অনেকেই বলে যুদ্ধাপরাধের বিচার করলে আওয়ামী লীগেরই বেশি ক্ষতি। একথা বিএনপিও বিভিন্ন সময় বলেছে। তারা বলেছে, সরকার আসলে যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় না। কিন্তু বিচার হচ্ছে। আর বিএনপি অভিযোগ করেছে এই ট্রাইবুনালের রায় শাহবাগের আন্দোলনের কারণে প্রভাবিত। বিএনপি অবশ্য বলেনি কাদের মোল্লার মামলার রায় নিরপেক্ষ ছিল কিনা। বিএনপি বলেনি কাদের মোল্লার মামলার রায় জামায়াতের চাপের কারণে হয়েছে কিনা। বিএনপি নেতারা বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছে জামায়াতের সাথে সরকারের আতাতের কারণে কাদের মোল্লার মামলার রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি।
বিএনপি কি প্রকারান্তরে শাহবাগকে একটি ফ্যাকটর হিসেবে মেনে নিল? বিএনপির অভিযোগ আওয়ামী লীগের মদদেই শাহবাগে আন্দোলন হচ্ছে।
বিএনপির এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুটি আওয়ামী লীগের দেখা মিলছে। একটি আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে আতাত করে, নিজের রাজনীতি বিপন্ন হবার ভয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে চায় না। আর অপর একটি আওয়ামী লীগকে দেখা যায় যে আওয়ামী লীগের মদদে শাহবাগে আন্দোলন হচ্ছে, আর সেই শাহবাগের আন্দোলনের ফলে ট্রইবুনালের রায় প্রভাবিত হয়েছে। দেলু রাজাকারের মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তির রায় এসেছে।
কোন আওয়ামী লীগ সত্যি? যে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে আপোষ করে নাকি যে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য শাহবাগের আন্দোলনে মদদ দেয়? নাকি দুটোই সত্যি?
তবে এসব কথার মধ্য দিয়ে একটি জিনিস পরিস্কার হচ্ছে আর তা হলো শাহবাগ আন্দোলন যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে যে কোনো ধরনের দোদুল্যমানতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে কোন ধরনের আপোষকে প্রতিহত করছে। বিএনপি অবশ্য এটাও স্বীকার করে না। আওয়ামী লীগ নেতারা স্বীকার করে। সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী তাদের অভিন্দন জানিয়েছে।
যে প্রধানমন্ত্রী শাহবাগের তারুণদের অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনিই কদিন আগে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন ছাত্রলীগের তরুণদের কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বিএনপিও চায়। কিন্তু তারা এর আগে কখনও বিচারের উদ্যোগ নেয় নি। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের এদেশে রাজনীতিতে পুনারায় অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে।
একবার ফৌদারী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সাথে যুগপত আন্দোলন করেছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে তখনও জামায়াত বিএনপির সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন করছে। যদিও শাহবাগের গণজোয়ারের পরে বিএনপি জামায়াতের সম্পর্ক এখন শীতল। বিএনপি এখন ঘরের খেয়ে জামায়াতের কার্যক্রমে নৈতিক সমর্থন দেয় না। নিজেরাই নিজেদের চরকায় তেল দেয়। শাহবাগের রাজনীতি এখানেই অনন্য। যে কারণে শাহবাগ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ছাড়াও আরও বৃহত্তর গোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে।
৭১-এ যা ঘটেছিল এখনও অনেকটা তেমনই ঘটছে। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছিল নির্বাচনে। বৃহত্তর দল হিসেবে মুক্তিযদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে মুক্তিযদ্ধে আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরও কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ ছিল। যে কারণে মাওলানা ভাসানী, মোজাফ্ফর আহমদ, মনি সিং অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। এখনও যুদ্ধাপরাধে বিচার প্রক্রিয়া কেবল আওয়ামী লীগ একা বাস্তবায়ন করছে না।
যুদ্ধ জয় হলো কিন্তু মাত্র ৪ বছেরর মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পূর্ণ উল্টা পথে পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির দিকে হাঁটতে শুরু করল। দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই এখনও চলছে। যে যুদ্ধাপরাধের বিচার সেই ৭১ পরবর্তী সময়ে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা সে বিচারের দাবীতে এখনও রাজপথে আন্দোলন করতে হচ্ছে।
আওয়ামী রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ক'জন বুঝতে পারে নানা রকম বিরোধীতা এবং চক্রান্ত ছাড়াও শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডে পিছনে আওয়ামী লীগের একটি বৃহত্ অংশের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতিপরায়ণ, অগণতান্ত্রিক আচরণও দায়ী? এখনও ২০১৩ সালে মানুষ একই কারণে আওয়ামী লীগকে পাহারা দেওয়ার জন্য দিনরাত শাহবাগের চেতনা ধারণ করে জেগে থাকে?
যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকই বলেছেন শাহবাগ থেকে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেওয়া উচিত্। রাজনীতিবিদরা যদি কিছু শেখে তাহলে তো ভালোই। তবে হাদিসে আছে, বিশ্বাস কোরো একটা পাহাড় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেটেঁ গেছে তবুও বিশ্বাস কোরো না একটা খারাপ মানুষ বলেছে-- আমি ভালো হয়ে গেছি।
শাহবাগের গণজাগরণ নিয়ে গান লিখেছেন সুমন সহ আরো অনেকে। কিন্তু সব প্রশংসা আর বাহবার পরেও শাহবাগ এখনও পর্যন্ত আমাদের প্রচলিত নষ্ট রাজনীতির বিকল্প নয়। ভবিষ্যতে হবে কিনা জানি না। তাছাড়া লড়াইয়ের এখনও অনেক পথ বাকি।
বলা হয় মহাজোট সরকারের বিপুল বিজয়ের পিছনে মানুষের পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে। এখনও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হয় না। সরকারের ভেতরের কারও কারও গণবিরোধী অবস্থানের কারণে সরকার বিরোধীরা কিছুটা হলেও হালে পানি পাচ্ছে।
মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে কে কোথায় কবে জয়ী হয়েছে? যদি তা হয় তবে সেটা কেবল সত্ পথের যাত্রীদের সততা, নিষ্ঠার ঘাটতির কারণেই হয়। আসলে তারা যখন ন্যয়ের পরিবর্তে অন্যায়ের আশ্রয় নেয় তখন ন্যয় পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়ে আর অন্যায় জয়ী হয়।