শৈশবের কথা মনে করলে আমার প্রথম মনে পড়ে লেবু গাছটার কথা । লেবুপাতার গন্ধে অস্থির সময় কাটত কিনা বলতে পারছি না । তবে গাছটা বুকে খুব আঁচড় কেটেছিল ! একদম ভেতরে রয়ে গেছে । মজ্জায়,ঘিলুতেও একটু আধটু জায়গা করে নিয়েছে ।
বিছানার চাদরের একটা আলাদা গন্ধ ছিল । কেমন জানি মাদকের মত । নাকে লাগতেই ঘুম পেত ভাল্লুকের মতন ! মায়ের আঙ্গুলে ছিল নাম না জানা একটা পিঠার ঘ্রাণ । বোনের চুলে তো পুরো চকলেট ফ্যাক্টরি ! বাবা যেন প্রতাপশালী এক রাজ্যের মাথা । তার বুকেও পাথুরে ফুলের গন্ধ পেয়েছি কোনো একদিন রাত দুইটায় । সর্দিকাশি জড়িয়ে পাথুরে ফুলের সুবাস নিতাম ।তিন-সাড়ে তিন শতাংশ একচিলতে লম্বাটে উঠোনেও যে হারিয়ে যেতাম । বারবার বলতাম বাবাকে উঠোনে ফুলগাছ লাগাই । সাথে একটা আমের গাছ হয়ত , নাহয় লিচু , বরই গাছ ! বাবা বলতেন বরই গাছে বড্ড বিছে পোকার আনাগোনা । গা ঘিন ঘিন করে উঠত । আবার বুকের মাঝে কিছু একটা চাইত বরই গাছ কে তা সে বিছে পোকা সহই হোক না কেন! ছোট্ট বুকে ঘোড়ার খুরের চঞ্চলতা দুধের সরের মতন ছিল জড়িয়ে । বরই গাছ অবশ্য ছিল একটা ! মনে নেই কবে কেটে ফেলতে হয়েছিল ! ভেবেছিলাম বুড়ো গাছটা ঠিক ফিরে আসবে হারিকেন হাতে । তবে শেষে হারিকেন-লণ্ঠন কেবল আমার ছোট্ট পাচটা আঙ্গুলেই ঠেকেছে !
আমার বড় বোনটা বলত , বাসায় নাকি একটা আপেল গাছ ছিল । শুনেছি আপেল বিদেশী ফল , আমাদের বাংলাদেশে হবে কিভাবে ? নিশ্চয় মিথ্যা ! সত্য মিথ্যা যাচাই করতে কতবার রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে গিয়েছি । মাছ কাঁটা যে একটা শিল্প তখন প্রথম বুঝতে পারি । কিছু একটা মুখে পুরে চলে আসছি আর মা হাতে পড়ে পানি খাইয়েও ছাড়ছেন না । আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন । সভ্য ছেলের মতন দাঁড়িয়ে থাকতাম সেই সময়টায় । দিনে কতবার যে সভ্য হয়েছি সেটা সভ্যতার অতীত ! পড়ে অবশ্য শুনেছিলাম আপেল গাছ একটা ছিল । ছোট একটা গাছ , ওই তো আমাদের সিঁড়িটার কাছে । আকাশে ওঠার সিঁড়ি না ! আবার দোতলায় ওঠবার সিঁড়িও নয়। দু কি তিনটে সিঁড়ি একসাথে । এক লাফ দিয়ে পার করা যেত । আর কারো কথা মনে নেই আমি ছোট্ট পায়ের দীর্ঘ একটা লাফে পার করতে পারতাম ! সিঁড়িটা আমাতে গেঁথেছে আরেকটি কারণে ! সিঁড়িটা ছিল আমার বাঁদরামির শাস্তির জায়গা। কতবার হোঁচট খেয়ে পড়েছি । কনুই ছিলে গেছে । নাক ফেটে রক্ত এসেছে । হাঁটু গেছে ফুলে । তখন খুব আত্মসম্মানে লাগত ! কাঁদতে হত খানিকক্ষণ । বড়ই অসম্মানজনক ব্যাপার ।
সিঁড়ির কথা যখন বলছি আরেকটা সিঁড়ির কথা বলতে হয় । ছাঁদে ওঠার সিঁড়ি । একটা ষ্টীলের সিঁড়ি সকাল নেই রাত নেই পীঠে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ! যখন শুনলাম ছাঁদে উঠতে পারব তখন সবার আগে মনে এসেছিল একটা কথাই ! আমাদের পেয়ারা গাছটা বোধহয় এখন চোরগুলোর কাছ থেকে একটু রেহাই পাবে । দু মুঠো নিঃশ্বাস আমাদেরও দিতে পারবে । গাছটা গায়ে গতরে বিশাল হয়েছিল , এক তলার ছাদ পেরিয়েছিল ! ঠিক মনে নেই ছাঁদে দাঁড়িয়ে হয়ত নাগাল পেতাম না , হয়ত পেতাম । ঝাঁকে ঝাঁকে পেয়ারা চোখে লেগেই থাকত ,লেগেই থাকত । কত গুলো সকালে গাছটা আমায় উপহার দিয়েছে ! দু একটা পেয়ারা । আমার রোমান্স ছিল আরেক জায়গায় । কাঁচা , কষা কষা ছোট্ট পেয়ারাগুলি লবন মরিচে ডুবিয়ে মুখে পুরতাম । এক ঘোর বর্ষা গাছটাকে মেরে ফেলে । গাছটার প্রায় বুকসমান পানি উঠেছিল সেইবার ।সব শুষে নিয়ে গেছে । এই গাছের মাঝে আমার কিছু একটা অংশ ছিল ! তাই তো কিছুটা আমিকেও শুষে নিল ঘোলা বরষা ! একটা মরা মানুষের মত দিন কতক হেসেছে গাছটা তারপর কোথায় গেছে কি জানি , কেউ হয়ত পিটিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে ! হয়ত আমিই !
কিন্তু আমার শৈশবের সবচেয়ে সুখকর স্মৃতি বোধ হয় এর কোনটিই নয় । সেই জায়গাটা কাল বৈশাখীর ঝড়ের ! ঝড়ের সেই রাতগুলো আমাকে যা দিয়েছে তা বোধ করি কেউ বা কোনো কিচ্ছুই দিতে পারেনি । সকালে , বিকালে বা কোনো এক প্রহরে হয়ত ঝগড়া-মারামারি হয়েছে বোনের সাথে , বা-মার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি , দু-তিন দিন একাধারে খালার বাসায় যাইনি ,(আমার খালার বাসা আমাদের বাসার একদম মুখোমুখি , সামনে) এতসব বিচ্ছিনতার উপকরন , এতসব দূরে দূরে থাকার ফন্দি-ফিকির সব গিয়ে মাথা ঠুকে মরেছে সেই ঝড়ের রাত্রিগুলোতে । তীব্র কাল বৈশাখীর ঝড় বাইরে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে , বাসার ভেতরে কেউ একজন সমানে আজান দিচ্ছে , সব্বাই একসাথে একটা রুমে , এমনকি একটা খাটে জড়সড় হয়ে বসে রয়েছি । সবাই যখন বলাবলি করত ঝড় কখন শেষ হবে , তাড়াতাড়ি শেষ হোক ইত্যাদি ইত্যাদি , মনে মনে আমি ভেবেছি , ইস ! আল্লাহ ঝড় থামিয়ে দিও না ! সেই ঝড়ের রাত গুলো , এমনকি দিনগুলো আমি কামনা করতাম তীব্রভাবে , এখনও করি , আর তীব্রভাবেই করি ! শিক্ষকতার খাতিরে কিশোরগঞ্জের বাইরে আমার মায়ের ট্রেনিং থাকত প্রায় সময়ই । সেই ট্রেনিং এর সময়টা আবার বেশিরভাগ সময় হত কালবৈশাখীর সময় । কোনো একদিন হয়ত আমরা তিন ভাইবোন বাসায় , বাবা হয়ত একটু বেড়িয়েছেন , মা তখন ময়মনসিংহ ট্রেনিং এ , বাসায় একটা ল্যান্ডফোন আছে সেটাও হয়ত ডেড অথবা তার ছিঁড়ে গেছে । তখন আমাদের কাজ ছিল খুব দ্রুত , ঝড়ের মাঝে দৌড়ে খালার বাসায় চলে যাওয়া । মনে আছে খালার বাসায় তখন একটা টিনের গেইট ছিল । ঝড়ের তীব্র শব্দে হয়ত মাঝে মাঝে আমাদের ধাক্কাধাক্কি শুনতে সমস্যা হত ! সেই সময়টায় মনে হত কোনো অভিশপ্ত প্রেতাত্মা যেন পেছনে ধাওয়া করছে! সত্যি বলতে সেই কাজটা আমি যতটুকুু উপভোগ করতাম , এ যাবত আর কোনো কাজ তার বিন্দুমাত্র উপভোগ করতে পারিনি । সে ছিল এক থ্রিলিং ব্যাপার !
ঝড়ের রাতের একটু আধটু খাওয়া-দাওয়া , ভূতের গল্পের আসর , ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠা যেকোনো রূপকথাকে হার মানাবে , তা আমি হলফ করে বলতে পারি !
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৫৫