[আরজ আলী মাতুব্বরের লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া মুসলিমের সংখ্যা কম নয়। এই সিরিজে আমি তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব। আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নকারী মনকে আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তার ইসলামী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে অনুধাবন করতে পেরে তার প্রতি আমার করুনাও হয়।]
আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র প্রথম খন্ড সত্যের সন্ধান (দ্বিতীয় প্রস্তাব – ঈশ্বর বিষয়ক) এর ৪-৬ নং প্রশ্নের উত্তর।
প্রশ্ন ৪: ঈশ্বর কি স্বেচ্ছাচারী না নিয়মতান্ত্রিক? ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী হইলে তাঁহার মহত্ত্বের লাঘব হয় এবং নিয়মতান্ত্রিক হইলে তিনি তাঁহার ভক্তদের অনুরোধ (সুপারিশ) রক্ষা করেন কিভাবে?
উত্তর: আল্লাহ যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন, তবে তিনি সব কিছু একটা নিয়মের মধ্যে করেন। কিন্তু, স্বেচ্ছাচারী শব্দটা আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ “অমুক ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী” বলতে বুঝায় ঐ ব্যক্তি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিজের সুবিধাভোগের জন্য অন্যের উপর জুলুম করে। মহান আল্লাহ আর-রাহমান, পরম দয়ালু, তিনি জুলুম করেন না।
আল্লাহ নিয়মতান্ত্রিক, কিন্তু সেই নিয়ম তিনি নিজেই তৈরী করেছেন এবং তিনি তার ব্যতিক্রম করেন না। আল্লাহ বলেছেন – আল্লাহর সুন্নাহয় (কর্মপদ্ধতিতে) কোন পরিবর্তন নেই (সূরা ফাতির ৩৫:৪৩)। প্রিয় বান্দারা দু’আ করলে আল্লাহ কবুল করে, এটা আল্লাহর তৈরী নিয়মের অন্তর্ভুক্ত, কাজেই দু’আ কবুল করলে নিয়ম ভংগ হয় না, নিয়ম রক্ষা হয়।
“সুপারিশ রক্ষার অর্থই হইল, আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কাজ করা” – পুরোপুরি বেকুবের মত কথা। আরজ আলী কোনদিন আয়াতুল কুরসী এর বাংলা অনুবাদটাও পড়ে দেখে নাই, আর আল্লাহ বিষয়ে বড় বড় বাণী কপচানো শুরু করেছে। আয়াতুল কুরসী সহ কোরআনের একাধিক স্থানে স্পষ্ট বলা আছে আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ তার কাছে সুপারিশ করতে পারে না।
এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? (সূরা বাকারাহ ২:২৫৫)
তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশকারী কেউ নেই। (সূরা ইউনুস ১০:৩)
নবী, রাসূল বা প্রিয় বান্দাদের সুপারিশ রক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ মোটেও তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। কারণ, কে সুপারিশ করতে পারবে এবং কার জন্য সুপারিশ করতে পারবে তা আল্লাহই ঠিক করে দিবেন। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউই সুপারিশ করার অনুমতি পাবে না।
প্রশ্ন দাড়ায় – সুপারিশ যদি আল্লাহর ইচ্ছাতেই করা হয়ে থাকে তাহলে সুপারিশের দরকার কি? এর উত্তর হলো - আল্লাহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করবেন, সুপারিশ এরকম একটা প্রক্রিয়া মাত্র। সুপারিশ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহ সুপারিশকারীকে সম্মানিত করবেন। যেমন – প্রিয় নবী মুহাম্মাদ(সা) সবচেয়ে বেশী মানুষের জন্য সুপারিশ করবেন, যেটা তাঁর জন্য বিরাট সম্মানের ব্যাপারে। আবার, সুপারিশ প্রক্রিয়ার কারণে সুপারিশকারীর প্রতি আমাদের ভালোবাসাও জন্মায়। যেমন – যেহেতু আমরা মুসলিমরা জানি যে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ(সা) বিচার দিবসে আমাদের সুপারিশকারী হবেন, কাজেই আমরা এই দুনিয়ায় তাঁর প্রতি বেশী ভালোবাসা অনুভব করব এবং তাঁকে বেশী বেশী করে অনুসরণের চেষ্টা করব।
প্রশ্ন ৫: আল্লাহ ন্যায়বান না দয়ালু? বিচারের ক্ষেত্রে দুইটা একত্রে হওয়া অসম্ভব।
উত্তর: আপনি যেভাবে একইসাথে পিতা এবং পুত্র হতে পারেন, আল্লাহও তেমনি একইসাথে ন্যায়বান ও দয়ালু হতে পারেন। ন্যায়বান ও দয়ালু হওয়া কোন মিউচুয়াল এক্সক্লুসিভ বিষয় নয়। যারা আল্লাহর বিধি-নিষেধ এই দুনিয়ায় মেনে চলবে, পরকালে আল্লাহ তাদের ভালো কাজকে ১০ থেকে ৭০০ গুন বাড়িয়ে দিয়ে, তাদেরকে জান্নাত দিয়ে দয়া করবেন। অন্যদিকে – এই দুনিয়ায় যারা খারাপ মানুষ ছিল, অহংকারী, পাপী, দুর্নিতীবাজ ছিল, সত্যগোপনকারী ছিল – আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামে জায়গা দিয়ে ন্যায়বিচার করবেন।
রাসূলুল্লাহ(সা) বলেছেন - আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)
প্রশ্ন ৬: যদি আল্লাহর ইচ্ছায় সকল ঘটনা ঘটে, তাহলে জীবের দোষ বা পাপ কি?
উত্তর: আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও পড়ে না। তবে, আল্লাহ মানুষকে একটা সীমার মধ্যে কিছু স্বাধীনতা দিয়েছেন, মানুষ সেই স্বাধীনতা কিভাবে ব্যবহার করবে, তার উপর সে পুরষ্কার বা শাস্তি পাবে।
একটা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝাই। দুই বন্ধুর ঝগড়া লেগেছে, দু’জনের হাতেই অস্ত্র আছে। এখন আল্লাহ এই দুই বন্ধুকে তিনটি অপশন দিয়েছেন – ঝগড়া থামাও, চালিয়ে যাও অথবা গুলি চালাও। এই তিনটা অপশনের কোন্টা কোন্ বন্ধু বেছে নিবে এটা সম্পূর্ন তাদের নিজেদের ব্যাপার, তাদের সিদ্ধান্তের জন্য পরকালে তাদেরকে জবাব দিতে হবে। এখন ধরুন, এক বন্ধু গুলি ছুড়তে গেল দ্বিতীয় বন্ধুর উপর। এখন – সেই গুলি দ্বিতীয় বন্ধুর গায়ে লাগবে কিনা, বা লাগলেও সে মরবে কিনা – সেটাও আল্লাহর ইচ্ছা। সুতরাং, যে কোন কাজের শুরুতে আমরা যে অপশনগুলো পাই তা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে, কোন একটা অপশন বেছে নেয়ার পর কি ঘটবে তাও আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। আমাদের স্বাধীনতা শুধু অপশনগুলো বেছে নেয়ার অংশটুকু, আর কোন্ অপশনটা বেছে নিলাম সেটার উপরেই আমাদের বিচার হবে। উল্লেখ্য, আল্লাহ চাইলেই যে কোন সময়ে আমাদের এই বেছে নেয়ার ক্ষমতাটুকুও কেড়ে নিতে পারেন, এভাবেই মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান।
[আমার ও পাঠকের সুবিধার্থে আমি আরজ আলীর প্রশ্নগুলি সংক্ষেপিত আকারে লিখেছি। প্রশ্নগুলির বিস্তারির ভার্শনের জন্য এটাচকৃত ছবি দেখুন।]