(এই গল্পটি লিখেছিলাম অনেক আগে, যখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দিলাম এখানে। কাচা লেখা। ত্রুটি মার্জনীয়)
নিশান ঠিক ছয়টায় খেলার মাঠ থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে তার ঘরে ঢুকল। পড়ার টেবিলে বসে বাংলা বই টানতে যাবে, দেখতে পেল বাংলা বইয়ের ওপর একটি নতুন বই, “সাজেশন ও সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র সহ সকল বিষয়ের গাইড”। সে খুশি হয়ে উঠল।এই বইয়ের জন্য সে তার বাপির কান ঝালাপালা করে দিয়েছিলো। নিশান পরম একটা স্বস্তির নিঃশাস ফেলল। সে বইয়ের প্রথম পাতা উল্টাতে কয়েকটা ছবি দেখতে পেলো। বিভিন্ন জীবজন্তু আর তাদের ব্যবচ্ছেদের ছবি। বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ও তাদের গঠণের ছবিও দেখল। নিশান খুশি যতটুকু হলো অবাক হলো তার চেয়ে বেশী। “আর স্যারদের কাছে যেতে হবে না...বাঁচা গেলো”।
নিশান ‘৯৩ সালের প্রশ্নপত্র বের করলো। প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র লিপিবদ্ধ রয়েছে। দুই পাতা দেখার পর সে ‘৯৪ সালের প্রশ্নপত্র পেল। সে পাতা উল্টিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো একটি পৃষ্ঠায়। সে অবিশ্বাস ভরা চোখ নিয়ে দেখলো ‘৯৪ এর প্রশ্নপত্রের পরেই লেখা রয়েছে, “১৯৯৫ সালের সকল বিষয়ের সম্ভাব্য প্রশ্নপত্র, উত্তরসমুহ-সূচীপত্রে দেখো”। সে অবাক হয়ে ভাবতে বসলো। ‘৯৫ এর পরীক্ষাই এখনো হয় নি। এখন ফেব্রুয়ারী মাস চলছে, ১৯৯৫ সাল। তার মাথা গুলিয়ে গেলো। “ছাপায় ভুল হয়নি তো”? সে প্রশ্নপত্রের উপর ঝুকে পড়লো। বাংলার প্রশ্ন ‘৯৪ সালের প্রশ্নের সাথে মিলিয়ে দেখলো কোন মিল নেই। ‘৯৩-এর সাথেও মিলিয়ে দেখলো কোন মিল নেই। একে একে ‘৯০ সাল পর্যন্ত সকল প্রশ্নপত্রের সাথে মিলিয়ে দেখলো, কোন মিল নেই। সে বইটা বন্ধ করলো। প্রচ্ছদে একটি হৃতপিন্ডের ছবি। সে দেখলো কাভারটা অতিরিক্ত মোটা। সে ভাবতে বসলো। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বইটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এখন আর পড়ায় মন বসবে না।
সে লক্ষ করলো বইটার কাভারের হৃতপিন্ডের ছবিটার কি কোন পরিবর্তন হলো? একটু ঘুরে গেল না? অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একসময় লক্ষ করল হৃতপিন্ডের ছবিটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। এবং সেখানে পাকস্থলীর ছবি ফুটে উঠল। নিশান হতবাক হয়ে গেল। এসব হচ্ছে কী! বাপিকে ডাকবে বলে উঠতে যাবে এমন সময় বইটার ভেতর থেকে কথা ভেসে এল, “Good evening master, I am here to guide you how to prepare for the examination this year. If you want to study now I shall stop talking, for that you will have to press the button on the back of the book. But if you want help with this book you can ask, I will search the database and try to help”। বলে বইটি চুপ করল। নিশান কিছুই বুঝতে পারছে না। বইটি কী বলল তাও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। সে কাঁপা হাতে বইটি উল্টালো। দেখলো কাভারের পেছন দিকটা ইলেক্ট্রিকাল। ওপরে একটি বোতাম রয়েছে। সে ওটি কাঁপা হাতে টিপে দিলো। বইটা উল্টিয়ে সোজা করে খেয়াল করল কাভারে কোন ছবি নেই। কয়েক সেকেন্ড পর সেখানে একটি লেখা ফুটে উঠল, “THIS YEAR, 2206 (LY)”। তার নীচে ছোট অচেনা অক্ষরে লেখা সম্পূর্ণ কাভার জুড়ে। নিশান অবাক হয়ে ভাবছে এসব কী হচ্ছে! সে হঠাত লক্ষ করল তার চোখের সামনে ঘরটা ঝাঁপসা হতে শুরু করেছে। তার চোখেও গভীর ঘুম নেমে আসছে। সে ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
নিশান ধীরে ধীরে চোখ মেলল। অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তার পড়ার ঘরের একি দশা! সে মনে করার চেষ্টা করল কোথায় সে। কয়েক সেকেন্ড পর তার সব মনে পড়ল। আবার তাকালো চারপাশে। মনে হচ্ছে ঘরটা পরিত্যক্ত হয়ে পরেছে। সে দেখল সে একটা ভাঙা চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে একটি পরিত্যক্ত টেবিল। সেখানে কিছু ছেড়া কাগজ। নিশান চেয়ার থেকে নামল। সে কোথায় চলে এসেছে জানে না। জানতেও চায়না। তার মাথায় একটাই চিন্তা চাপল, বাসায় ফিরতে হবে। দরজার দিকে তাকালো। একটু অবাক লাগল। দরজাটাকে একেবারে নতুন মনে হচ্ছে। কেমন এক নীলাভ কালো দরজা। নিশান দরজা ধাক্কা দিয়ে মামনিকে ডাক দিল। কোন সাড়া নেই। হঠাত তার একটা কথা মনে হল। আজকের তারিখ কত? এখন কয়টা বাজে? যখন সে পড়তে বসে তখন বাজে সাড়ে ছয়টা, ২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৫। নিশান নিজের হাতঘরির দিকে তাকালো। “ধুত! ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে”। টেবিলের পেছনে তার চোখে পরল একটা জানালার মত। নিশান সেই জানালা দিয়ে ঝুকে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার! সামনে একটা টানেলের মত সুড়ঙ্গ চলে গিয়েছে। কতদূর গিয়েছে ঠাহর করা যায়না। নিশান বুঝতে পারল এটা জানালা না। কিন্তু ঘরটায় আলো আসছে কোত্থেকে? নিশান চারিদিকে তাকায়। কিন্তু আলোর কোন উতস খুজে পায় না। সে সাবধাণে সুড়ঙ্গমুখে নামে। প্রথমে অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারে না। ধীরে অন্ধকার সয়ে এলে আস্তে ধীরে হাটতে থাকে। তাকে একটু নীচু হয়ে হাঠতে হচ্ছিল। বেশ কয়েক ফুট যাবার পর হঠাত তার প্রচন্ড ঘুম আসতে লাগল। সে চমকে উঠল। পেছন ফিরে ঘরটায় ফিরে আসতে চাইল। কিন্তু ক্রমশ তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছিল। দুই পা এগিয়ে আর পারল না, সুড়ঙ্গমুখের ২ ফুট দূরে সে পরে গেল।
১৯৯৫ সাল। নিশানের ঘর। সন্ধ্যা পৌনে সাতটা। ঘরে কেউ নেই। যে চেয়ারে নিশান বসে ছিল সে চেয়ারটা শুণ্য। তার টেবিলের পেছনে কোন সুড়ঙ্গমুখ নেই। শধু দেয়াল।
নিশান চোখ মেলল। কয়েক সেকেন্ড পর মনে পরতেই ধরমর করে উঠে বসল। অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে হাত বাড়াল। দেয়াল। বাঁ হাত বাড়ালো উপরের দিকে, দেয়াল। সামনে বাড়ল। এক পা পরেই দেয়াল। পিছিয়ে গেল। দেয়াল। সে ডুকরে কেঁদে উঠল।
২২০৬ সাল। বাংলাদেশের একটি বিঞ্জান গবেষণাগার। নানারকম যন্ত্রপাতিতে ভরা। মধ্যখানে একটি খুব বড় ম্যাটোমিক ফিল্ড। একে ঘিরে বিঞ্জাণীদের ভীড় জমে উঠেছে। এতে বস্তুকে অণু পরমাণুতে বিভক্ত করা হয়। একজন বিঞ্জাণী বর্ক্তৃতা দেবার ভঙ্গিতে বলতে শুরু করল, “শ্রদ্ধেয় বিঞ্জাণীগণ, আপনারা জানেন বর্তমানে কিছুদিন আগেই matter transmit সম্ভব হয়েছে। আমরা যে কোন বস্তুকে অণু-পরমাণুতে ভাগ করে এক স্থান হতে অন্য স্থানে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তা একই যায়গায় সম্ভব হয়। বিঞ্জাণীদের কঠোর সাধণায় আমরা বস্তুকে এক স্থান হতে যে কোন দূরত্বে নিয়ে যাবার পদ্ধতি আবিস্কার করেছি। আজকে আমরা তার পরীক্ষামূলক প্রমাণ প্রদর্শণ করব”। তিনি তাঁর পাশে দাঁড়ানো আরেকজন বিঞ্জাণীর দিকে তাকালেন। বিঞ্জাণীটি একটি যন্ত্রাংশের দিকে এগিয়ে গেল, “সাধারণভাবে বস্তুকে একই যায়গায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ট্রান্সমিট করা সহজ। কিন্তু ভিন্ন যায়গায় তা সহজ নয়। যে জায়গায় ট্রান্সমিট করা হবে সে যায়গার রিসিভারে বিভক্ত বস্তুর যাবার পথ থাকতে হবে। আমরা এই ল্যাব বিল্ডিং এর পাশের বাড়িতে, যেখানে একটি সাধারণ পরিবার থাকে, একটি রিসিভার রেখেছি। matter transmit-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সময়। কতক্ষণ পর বিভক্ত বস্তু পাশের বাড়ির রিসিভারে পৌছবে তা বিভক্ত বস্তুর গতির উপর নির্ভর করে। বিভক্ত বস্তুর গতি খুব মন্থর। আবার, রিসিভারকে কখনই চালু করা যাবে না যতক্ষণ না বস্তু সেখানে পৌছায়। সুতরাং, আমাদেরকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে”।
“রিসিভার চালু করা যাবে না কেন?”, প্রশ্ন করল একজন।
“কারণ বাতাসে আরো কত জিনিস ভাসমান রয়েছে তার হিসাব নেই। রিসিভার চালু করলে অন্যান্য জিনিস জমাট বাধতে শুরু করবে। ফলে বস্তুটি বস্তুতে পরিণত হবে না। ফলে চিরদিনের জন্য বস্তুটি সেই অবস্থায় থাকবে”।
তিনি থামলেন এবং ম্যাটোমিক ফিল্ডে একটি বই রাখলেন। বইটির কাভারে একটি হৃতপিন্ডের ছবি। তিনি একটি সুইচ টিপলেন। সাথে সাথে বইটি অদৃশ্য হয়ে গেল। ১৫ মিনিট পর একটা লোক দৌড়ে ল্যাবে ঢুকে বলল, “স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে। পাশের বাড়ির ছেলেটি রিসিভারে কিজানি করায় রিসিভারটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে”। সবাই হায় হায় করে উঠল। বিঞ্জাণীটি বললেন, “কী বলছ?ওখানে রাখাই আমাদের ভুল হয়েছে। যাই হোক, আপনাদেরকে আশাহত করতে হল বলে দুঃখিত। এখন বিভক্ত বস্তুটি অতীত বা ভবিষ্যতে যেতে পারে। কারণ রিসিভারটি নিজেই বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। ওটির সংস্পর্শে বিভক্ত বস্তু আসলে সে আবার পুণরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসবে”। বলে তিনি ল্যাবের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
শেষ