দৈনিক আমার দেশ-এর ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে গত ৬ অক্টোবর দেশের দুই অসামান্য ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা জানানো হয়েছে। এঁরা হলেন ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নায়ক ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন—ভাষা মতিন নামে যিনি সমধিক পরিচিত। অন্যজন হলেন হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ—প্রিয়জনদের কাছে যিনি পরিচিত ‘ফেব্রুয়ারির ফেরারী পাখি’ হিসেবে।
সম্মাননা প্রদান উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের বক্তারা শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। একই সঙ্গে তারা বলেন, জনগণের অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে আমার দেশ। ক্ষমতার আসনে যারাই থাক না কেন, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় সংগ্রাম-লড়াই অব্যাহত রাখবে আমার দেশ। এখানে আমন্ত্রিত অনেকেই রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাই আমার দেশ আজ যেন নির্যাতিত মজলুমের মেলায় পরিণত হয়েছে।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদক সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আতাউস সামাদের ইন্তেকালের কারণে আমার দেশ কার্যালয়ের মিলনায়তনে সীমিত পরিসরে ৬ অক্টোবর বিকালে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফলে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ সবার আলোচনায়ই ছিল আতাউস সামাদকে শ্রদ্ধাবনত স্মরণ। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে তেলাওয়াত ও মরহুম আতাউস সামাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করেন ঐতিহাসিক আম্বর শাহ শাহী জামে মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা আতাউল্লাহ।
অনুষ্ঠানে আবদুল মতিনকে দেয়া সম্মাননাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ-এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ। আর কবি আল মাহমুদের সম্মাননাপত্র পাঠ করেন কবি আবদুল হাই শিকদার। আবদুল মতিনের হাতে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। কবি আল মাহমুদের হাতে সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন আতাউস সামাদের একমাত্র ছেলে আশেকুস সামাদ।
এই দুই গুণীর অনুভূতি প্রকাশের আগে উদ্বোধনী বক্তৃতায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
গুণীজন সংবর্ধনা শেষে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা হয়। আলোচনা সভার আগে ও পরে আমার দেশ-এর শুভানুধ্যায়ী, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমার দেশ এবং এর সম্পাদককে শুভেচ্ছা জানানো হয়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আগত অতিথিরা আলোচনায় অংশ নেন। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এতে সভাপতিত্ব করেন। পত্রিকার ফিচার সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ সভা পরিচালনা করেন। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, সময়ের সাহসী পুরুষ মাহমুদুর রহমান। তিনি শুধু সাহসী পুরুষই নন, সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারীও। আমরা আমার দেশ-এর সঙ্গে আছি, পাশাপাশি আছি। অনুপ্রেরণার জন্য থাকব। সংগ্রামী ও অগ্রগামী মতিন ভাইকে আমি সেই ১৯৫৩ সাল থেকে চিনি; আর আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, আতাউস সামাদ অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের সত্-সাংবাদিকতায় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন আজীবন। আমার দেশ সম্পাদক সম্পর্কে তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমান জেল জুলুম নির্যাতনে এখন খাঁটি সোনায় পরিণত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহ্বুবউল্লাহ্ বলেন, চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মাহমুদুর রহমান। মতিন ভাই দ্রোহের প্রতীক। মাহমুদ ভাই দেশের হৃদয়স্পন্দন। তিনি বলেন, আমার দেশ-এর যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, ভবিষ্যতেও থাকবে না। আশা করি দেশের অগ্রযাত্রায় আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান পরাজিত হবেন না।
সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন এই বয়সেও যে লড়াইয়ের স্পৃহা দেখিয়েছেন, তা তরুণদের আরও অনুপ্রাণিত করবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তিনি বলেন, চোর ধরা পড়লে ডাকাত হয়ে যায়। আমার দেশকে এখন লড়াই করতে হবে ডাকাতদের বিরুদ্ধে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট মাহফুজ উল্লাহ বলেন, আবদুল মতিন, আল মাহমুদ, আতাউস সামাদ এবং মাহমুদুর রহমান সবাই আমার প্রিয় মানুষ। তাদের সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার দেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমার দেশ আজীবন তার লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখুক।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম বলেন, আমার দেশ সবার পত্রিকা। আমি এর সঙ্গে আছি, থাকব। আর এ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আমার একজন প্রিয় মানুষ। ওনাকে আমি নতুন করে আবিষ্কার করি তার জেলে যাওয়ার পর থেকে। আবদুল মতিন ও আল মাহমুদ সম্পর্কে পিয়াস করিম বলেন, এই দু’জনই আমার স্বপ্নের পুরুষ।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, মতিন ভাই এবং আল মাহমুদের কাছ থেকে আমরা এখনও অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। তারা এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। আমার দেশ সম্পাদক সম্পর্কে তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমানের মতো এরকম কয়েকজন মানুষ পেলে আজ আমাদের এ অবস্থা হতো না।
বিশিষ্ট গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, সংগ্রামের একাগ্র নায়ক মাহমুদুর রহমান। আমার বিশ্বাস আমার দেশ হারবে না, আমাদের স্বাধীনতাও হারাবে না। হারানোর জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি।
জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, আবদুল মতিন ও কবি আল মাহমুদ যদি বাংলাদেশে না হয়ে অন্য দেশেও জন্ম নিতেন, সেখানেও তারা র্কীতিমান হতেন। আমার দেশ ও এর সম্পাদক সম্পর্কে প্রেস ক্লাব সভাপতি বলেন, আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান এখন দেশের ইতিহাসের অংশ। আশা করি ভবিষ্যতেও আমার দেশ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, আমার দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় যে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, আশা করি ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে।
সদ্য পরলোকগত আমার দেশ-এর উপদেষ্টা সম্পাদক আতাউস সামাদের ছোট ভাই সাংবাদিক আতিকুস সামাদ বলেন, আতাউস সামাদ সব সময় আমার দেশ-এর সার্বিক অবস্থা নিয়ে আমাদের পারিবারিক পর্যায়ে আলোচনা করতেন। আমরা চাইব, এই আমার দেশ যেন বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে পারে।
আসাদুজ্জামান সাগর
সম্মাননাপত্র ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন
মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের দাবিতে পৃথিবীতে যেসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্ঠতম। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত ও বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জীবনবাজি রেখে আন্দোলন করেছেন আবদুল মতিন। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রথম প্রতিবাদ তিনিই করেন। একইভাবে তিনিই প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী দৃঢ় অবস্থান ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য তাঁকে কোনোদিন আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে পিছু হটাতে পারেনি। দেশের স্বার্থ ও গণতন্ত্রবিরোধী সব তত্পরতার বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা জাতিকে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ধুবালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। ১৯৩৩ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। ১৯৩৬ সালে দার্জিলিং গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৫ সালে তিনি রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অব আর্টস (পাস কোর্স)-এ গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ রাজপথে। ২০ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকায় সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে। ওইদিন সমবেত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন।
লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি মহান ভাষা সংগ্রামী আবদুল মতিন কয়েকটি বইও লিখেছেন। এই বইগুলো তাঁর চিন্তা-চেতনা, রাজনীতি, দর্শন ও আত্মসত্তাকে ধারণ করেছে। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী হচ্ছে : ‘জীবন পথের বাঁকে বাঁকে’, ‘গণচীনের উত্পাদন ব্যবস্থা ও দায়িত্ব প্রথা’, ‘ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাত্পর্য’, আহমদ রফিকের সঙ্গে যৌথভাবে ‘বাঙালি জাতির উত্স সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন’।
আজীবন লড়াকু, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার, দেশপ্রেমিক এই ব্যক্তিত্বকে সম্মানিত করতে পেরে আমার দেশ গর্বিত ও আনন্দিত।
সম্মাননাপত্র কবি আল মাহমুদ
হাজার বছরের বাংলা কবিতার ভুবনে স্বনামধন্য কবি আল মাহমুদ। সমকালীন বাংলা ভাষার জীবিত কবিদের মধ্যে তিনিই প্রধান। রবীন্দ্র-নজরুল ও ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতা তাঁর সোনালি অবদানে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। ভাটিবাংলার লোকজীবন, গ্রামীণ নিসর্গ শোভা, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবন-সংগ্রাম ও মানবীয় চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয় তাঁর কবিতার অবলম্বন। কবিতা সম্ভারে সমাজ-বিপ্লবের কথাও উচ্চারিত। সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চেতনা তাঁর কবিতায় সব সময়ই বহমান। শুধু কবি হিসেবেই নয়—সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার হিসেবেও আল মাহমুদের উজ্জ্বল কৃতিত্ব সমাজ ও ইতিহাসস্বীকৃত।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম ব্যবসায়ী পরিবারে এই কবির জন্ম। এ শহরেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। লেখাপড়া করেছেন কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে। এ সময়ই তাঁর লেখালেখি শুরু। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় এক সময় ছেদ ঘটে। বিপ্লবী রাজনীতি ও লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৯৫২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচারিত একটি লিফলেটে তাঁর লেখা চার লাইনের একটি কবিতা ছাপা হয়। এসময় পুলিশ তাঁকে খুঁজতে থাকে। তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি।
স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে ঢাকায় এসে আল মাহমুদ দৈনিক মিল্লাত, সাপ্তাহিক কাফেলা ও দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করেন। এসময় ছাপা হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) ও কালের কলস (১৯৬৬)। মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থের জন্য বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন ১৯৬৮ সালে। ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যোগদান করেন তিনি। কলকাতায় গঠিত প্রবাসী সরকারের স্টাফ অফিসার হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদান রাখেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে বিশৃঙ্খলা, দুর্বৃত্তায়ন ও স্বৈরশাসন জাতির ঘাড়ে চেপে বসে, সেই দুঃসময়ে প্রতিবাদের প্লাটফর্ম দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবে আল মাহমুদ পালন করেন দুঃসাহসী ভূমিকা। এজন্য তাঁকে প্রায় এক বছর জেল-জুলুম সইতে হয়। কারামুক্তির পর ১৯৭৫ সালে তিনি যোগদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। ১৯৯৩ সালে একাডেমীর পরিচালক পদ থেকে অবসর নেন। আবারও ফিরে আসেন সংবাদপত্রে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন আল মাহমুদ। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও ছোটগল্প। ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক ছোটগল্প সংকলনে ছাপা হয়েছে আল মাহমুদের ছোটগল্প। এই সংকলনে এশিয়া মহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি কবি আল মাহমুদ।
বয়স তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি। এখনও তিনি মনে লালন করেন তারুণ্য, রয়েছেন লেখালেখিতে সক্রিয়, সচল। একুশে পদকসহ দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন কবি আল মাহমুদ। শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, বাকশাল ও স্বৈরাচারবিরোধী কলমসৈনিক, বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের অনন্যসাধারণ প্রতিভা আল মাহমুদকে সম্মান জানাতে পেরে আমার দেশ আনন্দিত ও গর্বিত।
আবদুল মতিনের অনুভূতি
আমার দেশ সম্মাননা পদক পেয়ে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, আপনারা আমার বন্ধু ও সাথী। আপনাদের দেখলে আমি সাহস পাই। সাহস ছাড়া কোনো ভরসা নেই। তিনি বলেন, আমি চিন্তা করছি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় কি-না। মানবতা রক্ষা পাবে কি-না। মানুষ কীভাবে বাঁচবে। পৃথিবীতে যা ঘটছে, যে কোনো সময়ই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এ অবস্থায় সাহসই আমাদের সম্বল। সাহস ছাড়া আমাদের আর কী আছে। এই সাহস নিয়েই আমাদের লড়তে হবে। তিনি বলেন, আমার দেশ যে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তাতে আমি এখন সাহসী হচ্ছি? আমিও আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই। পাশে বসা আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বাহুতে হাত স্পর্শ করে তিনি বলেন, এই আমি গা ছুঁয়ে বলছি—আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। আপনারা সাহস রাখুন। আপনারা মহান কাজে ব্রতী থাকুন।
আল মাহমুদের অনুভব
কবি আল মাহমুদ তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমরা আমাদের দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য লড়াই করে চলেছি। এই লড়াইয়ে একটি বিশেষ গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে দৈনিক আমার দেশ এবং এই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। আমি তাদের এই আপসহীন ভূমিকার একজন সহযোগী, সমর্থক ও অংশীদার। আমি চাই এই সংগ্রামে সব সময় আমিও যেন থাকি।
তিনি বলেন, নানা বিষয়ে দুর্নীতি এবং দুর্ভাগ্যের অবসানের জন্য সব উপায়ে সংগ্রাম করে চলেছি। আমি মানুষকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা থেকেই আমার হৃদয়ে সাহসের সঞ্চার হয়। আমিও চাই এই দেশটি দুর্নীতিমুক্ত, সুন্দর এক অসম সাহসিকতাপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াক।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই প্রধান কবি বলেন, এই লড়াইয়ে দৈনিক আমার দেশ ও এই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের ভূমিকা আমাদের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আমার মনে পড়ে, আমিও একদা দুঃশাসন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কারাবরণ করেছিলাম। মাহমুদুর রহমানও কারাবরণ করেছেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও কারাবরণ করেছিলেন। দুঃশাসন ও দুর্নীতি যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকেই কেউ কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যায়। যেমন এ সময়ে দাঁড়িয়ে গেছেন মাহমুদুর রহমান। আমি সব সময় এই পত্রিকা ও এর সম্পাদকের মঙ্গল কামনা করি।
এই পত্রিকার পক্ষ থেকে আমাকে আজ যে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে, এর জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
মাহমুদুর রহমানের বক্তব্য
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তৃতায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, এবছর আমরা আড়ম্বরহীন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছি; আমার শিক্ষক ও সহকর্মী আতাউস সামাদ ভাইয়ের স্মরণে। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার এমন চলে যাওয়া কল্পনায়ও ছিল না। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান ‘দুর্নীতিমুক্ত দেশ’ সামাদ ভাই ও আমি মিলে ঠিক করেছিলাম। তিনি আমাদের বাতিঘর হয়ে বেঁচে থাকবেন। সম্মাননাপ্রাপ্ত দুই গুণীজন সম্পর্কে মাহমুদুর রহমান বলেন, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ও কবি আল মাহমুদ দু’জন সততা, স্বাধীনতা ও দ্রোহের প্রতীক।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের গুণীজন সম্মাননা দিতে পেরে আমরা সম্মানিত হচ্ছি। আপনারা দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে আমাদের আরও অনুপ্রেরণা জোগাবেন।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমার দেশ পত্রিকার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে সভাপতির বক্তৃতায় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, দেশ দুর্নীতির দ্বারা লুণ্ঠিত হতে পারে না। তাই আমার দেশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এদেশের জনগণ ও আপনাদের অনুপ্রেরণা আমার দেশ পত্রিকাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যাতে আমরা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারি। সত্য প্রকাশ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও মানবাধিকার রক্ষায় কথা বলতে পারি। মাহমুদুর রহমান আরো বলেন, আপনারা আমাদের যে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, তা আমাদের স্মরণে থাকবে। ক্ষমতার আসনে যারাই থাকুক না কেন, আমাদের লড়াই ও প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, আজকে এখানে মতিন ভাই, আল মাহমুদ, মাহ্বুবউল্লাহ্, আমাদের পরিচালক অধ্যাপক তাসনীম আলমসহ অনেকেই কারা নির্যাতিত মজলুম। তাই আমার দেশ আজ পরিণত হয়েছে মজলুমের মেলায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১:১৯