মূল প্রবন্ধ আলালওদুলাল-এ
আজকাল 'চারণ সাংবাদিক' হিসেবে খ্যাত মোনাজাতউদ্দিনের নাম আর শোনা যায় না বললেই চলে। ভুলেই যেতে বসেছি আমরা যে বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মোনাজাতউদ্দিনের ভুমিকা ছিল বহু উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ বা শিল্পী থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ন। যেমন ধরুন না সাম্প্রতিক কালের 'বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন'-এর কথা। ১৯৮০ থেকে '৯৫-এর মাঝে করা মোনাজাতউদ্দিনের তুখোড়, হৃদয়বিদারক আর বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ের কারনেই কিন্তু বাল্যবিবাহ প্রথা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। এছাড়াও তাঁর বন্যার উপর প্রতিবেদনের ফলে প্রবল হয়েছে ত্রান কার্যক্রম। মঙ্গার সংবাদে রাষ্ট্রপতি এরশাদ ছুটেছেন উত্তরে। তাঁর লেখনিতে কৃষকের হাহাকারে অন্যান্য সংবাদপত্রের টনক নড়েছে। মোনাজাতের লেখায় জাতীয় এজেন্ডা ঘুরেছে, ফিরেছে হতদরিদ্র মানুষের ভাগ্য।
মূল প্রবন্ধ আলালওদুলাল-এ
মোনাজাতের জন্ম ১৯৪৯ সালে রংপুরে। অতি অল্প বয়েসে বাবা-কে হারিয়ে তার হাল তুলে নিতে হয় সংসারের। বই-বাধাই থেকে শুরু করে হকার, লাইব্রেরিয়ান হিসেবেও কাজ করতে হয় তাঁকে। অবশেষে তিনি খুঁজে পান তাঁর প্রকৃত নেশা, পেশা, ভালোবাসা: সাংবাদিকতা।
দৈনিক সংবাদে উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সময়ই মোনাজাত শুরু করেন তাঁর অন্যতম, স্বকীয় অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার উপর। সংবাদের খোজেঁ তিনি চলে যেতেন একেবারে গ্রামবাংলার অন্তরে, স্থানীয় কারো বাড়িতে মেহমান হয়ে। এখানেই মাস, দু'মাস থেকে তিনি সংগ্রহ করতেন তথ্য উপাত্ত। কার বাড়িতে কয় বউ, কার কয়টা হালের বলদ আর কোথায় কার শ্বশুড়বাড়ি - এসব জেনে নিয়ে তিনি হয়ে উঠতেন যেন গ্রামেরই একজন।
মোনাজাতউদ্দিনের কাজের আরেকটা বিশেষ দিক ছিল 'ফলো আপ' সংবাদ। যেমন ধরা যাক বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান পায়রাবন্দ প্রামের কথা। একবার সেখানের পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি সেখানে ফিরেছেন আবার এক যুগ পরে। খোঁজ নিয়েছেন কেমন উন্নয়ন হলো পায়রাবন্দে। তাঁর কাজের জন্য অশোকা ইনস্টিটিউট তাঁকে ফেলোশিপ প্রদান করে ১৯৯১ সালেই।
মোনাজাত এর বেশ কিছু চমৎকার বই দোকানে পাওয়া যায়। 'পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ', 'নিজস্ব রিপোর্ট', 'চিলমারীর এক যুগ' এমনই কিছু বই। এর যে কোন একটা হাতে পড়লেই বোঝা যায় যা মোনাজাত এই কালো, দুস্থ মানুষগুলোকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ফলে, তাঁর চোখ ছিল না প্রথম পাতার দিকে। লোভ ছিল না কলামিস্ট হবার। বরং একাগ্রচিত্তে তিনি গ্রামবাংলার মানুষের খবর নিরলস ভাবে পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের দোড়গোড়ায়। অবশেষে যখন তাঁর ডাক আসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানেরর সফরসঙ্গী হবার জন্য, তাঁর ছিলো না একখানা স্যুট। আর ছেঁড়া পাঞ্জাবী পরে আর যাই হোক, খোঁদ রাষ্ট্রপতির বহরে তো আর ঢোকা যায় না।
১৯৯৫ সালে নৌকাডুবির অনুসন্ধান করতে গি্য়ে আকস্মিকভাবেই পানিতে পরে যান এই সাংবাদিক। সেই পানি থেকে তাঁর আর বেঁচে উঠা হয়নি। ১৯৯৭ সালে তাঁকে বিরল সম্মাননা 'একুশে পদক'-এ ভুষিত করা হয়। আর ৪দিন পর, আগামী ২৯শে ডিসেম্বর চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। অন্তত সেই দিনটিতে যেন আমরা তাঁর নিষ্ঠা, ভালোবাসা আর সাংবাদিকতায় অসামান্য কৃতিত্বের কথা স্মরণ করি।
মূল প্রবন্ধ আলালওদুলাল-এ
ছবি সংগ্রহ: বাংলাপিডিয়া, গুনিজন, পাবনা নিউজ
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৩:৫২