আল্লাহ ও রাসূলকে অপমান বা এ জাতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে মুসলিমদের করণীয়:
১.ব্যক্তির উচিত প্রতিবাদ করা। নিজ হাত দ্বারা, তদক্ষমে জিভ দ্বারা, তদক্ষমে অন্তর (বা পরিকল্পনা) দ্বারা প্রতিবাদ করতে হবে। (মুসলিম)
২.ইসলামী শাসন থাকলে শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না।
৩.ইসলামী শাসন না থাকলে যথাসম্ভব তাকে উপদেশ দিতে থাকবে। অপরাধীর অপরাধের কারণে অন্তর ফেটে পড়বে ঠিকই কিন্তু ধৈর্যধারণ করবে এবং আবেগবশে এমন কিছু করে বসবে না যা তার জন্য বৈধ নয়।
৪.দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য বৈধ নয়। মাক্কী জীবনে বসবাস করলে মাক্কী জীবনের মতো ধৈর্যধারণ করে বসবাস করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের এবং অংশীবাদী (মুশরিক) দের কাছ থেকে অবশ্যই তোমরা অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনতে পাবে। সুতরাং যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং সংযমী হও, তাহলে তা হবে দৃঢ়সংকল্পের কাজ। (৩/আলে ইমরান:১৮৬)আল্লাহ আরও বলেন, “সুতরাং তোমরা ক্ষমা কর ও উপেক্ষা কর; যতক্ষণ না আল্লাহ কোন নির্দেশ দেন।” (২/আল বাকারাহ:১০৯)
৫.এ সকল উপদেশ শুনে অনেক আবেগী যুবক উপদেশদাতাকে কাফির, মুনাফিক ও নাস্তিকদের দালাল বলে থাকে। তারা যা বলে, তা মনের আবেগবশে বলে। কিন্তু যে আবেগের শরয়ী লাগাম নেই, সে আবেগ নিয়ে বেগ পেতে হয় পথে-পথে, পদে-পদে। তারাই যেন ইসলামী শাসনের একচ্ছত্র ঠিকাদারী পেয়ে বসে আছে!
৬.ইসলামে মানুষ খুন করাই উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, মানুষকে হিদায়াত করা। আর তাও আবার আল্লাহর হাতে আছে।
৭.মহানবী (সা.) হাতের কাছে পেয়েও অপরাধীকে হত্যা করেননি। আর যখন ক্ষমা করেননি, তখন তিনি রাষ্ট্রনেতা হয়ে শাস্তি প্রদান করেছেন। আর এ ধরণের আবেগী যুবক তো ইসলামী রাষ্ট্রনেতা হওয়া দূরের কথা রাষ্ট্রনেতার কাছ থেকে ভারপ্রাপ্তও নয়। সুতরাং যে কাজে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি আছে, তা আবেগবশে না করাই জ্ঞানীর কাজ।
৮.তাওহীদবাদী মানুষ গঠন করুন। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জাতি ও দেশ গড়ুন এবং সেই মানুষদের দাবীতেই ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তুলুন। তারপর ইসলামী দণ্ডবিধি প্রয়োগ করুন। আল্লাহ বলেন, “ফিতনা (অশান্তি, শিরক, ধর্মদ্রোহিতা, বিপর্যয়) হত্যার চেয়েও গুরুতর। (২/আল বাকারাহ:১৯১)
৯.ক্ষমতায় আসার আগে নির্ভেজাল ইসলাম প্রচারের কার্যক্রম চালাতে না পারলে এবং ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে শিরকের আখড়া ভাঙ্গার সংকল্প করলে শাসনক্ষমতা টেকানোই মুশকিল হয়ে পড়বে।
১০.ইসলামী জিহাদের শর্তাবলী পূরণ ও পালন করে তার পথ ধরুন। নচেৎ জিহাদের নামে এককভাবে এমন কোন কাজ করবেন না, যাতে ইসলাম ও মুসলিমদের বদনাম হয় এবং মানুষের কাছে ইসলাম ও মুসলিমরা ঘৃণ্য রূপে পরিচিত হয়।
১১.সশস্ত্র জিহাদ সকলের জন্য ও সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য নয়। বরং অন্য বিভিন্ন জিহাদ আছে যা সর্বাবস্থায়ই করতে হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “..যে ব্যক্তি তাদের (যারা আদেশের বিপরীতে চলে তাদের) বিরুদ্ধে নিজ হাত দ্বারা সংগ্রাম করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে জিভ দ্বারা সংগ্রাম করবে সে মুমিন এবং যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে অন্তর দ্বারা জিহাদ করবে সে মুমিন।” (মুসলিম, ১৮৮ নং)
১২.আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, আমি আম্মাকে ইসলামের দাওয়াত দিতাম। তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। একদিন তাকে দাওয়াত দিলে তিনি আমাকে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর ব্যাপারে এমন কথা শুনালেন, যা আমার পছন্দ ছিল না। সুতরাং আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) এর কাছে কাঁদতে কাঁদতে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.).. আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন, যাতে তিনি আবু হুরাইরার আম্মাকে হিদায়াত করেন।.. সুতরাং আল্লাহর নবী (সা.) এর দুআতে সুসংবাদ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।.. আম্মা.. বলে উঠলেন,.. আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্যিকার ইলাহ নেই এবং এও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল।.. (আমি) বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সুসংবাদ নিন। আল্লাহ আপনার দুআ কবুল করেছেন এবং আবু হুরাইরার আম্মাকে হিদায়াত করেছেন।.. (মুসলিম:৬৫৫১ নং)প্রশ্ন ওঠে রাসূলকে কটুক্তি করায় আবু হুরাইরা কি আম্মাকে শাসন করা বা হত্যা করার চিন্তাও করেছিলেন?
১৩.আল্লাহ বলেন, “.. যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর কোন আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে বিদ্রূপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত না হয় তোমরা তাদের সাথে বসো না, নচেৎ তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে।..। (৪/আন নিসা:১৪০)এ আয়াতে আল্লাহ কি বলেছেন- আঘাত বা প্রত্যাঘাত করতে?
১৪.কবি বলেন, “রাসূলের অপমানে যদি কাঁদে না তোর মন, মুসলিম নয়, মুনাফিক তুই রাসূলের দুশমন।” এখানে কনি রাসূলের অপমানে মন ব্যথিত হবার কথা বলেছেন, অপমানকারীকে ব্যক্তি উদ্যাগে হত্যার কথা বলেননি। তাই, খবরদার! আবেগ ও রাগবশে মহান আল্লাহর দণ্ডবিধি নিজেই প্রয়োগ করে বসবেন না। নচেৎ তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। যেহেতু ব্যক্তি পর্যায়ে দণ্ড প্রয়োগের বৈধতা থাকলে বিশাল বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে সমাজে। নির্বিচারে খুন হবে বহু মানুষ। সুতরাং ধৈর্য সহকারে অন্যান্য বৈধ পন্থা অবলম্বন করুন।
দণ্ডবিধি প্রয়োগ করবে শাসক:
১.ইসলামে যে সকল অপরাধের কিসাস ও হুদুদ (দণ্ডবিধি) আছে, তা প্রয়োগ করবে একমাত্র ক্ষমতাসীন শাসক। খুনের বদলে খুন, বিবাহিত ব্যভিচারীকে হত্যা, মুর্তাদকে হত্যা, চোরের হাত কাটা ইত্যাদি শাস্তি কোন সাধারণ লোক (পাবলিক) দিতে পারে না। যেহেতু সকলেই নিজ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী বিচার করে দণ্ড দিতে থাকলে পরিবেশে বিশাল বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেবে। সবল দুর্বলকে ধ্বংস ও বিনাশ করে ছাড়বে।
২.অবশ্য অপরাধী যদি অধিকারভুক্ত দাসী বা ক্রীতদাস-দাসী হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে শাসকের অনুমতি না নিয়ে দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার বৈধতা আছে মালিকের (ব্যাখ্যা সাপেক্ষ ও মতভেদপূর্ণ)। উল্লেখ্য, অধিকারভুক্ত দাস-দাসীর বিষয়টি এ মুহূর্তে আমাদের মাঝে বিদ্যমান নেই। বিদ্যমান থাকলেও তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার আগে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ধরন, প্রচলিত আইন, বর্তমান শাসকের চরিত্র ইত্যাদি বিষয়কে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
৩.বহু আবেগী মানুষ আছে, যারা সাধারণ নাগরিক হয়ে খলিফা উমার সাজতে চায়। খলিফা না হয়ে খলিফার শাস্তি প্রয়োগ করতে চায় স্বাধীন মানুষদের উপর। অবশ্য তাদের কিছু দলীলও আছে (যদিও তা অগ্রহণযোগ্য)।
৪.আল্লাহ বলেন, “তারা মুমিন হতে পারবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারাভার তোমার (অর্থাৎ রাসূলের- যিনি শাসক ও বিচারক ছিলেন) উপর অর্পণ না করে, তারপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়।” (৪/আন নিসা:৬৫)
৫.সাধারণত আল্লাহর রাসূল (সা.) এর অভ্যাস ছিল এই যে, তাঁর বিচারে কেউ সন্তুষ্ট ও সম্মত না হলে তিনি খুব রাগান্বিত হতেন এবং তাকে ধমক দিতেন। (বুখারী ২৩৬০ নং, মুসলিম ৬২৫৮ নং)
৬.বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, যদি কোন অপরাধী হত্যাযোগ্য হতো, তাহলে সাহাবাগণ রাসূল (সা.) এর কাছে হত্যা করার অনুমতি চাইতেন। যেমন: হাতেব বিন বালতায়া মক্কা অভিযানের খবর গোপনভাবে চিঠি লিখে মক্কার কুরাইশদের জানাতে চেয়েছিলেন। ধরা পড়লে উমার (রা.) বলেছিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দিই (বুখারী ৩০০৭ নং, মুসলিম ৬৫৫৭ নং)। শাসকের অনুমতি না নিয়েই আবেগে, রাগে, ক্ষোভে উমার (রা.) তলোয়ার চালিয়ে দেননি।
৭.হাদীসে বর্ণিত কোনো ঘটনাতেই একথার দলীল নেই যে, শাসনকর্তৃপক্ষ ছাড়া জনসাধারণ কোন দণ্ডবিধি কোন অপরাধীর উপর (অধিকারভুক্ত দাস-দাসীর ক্ষেত্র ছাড়া) প্রয়োগ করতে পারে। যেহেতু তাতে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি এবং বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাবনাই অধিক।
৮.সুতরাং ব্যক্তিবিশেষ কেউ কোন দণ্ডবিধি নিজের স্ত্রী-পরিবারের উপরেও প্রয়োগ করতে পারে না। স্ত্রীকে ব্যাভিচারে লিপ্ত দেখলে ঈর্ষায় তাকে হত্যা করতে পারে না। হিলাল বিন উমাইয়াহ মহানবী (সা.) এর কাছে অভিযোগ করলেন যে, তার স্ত্রী শারীক বিন সাহমার সাথে ব্যাভিচার করেছে। তিনি তাকে বললেন প্রমাণ উপস্থিত কর। নচেৎ তোমার পিঠে (চাবুক) দণ্ড প্রয়োগ করা হবে। (বুখারী ২৬৭১, ৪৭৪৭ নং) এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর বিধান হল, “যারা সাধ্বী রমণীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর স্বপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশি বার কশাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না; এরাই তো সত্যত্যাগী।” (২৪/আন নূর:৪) প্রচণ্ড ঈর্ষা ও ক্ষোভে কেউ হত্যা করে বসতে পারে। অথচ তা তার জন্য বৈধ নয়। সুতরাং প্রমাণ পেশ না করে খুন করলে ঈর্ষাবান খুনীকে খুনের বদলে খুন করা হবে। (আল-মুন্তাকা ১২২২ নং)
৯.কেউ দণ্ডনীয় অপরাধ করলে সে দণ্ড কোন সাধারণ লোক প্রয়োগ করবে না। বরং সে ঐ অপরাধের খবর শাসনকর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেবে। ইসলামী শাসন না থাকলে হত্যার ব্যাপারে সে নিজে তা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ইবনুল মুফলিহ বলেন, দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা রাষ্ট্রনেতা বা তার নায়েব ছাড়া অন্যের জন্য হারাম। (আল-মাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ ৫/২৮০)
সূত্র: নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ কুফরীর অঙ্গ- আবদুল হামীদ ফাইযী আল-মাদানী (বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ইসলামী গবেষক, লেখক, মুহাক্কিক আলিম ও দাঈ), সম্পাদনা: ইঞ্জিনিয়ার আবু রামিন।