ল্যান্ডফোনে কথা বলা সবার জন্য সহজলভ্য ছিলনা বলে একযুগ আগে আমাদের দেশে যখন মোবাইল ফোন এলো, তখন ধনী গরিব নির্বিশেষে সবাই এই যন্ত্রটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমার মনে আছে, ২০০০ সালের দিকে আমি যখন প্রথম এই যন্ত্রটি কিনি তখন তিনশো টাকার কার্ড কিনে মাত্র একুশ দিনের মধ্যে কথা বলে শেষ করতে হতো। তাও আবার প্রতি মিনিট ভ্যাট ট্যাক্স সহ প্রায় সাত টাকা রেটে।
কিছুদিনের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হল। হাওয়া বেঁচে এত লাভ হচ্ছে দেখে আরও অনেক মোবাইল অপারেটর দেশে এলো। দশ বারো হাজার টাকা দামের মোস্ট অর্ডিনারি সাদাকালো পর্দার সেটের বদলে দু’তিন হাজার টাকা দামের রঙিন পর্দাওয়ালা নানারকম অপশনের হ্যান্ডসেট বাজারে এলো। অপারেটর কোম্পানিগুলো খদ্দের ধরার জন্য গ্রাহকদের নানারকম অফার দিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি শুরু করলো। কল রেট ভীষণভাবে কমে গেল। রাত জেগে কথা বলার জন্য কল রেট আরও কমিয়ে দেওয়া হল। তরুন তরুণীরা সারারাত নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেল। অনেকে একাধিক কোম্পানির সংযোগ এবং নিত্য নতুন হ্যান্ডসেট কিনে স্ট্যাটাস বাড়িয়ে নিল। ডুয়েল সিম, ট্রিপল সিম, এমনকি কোয়াড্রপল সিম পর্যন্ত একই সেটে ব্যবহারের সুবিধা এসে গেল। টু-জি থেকে থ্রি-জিতে ড্রাইভ। আগামিতে হয়তো ফোর-জি সুবিধাও এসে যাবে।
এখন এই এক যুগে এই ছোট যন্ত্রটি নিয়ে কী কী হল, তার একটা তালিকা দেখুন।
১) হাই, হ্যালো, ইয়া, বাট, সো, থ্যাংকস –এইসব ইংরেজি শব্দের ব্যবহার বেড়ে গেল। তবে ইংরেজি ভাষাটা ঠিক মতো জানা না থাকায় মোবাইল ফোনে ইংরেজি হরফে বাংলা চিঠি(এস এম এস) লেখার প্রচলন হল।
২) রিংটোনে নানা রকম গান বাজনা ও পশুপাখির ডাক শোনা যেতে লাগলো। আমার এক মামাশশুরের সেলফোনে রিং দিয়ে আজান পর্যন্ত শুনতে পেলাম – যদিও তিনি নিজে কখনো নামায পড়েন না।
৩) ‘মিসকল’ নামের এক মহা উপদ্রব চালু হয়ে গেল। মেয়েরা তাদের ছেলে বন্ধুদের ফোনে মিসকল দিয়ে ব্যয় সাশ্রয়ে যত্নবান হল (মেয়েরা সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন সেটা তো জানেনই)। অন্যদিকে ছেলেদের মোবাইল খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের ‘মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল’ দশা। অবশ্য মিসকলের কিছু ভাল দিকও আছে। যেমন, এই সেদিন দেখলাম আমার ছোট ছেলেটি সন্ধ্যের পরেও বাড়ি ফিরছে না দেখে তার মা তাকে ঘন ঘন মিসকল দিচ্ছে। অর্থাৎ মিসকলের মধ্যমে মা তার ছেলেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছে। মা ও ছেলের মধ্যে কি চমৎকার বোঝাপড়া!
৪) মেয়েরা রান্নাবান্নায় পারদর্শী হয়ে উঠলো। যেমন, সেদিন দেখলাম আমার ছেলেদের খালা ঢাকা থেকে রাজশাহীতে ফোন করে তার বড় বোনের (মানে আমার স্ত্রীর) কাছ থেকে রান্নাবান্নার লাইভ রেসিপি সংগ্রহ করছে। আমার স্ত্রী বলছেন, ‘এবার দুই চা চামচ লবণ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে ঢেকে দে।’
‘জিরা বাটা দিয়েছিস ?’
‘আহা, পানি অতো কম দিলি কেন ? সেদ্ধ হওয়ার আগেই তো ধরে যাবে!’
‘তেল ওপরে উঠেছে ? ওঠেনি ? তাহলে আর একটু থাম্।’
এভাবে প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে লাইভ রেসিপি সরবরাহ করা হল।
৫) সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের খুব সুবিধা হল। তারা চান্দিছিলা রহিম, ডাইল ডাবলু, হিজড়া সেলিম ইত্যাদি নামে চাঁদা চাইতে লাগলো। তাদের ক্লায়েন্টরা মোবাইলের স্ক্রীনে অপরিচিত নম্বর দেখে আঁতকে উঠতে লাগলো।
৬) পুলিশ বা বিজিবির লোক কে কোথায় আছে, মাদক ব্যবসায়ীরা তা আগেভাগেই জেনে ফেলে সাবধান হয়ে গেল। ফলে তাদের ব্যবসায় লোকসান কমে গেল।
৭) বিদেশে থাকা পাত্রদের সাথে দেশে থাকা পাত্রীদের বেশ কিছু বিয়ে মোবাইল ফোনে কবুল ফরমান হয়ে গেল।
৮) তোরা যে যা বলিস ভাই/ আমার সোনার হরিণ চাইঃ- তবে সবচে’ বড় যে ঘটনাটা ঘটলো, তা’ হল বাংলাদেশে অন্ততঃ টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে এক ধরনের সাম্যবাদী বিপ্লব ঘটে গেল। নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব, ছোট-বড়, চাকর-বাকর, ড্রাইভার- মালি, দারোয়ান-গাড়োয়ান, রাজমিস্ত্রি-রংমিস্ত্রি, নিজ স্ত্রী-পরস্ত্রী, শ্যালক-শ্যালিকা, বালক-বালিকা, গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, জমির দালাল, গরুর দালাল, হাফ ম্যাড, ফুল ম্যাড সবার হাতেই মোবাইল ফোন চলে এলো। এই কমিউনিস্ট ব্যবস্থাপনা কিভাবে আমাদের সমাজে বহাল হল, তা জানতে হলে উইকিপিডিয়ায় সার্চ দেওয়ার দরকার নাই। সালেহার ঘটনাটা শুনলেই আপনি তা’ বুঝতে পারবেন।
চালের আড়তের পালাদার গফুরের মেয়ে সালেহা মাত্র এক বছর আগে যৌবনে পা দিয়েছে। হাতে হাতে মোবাইল ফোন দেখে তারও মোবাইলে কথা বলার শখ হল। কিন্তু সংযোগসহ সবচে’ কমদামী সেট কেনারও সামর্থ্য নাই তার। অগত্যা যা হয়! বস্তির রিকশাওয়ালা মজিদের গাঁজাখোর ছেলে সবুরকে দেখলে সালেহা আগে নাক সিটকাতো। মোবাইল-ম্যানিয়া হবার পর তাকে দেখেই সালেহা ‘ভাইয়া কেমন আছেন ?’ বলে নানা রকম ‘আই-থেরাপি’ প্রয়োগ করা শুরু করলো। সবুর গাঁজার নেশায় এমনিতেই সারাদিন কাত হয়ে থাকে, তার ওপর সালেহার নয়ন তীরে বিদ্ধ হয়ে সে আরও কাত হয়ে গেল। চুরি চামারি করে সে সালেহাকে একখানা মোবাইল ফোন কিনে দিল।
কিন্তু সমস্যা হল, সবুরের নিজেরই মোবাইল ফোন নাই। আগে একটা ছিল। হাফ দামে বেঁচে দিয়ে সে নেশা করেছে। সালেহা মোবাইল ফোনে কথা বলবে কার সাথে ? আর তাকে ফোনই বা করবে কে ? বস্তিতে ঢোকা বা বেরনোর সময় সে কিছুদিন অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়ে মোবাইল সেট কানে ধরে কথা বলার অভিনয় করলো। কিন্তু মাছের স্বাদ কি আর মাছের আঁশ চুষে পাওয়া যায় ?
অগত্যা যা হয়! সালেহা মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে শেষে বস্তির পান সিগারেটের দোকানদার তিন সন্তানের বাপ জলিল মিয়ার ফোনে যখন তখন মিসকল দিতে লাগলো। আর জলিল মিয়াও দোকান থেকে নেমে দূরে গিয়ে রিং ব্যাক করে সালেহার সাথে ফিস ফিস করে কথা বলে আবার দোকানে এসে বসতে লাগলো।
এভাবে ছয়মাস যাওয়ার পর জানা গেল সালেহা সন্তান সম্ভবা। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা! বিয়ের আগেই গর্ভবতী ? পালাদার গফুরকে পঞ্চাশ ঘা জুতাপেটা করে সপরিবারে বস্তি থেকে উচ্ছেদ করা হল। আর দোকানদার জলিল মিয়ার পাঁচশ টাকা ফাইন। জলিল মিয়া বকেয়া টাকার জন্য বস্তির খদ্দেরদের সাথে এখন আর হম্বি তম্বি করে না। হাসিমুখে বলে, ‘ভাইজান, আগের বোধহয় পনের টাকা ছিল......।’
*********************************************************************************************************************
[এই লেখাটি মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকার ডিসেম্বর/২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।]
রি-পোস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৪