somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাত্যহিকী-৫

০১ লা জানুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একঃ

ফি বছর জানুয়ারী মাসে বিরাট রকম অর্থ কষ্টে পড়ে মাহমুদ। তিন বাচ্চার স্কুলে ভর্তি, ইউনিফর্ম, স্কুল ব্যাগ আর বই খাতা বাবদ প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। একই স্কুলে প্রতি বছর উন্নয়ন ফি’র নামে এতো টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া লাগবে কেন? মাহমুদ ভাবে, তার বাবা তার পুরো শিক্ষা জীবনেও তার পিছে এতো টাকা খরচ করে নাই যে টাকা প্রতি বছর বাচ্চাদের স্কুলে পড়াতে গিয়ে খরচ হয়। মাহামুদ একটা লিজিং কোম্পানীতে চাকরী করে। যা ইনকাম তা দিয়ে মোটামুটি টেনেটুনে সংসার চলে যায়।
ইদানিং আর পারছেনা মাহমুদ। দু’টো ক্রেডিট কার্ডের প্রায় সব লিমিট শেষ। প্রতিমাসে মিনিমাম পেমেন্ট দিয়ে কোন রকম জরিমানার হাত থেকে উদ্ধার হওয়া আরকি।
গত পাঁচ বছর ধরে বাড়িওয়ালা প্রতি জানুয়ারীতে এক হাজার টাকা করে বাসা ভাড়া ধারাবাহিক ভাবে বাড়াচ্ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম না।
ওদিকে আলিকো ইনসুরেন্স কোম্পানীতে একটা বীমা পলিসি আছে মাহামুদের। তার প্রিমিয়াম প্রায় দশ হাজার টাকা। সেটাও জানুয়ারীতে দেয়া লাগে। আর ইনকাম ট্যাক্স অফিস রিটার্ন সাবমিটের মেয়াদ আরো একমাস বাড়িয়েছে, তাই রক্ষা। কারন বেতন থেকে প্রতিমাসে কাটার পরও ফাইল হিসাব করে দেখা গেছে আরো এগারো হাজার টাকার পে-ওয়ার্ডার দেয়া লাগবে।
এর মধ্যে বিজয় দিবসে মহল্লার পোলাপানকে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট উপলক্ষে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে।
মাহামুদ খুব চিন্তায় আছে কেমনে কি করবে।

দুইঃ

দিলু মিয়া সামনের ভবনের দাড়োয়ান। বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। সারাক্ষন দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকে। ধার-দেনা করে সৌদি আরব গিয়েছিলো। সৌদিতে ছয়মাস জেল খেটে দেশে আসার পর গ্রামে পাওনাদারের জ্বালায় আর টিকতে না পেরে ঢাকায় চলে এসেছে। বউ আর একটা বাচ্চা নিয়ে ঐ ভবনের ছাদের চিলে কোঠায় থাকে দিলু মিয়া।
শো’রুম থেকে কিস্তিতে বাইক কিনে ডিউটির পর ঢাকায় রাইড শেয়ার করতো। গত সপ্তায় এ্যাকসিডেন্ট করে বাম হাত ভেংগে ফেলেছে। তিন মাস আর বাইক চালাতে পারবেনা।
দিলু মিয়ার দুঃখের সীমা নাই ।

তিনঃ

মটর মেকানিকের দোকানে কাজ করে বাবলু। বয়স কতো আর হবে, এই বারো তেরো। এই বয়সে ভালোই গাড়ীর কাজ শিখে গেছে সে। বাবলুর বাবা নাই। মা ছুটা বুয়ার কাজ করে বাসা বাড়িতে। আমি বাইক নিয়ে ঐ গ্যারেজে গেলে চাকার হাওয়া দেয়া, ফিল্টার চেঞ্জ করা সহ টুকিটাকি কাজ বাবলুই করে দিতো। বাবলু আমাকে মামা বলে ডাকে।
প্রায় এক মাস পর বাইক নিয়ে গেলাম মবিল চেঞ্জ করার জন্য। দেখি বাবলুর মন বিরাট খারাপ। আগের মতো সেই চঞ্চলতা নাই, দৌড় দিয়েও আর কাছে আসছে না। গ্যারেজ মালিককে জিগ্যেস করলাম বাবলুর কি শরীর খারাপ? গ্যারেজ মালিক জানালো;
- ওর মা এক হুজুরের লগে বিয়া বইছে কুড়ি বাইশ দিন আগে। রুহিতপুরে হেই হুজুরের একটা এতিমখানা আছে। হেইখানে চইলা গেছে অর মায়। বাবলুরেও নিছিলো কিন্তু নতুন বাপে দুই দিন থাবরাইছে ধইরা। তারপর বাবলু হেইখান থিকা চইলা আসছে। এহন আমার বাসায় খায় আর গ্যারেজেই রাইতে ঘুমায়।
আহা ! বাবলুর জন্য বিরাট মায়া লাগতেছে।

চারঃ

মহল্লায় গলির মুখেই মনু মিয়ার পান-সিগারেটের দোকান। বয়স সত্তুরের বেশি ছাড়া কম হবেনা। দোকানের নাম “মনু মিয়া ষ্টোর”। কোমল পানীয়, রুটি-কলা, বিস্কুটও বিক্রি করে। মনু মিয়ার এই দুনিয়ার একটা নাতি ছাড়া আর কেউ নাই। নাতির বয়স ১৬ বছর। এবার এসএসসি পরিক্ষা দেবে। মনু মিয়ার একটাই ছেলে ছিলো। ছেলের বউ আতœহত্যা করার আগে চিরকুটে স্বামীকে দায়ি করে লিখে গিয়েছিলো। সেই মামলায় যাবজ্জিবন সাজা খাটতে গিয়ে জেলেই মারা গিয়েছিলো মনু মিয়ার ছেলে।
নাতিকে নিয়ে একটা রুম ভাড়া করে মনু মিয়া লালবাগে থাকে। আজকাল মনু মিয়ার নাতির মতিগতি ভালো ঠেকছে না। খালি টাকা চায় দাদার কাছে। স্মার্ট ফোনের এমবি কেনা আর পকেট খরচ বাবদ মনু মিয়া প্রতিদিন একশো টাকা দিতো। একশো টাকায় এখন আর চলে না। ডেইলি তিনশো টাকা লাগবে।
মনু মিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক এই মহল্লায় বাসা ভাড়া নেওয়ার পর থেকেই। শুধুমাত্র সিগারেট কিনতে গিয়ে একটা লোক কতো আপন হয়ে ওঠে মনু মিয়া সেরকম একজন। তাকে দেখে আমার খটকা লাগে মাঝে মাঝে। আমার সাথে মাঝে মাঝে সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতে তার চোখে জল আসে, সাথে আমারও ।
আজ মনু মিয়ার দোকান বন্ধ। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে মনু মামুর কি হয়েছে।

পাঁচঃ

রেনুদের বাসায় আবার শেফালী ফিরে এসেছে দুই বছরের একটা বাচ্চা নিয়ে। সারাদিন রেনুকে বাসার সকল কাজে সহযোগিতা করে। পাশাপাশি এক বাসায় ঘর মোছার কাজও ঠিক করে দিয়েছে রেনু। শেফালীর থাকার জন্য বাসা থেকে কয়েকটা বিল্ডিংয়ের পর একটা টিনশেডে রুম ভাড়া করে দিয়েছে রেনুর স্বামী।
গত তিন দিন ধরে গভীর রাতে শেফালির ঘরের দরজায় কে জানি টোকা দেয়। প্রথম দিন দরজা খুলে কাউকে দেখতে পায়নি। পরের দিন দেখে ফেলেছে পাশের ঘরের আরেক ভাড়াটিয়া এই কাজ করছে। রেনু আজকে সেই ভাড়াটিয়াকে তার বাড়িওয়ালাকে দিয়ে শাষিয়ে এসেছে।
বিপদ শেফালীর পিছু ছাড়ছে না।

ছয়ঃ

মুদি দোকানদার ফয়সাল গাজী। মহল্লার লোকদের বাকি দিতে দিতে দেউলিয়া হবার উপক্রম। দোকানের মাসিক ভাড়া গত ছয় মাস ধরে অগ্রীম থেকে কাটিয়ে কাটিয়ে পার করেছে। এমাসে দোকান মালিক বলেছে দোকান ছেড়ে দিতে। কাষ্টমারদের কাছে দেড় লাখ টাকা পাওনা। দোকান ছেড়ে দিলে ফয়সাল টাকাগুলো আর তুলতে পারবেনা। ফয়সাল বৌ-বাচ্চা নিয়ে তার বাবা মায়ের সাথেই থাকে।
দেখলাম ফয়সাল প্রান কোম্পানীর সেলস রিপ্রেজেনটিভ হিসাবে চাকরির কথা ফাইনাল করার চেষ্টা করছে। পাওনা টাকা তুলতে পারবেনা মন ভিষন রকম খারাপ। আমি তার নগদ কাষ্টমার। আমার কাছে ফয়সালের প্রশ্ন;
- এই মহল্লার লোকজন গুলা এতো বাটপার ক্যা ভাই?

সাতঃ

আমার বাসায় কম্পিউটার নাই। মোবাইল দিয়া সামুতে আসি। অফিসের দিনগুলোতে কাজের ফাঁকে টাইপ করি, পোষ্ট করি, মন্তব্য করি।
পিওন আকমল হোসেন আজকে আমাকে প্রশ্ন করছে; -স্যার আপনি নাকি ব্লগার? আমি বললাম ; হ্যাঁ । সাথে সাথে আকমল বলে উঠলো;
- আসতগফিরুল্লাহ, হুনছি ব্লগাররা নাস্তেক হয় কিন্তু আফনেতো দেহি নামাজ পড়েন, ব্লগার কেমনে হইলেন?
আমি তারে পাল্টা প্রশ্ন করলাম; তুমিতো নামাজ কালাম পড়োনা তাইলে তুমি কি?
-স্যার শুক্কুরবার দিন জুমার নামাজতো পড়ি। আমি এহন যাই স্যার, বড় স্যারে ব্র্যাক ব্যাংকের কিস্তির বিশ হাজার ট্যাকা জমা দিতে কইছে আইজ বারোটার মইধ্যে, জমা স্লিপটা একটু লেইখ্যা দিবেন?


ঢাকা,
১৭ পৌষ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।

ছবিঃ অন্তর্জাল।


প্রাত্যহিকী-১
প্রাত্যহিকী-২
প্রত্যহিকী-৩
প্রাত্যহিকী-৪


সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫১
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্পা এবং দেহ ব্যবসায়ীদের কথা শুনলে রেগে যাবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:৪৯



পুরো পৃথিবীতে স্পা এর সংখ্যা ১ লক্ষ ৮১ হাজার। এইসব স্পা-গুলোর বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে ইউরোপে। এশিয়া - প্যাসিফিকের দেশগুলোতেও স্পা-এর সংখ্যা কম নয়। ৫১ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশে স্পা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম বিহীন বিশ্ব গড়ার চেষ্টা বিশ্ব জনসংখ্যা অনেক কমিয়ে দিবে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৫০



নেতানিয়াহু বলেছে তাদের সাথে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র আছে। সে মুসলিম বিশ্বকে বড় রকমের হুমকি দিয়েছে। সে গণহত্যা চালাচ্ছে। আত্মরক্ষায় মরিয়া মুসলিমরাও গণহত্যা চালাবে। তখন আর সভ্যতার বাণীতে কাজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার মিরর ডোল, নিজের মনের অশান্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করবেন না

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩৫

ব্লগার মিরর দৌলাকে বলছি।
আপনাকে কিছু কড়া কথা আজ বলবো। ব্লগে বর্তমানে আপনার কোন অবদান নেই। সামুর যে ব্লগপেইজটা আপনি চালান, সেখান থেকে সব পোষ্ট আপনি ড্রাফটে নিয়েছেন। সেটা আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এনসিপিনামা - যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১


জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল আত্নপ্রকাশ করেছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি) কে নিয়ে। জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নিয়ে এই দল গঠিত হয়েছে। প্রচলিত রাজনৈতিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

হারিয়েছি অনেক কিছু....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৫৪

হারিয়েছি অনেক কিছু....

আমি প্রতিদিন নিয়ম করে বেশ কয়েক কিলোমিটার হাটি। তবে ইদানিং হাটাহাটিতে অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন হচ্ছে! এই যেমন, হাটাহাটির টার্গেট মিসিং! যে পথে হাটার কথা, সে পথে না গিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×