আলেয়া কান পেতে আছে। কই মানুষটার পায়ের শব্দ তো পাচ্ছি না? কত পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই গভীর রাতে একটু আগেই একটা শিয়াল বোধ হয় জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। আলেয়া কান পেতে আছে।
বিকাল বেলা জয় খবর দিয়ে গেল- আলে’পা আজ রাত্রে বাসায় থকবেন? দুলাভাই আসবে।
এখন রাত দুইটা বাজে। ও কখন আসবে। দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে না ? কে হতে পারে? ও এল নাকি। সেই কত দিন ওর পায়ের শব্দ শুনি না। কিন্তু এখন ও আসবে নিঃশব্দে।
আলেয়া উঠে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে দরজার পাশে এসে দাড়ালো। নাহ্ কোন শব্দ নেই। ঘরের পিছনের দিকে রান্না ঘরের দরজার কাছে কে যেন শব্দ করছে খুব আস্তে আস্তে? আলেয়া অসীম সাহসে ভারি শরীরটাকে তুলে নিয়ে গেলেন দরজার পাশে। তার মন বলছে মানুষটা এসেছে।
আলেয়া কোন কথা না বলে দরজাটা খুলে ফেললো। দরজা খুলে দেখলো, দরজার সামনে দাঁড়ানো টুনা চৌধুরী। আলেয়া তাকে দখে চমকে উঠলো। টুনা বললো -- তুমি এত রাতে ঘরের দরজা খুলেছ কেন? তোমার তো এখানে থাকার কথা না। দরজা বন্ধ করে ভিতরে যাও।
আলেয়া তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল এবং তার মনে হল তাকে এখান থেকে পালাতে হবে এক্ষুনি। মানুষটা আজ এলেই ধরা পরবে। টুনা চৌধুরীরা খবর পেয়েছে আজ সোলায়মান আসবে।
আলেয়া জয়দের বাসায় ভাড়া থাকে। পাশেই তার বাবার বাড়ি। রান্নাঘরের যে দরজার সামনে টুনা চৌধুরী দাঁড়িয়ে সেই দরজা দিয়ে বের হয়ে বাসার পিছন দিয়ে আলেয়া তার বাবার বাড়িতে যেতে পারে। এখন এই বাড়ি থেকে পালাবার একটাই রাস্তা আছে বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। এত রাতে সারা শহরে কারফিউ চলছে? বাসা থেকে বের হওয়া আর পাক আর্মির ক্যাম্পে যেয়ে ঢোকা একই কথা।
হঠাৎ আলেয়ার এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। তিনি পালাবেন। বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ নেই। অতএব তিনি পালাবেন। ঘর থেকে বের হয়ে কূয়া তলায় এলেন। সেখানে একটা পেয়ারা গাছ আছে। এই পেয়ারা গাছ দিয়ে উঠে সাবুদের বাসার ছাদে যাওয়া যায়। ছাদের চিলেকোঠায় সাবুর ঘর। সাবুকে খবর দিলে সাবুই সোলায়মানকে আসতে নিষেধ করবে।
আলেয়া পাঁচ মাসের অন্তঃস্বত্তা। অত্যান্ত দৃঢ় মনবলের আধিকারী আলেয়া পেয়ারা গাছে উঠলেন। ধীরে ধীরে অত্যান্ত সাবধানে। তার মনে একমাত্র চিন্তা সোলায়মানকে বাঁচাতে হবে। ও একা নাও আসতে পারে। ওর সাথে আরও দুই একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। টুনা ওদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। আলেয়ার ভয় তার নিজেকে নিয়ে। তার গর্ভের পাঁচমাসের শিশুটিকে নিয়ে।
সবচেয়ে ভরসার কথা আজ বাসায় কোন আর্মস নেই। একসময় ছাদে পৌঁছালেন আলেয়া। খুব সাবধানে হাঁপাতে হাঁপাতে যেয়ে হাজির হলেন সাবুর দরজায়। নিশ্ছ্রিদ অন্ধকার। দরজায় হেলান দেবার সাথে সাথে দরজাটা খুলে গেলো আর তার পরে যাওয়া শরীরটা কে যেন ধরে ফেললো। অন্ধকারে আলেয়া দেখলো তার সামনে দুইজন লোক, কাউকে চিনতে না পেরে আলেয়া ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । কে যেন আলেয়াকে ধরে বিছানায় বসালো। আর হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকলো। আলেয়ার মনে হল এই হাতকে ভরসা করা যায়। গায়ের গন্ধটা পরিচিত। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে লোকগুলি ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকলো। একটু পরে দরজায় টোকা। কেউ আস্তে দরজা খুলে দিল । ভিতরে ঢুকে একটি চাপা স্বর বললো-- বাড়ি সার্চ করে ওরা চলে গেছে। টুনা বোধ হয় আলে’পার কথা কিছু বলে নাই। কন্ঠটি জয়ের।
একজন একটি কালো কাগজ দিয়ে ঢাকা হারিকেন জ্বালালো। আলেয়া সেই আলোতে দেখলো সোলায়মান তাকে ধরে বসে আছে । আলেয়া এতক্ষনে কথা বললো-- একগ্লাস পানি খাব।
সোলায়মান আলেয়ার হাত ধরে শুধু বললো ---ভুল আমারই। তোমাকে একবার দেখার জন্য আস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তাই জয়কে বলেছি তোমাকে বাসায় আসার কথা বলতে। আজ তুমি যে নিজের বুদ্ধিতে পালিয়েছ এবং যে রিক্স নিয়েছো তোমার কিছু হলে নিজেকে মাপ করতে পারতাম না।
সোলায়মানরা যখন এস,ডিও সাহেবের বাসার কাছাকাছি আসে ঠিক তখনই এস, ডি,ও এর বাসার কাজের ছেলেটা ওদের ফিরে যেতে বলে বাসায় ঢুকে যায়। এমন সময় ওরা খবর পায় যে ফেরার আর উপায় নেই। আর এই ছেলেটা কিভাবে খবর পেলো যে ওরা আসবে এখানে। তখন ওরা দেয়াল টপকে এস,ডি,ওর বাসায় ঢুকে। এভাবে দেয়াল টপকে টপকে সাবুদের বাসায় আসে ওরা তিন জন।
টুনা চৌধুরীরা বুঝতে পারেনি যে ওরা সাবুদের বাসায় এসেছে। বুঝলে আর্মি নিয়ে সেখানেই আসতো।
এই টুনা ১৪ই ডিসেম্বর আলেয়াদের বাসায় এসে আলেয়ার বাবাকে বলে গেছে ---কী হে ডাক্তার তোমার জামাই কোথায়?? তোমার মেয়েটা কই?! জামাই আর আসবে না। যদি বাঁচতে চাও মেয়েটা কোথায় বলে দাও। স্বাধীনতা চায় তোমার জামাই ওর রক্তে আমি গোসল করব।" আলেয়ার দিন রাত কেটেছে খড়ের গাদার নিচে ট্রেঞ্চের ভিতরে।
৯ডিসেম্বর সাবুকে আর আলেয়ার বড় ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যায় শান্ত শিষ্ট জয় ও তার পরিচিত এক রিক্সা ওয়ালা নাম হারেছ তারা দুজন গোপনে আলেয়ার বড় ভাইয়ের লাশটা এনে বাসার পিছনে রাখে। সেই লাশটা টুনা চৌধুরীরা কবর দিতে দেয় নি। সেই লাশ শিয়াল শকূন খেয়েছে। ১২ তারিখ সন্ধ্যায় বাসা থেকে ডেকে নিয়ে টুনা চৌধুরীর দল জয়কে স্ট্যাপ করে।
বুক থেকে তল পেট পর্যন্ত কাটা পেট নিয়ে জয় হাত দিয়ে পেট চাপে ধরে ছুটে আসে আলেয়ার বাবার কাছে।--- চাচা আমাকে বাঁচান।
আলেয়ার ডাক্তার বাবা অসহায়। আলেয়ার মায়ের শাড়ী ছিঁড়ে জয়ের পেটটা বেঁধে দেয়। ছেলেটাকে বাচাঁনোর উদ্দ্যেশে তিনি কাঁথা সেলাই করা সূই সুতা জোগার করেন। কিন্তু ততক্ষনে জয় মৃত্যুর মুখে ঢলে পরে।
১৪ তারিখে রিক্সা ওয়ালা হারেছ এসে খবর দেয় ডাক্তার সাহেব স্টেশন এর পাশে শশ্মানে ধারে ২০/২৫ জনের লাশ পড়ে আছে। হাত চোখ বাঁধা।
আলেয়ার বাবার মাথাটা একেবারে নিচে নেমে যায়। চোখ তুলে হারেছের দিকে তাকাবার সাহস তার হয় না। হারেছ ফিস ফিস করে বলে---আমি ভালো করে দেখে এসেছি ওখানে জামাই এর লাশ নাই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। কিন্তু এই রাজাকার আল বদরেরা যদি সাহায্য না করতো তবে পাক হানাদার বাহিনী কিহুতেই এত নৃশংস হত্যা জজ্ঞ ঘটাতে পারতো না। এত ম্রৃত্যু আমাদের দেখতে হত না। বাঙ্গলাদেশ আরও অনেক কম রক্তমূল্যে আরও কম সময়ে স্মাধীনতা লাভ করতো।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৩৫