই। এসব পরিস্থিতে যে সব কথা বলে সান্তনা দিতে হয় সব আজকাল সস্তা হয়ে গেছে। আমি চিনি কম দিয়ে দুইটা রংচায়ের ওয়ার্ডার দিলাম বাবুলের টং দোকানে।
বাবুল চা বানানোর ফাঁকে আমাদের সব আলোচনা শুনে ফেলে মন্তব্য করছেঃ
‘‘আমরা পরিবারের জন্য গলা পানিতে নাইমা গেছি কিন্ত আমাগো জইন্নে কেউ নলা পানিতেও নামে নাই’’
তিনঃ
গত তিন মাস যাবৎ ভুমি অফিসে দৌড়াইতে দৌড়াইতে জীবন তেজপাতা বানায়া ফালাইছি। সরকার কতো সুন্দর সিস্টেম করে দিছে, অনলাইতে সব কাজ সারা যায় । অথচ অনলাইনে সকল রিকোয়ারমেন্ট ফুলফিল করে আবেদন করার পরও রিজেক্ট কইরা দিছে। কয় ভুমি অফিসে সরাসরি আইসা যোগাযোগ করেন। বাধ্য হয়ে গেলাম এবং যথা রিতি বারোশো টাকার কাম সাড়ে ছয় হাজার টাকা দিয়া হাত পাও ধইরা কাজ উদ্ধার কইরা আনছি। বহুবার ধর্মের দোহাই দিয়াও ভুমি অফিসের মুমিন বান্দার মন গলাইতে পারলাম না। ঘুষের রেট দুই টাকাও কমাইতে পারি নাই।
মনে মনে ভাবতেছি আমার মতো অথর্ব আর কেউ আছে কিনা দুইন্নায়।
চারঃ
সবার ফেমিলিতে মনে হয় সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া একজন ছোট কাকা থাকে। আমারও একজন আছে। দাদার সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে ছোট কাকা এখন বিরাট মওলানা। এক পীরের মুরিদ হয়ে সকাল বিকাল হালকায়ে জিকিরও করে। এখন সে একখান মসজিদ খাড়া করবে । আমার কাছে চান্দা চাইছে পাঁচ বান টিন। আমি জিগাইলাম জমি পাইলা কই? কেডা দিছে?
চাচায় কইলো – -খাল পাড়ের খাসের যায়গায় তুলমু।
আমি কইলাম- ‘একশো হাত দুরে থাকুন‘।
পাঁচঃ
প্রতিদিন খুব ভোরে উইঠ্যা আমার তিনডা বাচ্চা লইয়া বাইক চালায়া সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আইতাম। এক ঘন্টা এক্সারসাইজ কইরা বাসায় যাইতাম। ফেব্রুয়ারী মাসের দুই তারিখ সকালে কালি মন্দিরের গেট দিয়া প্রবেশ করার সময় পুলিশ আটকায়া দিছিলো। প্রবেশ নিষেধ। আমি কইলাম;
- আমি তো রেগুলার আন্ডাবাচ্চা সমেত এইখানে জগিং করতে আহি, আর এতো ভোরে আটাকানের দরকারটা কি? উত্তরে যা শুনাইলো তাতে বাচ্চদের কানে আংগুল দিয়া বাইক ঘুরায়া দৌড় দিসিলাম।
গত একমাস সকালে জগিং বন্ধ। পোলাপান কয়; -বাবা জগিং করা বন্ধ আর কতোদিন থাকবে।
ভাবতাছি সামনের শুক্কুরবার থিকা আবার দৌড়ানো শুরু করুম।
ঢাকা,
২১ ফাল্গুন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
ছবিঃ অন্তর্জাল।
প্রাত্যহিকী-১
প্রাত্যহিকী-২
প্রত্যহিকী-৩
প্রাত্যহিকী-৪
প্রাত্যহিকী-৫
প্রাত্যহিকী-৬
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:০১