somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওদের কি দেশে ফেরা হবে না?

০৭ ই মে, ২০১৪ সকাল ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই ডিসেম্বর মাসেই তার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের এক বন্ধুর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এক অধ্যাপক বাংলাদেশ থেকে কিছু ছাত্র ছাত্রীকে তার গবেষণাগারে চাকুরী দিবে এবং বাংলাদেশের সাথে স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে যৌথ গবেষণার উদ্যোগ নিবে এই আশায়। কিন্তু গোলাগুলি আর মৃত্যুর মিছিল দেখে তার আর যাওয়া হলনা। একটা বড় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। তার আগের মাসেই এক অস্ট্রেলিয়ান শিল্পোদ্যোক্তা তার বিশাল শোরুমে বাংলাদেশের পণ্যকে স্থান দেয়ার জন্য যাচাই করতে যেতে চেয়েছিল আমাদের আরেক পরিচিত বাঙ্গালীর সাথে। পত্রপত্রিকা আর সংবাদ মাধ্যমে দেশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখে ভদ্রলোক আর গেলেন না। ভেস্তে গেল কোটি টাকার ব্যবসার সম্ভাবনা। আমাদের আরেক বন্ধু ফ্লোরিডা থেকে দীর্ঘ চার বছর পর ডিসেম্বরে দেশে গিয়েছিল আপনজনদের দেখতে এবং একইসাথে সম্ভব হলে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। বিয়ে তো করা হলইনা, ঘরে বন্দী থাকতে হল তাকে এবং কোন নিকটাত্মীয়ের সাথে দেখা না করেই তাকে চলে আসতে হল বিদেশে এক বুক বেদনা নিয়ে। আগামী কয়েকদিনের মাঝেই ইংল্যান্ডের একজন উদ্যোক্তা দেশে যাওয়ার কথা ছিল নতুন বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা দেখতে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অপহরনের ভয়ংকর আর মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে তিনি বাতিল করেছেন দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। এভাবেই কি একের পর এক সুযোগ হারানোর মিছিল তৈরি হবে বাংলাদেশে? অবাক হয়ে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে একই বৃত্তে ঘুরতে থাকার দৃশ্যপট?
আমরা সবাই দেশের বাইরে থাকি। কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ যুক্তরাষ্ট্র, কেউ যুক্তরাজ্য আবার কেউ জাপানে। কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তায় জুড়ে আছে বাংলাদেশ। অদ্ভুত ভাবে আমরা লক্ষ্য করলাম, অনেক অনেক দিন ধরে বাইরে থাকা এমনকি উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশীরা এখনও ভুলতে পারেনি নিজের শেকড়কে, এখনও তাদের আলোচনায় সবার আগে বাংলাদেশ, বিতর্কের ঝড় ওঠে অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে। অবাক হয়ে দেখি কি পরিমান কষ্ট নিয়ে একেকজন বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছে এই দূর পরবাসে। সিডনির রাস্তায় ট্যাক্সি চালানো বাংলাদেশের বুয়েটের ছেলেটি কিংবা নিউইয়র্কে সুপারশপে কাজ করা চট্টগ্রাম মেডিকেলের চিকিৎসক মেয়েটি নিজের পেশা বিসর্জন দিয়ে এই সহস্র মাইল দূরে বসে আছে বাংলাদেশে চাকুরীতে যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও অনেক সময় প্রমোশন না পাওয়ার কষ্টে, ভিন্ন ধর্মালম্বি হওয়ার কারনে বিশেষ কোন সময়ে উপেক্ষার শিকার হয়ে, ক্ষমতাধর মামা না থাকায় নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী পছন্দের চাকুরী না পাওয়ার কারনে। আর কতদিন এভাবে যোগ্যতার অবমূল্যায়ন চলতে থাকবে আর আমরা হারাতে থাকব সবচেয়ে মেধাবী সন্তানগুলোকে?
টরেন্টোর বিশতলা উঁচু এপার্টমেন্টে বসে বাংলাদেশের ছেলেটি আধুনিক কক্ষের উষ্ণতা অনুভব করছে ঠিকই কিন্তু আজন্ম গ্রামে বেড়ে ওঠা ছেলেটি এখনো ভুলতে পারেনা পুর্নিমা রাতে ঘরের উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে থাকায় মধুর স্মৃতি। প্রতিদিন সকালে অফিসে এসেই সবার আগে প্রবাসীদের কম্পিউটারের স্ক্রিনে বিবিসি কিংবা সিএনএন ভাসেনা, দেখা যায় প্রথম আলো কিংবা বাংলাদেশের কোন অনলাইন পত্রিকা। যত বড় গবেষণাগারেই পাশ্চাত্তের সমস্যা নিয়ে কাজ করি না কেন সবার চিন্তায় বাংলাদেশ। আমাদের এক বন্ধু তাজ গবেষনা করছে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সোয়ান নদীতে ভাঙ্গনের সম্ভাব্যতা প্রতিরোধ নিয়ে; কিন্তু তার উদাহরনে বর্ননায় সবসময়ই চলে আসে সন্দীপের নদী ভাঙ্গনের দুঃখ। ম্যাকডোনাল্ডস কিংবা হাংগরি জ্যাকসে সবাই খাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মাথায় ঘুরছে কুমড়ো পাতার বড়া, সর্ষে ইলিশ আর ফুচকা। দিন শেষে নীড়ে ফেরার প্রতীক্ষা সবার কিন্তু বাস্তবতা হল এই মানুষগুলোর বেশীরভাগেরই দেশে ফেরার উপায় নেই। ন্যানোটেকনোলোজি কিংবা জৈবপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করা ছেলেটা দেশে ফিরতে পারবেনা কারন দেশে সুযোগ থাকা স্বত্বেও কর্ম ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছেনা। সংখ্যালঘু মেয়েটিকে একটা ভয় তাড়িয়ে বেড়ায় – আবার তার বাস্তুভিটা উচ্ছেদ করা হবে না তো? নিজের সম্ভ্রম থাকবে তো? নিজের পেনশনের টাকা আদায় করতে গিয়ে বিধ্বস্ত বাবা কিংবা অপহরনের আতঙ্কে থাকা মা বারবার বিদেশে থাকা ছেলেকে ফোন করে বলছেন দেশে ফিরতে হবেনা।
আমরা বিদেশে পিএইচডি করছি, গবেষনা করছি। আমরা সবাই দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু এখানে আমাদের সুপারভাইসররা যখন বলেন আসলেই কি এই উন্নত কাজগুলো তোমার দেশে করতে পারার সুযোগ ও অর্থায়ন পাবে? আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। চাইলে হয়ত আমরা অনেকেই এসব দেশে নাগরিকত্ব পেয়ে যাব। কিন্তু আমরা বাঙালি পরিচয়ে থাকতে চাই, অন্য কোন দেশের নাগরিক নয়। তারপরও দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দেখি শিক্ষক এই পরিচয়ের চেয়ে আমি কোন দল সমর্থন করি এটাই অনেকক্ষেত্রে বড় পরিচয়, তখন মাঝে মাঝে সেই গানটির মত মনে হয়- হেথায় তোকে মানাইছে নাইকো, এক্কেবারে মানাইছে নারে। শিকড় ছড়িয়ে থাকা এই কষ্ট ও অনিশ্চয়তাগুলো মাঝে মাঝে মনে প্রশ্নের উদয় ঘটায় – আমাদেরও কি তবে দেশে ফেরা হবেনা?
লেখার শেষে পার্থের কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামসুল আরেফিন আনামের একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়। কিছুদিনের মাঝেই সে পাবে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব কিন্তু তবুও বাংলাদেশকে নিয়ে তার অনেক ভাবনা ও উৎকণ্ঠা। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, কিছুদিনের মাঝেই যেখানে অস্ট্রেলিয়ার মত একটা উন্নত দেশের নিরাপদ নাগরিক হতে যাচ্ছ,বাংলাদেশ কে নিয়ে এত চিন্তা কেন তোমার? উত্তরে সে বলেছিল, “পৃথিবীর যেই প্রান্তেই যাইনা কেন, যেখানেই থাকিনা কেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভাল আছে – এটা দূর থেকে দেখেও শান্তি পাব, ভীষণ ভাল লাগবে”। মাননীয় সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ , দোহাই লাগে আপনাদের। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। লক্ষ লক্ষ প্রবাসী প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ ভাল আছে এটা দেখার জন্য বসে আছি, কোন এক কাকডাকা ভোরে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। ঘরে ফেরার তাড়া সবারই থাকে। আমাদের দেশে ফিরতে দিন।

(লেখকবৃন্দ বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে গবেষনারত চট্টগ্রাম, ঢাকা ও রাজশাহী ও বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউএসটিসি’র তরুন শিক্ষক)
আদনান মান্নান,পিএইচডি গবেষক, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া ও শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল- adnan_orko@yahoo.com
মুশতাক ইবনে আয়ুব, পিএইচডি গবেষক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল- clingb@gmail.com
ইমতিয়াজ হাসান, পিএইচডি গবেষক, ইয়োকোহামা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান ও শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল- imtiajhasan@gmail.com
নাসরিন জাহান ববি, পিএইচডি গবেষক, লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র ও শিক্ষক, ইউএসটিসি, ইমেইল- nasrin.jahan@hotmail.com
জয়শ্রী দাশ, পিএইচডি গবেষক, ডংকুক বিশ্ববিদ্যালয়, কোরিয়া ও শিক্ষক, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইমেইল- joysree333@yahoo.com
(৭।০৫।২০১৩ তারিখে প্রথম আলো তে প্রকাশিত) লিঙ্ক- Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঘুষ ইজ গুড ফর হেলথ !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১:২৩


সিরাজদিখানের মাহফুজুর রহমান সাহেবের কান্ড দেখে মনে হলো, তিনি ব্রিটিশ আমলের একটা গল্প খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছেন। গল্পটা পুরনো, কিন্তু ঘুষখোরদের মধ্যে এখনো জনপ্রিয়। এক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট বাংলায় দুর্বল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছায়ার রক্তচোখ: ক্রোধের নগর

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:৫২


ষড়ঋপু সিরিজের দ্বিতীয় কাহিনী ”ক্রোধ”

রাত্রি নেমেছে শহরের উপর, কিন্তু তিমির কেবল আকাশে নয়—সে বসেছে মানুষের শিরায়, দৃষ্টিতে, শ্বাসে। পুরনো শহরের এক প্রান্তে, যেখানে ইট ভেঙে পড়ে আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৭৪

লিখেছেন রাজীব নুর, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:৪২



প্রিয় কন্যা আমার-
ফারাজা, তুমি কি শুরু করেছো- আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! রাতে তুমি ঘুমানোর আগে ঘুমানোর দোয়া পড়ে ঘুমাতে যাও। প্রতিদিন তোমার মুখে ঘুমের দোয়া শুনতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। নববর্ষের শোভাযাত্রা নাম বদল করছি না, পুরোনো নাম–ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি: ঢাবি উপাচার্য

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:০৪



পয়লা বৈশাখে ফি বছর চারুকলা অনুষদ আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেছেন, ‘আমরা নাম পরিবর্তন করছি না। আমরা পুরোনো নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

'৭৪ সালের কুখ্যাত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল এখন সময়ের দাবী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১১ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৫


বিগত আম্লিক সরকারের আমলে যে কুখ্যাত আইনের অপব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই আটক করে গায়েব করার চেষ্টা চলতো তা হলো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইন ব্যবহার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×