আজ একজন রাগী মানুষের গল্প শুনুন। ১৯৭৮ সালের ঘটনা। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ি। ঐ সময় আমার সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা চলছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে শহর থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করি। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে আমার বাড়ির কাছাকাছি একটা স্টপেজে নেমে দেখা হয়ে গেল আসগর চাচার সাথে।
আসগর চাচা আমার প্রতিবেশি। তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শাখায় লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের পদে চাকরি করেন। ছোটখাটো মাঝ বয়সী মানুষ। আমাদের মহল্লায় ভাড়া থাকেন। স্ত্রী ও সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর টানাটানির সংসার। তারপরেও তিনি কোন দোকানে বাঁকি খান না। কারো সাথে দু’নম্বরী করেন না। ভীষণ সৎ মানুষ। সততার কারণে অভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী। আর অভাবের কারণে তাঁর মেজাজ সব সময় তুঙ্গে থাকে। সম্ভবতঃ প্রকৃতিগতভাবেও তিনি খুব রাগী ও বদমেজাজি স্বভাবের। সততার সাথে রাগের বোধহয় একটা সম্পর্ক আছে।
আসগর চাচার এই রাগী স্বভাবের কারণে অন্যান্যদের সাথে তাঁর প্রায়ই খিটিমিটি লেগে যায়। বিশেষ করে মুদি দোকান এবং বাজারের মাছ মাংস ও সব্জি বিক্রেতাদের সাথে তাঁর প্রায়ই তর্কাতর্কি, হাতাহাতি, এমনকি ঘুষোঘুষি পর্যন্ত হয়ে যায়। বাসাতেও স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাথে তাঁর গালাগালি ও ধ্বস্তাধস্তির ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। মহল্লার লোকজন পারতপক্ষে আসগর চাচাকে এড়িয়েই চলে। খামোকা ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়তে কে চায়, বলুন?
আমি বাস থেকে নেমে তাঁকে সালাম দিতেই তিনি সালামের কোন উত্তর না দিয়ে চড়া গলায় বললেন, ‘আমার কী হয়েছে, এ প্রশ্ন করবেনা। ঠিক আছে?’
আসগর চাচা বাজার করে ফিরছিলেন। তাঁর শার্টের পকেট ও ডান হাতা ছেঁড়া। বোতামগুলো উধাও। কপালের এক অংশ আলুর মতো ফোলা। চোখের নিচে কালশিটে দাগ। ভুরুর ওপর দিকে কেটে রক্ত ঝরছে।
এমন চেহারার একজন মানুষকে (বিশেষ করে প্রতিবেশি মুরুব্বী শ্রেনীর মানুষকে) কী হয়েছে জিজ্ঞেস করা যাবে না, এমন নিষেধাজ্ঞা আপনারা পেয়েছেন কোনদিন? আমার মনে হয় না। কিন্তু আসগর চাচা বলে কথা। আমি তাঁকে ঘাঁটাতে চাইনা। তাঁর নিষেধাজ্ঞার পরেও কিছু বললে দক্ষযজ্ঞ বেধে যাবে। তাই তিনি চলে যাবার পর আমি বাড়ি না ফিরে কাঁচাবাজারের কাছাকাছি আমার পাড়ার এক বন্ধুর তৈজসপত্রের দোকানে গেলাম। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতেই সব জানা গেল। প্রতিদিনের ঘটনা। বাজার করার সময় জিনিষপত্রের দাম নিয়ে দোকানিদের সাথে আসগর চাচার বাক বিতণ্ডা। গতকাল আলুর দাম ছিল পৌনে দু’টাকা, আজ দুই টাকা দিতে হবে কেন? আলু কী রাতারাতি আপেল হয়ে গেছে? কাচকি মাছের ভাগা গতকাল ছিল তিন টাকা, আজ সাড়ে তিন টাকা দিতে হবে কেন? এক দিনের মধ্যে কাচকি মাছ কী সব বোয়াল মাছ হয়ে গেছে? আসগর চাচার এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দোকানিরা প্রতিদিন হিমশিম খায়। তর্কাতর্কি হয়, ঝগড়াঝাঁটি হয়। আজ একটু বাড়াবাড়ি রকমের ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেছে, যা শেষ পর্যন্ত জামা ধরে টানাটানি ও ঘুষি বিনিময় পর্যায়ে চলে গেছে। মাসে তিন চারবার এমন বাড়াবাড়ি রকমের ঝগড়াঝাঁটি হয়ে থাকে। আমাদের মহল্লার অনেক লোক বাজারে ব্যবসা করে। তারাই মিটমাট করে দেয়। মিটমাট করতে গিয়ে অনেক সময় দোকানিদের কেনা দামে মাল বেঁচে আসগর চাচাকে শান্ত করতে হয়।
আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এত দুর্নীতি ছিল না। তারপরেও কিছু এ হাত ও হাত যে হতো না, তা’ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শাখার অনেক কর্মচারী ঐতিহ্যগত ভাবেই কিছু অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এই কর্মগুলোর মধ্যে একটি ছিল বাসায় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য অফিসের কাগজ, কলম, পেন্সিল, কাটার, কার্বন, ইরেজার ইত্যাদি চুরি করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া। এ যুগের হিসাবে খুবই সামান্য অপরাধ। সে যুগের হিসাবে অতটা সামান্য নয়, বিশেষ করে আসগর চাচার মতো মানুষের চোখে পড়লে তো নয়ই। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করার পাত্র নন। তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি সরল। চোর কর্মচারীর জামার কলার ধরে বাঁ হাতে ঠাস্ ঠাস্ করে আধা ডজন চড় বসিয়ে দেওয়া (বলতে ভুলে গেছি, আসগর চাচা ছিলেন ন্যাটা। তাঁর সব কাজ ছিল বাঁ হাতে)। এ নিয়ে প্রায়ই অফিসের মধ্যে হৈ চৈ হতো। অফিস ডেকোরাম ভাঙ্গার অপরাধে আসগর চাচা দু’একবার সাসপেন্ডও হয়েছেন। আর শো-কজের তো হিসাব নাই। কিন্তু চোর কর্মচারীরা কোনদিন পাল্টা আঘাত করার সাহস করেনি। মনের ভেতর অপরাধবোধ থাকলে যা হয় আর কী!
কিন্তু একদিন এর ব্যাতিক্রম হলো। আমি দুপুরের ক্লাস শেষে কয়েকজন বন্ধুসহ বাস ধরার জন্য মমতাজউদ্দিন কলাভবন থেকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় দেখলাম, রক্তাক্ত নাক চেপে ধরে দু’জন কর্মচারীর সাহায্যে আসগর চাচা প্রশাসনিক ভবন থেকে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারের দিকে যাচ্ছেন আর চরম উত্তেজিত কণ্ঠে কাকে যেন গালাগাল করছেন। তাঁর প্যান্ট শার্টে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
জানা গেল, সেই কাগজ চুরির মামলা। আসগর চাচা এমনিতে ছোটখাটো গড়নের দুর্বল মানুষ। দেহে তেমন বল শক্তি নেই। পাল্টা মার খেতে হয়না বলে বেশিরভাগ সময় তিনিই জেতেন। কিন্তু আজকের মামলায় তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল দশাসই চেহারার এক চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী। আসগর চাচার চড় খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে সে একটা ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে। আর তাতেই আসগর চাচার নাক ফেটে চৌচির।
সেই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ দু’জনকেই সাসপেন্ড করে দিল। আসগর চাচা এর আগেও সাসপেন্ড হয়েছেন। তিনি যতদিন সাসপেন্ড থাকেন, ততদিন আমাদের মহল্লার মসজিদে মোয়াজ্জিনের কাজ করেন। তাঁর আজানের সুর খুব চমৎকার। মহল্লার সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে যে, আসগর চাচার আজান শুনলে মসজিদে যেতে ইচ্ছে করে। এমন সুরেলা গলার মিষ্টি আজান রাজশাহী শহরের আর কোন মসজিদে শোনা যায় না। আমাদের মসজিদের একজন বেতনভুক মোয়াজ্জিন ছিল। আসগর চাচা আজান দিলে তার তো কোন কাজ থাকে না। কিন্তু তার বেতন নেওয়া যাতে হালাল হয়, সেজন্য আসগর চাচা সারাদিন তাকে মসজিদের কাজে খাটিয়ে মারেন। মসজিদের মেঝে ঝাড়ু দেওয়া, জায়নামাজগুলো ঝাড় পোঁছ করে রোদে দেওয়া, মইয়ে চড়ে ফ্যান মোছা, দেয়ালের ঝুল ঝাড়া, ওযুর জায়গা পাক সাফ রাখা ইত্যাদি হেন কাজ নেই, যা তাকে দিয়ে তিনি করান না। সাথে অবশ্য আসগর চাচা নিজেও হাত লাগান। তবে এসব কাজ ও আজান দেওয়ার জন্য তিনি মসজিদ থেকে একটি পয়সাও নেন না। কিন্তু তারপরেও একদিন মসজিদ থেকে আসগর চাচাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।
বেতনভোগী মোয়াজ্জিন মসজিদের দানবাক্স থেকে মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা সরাতো। একদিন এ কাজ করতে গিয়ে সে সরাসরি আসগর চাচার হাতে ধরা পড়ে যায়। আসগর চাচা তাঁর স্বভাব অনুযায়ী মোয়াজ্জিনকে চড় থাপড় দিতে দিতে মসজিদ সংলগ্ন হুজরাখানায় ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে হাজির করেন। ইমাম সাহেব সব শুনে মসজিদ কমিটির সভা ডাকলেন। পাড়ার মুরুব্বীরাই মসজিদ কমিটির সদস্য। সভায় আসগর চাচা চুরির ঘটনা বর্ণনা করলেন। মোয়াজ্জিনকে জবাব দিতে বলা হলে সে টাকা চুরির কথা বেমালুম অস্বীকার করে উল্টো এই বলে অভিযোগ করলো যে, আসগর চাচার এখন চাকরি না থাকায় তিনি মোয়াজ্জিনের চাকরিটা বাগানোর জন্য মিথ্যা অভিযোগ এনে তাকে তাড়ানোর ষড়যন্ত্র করছেন। মোয়াজ্জিনের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘সে তো এই মসজিদে দশ বারো বছর থেকে আছে। আমি তো তাকে কখনো এ কাজ করতে দেখিনি বা শুনিওনি। এখন আল্লাই ভালো জানেন।’
মসজিদ কমিটির লোকজন দু’পক্ষের বক্তব্য ও ইমাম সাহেবের কথা বিবেচনায় নিয়ে মোয়াজ্জিনের বক্তব্যকে যুক্তিসঙ্গত মনে করলো এবং আসগর চাচাকে শুধু নামাজ পড়া ছাড়া মসজিদের সকল কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিল। সেদিন থেকে আসগর চাচার সুরেলা কণ্ঠের আজান শোনা বন্ধ হয়ে গেল।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর আসগর চাচা ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে তাঁর দেশের বাড়ি চুয়াডাঙ্গায় চলে যান। যাওয়ার আগের দিন তৈজসপত্রের দোকান মালিক আমার সেই বন্ধুর কাছে তিনি দুটো পুরাতন পিতলের কলস ও চারখানা কাঁসার থালা বিক্রি করে গাড়ি ভাড়ার টাকা জোগাড় করেছিলেন। সাসপেনসন উইথড্র হয়ে পরে তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন কী না তা’ বলতে পারবো না। কারণ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নয়, রাজশাহী শহরেই তাঁকে আর কখনো দেখিনি আমি। সম্ভবতঃ বার বার শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সেবার আর তিনি চাকরি ফিরে পাননি।
অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, Bad money drives good money out of circulation. একই ভাষায় এ কথা বললে কী খুব বেশি অন্যায় হবে যে, Bad man drives good man out of existence?
একটা তথ্য দিয়ে রাগী মানুষের গল্পটি শেষ করি। আসগর চাচা চুয়াডাঙ্গা চলে যাবার মাস তিনেক পর একই অপরাধে স্বয়ং ইমাম সাহেবের হাতে ধরা পড়ে সেই মোয়াজ্জিনের চাকরি চলে যায়।
*****************************