somewhere in... blog

ভাগ্যের তাৎপর্য সম্পর্কিত গবেষণা

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তাকদীরের হাকীকত

ভূমিকা:
অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করা বা মনে করা যে- মানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই- এটা ঈমানের বিষয় নয় বরং মানুষ চাইলেও সব কিছু করতে পারে না- এটাই হলো ঈমানের বিষয়।
আল্লাহ বলেন, “বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামাত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর..।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৭৭)

স্বাধীনতা ও অধীনতা:
ইচ্ছাকৃত আর অনিচ্ছাকৃত কাজ এক নয়। মানসিকভাবে সুস্থ কেউ গালি দিলে সেটাকে অনিচ্ছাকৃত মনে করা হয় না। অপরদিকে কোনো পাগল কাউকে গালি দিলে সেটাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না।
মানুষ কিছু কাজে স্বাধীন আর কিছু কাজে বাধ্য। মানুষকে শাস্তি বা পুরস্কারের যোগ্য ধরা হয় স্বাধীনভাবে করা কাজের ক্ষেত্রে।

তাকদীর সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ:
যেমন: (ক)অতি প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ (খ)প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ (গ)নৈতিক দৃষ্টিকোণ এবং (ঘ)ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ

অতি প্রাকৃতিক দৃষ্টিকোণ (Metaphysics) বা অধীনতাবাদ:
জাবরিয়া (বা অধীনতাবাদী) দের জবাবে কাদরিয়া (বা স্বাধীনতাবাদী) রা সবচেয়ে বলিষ্ঠ যে যুক্তি দিয়েছে, সেটা এই যে, ভবিষ্যতের কোনো ঘটনা সম্পর্কে কারোর নির্ভুল জ্ঞান থাকার অর্থ এটা নয় যে, ঐ জ্ঞানই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এ যুক্তিও অতো বলিষ্ঠ নয়। কারণ, নির্ভূল আগাম জ্ঞান এবং আগাম অনুমান এক কথা নয়। অনুমিত ঘটনা ঘটে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্বাহ্নের অনুমানের কোনো হাত থাকে না কিন্তু ভবিষ্যতের যে ব্যাপরটা নির্ভুলভাবে আগাম জানা যায় তার সাথে ঐ জ্ঞানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক নেই এমন কথা বলা খুবই কঠিন।
মুসলিম দার্শনিকদের একটি দল বলেছেন, “(তাকদীর হলো) স্বাধীনতাও নয়, অধীনতাও নয়, মধ্যবর্তী একটা অবস্থা।” (অর্থাৎ মানুষ পুরোপুরি স্বাধীন বা পরাধীন নয়)
দার্শনিকদের যা কিছু মতভেদ হয়েছে তা প্রধানত জাবরিয়াত (অধীনতাবাদ) বনাম কাদয়িাত (স্বাধীনতাবাদ) নিয়ে হয়নি বরং চরম জাবরিয়াত ও মধ্যম জাবরিয়াত নিয়ে হয়েছে।

বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ (Physics):
বস্তুবাদী দর্শন সব সময় মানুষের অক্ষমতা ও অধীনতারই পক্ষপাতী।
বিশ্বের সকল জিনিস প্রাকৃতিক নিয়মের অটুট নিগড়ে আবদ্ধ। (ডেমোক্রিটিস প্রদত্ত) এ মত অনুযায়ী মানবাত্মা বস্তুর রাসায়নিক মিশ্রণ পক্রিয়ার ফল। মানুষ আত্মীক সত্তা নয় বরং যান্ত্রিক সত্তা।
নৈতিকতার ভাষায় যে জিনিসকে আমরা পুণ্যকর্ম ও সদাচার বলে আখ্যায়িত করে থাকি, ‘বিজ্ঞানের’ ভাষায় তা নিছক শরীরিক উপাদান সমূহের নিখুঁত বিন্যাস এবং স্নায়ুতন্ত্রীর সুস্থতারই নামান্তর।
উত্তরাধিকার বিধান (laws of heredity) অনুযায়ী (প্রবক্তা: ডারউইন, রাসেল ওয়ালেস..) বিগত যুগকাল ধরে পুরুষানুক্রমিকভাবে যে ধাঁচের চারিত্রিক ধারা চলে আসছে, প্রতিটি মানুষের চরিত্র ও স্বভাব সেই ধাঁচেই গড়ে ওঠে। টক আমের আঁটি থেকে অংকুরিত আমগাছ যেমন টক আম জন্মাতে বাধ্য, খারাপ মানুষের সন্তানও তেমনি দুষ্কর্ম করতে বাধ্য। (ইতিহাস দর্শন ও পরিসংখ্যান বিদ্যাও এ ধরনের তথ্য দেয়)
যে ‘বিজ্ঞানের’ ওপর নির্ভর করে মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও গর্ববোধকে লালন করে আসছিলো, সেই ‘বিজ্ঞানই’ মানুষের সমস্ত চিন্তাগত উন্নতি, উৎকর্ষ, গবেষণা ও আবিষ্কারের জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের গৌরব মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং মানুষকে উদ্ভিদ, জড় পদার্থ ও নিস্প্রাণ যন্ত্রের মতো একটি অক্ষম ও অসহায় সত্তা বলে মেনে নেয়।
মানুষ নিজের মধ্যে যে ক্ষমতা ও স্বাধীনতার অস্তিত্ব স্বতস্ফূর্তভাবেই অনুভব করে ‘বিজ্ঞান’ সেই ক্ষমতা ও স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। বরং স্বয়ং বিবেক ‘বিজ্ঞানের’ গবেষণা ও উদ্ভাবনের উর্ধ্বে প্রমাণিত হয়েছে। কোনো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রণালী দ্বারা এখন পর্যন্ত সেই জিনিসটার রহস্য উদঘাটন করা যায়নি।
শারীরিক দোষ-গুণগুলো মানসিক দোষ-গুণের একমাত্র কারণ নয়। তাছাড়া সব দোষ-গুণই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত; কোনো গুণই অর্জিত নয়- এটাও ঠিক নয়। সুতরাং প্রাকৃতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং তার শাখা প্রশাখা প্রকৃতপক্ষে অদৃষ্ট সমস্যার সমাধান দেয় না। কেবল অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে আমাদেরকে এতটুকু অবহিত করে যে, আমাদের জীবনে বাধ্যবাধকতার সীমা কতদূর বিস্তৃত।

নৈতিক দৃষ্টিকোণ:
অধীনতাবাদী (বা জাবরিয়া) মতে মানুষ অক্ষম দু’টো কারণে। (এক)জন্মগত মৌলিক স্বভাব (দুই)বহিরাগত প্রভাব। অপরদিকে স্বাধীনতাবাদী (বা কাদরিয়া) মতে স্বেচ্ছায় কাজ করলে উপরের দু’টোর কোনো হাত নেই। কিন্তু এ স্বাধীনতা কি পূর্ণ? সচেতনতা, বুদ্ধি-বিবেক, বাছ-বিচার ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা যা মানুষের ইচ্ছাকৃত কাজের ভিত্তি এগুলোর সবই তো আল্লাহপ্রদত্ত।
এদিকে, মধ্যমপন্থী স্বাধীনতাবাদীদের অভিমত এই যে, আমরা মানুষকে যে সৎ বা অসৎ বলি, সেটা তার জন্মগত স্বভাব কিংবা সামাজিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলি না বরং অপরিকল্পিত ইচ্ছার ভিত্তিতেই বলে থাকি। এই অপরিকল্পিত ইচ্ছার (তৃতীয় জিনিস) ভিত্তিতেই চারিত্রিক মূল্যমান নির্ধারণ এবং সততা ও অক্ষমতার ব্যাপারে রায় দেওয়া সম্ভব। তাত্ত্বিকভাবে এ বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও সমস্যা এই যে, আমাদের কাছে এমন কোনো মানদণ্ড নেই যার সাহায্যে আমরা মানুষের চরিত্রে জন্মগত স্বভাব, বাহ্যিক পরিবেশ ও অপরিকল্পিত ইচ্ছার অবদানগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারি। স্বাধীনতাবাদের এ মতবাদ মেনে নিলে আদালত ও জেলখানা বন্ধ করে দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ বিচারপতিও জানেন না যে, অপরাধ ঘটায় ব্যক্তির অপরিকল্পিত ইচ্ছার অবদান কতটুকু। এ প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব অধীনতাবাদ তথা অদৃস্টবাদের কাছেও নেই।
মোটকথা, মানুষ অদৃষ্টের নিগড়ে অসহায়ভাবে বন্দী, না স্বাধীন ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে নৈতিক দর্শন ব্যর্থ হয়েছে।

ধর্মীয় (তথা ইসলামী) দৃষ্টিকোণ:
ইসলাম কোনো না কোনো ভাবে বাস্তব কর্মকুশলতা ও অতি প্রাকৃতিক বিষয় উভয়ের প্রতিই দৃষ্টি দিয়েছে। ইসলাম মানুষের ওপর বিভিন্ন আদেশ নিষেধ আরোপ করে এবং আনুগত্যের জন্য পুরস্কার এবং নাফরমানীর জন্য শাস্তি প্রয়োগের বিধান উপস্থাপিত করে। আর এজন্য মানুষের আপন কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী এবং কিছু না কিছু স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার অধিকারী হওয়া জরুরী হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে সে এমন এক উচ্চতর সত্তা বা উচ্চতর আইনের কথাও বলে, যার একচ্ছত্র আধিপত্য মানুষসহ সমগ্র বিশ্বনিখিলের উপর পরিব্যাপ্ত এবং যার দুর্ভেদ্য নিয়ন্ত্রণে আটকা পড়ে আছে ভাঙ্গা গড়ার শাশ্বত নিয়মে বিকাশমান বিশ্বজগত।
তাই, ধর্মতত্ত্বে তাকদীরের বিষয়টি দর্শন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও নৈতিকতা এ তিনটির সব কটির চেয়ে জটিল। অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম এ জটিলতা নিরসনে কতটুকু সমর্থ সেটা নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা না করে ইসলাম সম্পর্কেই আলোকপাত করা হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ পরস্পর বিরোধী সকল ধর্ম প্রসঙ্গে আলোকপাত করার বিশাল আয়োজন এখানে করা হয়নি।

বিশুদ্ধ ইসলামী মতাদর্শ:
যে জিনিস যতোটুকু জানা দরকার তা আল্লাহ ও রাসূল (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে বেশি জানতে চেষ্টা করা যেমনি নিরর্থক তেমনি বিপজ্জনকও। কুরআনের ঘোষণা, “এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যার নিগুঢ় রহস্য তোমাদের সামনে উদঘাটন করলে তোমাদের খারাপ লাগবে।” (৫/সূরা আল মায়িদাহ:১০১) রাসূল (সা.) বলেছেন, “নিস্প্রয়োজন ও অসংলগ্ন ব্যাপার এড়িয়ে যাওয়াই ইসলামের জন্য কল্যাণকর।” (তিরমিযী) তাকদীরের ব্যাপারটিও এ ধরনেরই একটি সমস্যা। রাসূল (সা.) এ ব্যাপারে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বারবার তাকিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার চূড়ান্ত নির্দেশ এই যে, তোমরা এ (তাকদীরের) ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হয়োনা।” (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ) তিনি (সা.) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি তাকদীরের বিষয়ে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হবে, কিয়ামাতের দিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে (কারণ তার কথা ভুল বা শুদ্ধ হতে পারে)। কিন্তু যে ব্যক্তি চুপ থাকবে তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হবে না।”
কর্মজীবনের নৈমিত্তিক ব্যাপারে তাকদীর তত্ত্ব দ্বারা যুক্তি প্রদর্শন করা রাসূল (সা.) এর পছন্দ হয়নি। এ জন্যই হাদীসবেত্তা ও ফিকাহবিদগণ সংক্ষেপে কেবল এতোটুকু বিশ্বাস করাই যথেষ্ট মনে করেছেন যে, “তাকদীরের ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর তরফ থেকে আসে।” “অমুক কাজ কপালে লেখা ছিলো, তা না করে উপায় ছিলো না আর অমুক কাজ না করেও পারা যেতো, ইচ্ছা করেই করা হয়েছে” ইত্যাকার পাকাপাকি বক্তব্য দেওয়ার ব্যাপারে তারা কঠোর নিন্দা করেছেন।
অন্যান্য জাতির দার্শনিক ও জড়বাদী অদৃষ্ট তত্ত্ব অধ্যয়ন ও প্রচারের কারণে তাকদীরের ব্যাপারটা মুসলিম সমাজেও একটি সমস্যার রূপ ধারণ করেছে। নিছক ইসলামী চিন্তার প্রভাব গ্রহণ করলে এ সমস্যা হওয়ার কারণ থাকতো না।

কাদরিয়া (স্বাধীনতাবাদী) মতবাদ:
সর্বপ্রথম এই মতবাদের মূলনীতিগুলো প্রণয়ন করেন ওয়াসেল বিন আতা আল গাজ্জাল। এ মতবাদ অনুযায়ী, ভালো ও মন্দ কাজের কর্তা বান্দাহ নিজেই। আল্লাহ এ সব কাজের ক্ষমতা তাকে দান করেছেন।
ইবরাহীম বিন সাইয়ার আন নাজ্জাম সংযোজন করে বলেন, আল্লাহ শুধু ভালো জিনিসের ব্যাপারেই ক্ষমতাবান।
মুয়াম্মার বিন আব্বাস আসসালামী এবং হিশাম বিন আমর আরও উগ্র মত পোষণ করেছেন। তারা “অদৃষ্টের ভালো ও মন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়” এ বিশ্বাস পোষণকারীকে কাফির ও গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, এ ধারণা আল্লাহকে অত্যাচারী সাব্যস্ত করে।
পরে জাহেজ, খাইয়াত, জিয়ালী, কাজী, আবদুল জব্বার প্রমুখ মুতাজিলা দার্শনিক বলেন, বান্দা যা কিছু করে তার স্রষ্টা আল্লাহ নন বরং বান্দা নিজেই তা সৃষ্টি করে। বান্দা যে কাজ করতে অক্ষম তা তার উপর চাপিয়ে দেওয়া আল্লাহর পক্ষে বৈধ নয়।

কুরআনের যে আয়াতগুলোকে কাদেরিয়া (স্বাধীনতাবাদী) মতবাদের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়:
যেসব আয়াতে বান্দার কার্যকলাপের জন্য বান্দাকে দায়ী করা হয়েছে
“যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে অত:পর বলে যে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, তাদের জন্য ধ্বংস।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৭৯)
“আল্লাহ কোনো জাতিকে যে নিয়ামাত দান করেন, তা ঐ জাতি নিজেই তার অবস্থা না পাল্টানো পর্যন্ত পাল্টান না।” (৮/সূরা আল আনফাল:৫৩)
“যে খারাপ কাজ করবে, সেই অনুযায়ীই সে কর্মফল ভোগ করবে।” (৪/সূরা আন নিসা:১২৩)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের নিজের কার্যকলাপের ভিত্তিতেই পুরস্কার ও শাস্তি প্রদত্ত হবে
“আজ প্রত্যেক প্রাণীকেই তার কর্ম অনুসারে প্রতিফল দেওয়া হবে।” (৪০/সূরা আল মুমিন:১৭)
যেসব আয়াতে জুলুম, অন্যায় ও নিন্দনীয় কার্যকলাপ থেকে আল্লাহকে পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে
“যিনি তার প্রতিটি সৃষ্টিকে উত্তম করেই সৃষ্টি করেছেন।” (৩২/সূরা সিজদাহ:৭) (কুফরী যে ভালো নয় তা সর্বজনবিদিত)
“তোমাদের প্রতিপালক বান্দাদের জন্য কখনো জালেম নন।” (৪১/হা মীম সিজদাহ:৪৬)
যে আয়াতগুলোতে কাফির ও গুনাহগারদেরকে তাদের অপকর্মের জন্য ভর্ৎসনা করা হয়েছে
“তোমাকে সিজদা করতে বাধা দিলো কিসে?” (৩৮/সূরা সোয়াদ:৭৫)
“তাদের কি হলো যে ঈমান আনছে না।” (৮৪/সূরা ইনশিকাক:২০)
“তোমরা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখো কেনো?” (৩/সূরা আলে ইমরান:১০)
যেসব আয়াতে ঈমান ও কুফরীকে বান্দার ইচ্ছানির্ভর বলা হয়েছে
“বলুন, সত্য তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত। অতএব, যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক।” (১৮/সূরা আল কাহফ:২৯)
“যার ইচ্ছা হয় আপন প্রতিপালকের পথ অবলম্বন করুক।” (৭৩/সূরা মুযযাম্মিল:১৯)
“মুশরিকরা বলেছে যে, আল্লাহ না চাইলে আমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করতাম না।” (১৬/সূরা আন নাহল:৩৫) (অর্থাৎ, মুশরিকদের মতো এরূপ বলা নিন্দনীয়)
যেসব আয়াতে বান্দাদেরকে নেক কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে
“তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা পাওয়ার জন্য ছুটে যাও।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৩৪)
“আল্লাহর দিকে যে দাওয়াত দিচ্ছে, তার ডাকে সাড়া দাও।” (৪৬/সূরা আল আহকাফ:৩১)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, বান্দা এমন সব কাজ করে থাকে, যার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দেননি
“তারা আল্লাহদ্রোহী শক্তির কাছে বিবাদ মীমাংসার জন্য যেতে চেয়েছিলো। অথচ সকল আল্লাহদ্রোহীকে অস্বীকার করতে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” (৪/সূরা আন নিসা:৬৯)
“আল্লাহর ইবাদাত করা ছাড়া তাদেরকে আর কিছু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়নি।” (৯৮/সূরা বাইয়িনাহ:৫)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে নিজের কর্মফল ভোগ করে
“পানিতে ও স্থলে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের নিজেরই কর্মের দোষে।” (৩০/সূরা আর রূম:৪১)
“জনপদগুলোর অধিবাসীরা জালেম না হলে আমি (আল্লাহ) তা ধ্বংস করতাম না।” (২৮/সূরা আল কাসাস:৫৯)
যেসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ কাউকে হিদায়াত কিংবা গোমরাহীর জন্য বাধ্য করেন না
“এবার সামুদ জাতির কথা শোনো। তাদেরকে আমি হিদায়াত করেছিলাম। কিন্তু তারা হিদায়াত পাওয়ার চেয়ে অন্ধ হয়ে চলাকেই অগ্রাধিকার দিলো।” (৪১/হা মীম সিজদা:৩০)
“যে ব্যক্তি হিদায়াত গ্রহণ করে তার হিদায়াত গ্রহণ করা স্বয়ং তার জন্যই কল্যাণকর।” (১০/সূরা ইউনুস:১০৮)
“ইসলামে কোনো জোরজবরদস্তি নেই। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় তা আলাদা করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৬)
যেসব আয়াতে নবীগণ আপন ত্রুটি স্বীকার করেছেন এবং তাকে নিজেরই ত্রুটি বলে উল্লেখ করেছেন
“(হযরত আদম আ. বলেন) হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। (৭/সূরা আল আরাফ:২৩)
“(হযরত ইউনুস আ. বলেন) তুমি পবিত্র। দোষ তো আমিই করেছি।” (২১/সূরা আল আম্বিয়া:৮৭)
“(হযরত মুসা আ. বলেন) হে রব! আমি নিজের উপর জুলুম করেছি।” (২৮/সূরা আল কাসাস:১৬)
“(হযরত নূহ আ. বলেন) হে রব! আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই, যেনো নিজের অজান্তে কোনো অন্যায় আবদার তোমার কাছে না করে বসি।” (১১/সূরা হুদ:৪৭)

জাবরিয়া (বা অধীনতাবাদী) মতবাদ:
(বিপরীতক্রমে) জাবরিয়া গোষ্ঠীর বক্তব্য এই যে, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই হয় না। বিশ্বজগতের প্রতিটি অণুপরমাণুর তৎপরতা ভাগ্যবিধির অধীনে সংঘটিত হয়। আল্লাহর হুকুম ও ফায়সালা ছাড়া কেউ চুল পরিমাণও নড়াচড়া করতে পারে না।
জুহাম বিন সাফওয়ান এবং শাইবান বিন মুসলিম খারেজীর মত এই যে, মানুষ তার কার্যকলাপে সম্পূর্ণরূপে ভাগ্যের অধীন। তার না আছে ইচ্ছাশক্তি, না আছে বাছ-বিচারের ক্ষমতা। মানুষের কাজ করা নেহাত রূপক অর্থেই সত্য।
তাহলে শাস্তি ও পুরস্কার কেনো? জবাবে বলা হয়, কাজে যেমন সে ভাগ্যের অধীন, তেমনি তার পুরস্কার ও শাস্তিও অদৃষ্ট ঘটিত। এ মতবাদ হলো নিরেট ও নির্ভেজাল অদৃষ্টবাদ বা অধীনতাবাদ। মুতাজেলাদের কথিত নিরেট স্বাধীনতাবাদের বিপরীত বিন্দুকে এর অবস্থান।
তবে, জাবরিয়াদের (বা অধীনতাবাদীদের) মধ্যে একটি গোষ্ঠী বান্দাকে কিছু পরিমাণে ক্ষমতা ও এক ধরনের সাময়িক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী বলে মেনে নেয়। এটাকে তারা ‘কাছব’ (উপার্জন) বলে থাকে। তাদের মতে, এই উপার্জনের কারণেই বিভিন্ন আদেশ ও নিষেধ মানুষের প্রতি জারি হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ আযাব ও সওয়াবের উপযুক্ত হয়ে থাকে।
পরে ‘ইমাম’ রাজী জাবরিয়া মাযহাবের জোরদার ওকালতী করেন। তার মত জেনে প্রশ্ন জাগে যে, মানুষের পাপী ও পুণ্যবান হওয়া যদি আগে থেকেই স্থির হয়ে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে চলার ক্ষমতাই বান্দার না থাকে, তাহলে তাকে আদেশ ও নিষেধ করা কিভাবে বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? এর জবাবে ‘ইমাম’ সাহেব বলেন যে, এটা আল্লাহর জন্য বৈধ। বান্দা মেনে চলতে অক্ষম এমন আদেশ নিষেধও তিনি দিতে পারেন। তাঁর কোনো কাজে ‘কেনো’ ও ‘কি জন্য’ প্রশ্ন উঠতে পারে না।

কুরআনের যে আয়াতগুলোকে জাবরিয়া (বা অধীনতাবাদী) মতবাদের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়:
যে সমস্ত আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ যাবতীয় শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী
“যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৬৫)
“আল্লাহ তোমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা যা তৈরি করো তাও।” (৩৭/সূরা আস সাফফাত:৯৬)
যে আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক ব্যাপারে আল্লাহর ফায়সালা আগে থেকেই লেখা হয়ে রয়েছে
“কোনো স্ত্রী জাতীয় প্রাণী এমন কোনো গর্ভধারণ করে না এবং কোনো সন্তান প্রসবও করে না, যা আল্লাহর জানা নেই। কোনো দীর্ঘজীবীর আয়ু দীর্ঘায়িত হোক বা কারোর আয়ু হ্রাস পাক তা একটি লিপিতে লিখিত থাকেই।” (৩৫/সূরা ফাতির:২০)
“আমি কিতাবের মাধ্যমে বনী ইসরাইলকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, তোমরা নির্ঘাত দু’বার পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:৪)
“সংঘর্ষের দিন তোমাদের ওপর যে দুর্যোগ নেমে এসেছিলো, তা আল্লাহর ইচ্ছাক্রমেই এসেছিলো।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৪৬)
“পৃথিবীতে কিংবা তোমাদের ওপর এমন কোনো বিপদই আসে না, যা আমি সৃষ্টি করার আগেই লিপিবদ্ধ থাকে না।” (৫৭/সূরা আল হাদীদ:২৩)
যেসব আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্যই একটা ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। জীবিকা, সম্মান, ধন-সম্পদ, বিপদ ও শান্তি, জীবন ও মৃত্যু সবই এই ভাগ্যের অধীন
“আকাশ ও পৃথিবীর কর্তৃত্বের চাবিকাঠি তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। তিনি যাকে ইচ্ছে ব্যাপকভাবে জীবিকা দেন আর যাকে ইচ্ছা পরিমিত করে দেন।” (৪২/সূরা আশ শুরা:১২)
“কোনো মঙ্গল অর্জিত হলে তারা বলে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আর কোনো দুর্যোগ এলে বলে যে এটা (হে নবী) তোমার কারণে হয়েছে। তুমি বলে দাও যে, সবকিছু আল্লাহর তরফ থেকেই আসে।” (৪/সূরা আন নিসা:৭৮)
“প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর জন্যই একটা মেয়াদ নির্দিষ্ট আছে। সেই মেয়াদ যখন শেষ হয়ে যায়, তখন এক মুহূর্তও আগপাছ হয় না।” (৭/সূরা আল আরাফ:৩৪)
যেসব আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। বান্দার কোনোই ক্ষমতা নেই। সকল ক্ষমতা কেবল আল্লাহর। মানুষ যতো চেষ্টা-তদবিরই করুক, আল্লাহর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে সক্ষম নয়।
“আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তোমরা কিসেরই বা ইচ্ছা করবে?” (৭৬/সূরা আদ দাহর:৩০)
“(হে নবী) তোমার হাতে কোনোই ক্ষমতা নেই।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১২৮)
“কখনো কোনো ব্যাপারে এ কথা বলো না যে, আমি এটা করবোই। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তোমার এ কথা কার্যকর হতে পারে না।” (১৮/সূরা আল কাহফ:২৩)
“তুমি বলে দাও যে, তোমরা যদি নিজ নিজ ঘরেও থাকতে তবুও যাদের ভাগ্যে হত্যা লেখা ছিলো, তারা নিজ নিজ হত্যার জায়গায় নিজেরাই উপস্থিত হতো।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৫৪)
“আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো কষ্টে নিক্ষেপ করেন তবে তা হটানোর ক্ষমতা তাঁর ছাড়া আর কারোর নেই।” (৬/সূরা আল আনআম:১৭)
যেসব আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, হিদায়াত ও গোমরাহী পুরোপুরিভাবে আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন।
“আল্লাহ কুরআন দ্বারা অনেককে গোমরাহ করে দেন আবার অনেককে সুপথগামী করেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৬)
“আল্লাহ যাকে খুশি বিপথগামী করেন, যাকে খুশি সরল পথে চালিত করেন।” (৬/সূরা আল আনআম:৩৯)
“সুতরাং আল্লাহ যাকে হিদায়াত দিতে চান, ইসলামের জন্য তার বক্ষ (অন্ত:করণ) খুলে দেন।” (৬/সূরা আল আনআম:১২৫)
“আমি যদি তাদের কাছে ফেরেশতাদেরকে অবতারণ করতাম এবং তাদের সাথে মৃতরা কথাবার্তা বলতো এবং আমি সব বস্তুকে তাদের সামনে জীবিত করে দিতাম, তথাপি তারা কখনও বিশ্বাস স্থাপনকারী নয়; কিন্তু যদি আল্লাহ চান।” (৬/সূরা আল আনআম:১১১)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে সবাই ঈমান আনতো এবং কোনো বিতর্ক অবশিষ্ট থাকতো না
“আল্লাহ যদি চাইতেন তবে তারা লড়াই করতো না। আসলে আল্লাহ যা চান তা করেই ছাড়েন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৩)
“আর তোমার পরওয়ারদেগার যদি চাইতেন, তবে পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছে, তাদের সবাই ঈমান নিয়ে আসতে সমবেতভাবে। তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে ঈমান আনার জন্য?” (১০/সূরা ইউনুস:৯৯)
“আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ।” (৭/সূরা আল আরাফ:১৭৯)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ কাফির ও মুনাফিকদেরকে ঈমান আনা ও নেক আমল করা থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন এবং এ ধরনের লোকেরা হিদায়াত পেতেই পারে না।
“নিশ্চিতই যারা কাফির হয়েছে তাদেরকে আপনি ভয় প্রদর্শন করুন আর নাই করুন তাতে কিছুই আসে যায় না, তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৬-৭)
“তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে। আল্লাহ তাদের রোগ আরো তীব্র করে দিয়েছেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১০)
“আমি তাদের হৃদয়ের ওপর পর্দা দিয়ে রেখেছি। এতে তাদের কুরআন বুঝার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে।” (৬/সূরা আল আনআম:২৫)
“আর আমি তাদের মনের ওপর সিল মেরে দিই। ফলে তারা শুনতে পায় না।” (৭/সূরা আল আরাফ:১০০)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, কাফিরদেরকে যেসব অপকর্মের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে শাস্তি দেওয়া হয়, তা আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশক্রমে তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়।
“যখন আমি কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তার অবস্থাপন্ন লোকদেরকে উদ্ধুদ্ধ করি অত:পর তারা পাপাচারে মেতে ওঠে।” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:১৬)
“আর এমনিভাবে আমি প্রত্যেক জনপদে অপরাধীদের জন্য কিছু সর্দার নিয়োগ করেছি-যেনো তারা সেখানে চক্রান্ত করে।” (৬/সূরা আল আনআম:১২৩)
“তাদের (খারাপ) কাজগুলোকে আমি মোহনীয় বানিয়ে রেখেছি। ফলে তারা উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।” (২৭/সূরা আন নামল:৪)
যেসব আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ স্বয়ং গোমরাহকারী শয়তান ও অসৎ নেতাদের আধিপত্য মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
“আর আমি তাদেরকে আগুনের দিকে আহ্বানকারী নেতা বানিয়েছি।” (২৮/সূরা আল কাসাস:৪১)
“আর আমি তাদের জন্য এমন সাথী নিয়োগ করেছি যারা তাদের সামনের ও পেছনের জিনিসগুলোকে তাদের জন্য চিত্তাকর্ষক বানিয়ে দেয়।” (৪১/সূরা হা মীম সিজদা:২৫)

উপরিউক্ত আকিদা শাস্ত্রবিদদের ব্যর্থতা:
পরস্পরবিরোধী যুক্তিতর্ক থেকে বুঝা যায়, অদৃষ্ট সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে উভয় গোষ্ঠীই ব্যর্থ হয়েছেন। তারা কুরআন থেকে পথ না নিয়ে দার্শনিক দিক-নির্দেশনা লাভ করতে চেয়েছেন এবং বিপরীতমুখী চিন্তাদ্বয়ের একটিকে পুরোপুরি গ্রহণ করে অপরটিকে পুরোপুরি বর্জন করেছেন। তারপর নিজেদের সমর্থনে কুরআনের বাণী খুঁজে বের করেছেন। যে আয়াত নিজেদের পক্ষে এসেছে সে আয়াতকে খেয়াল-খুশি মতো গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আগে থেকেই কোনো বিশ্বাস বদ্ধমূল করে না নিয়ে কুরআন দ্বারা সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে এ সমস্যা হতো না। কিন্তু আগে মত স্থির করে পরে কুরআন থেকে প্রমাণ খোঁজার ভুলের কারণে কুরআনে তথাকথিত স্ববিরোধিতা (?) আবিষ্কৃত হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)

তাকদীর সমস্যার গ্রন্থী উন্মোচন:
মানুষ এ পর্যন্ত তাকদীরের রহস্য উন্মোচনের যতো চেষ্টা করেছে, তার সবই ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়েছে। কারণ এই যে, এই বিশাল প্রাকৃতিক রাজ্যের শাসব্যবস্থা এবং আল্লাহর এই বিরাট বিশ্ব সাম্রাজ্যের পরিচালনার মৌলিক বিধান অবগত হওয়ার উপায়-উপকরণ মানুষের নাগালের বাইরে।
অনুভূতি ও উপলব্ধির নাগালের বাইরের বিষয়গুলো তো পরের কথা, সৃষ্টি জগতের যে সকল জিনিস অনুভূতি ও উপলব্ধির সীমার ভেতরে অবস্থিত, আমরা তো তাও এখনো আয়ত্তে আনতে পারিনি।
আমাদের জ্ঞান এবং জ্ঞান আহরণের উপায়-উপকরণের সাথে আমাদের অজ্ঞতা ও অজ্ঞতার কারণগুলোর সম্পর্ক অসীমের সাথে সসীমের সম্পর্কের মতোই।
কুরআনে তাকদীর তত্ত্ব সম্পর্কে আভাস-ইঙ্গিতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, তাতে আপাত:দৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী তথ্যাবলীর সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়। কোথাও বলা হয়েছে যে, বান্দা স্বয়ং তার কর্মকান্ডের কর্তা, কোথাও বলা হয়েছে যে, বান্দা কোনোই কর্মক্ষমতা নেই। যদি এসব উক্তি পরস্পর বিরোধী হয়ে থাকে যেমন আপাত:দৃষ্টিতে মনে হয়, তাহলে এতোসব বিপরীতমুখী উক্তি সম্বলিত কিতাবকে আমরা আমরা আল্লাহর কিতাব বলে কিভাবে মানতে পারি? আর যদি এগুলোর বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা স্বীকার করা না হয় তাহলে এগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য বিধানে উপায় কি, তা ব্যাখ্যা করা জরুরী।

অতি প্রাকৃতিক ও ইন্দ্রিয়াতীত তথ্যাবলী বর্ণনার পেছনে কুরআনের আসল অভিপ্রায়:
কুরআনে অদৃষ্টসহ পঞ্চেন্দ্রিয়ের ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বিষয়গুলো প্রতি আভাস দেওয়ার উদ্দেশ্য সে সকল বিষয়ের প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত করা নয়। এতোসব বিস্তারিত সৃষ্টিতত্ত্ব লেখার জন্য এক সীমাহীন খাতার প্রয়োজন এবং তা পড়ে শেষ করার জন্যও চাই এক অনাদি অনন্ত জীবন ও অসীম মেধাশক্তি। আল্লাহ বলেন, “বলুন, আমার পালনকর্তার কথা লেখার জন্যে যদি সমুদ্রের পানি কালি হয়, তবে আমার পালনকর্তার কথা, শেষ হওয়ার আগেই সে সমুদ্র নি:শেষিত হয়ে যাবে। সাহায্যার্থে অনুরূপ আরেকটি সমুদ্র এনে দিলেও।” (১৮/সূরা আল কাহফ:১০৯)
মানুষের বোধ শক্তির অবস্থা এই যে, এরিস্টট ও পিথাগোরাসের আমলে যদি কেউ বিংশ শতাব্দীর টেলিফোন, সিনেমা, রেডিও, উড়োজাহাজ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদির বিবরণ দিতো তাহলে যাদেরকে আজও বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী বলে বিবেচনা করা হয় তারাই তাকে পাগল বলতো। আর আজ থেকে এক হাজার বছর পরে পৃথিবীতে যেসব নতুন নতুন জিনিসের উদ্ভব হবে, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যদি আজ এ শতাব্দীতে করা হয়, তবে আমাদের বড় বড় বিজ্ঞানী ও দার্শনিক পর্যন্ত তা বুঝতে পারবে না।
যেসব জিনিস জানা ও বুঝার ক্ষমতা মানুষের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে, কেবল সক্রিয় হওয়া বাকি, সেগুলোর অবস্থাই এরূপ। আর যেসব জিনিসের জানা ও বুঝার ক্ষমতাই মানুষের নেই এবং যার কল্পনা করাও যার অসাধ্য, তা তাদের কাছে বর্ণনা করে কি লাভ হতো?
আল্লাহ বলেন, “(মানুষের) দৃষ্টির সামনে কিংবা পেছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। কিন্তু তাঁর জানা কোনো জিনিসই তাদের আওতাধীন নয় কেবল আল্লাহ যা কিছু জানাতে চান, তার কথা ভিন্ন। আকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র তাঁর ক্ষমতা বিস্তৃত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৫৫) আল্লাহ আরও বলেন, “তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে” (১৭/সূরা বনী ইসরাইল:৮৫)
অতএব, এ ধরনের (ইন্দ্রিয়াতীত) বিষয়গুলোর প্রতি কুরআনে যেসব আভাস-ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তা গোপনীয় তথ্য জানানোর জন্য নয় বরং মানুষের নৈতিক ও বাস্তব স্বার্থসংশ্লিষ্ট লক্ষ্য সমূহ অর্জনে সহায়তা করার জন্য। অবশ্য কোথাও কোথাও এর মাধ্যমে সূক্ষ্মদর্শী ও উচ্চ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের অল্পবিস্তর ‘আসমানী’ গোপন রহস্যও অবগত করা হয়।

তাকদীর তত্ত্ব বর্ণনা করার উদ্দেশ্য:
তাকদীর বিষয়ে কুরআনে আভাস এজন্য নয় যে আমরা তা বুঝার যোগ্যতা রাখি না বরং এর উদ্দেশ্য অল্পে তুষ্টি, একাগ্রতা, আল্লাহর উপর নির্ভরতা, ধৈর্য ও স্থিতি এবং পার্থিব শক্তিগুলোর ব্যাপারে নির্ভীকতা। যেনো হতাশা, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা, ভীতি, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও লোভ-লালসা ব্যক্তির কাছে ঘেঁষতে না পারে। যেনো ব্যক্তি সৎকর্মের উপর বহাল থাকে, অন্যকে ন্যায়ের দিকে ডাকতে পারে, বাধা-বিঘ্নের মোকাবেলায় অবিচল থাকতে পারে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর দ্বারা লাভ-ক্ষতির পরোয়া না করে, অভাবে যেনো হতোদ্যম না হয়, প্রাচুর্যে যেনো মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী না হয়।

এ সংক্রান্ত কুরআনের আয়াত:
“আযাব প্রত্যক্ষ করার সময় যে আল্লাহই সর্বশক্তিমান বলে মনে হবে, সেটা যদি জালেমরা আগেই বুঝতে পারতো, তবে, কতোই না ভালো হতো।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৬৫)
“তিনি ছাড়া আর কেউ আনুগত্য লাভের যোগ্য নয়। অতএব তুমি একমাত্র তাঁকেই নিজের সর্বময় ব্যবস্থাপক মেনে নাও।” (৭৩/সূরা মুযযাম্মিল:৯)
“আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সাহায্য করেন তাহলে তোমাদের ওপর বিজয়ী হতে পারে এমন কেউ নেই। আর তিনি যদি তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করেন তাহলে তার পরে আর কে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে?” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৬০)
“বলো, হে আল্লাহ! রাজ্যের অধিপতি! তুমি যাকে চাও, রাজ্য দিয়ে থাকো, যার কাছ থেকে চাও রাজ্য ছিনিয়ে নাও, যাকে ইচ্ছা সম্মান দাও, যাকে ইচ্ছা অপমানিত করো, যাবতীয় কল্যাণ একমাত্র তোমার হাতে। তুমিই সর্বশক্তিমান।” (৩/সূরা আলে ইমরান:২৬)
“আকাশ ও পৃথিবীর চাবিকাঠি তাঁরই হাতে। যাকে ইচ্ছা মুক্ত হস্তে জীবিকা দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা পরিমিতভাবে দেন।” (৪২/সূরা আশ শুরা:১২)
“আর আল্লাহ যদি তোমার উপর কোনো কষ্ট আরোপ করেন তাহলে কেউ নেই তা খন্ডাবার মতো তাঁকে ছাড়া। পক্ষান্তরে যদি তিনি কিছু কল্যাণ দান করেন, তবে তার মেহেরবানীকে রহিত করার মতোও কেউ নেই।” (১০/সূরা ইউনুস:১০৭)
“বলো যে, আমাদের ভাগ্যে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন, তাছাড়া আর কোনো বিপদ-মুসিবত আমাদের ওপর কখনো আসতে পারে না।” (৯/সূরা আত তাওবাহ:৫১)
“আল্লাহর অনুমোদন ছাড়া কারোর মরার সাধ্য নেই। মৃত্যুর সময় নির্ধারিত এবং আগে থেকে স্থিরিকৃত রয়েছে।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৪৫)
“তারা বলে থাকে যে, আমরা যদি কিছু কলা-কৌশল খাটাতে পারতাম তাহলে এখানে খুন হতাম না। তুমি বলে দাও যে, তোমরা যদি নিজ নিজ ঘরেও থাকতে তবুও যাদের ভাগ্যে হত্যা লেখা ছিলো, তারা নিজ নিজ হত্যার জায়গায় নিজেরাই উপস্থিত হতো।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৫৪)
“পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোনো বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এজন্যে বলা হয়, যাতে তোমরা যা হারাও তজ্জন্যে দু:খিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তজ্জন্যে উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (৫৭/সূরা হাদীদ:২২-২৩)

বাস্তব জীবনে তাকদীরে বিশ্বাসের উপকারিতা:
তাকদীরে বিশ্বাস অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও প্রতিযোগিতা ইত্যাদি কমিয়ে সুখ-শান্তি এনে দিতে পারে। তখন মানুষ অন্য জীবিকা হরণকারী ভাববে না এবং এভাবে সংঘাত থেকে মুক্ত থাকবে। রাসূল (সা.) বলেন:
“কিয়ামাত পর্যন্ত যতো সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া নির্ধারিত রয়েছে তারা ভূমিষ্ঠ হবেই।” (বুখারী, বিয়ে সংক্রান্ত অধ্যায়)
“কোনো মহিলার পক্ষে এটা বৈধ নয় যে, সে তার অপর বোন (বা সতীন) কে তালাক দেওয়ার দাবি জানাবে যাতে তার নিজের অধিকার ও ভোগবিলাসে অন্য কেউ ভাগ না বসায় এবং জীবিকার পেয়ালা সে একচেটিয়াভাবে ভোগ করতে পারে। কেননা তার জন্য যা বরাদ্দ করা রয়েছে, সে কেবল তাই ভোগ করতে পারবে।” (বুখারী, বিয়ে সংক্রান্ত অধ্যায়)
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা তাকদীরের বাস্তব ও নৈতিক সার্থকতা ও উপকারিতার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তার দার্শনিক তত্ত্বের (গোলকধাঁধার) দিকে মনোনিবেশ করেছি।
কুরআন আমাদেরকে অতিপ্রাকৃতিক তথা ইন্দ্রিয়াতীত ত্ত্ত্ব ও তথ্য (এর পুরো রহস্য) শিক্ষা দেওয়ার জন্য নাযিল হয়নি। রাসূলও (সা.) (বিপরীতধর্মী) দর্শনের অধ্যাপনা করার জন্য আসেননি। আমরা আমাদের জীবনের বাস্তব সমস্যাবলী বাদ দিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতে আদৌ লাভজনক নয় এমন সব ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে দিই- এটা কখনো আল্লাহ ও রাসূলের কাছে অভিপ্রেত নয়।

বৈপরীত্যের অভিযোগ কতটুকু সত্য:
যদি বিভিন্ন জিনিসকে কোনো জিনিসের কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয় তবে সে ক্ষেত্রে একটিকে আরেকটির বিপরীত বলা যায় কেবল তখনই যখন ঐ জিনিসের একটি মাত্র কারণ থাকে।
যদি কখনো বলা হয় ‘দেশটিকে রাজা জয় করেছে’; আবার যদি বলা হয় ‘সেনাপতি জয় করেছে’; আবার যদি বলা হয় ‘সেনাবাহিনী জয় করেছে’; আবার যদি বলা হয় ‘অমুক সাম্রাজ্য কর্তৃক বিজিত হয়েছে’; আবার যদি কখনো সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিককে বিজয়ের কৃতিত্ব দেওয়া হয়, তাহলে এ সব কথাকে পরস্পরবিরোধী বলা চলে না। কেননা বিজয়ের কৃতিত্ব এদের সকলেরই প্রাপ্য। কেউ যদি শুধুমাত্র এসবের কোনো একটিকেই নির্দিষ্টভাবে বিজয়ের কারণ বলে আখ্যায়িত করে, তাহলে তার অভিমতকে ভ্রান্ত বলতে হবে।
কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে একদিকে বান্দা এক ধরনের স্বাধীন কর্মক্ষমতা ও ইচ্ছা কাজে লাগায়। আর এক দিক দিয়ে তা আল্লাহর কাজ। কেননা আল্লাহ নিজ পরিকল্পনার অধীনে বান্দার মধ্যে ইচ্ছা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সৃষ্টি করেছেন এবং স্বাধীনভাবে সেই ইচ্ছা প্রয়োগ করার শক্তি যুগিয়েছেন।
হাদীসে বলা হয়েছে, “নিয়ত দ্বারাই কাজের গুণাগুণ নির্ধারিত হয়।” উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি পথে একটা টাকা পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলেন। তার তুলে নেওয়াটা নিছক একটি তৎপরতা। একে যাচাই ছাড়া ভালো বা মন্দ কোনোটিই বলার অবকাশ নেই। কিন্তু অন্যের টাকাকে বিনা অধিকারে ভোগ করার লক্ষ্য থাকলে কাজটি খারাপ। আর মালিককে খুঁজে তাকে টাকাটা ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকলে সেটা ভালো কাজ। প্রথম ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা, শয়তানের প্ররোচনা এবং ব্যক্তির নিয়ত সক্রিয় থাকবে এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকবে আল্লাহর সহযোগিতা ও ব্যক্তির ইচ্ছা। তবে এটা কোনো ক্রমেই বুঝে ওঠা সম্ভব নয় যে, কাজ সম্পাদনে এসব কারণের কোনটি কতটুকু কার্যকর ভূমিকা ও প্রভাব রেখেছে।
কেউ স্রষ্টার কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত প্রবল বাছ-বিচার ক্ষমতা, প্রখরতর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, আল্লাহর গুণগুলোর প্রতি অধিকতর আকর্ষণ এবং শয়তানী কুপ্ররোচনা প্রতিরোধের তীব্রতর শক্তি নিয়ে এসেছে। আবার কেউবা এসব পেয়েছে স্বল্প মাত্রায়। আর এসব বৈশিষ্ট্যের পরিমাণগত তারতম্যের ওপরই কাজ-কর্মে মানুষের ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের কম-বেশি হওয়া নির্ভরশীল।
কাজেই, মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের জন্য বিভিন্ন কারণ বা উপকরণ এর সবগুলোকে দায়ী করতে হবে, অথবা কখনো এক কারণকে কখনো অন্য কারণকে দায়ী করতে হবে অথবা একটি কারণকে দায়ী করে অন্য কারণকে দায়ী নয় বলে প্রমাণ করতে হবে। কুরআনে বিভিন্ন কারণকে সক্রিয় বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন:
যেসব আয়াতে আল্লাহকে সকল কাজের কর্তা সাব্যস্ত করা হয়েছে
“যদি আল্লাহ তাঁর সকল বান্দাকে প্রচুর রিযিক দিতেন, তবে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতো। কিন্তু তিনি যে পরিমাণ ইচ্ছা সে পরিমাণ নাযিল করেন।” (৪২/সূরা আশ শুরা:২৭)
যেসব আয়াতে বান্দাকে কাজের কর্তা বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে
“আল্লাহ কোনো সত্তাকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেন না। সে যা উপার্জন করে তার সুফল বা কুফল সে নিজেই ভোগ করবে।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৮৬)
যেসব আয়াতে ভালো কাজের কৃতিত্ব বান্দাকে প্রদান করা হয়েছে
“আর যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে, আল্লাহ তাদের পুরোপুরি প্রতিদান তাদেরকে দেবেন। তিনি অন্যায়কারীদের পছন্দ করেন না।” (৩/সূরা আলে ইমরান:৫৭)
যেসব আয়াতে আল্লাহ খারাপ কাজ হতে দিয়েছেন মর্মে উপস্থাপন করা হয়েছে
“আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য তুমি কখনো পথ পাবে না।” (৪/সূরা আন নিসা:৮৮)
যেসব আয়াতে খারাপ কাজের জন্য শয়তানকে দায়ী করা হয়েছে
“শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে লজ্জাকর কাজ করতে প্ররোচিত করে।” (২/সূরা আল বাকারাহ:২৬৮)
যেসব আয়াতে খারাপ কাজের জন্য বান্দাকে দায়ী করা হয়েছে
“আর যারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে এবং আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে তারা দোযখের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৪৯)
যেসব আয়াত মতে ভালো কাজের সূচনা হয় মানুষের পক্ষ থেকে এবং পূর্ণতা দেওয়া হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে
“আর যে ব্যক্তি তাঁর প্রতি অনুগত হয় তাকে তিনি স্বীয় পথ দেখিয়ে দেন। (১৩/সূরা আর রাদ:২৭)
যেসব আয়াত মতে খারাপ কাজের সূচনা হয় মানুষের পক্ষ থেকে এবং পূর্ণতা দেওয়া হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে
“যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাবো যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।” (৪/সূরা আন নিসা:১১৫)
যেসব আয়াতে মানুষ কর্তৃক গুনাহ করার দায় আল্লাহর উপর চাপানো হয় এমন ধারণার খন্ডন করা হয়েছে
“তারা বলে, রহমান আল্লাহ ইচ্ছা না করলে আমরা ওদের পূজা করতাম না। এ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। তারা কেবল অনুমানে কথা বলে।” (৪৩/সূরা যুখরুফ:২০)
যেসব আয়াতে মানুষ নিজের চেষ্টাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে তাকদীরকে অস্বীকার করে সেখানে তা খন্ডন করা হয়েছে
“তারা বলে থাকে যে, আমরা যদি কিছু কলা-কৌশল খাটাতে পারতাম তাহলে এখানে খুন হতাম না। তুমি বলে দাও যে, তোমরা যদি নিজ নিজ ঘরেও থাকতে তবুও যাদের ভাগ্যে হত্যা লেখা ছিলো, তারা নিজ নিজ হত্যার জায়গায় নিজেরাই উপস্থিত হতো।” (৩/সূরা আলে ইমরান:১৫৪)

রহস্য উন্মোচন:
মানুষের জীবনে প্রতিটি কাজে স্বাধীনতা ও অধীনতা কতটা আছে তা নির্ণয় করার পরই ন্যায়বিচার সম্ভব। আর এ নির্ণয় করাটা আল্লাহর পক্ষে সহজ কিন্তু বান্দার পক্ষে তা অসম্ভব।

সৃষ্টিজগতে মানুষের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবস্থান:
মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষ ও জ্বীন ছাড়া অন্য সৃষ্টি জন্মগত ও স্বভাবগতভাবে আনুগত্যশীল (অবশ্য জ্বীনেরা খিলাফাতের মর্যাদা প্রাপ্ত নয়)।
বাছ-বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা (তথা বিবেক) অন্য সৃষ্টির মাঝে নেই। তাদের মধ্যে ফেরেশতারা শ্রেষ্ঠতম। ফেরেশতারা আল্লাহর অবাধ্য হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তাদেরকে যা কিছু আদেশ করেন, তারা তার অবাধ্য হয় না। যা করতে বলা হয় তারা অবলীলাক্রমে তাই করে।” (৬৬/সূরা আত তাহরীম:৬)
অনুরূপভাবে আকাশে বিরাজমান বিশালকায় বস্তুরাজিও আল্লাহর সম্পূর্ণ অনুগত। আল্লাহ বলেন, “আপন প্রতিপালকের আনুগত্যের ব্যাপারে তারা দাম্ভিকতাও প্রদর্শন করে না, ক্লান্তও হয় না। দিন রাত তাসবীহ করে, একটুও বিশ্রাম নেয় না।” (২১/সূরা আম্বিয়া:১৯-২০)
আল্লাহ স্বীয় সৃষ্টির আধুনিকতম সংস্করণ প্রকাশ করলেন, যার নাম মানুষ। আল্লাহ বলেন, “আমি আমানাতকে (অর্থাৎ খেলাফতির বা প্রতিনিধিত্বের গচ্ছিত বিষয়কে, সম্পদকে বা দায়িত্বকে) আকাশমণ্ডল, পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বতের সামনে পেশ করেছিলাম (এটা আল্লাহ ও তার সৃষ্টির মধ্যকার বিষয় যা অনুধাবন সকলের জন্য সম্ভব নয়। আবার বিষয়টা রূপকও হতে পারে)। কিন্তু তা তারা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলো না বরং তারা ভয় পেয়ে গেলো। মানুষ তা (বা সেই দায়িত্ব) নিজের কাঁধে তুলে নিলো। (এ দায়িত্ব নেওয়ার পরও যারা তার মর্যাদা বুঝল না এবং পালন করল না) সে মানুষগুলো বড় ধরণের জালেম ও বড় ধরনের মূর্খ।” (৩৩/সূরা আল আহযাব:৭২) এ দায়িত্বটি কি ছিলো? আল্লাহর জ্ঞান, শক্তি, নির্বাচনী ক্ষমতা, ইচ্ছা ও শাসন প্রভৃতি গুণ-বৈশিষ্ট্যের একটি প্রতিবিম্ব। এ দায়িত্ব আর কাউকে দেওয়া হয়নি। এটা বহন করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা না ছিলো ফেরেশতার, না ছিলো আকাশের বিশাল বিশাল আলোকপিন্ডের, না পাহাড়-পর্বতের, না পৃথিবীর আর কোনো সৃষ্টির।
আল্লাহ বলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলিফা নিযুক্ত করতে চাই।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১৩) মানুষকে জন্মগতভাবে অনুগত ও বশীভূত করা হয়নি। আল্লাহ বলেন, “তোমার প্রভু যদি ইচ্ছা করতেন তবে পৃথিবীর সকলেই ঈমান আনতো।” (১০/সূরা ইউনুস:৯১) আল্লাহ আরও বলেন, “আল্লাহ যদি চাইতেন তবে কেউ শিরক করতো না।” (৬/সূরা আল আনআম:১০০) এসব আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, মানুষকে বল প্রয়োগে শিরক থেকে ফিরিয়ে রাখা ও তাওহীদে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা স্বয়ং আল্লাহর মনোপুত নয়। অর্থাৎ, মানুষ একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে বাধ্যতামূলক আনুগত্য থেকে মুক্ত। সেখানে এতোটুকু ক্ষমতা তার রয়েছে যে, ইচ্ছা হলে আনুগত্য করতে পারে; ইচ্ছা হলে অবাধ্যতা ও নাফরমানীও করতে পারে।
পশু-পাখির ক্ষেত্রে বলা হয়নি যে তারা পূর্ণভাবে আনুগত্যের পুরস্কার বা নাফরমানীর শাস্তি পাবে। বরং মানুষের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, “তারা আপন প্রভুর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলো।” (৭/সূরা আল আরাফ:৭৭) আরও বলা হয়েছে যে, “তারা আমার ওপর জুলুম করে না। বরং নিজেদের ওপরই জুলুম করে।” (৭/সূরা আল আরাফ:১৬০)

হিদায়াতি ও গোমরাহী:
ন্যায় ও অন্যায়ের বাছ-বিচার ক্ষমতা মানুষের প্রকৃতিতেই গচ্ছিত রাখা হয়েছে। কুরআনে ঘোষণা, “মানুষকে আল্লাহ পাপাচার ও সদাচার উভয়েরই প্রচ্ছন্ন জ্ঞান দিয়েছেন।” (৯১/সূরা আশ শামস:৮) “আমি তাকে উভয় পথই দেখিয়ে দিয়েছি।” (৯০/সূরা আল বালাদ:১০) “যার ইচ্ছা হয় আপন প্রভুর পথ অবলম্বন করুক।” (৭৬/সূরা আদ দাহর:২৯) “যার ইচ্ছা হয় ঈমান আনুক, যার ইচ্ছা হয় কুফরী করুক।” (১৮/সূরা কাহফ:৪৯) “সে (ইবলিস) বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পৃথিবীতে নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করবো এবং তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেবো।” (১৫/সূরা হিজর:৩৯) “তাদের কাছে তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট নিদর্শন, পুস্তিকাসমূহ এবং আলোকময় কিতাবসমূহ নিয়ে এসেছিলেন।” (৩৫/সূরা ফাতির:২৫)
মানুষ যদি খারাপ পথ বেছে নেয় তাহলে আল্লাহ তার ভাগ্যে নির্ধারিত প্রাকৃতিক শক্তি সমূহ ও ঐসব পারিপার্শ্বিক উপকরণগুলোকে তার অনুগত করে দেন এবং ঐ পথটাকে তার জন্য সহজ করে দেন। আল্লাহ বলেন, “অতএব, যে দান করে এবং আল্লাহভীরু হয় এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করবো। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের জন্যে সহজ পথ দান করবো।” (৯২/সূরা আল লাইল:৫-১০)
যে ব্যক্তি গোমরাহী অবলম্বন করে, তার বিবেকে তখনো একটা ‘খোদায়ী’ শক্তি বিদ্যমান থাকে যা তাকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান জানাতে থাকে। কিন্তু যখন সে বিভ্রান্তির ওপর বহাল থাকার জন্য জিদ ধরে, তখন ঐ শক্তি ক্রমে দুর্বল হয়ে যেতে থাকে এবং গোমরাহীর ব্যাধি ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। আল্লাহ বলেন, “তাদের মনে একটা ব্যাধি রয়েছে। অত:পর আল্লাহ তাদের ব্যাধিকে বাড়িয়ে দিলেন।” (২/সূরা আল বাকারাহ:১০) “আল্লাহ তাদের মনে ও কানে সিল মেরে দিয়েছেন। আর তাদের চোখ পর্দায় আচ্ছাদিত।” (২/সূরা আল বাকারাহ:৭)
অবশ্য, একথা মনে করা ঠিক নয় যে, মানুষের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা সীমাহীন। আল্লাহ বলেন, “আমি যে জিনিসই সৃষ্টি করেছি, একটি পরিকল্পনার অধীনে সৃষ্টি করেছি।” (৫৪/সূরা আল কামার:৪৯) আল্লাহ বলেন, “তিনি স্বীয় বান্দাদের ওপর পরাক্রান্ত।” (৬/সূরা আল আনআম:১৮)

ন্যায়বিচার ও কর্মফল:
সত্যিকার ন্যায়বিচার করা আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা যে সীমার মধ্যে মানুষ স্বাধীনতা ভোগ করে, সেটা আল্লাহ নির্ধারিত সীমা। মানুষের কাজ-কর্মে তার স্বাধীন ইচ্ছার ভূমিকা ও অবদান কতটুকু, তা শুধু আল্লাহই জানেন। দুনিয়ার কোনো জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন, “সেদিন একেবারে নির্ভুল পরিমাপ করা হবে।” (৭/সূরা আল আরাফ:৮) আল্লাহ আরও বলেন, “তাদেরকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে এবং হিসেব নেওয়া আমারই দায়িত্ব।” (৮৮/সূরা আল গাশিয়া:২৫-২৬)
আকিদা শাস্তবিদরা এবং দার্শনিকরা যেসব অতি প্রাকৃতিক সমস্যায় দিশেহারা, যেমন আল্লাহর জ্ঞান এবং তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত জিনিসসমূহ, তাঁর ক্ষমতা ও ক্ষমতার আওতাধীন জিনিসসমূহ এবং তাঁর ইচ্ছা ও ইচ্ছাধীন জিনিসসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক কিরূপ, আর তার পূর্বজ্ঞান, চিরন্তন ইচ্ছা এবং নিরংকুশ ক্ষমতার উপস্থিতিতে মানুষ কিভাবে স্বাধীন ইচ্ছা ও ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে, এ জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে কুরআন কোনো আলোচনাই করেনি; কেননা তা বুঝার ক্ষমতা মানুষের নেই।

অদৃষ্ট (বা ভাগ্যের) রহস্য:
আমরা কি দুনিয়ার রঙ্গমঞ্চে এমন কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রী, যার ভূমিকা (বা ভাগ্য) আগে থেকেই কেউ নির্ধারণ করে রেখেছে? আপনি জবাবে ‘হাঁ’ বা ‘না’ যেটাই বলেন, তা থেকে আরো অসংখ্য প্রশ্ন জন্ম নেবে, যার জবাব ‘হাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না।
আপনি যদি ‘হাঁ’ বলেন তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে, পাথর, লোহা, গাছ ও ইতর প্রাণীর সাথে মানুষের কোনো সত্যিকার পার্থক্য নেই। আপনি যেমন ‘সৎ মোটর গাড়ি’, ‘অভদ্র যন্ত্র’, ‘ঈমানদার ইঞ্জিন’, ‘বদমাশ ল্যাপটপ’ ইত্যাদি বলেন না, তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও সৎ ও অসৎ, ভদ্র ও অভদ্র, ঈমানদার ও বেঈমান ইত্যাদি বলাও আপনার ক্ষেত্রে শোভা পায় না।
ধর্ম ও নৈতিকতার যে রেওয়াজ আমাদের সমাজে রয়েছে, আইন ও আদালতের যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত, জেল, পুলিশ ও অপরাধ তদন্তের যে বিভাগগুলো আমরা কর্মরত দেখতে পাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং সংস্কার ও সংশোধনকামী যেসব প্রতিষ্ঠানের আওতায় আমাদের সমাজ কাঠামো গঠিত, তার সবই তাহলে নিরর্থক ও বৃথা হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে যে ব্যক্তি নিভৃতে ইবাদাত বা উপাসনা করে এবং যে ব্যক্তি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে অন্যের ঘরে সিঁদ কাটে, এরা উভয়ে এই তামাশায় কেবল নির্ধারিত ভূমিকায় অভিনয় করে চলছে (যেমনে নাচাও তেমনে নাচি)।
তাহলে কি আপনি ‘না’ সূচক জবাব দেবেন? তখন সম্ভবত আপনি এ কথাই বুঝাতে চান যে, মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, মানুষ শব্দের অর্থ কি? ব্যক্তিগতভাবে এক একজন মানুষ? না সমগ্র মানবজাতি?
আপনার কথার অর্থ যদি এটা হয়ে থাকে যে, প্রতিটি মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে, তাহলে যে জিনিসগুলোর সাহায্যে ভাগ্য তৈরি হয় তার দিকে একটু তাকান। তারপর বলুন যে, এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
প্রতিটি মানুষ আপন বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে এবং সেগুলো তার ভাগ্যের ভাঙ্গা গড়ায় যথেষ্ট অবদান রাখে। আবার যে পরিবারে, যে সমাজে, যে শ্রেণীতে, যে জাতি বা সম্প্রদায়ে এবং যে দেশে সে জন্ম নেয় তার মানসিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার অপরিসীম প্রভাব দুনিয়ায় আসা মাত্রই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এ সকল জিনিস তার ভাগ্য গড়ায় অবদান রাখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন কোনো মানুষ কি পৃথিবীতে আছে, যে কোন বংশে, কোন প্রজন্মে ও কোন পরিবেশে জন্ম নেবে, তা নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী নির্ধারণ করেছে এবং কার কোন প্রভাব গ্রহণ করবে, সেটা নিজেই স্থির করেছে? অনুরূপভাবে দুনিয়ার বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনার ভালো-মন্দ প্রভাব মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, আবহাওয়া, রোগ-ব্যাধি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থনৈতিক উত্থান-পতন, আকস্মিক দুর্ঘটনা প্রভৃতি বেশি ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের জীবনধারা পাল্টে দেয়। সুতরাং মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে থাকে, এ কথা কিভাবে স্বীকার করে নেওয়া সম্ভব?
হয়তো বলবেন যে, ব্যক্তি নয়, বরং জাতি নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে। কিন্তু এ কথাও মেনে নেওয়ার যোগ্য নয়। যেসব উপায়-উপকরণের বলে প্রত্যেক জাতির ভাগ্য তৈরি হয়, তাতে বংশীয় ও প্রজন্মগত বৈশিষ্ট্য, ঐতিহাসিক প্রভাব, ভৌগোলিক অবস্থা, প্রাকৃতিক সমস্যাবলী এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির যথেষ্ট হাত থাকে। এসব উপায়-উপকরণের প্রভাব মুক্ত হয়ে নিজের ভাগ্য নিজের ইচ্ছা মতো গড়া কোনো জাতির পক্ষেই সম্ভব নয়। তাছাড়া যে প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে আকাশ ও পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা চলছে এবং যাতে হস্তক্ষেপ করা দূরের কথা, তার নিগূঢ় রহস্য পুরোপুরি জানাও কোনো জাতির পক্ষে সম্ভব নয়, সেই প্রাকৃতিক নিয়ম বিভিন্ন জাতির ভাগ্যের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, তা রোধ করা বা তা থেকে আত্মরক্ষা করার শক্তি কোনো জাতির নেই।
একটি জাতির উপযুক্ত নেতৃত্ব লাভ এবং সেই নেতৃত্ব দ্বারা লাভবান হওয়ার জন্য সেই জাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে যে গুণাবলী থাকা জরুরী, তার উপস্থিতি- এ দু’টো জিনিসের ওপর একটি জাতির ভাগ্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা এমন কোনো সাক্ষ্য পাইনা এবং চলমান যুগের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকেও আমরা এমন কোনো দৃষ্টান্ত পাইনা যে, কোনো জাতির এ দু’টো উপকরণ অর্জন করতে নিজের ইচ্ছা ও পছন্দকে স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে।
এরপর কি আপনি জাতিগুলোকে বাদ দিয়ে সমগ্র মানবজাতি সম্পর্কে এই সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করবেন যে, সে সামগ্রিকভাবে নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে থাকে? বিশাল মানবজাতির কি বিশেষ বা একই ধরণের সামগ্রিক ইচ্ছা বলে কিছু আছে? তাহলে সেই ইচ্ছার আলোকে ভাগ্য গড়াটা কি বিস্ময়কর ধারণা নয়? তাই আপনার এ মতে অবিচল থাকার আর কোনো উপায় থাকে না যে মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে।
কাজেই ভাগ্য গড়ায় মানুষ স্বাধীন কিনা এর জবাব ‘হাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ প্রকৃত সত্য এই দুই জবাবের মাঝখানের কোনো এক স্থানে অবস্থিত, যেটি মানুষের অজানা।
যে মহা-প্রতাপান্বিত ইচ্ছাশক্তি বিশ্বজগতের গোটা ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে, তার আওতা থেকে মুক্ত হয়ে কোনো জিনিসই দুনিয়াতে কোনো কাজ করতে সক্ষম নয়। কাজ করা দূরে থাক, আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেও সক্ষম নয়।
বাস্তবিক পক্ষে দুনিয়াতে আমাদেরকে সীমিত পর্যায়ে কিছু স্বাধীনতা দান করা হয়েছে এবং এই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করার ব্যাপারেও আমাদেরকে উপযুক্ত পরিমাণে স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বনির্ভর করা হয়েছে। এই স্বাধীনতা ও স্বয়ম্ভরতা আমরা অর্জন করিনি, আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। এর পরিমাণ কতটুকু, এর সীমারেখা কি এবং এর ধরন ও প্রকৃতি কি, তা নির্ণয় করা শুধু কঠিন নয় বরং অম্ভব। কিন্তু এই স্বাধীনতা যে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না।
বিশ্বনিখিলের মহাপরিকল্পনায় আমাদের জন্য এতটুকু স্থানই বরাদ্দ করা হয়েছে যে, আমরা যেনো একটা সীমাবদ্ধ পর্যায়ে স্বাধীনভাবে কর্মরত অভিনেতার ভূমিকা পালন করি। এই মহাপরিকল্পনায় আমাদের জন্য যতোটুকু স্বাধীনতার অবকাশ আছে, ততোটুকু স্বাধীনতাই আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। আর যে পরিমাণ স্বাধীনতা আমরা ভোগ করি, প্রকৃতপক্ষে আমাদের নৈতিক দায়-দায়িত্বও ঠিক ততোটুকু। অদৃষ্ট প্রশ্নে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই।
(এ অংশের সূত্র: ১৯৪২ সালের ২৩ অক্টোবর লাহোর বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কথিকা)
পুরো লেখার মূল উৎস: তাকদীরের হাকীকত, অনুবাদ: আকরাম ফারুক, সম্পাদনা: আবু রামিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:১৭
৪৫৬ বার পঠিত
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এক্স লইয়া কি করিব

লিখেছেন আনু মোল্লাহ, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইলিশনামা~ ১

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন

৯০% মুসলমানের এই দেশ? ভারতে কতগুলো মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হয়েছে? গতকালও ভারতে মসজিদের পক্ষে থাকায় ৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪২

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD

লিখেছেন আজব লিংকন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩



শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি

লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী শান্তু, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮



আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×