প্রিয় মা মণি,
...............চিনতে পারছো ? আমি তোমার বাবু। তুমি অবশ্য এখনও আমাকে দেখনি, চেনারও কথা না। আমার বয়স কেবল সবে কয়েক সপ্তা হল। এইতো আর কটা দিন পরেই তুমি আমার ব্যপারে জানতে পারবে, হু, আমি হলফ করে বলতে পারি।
আম্মু চলো তোমাকে কয়টা কথা বলি। আমার নাম জারীর। জানো আম্মু আমার ভ্রুগুলো না এত্তো সুন্দর, আর চুলগুলোও একেবারে মিশমিশে কালো। চুলগুলো অবশ্যি এখনও গজায়নি, তবে দেখো- আমার যখন জন্ম হবে, তখন ওগুলো ঠিক ঠিক যেমন বললাম তেমনই হবে। আমি তো তোমার একমাত্র বাবু, তাইনা আম্মু? আর তখন তো তুমিও ব্লবে,”আমার একটি মাত্র কলজের টুকরা, নাড়িছেঁড়া আদরের ধণ।“ বাবার আদর হয়তো আমার কপালে জুটবে না; বাবার পরিচয়ে হয়তো বড়ও হতে পারব না। তাতে কী? আমি আর তুমি কিন্তু সারাজীবন একসাথে থাকব, একে অপরকে সাহায্য করব, ভালবাসবো। আম্মু, শোন, আমি না বড় হয়ে কী জানি হবো...... উঁ...উঁ......যা ভুলেই গেলাম! ওহ, মনে পড়েছে... ডাক্তার হবো। হু ডাক্তারই হবো যাও।
এতদিনে আজকেই প্রথম তুমি টের পেলে যে তোমার ভিতর আমি আছি। তুমি এতে এতই খুশি হলে যে সব্বাইকে বলার জন্য আর তর সইছিল না। কত্ত কিছুই না করলে; সারাটা দিন হেঁসে হেঁসে কুটিকুটি হলে; তোমার জীবন যেন আজ পুর্ণতা পেল। আম্মু, তোমার হাসি না খুউব সুন্দর। জীবনে প্রথম তোমার ঐ মুখখানিই আমি দেখতে পাবো, আর ওটা হবে সারা জীবনে দেখা আমার সবচে ভাল জিনিষ, আমি অবশ্যি এখনি এটা জানি।
আজ তুমি বাবাকে আমার কথা বলেছ, না? তুমি তো খুশিতে বাগবাগ হয়ে বাবাকে বললে আমার কথা, কিন্তু আমার মনে হয় তুমি ব্যাপারটা ঠিক খেয়াল করনি, আমি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারলাম যে বাবা ব্যাপারটাকে ভালভাবে নেননি, উনি মনে হয় রেগে গেলেন। বাবা তোমার বিয়ের জামানতের টাকা (মোহরানা), খরচাপাতি আরও হেনতেন কী সব বলতে লাগল তখন, আমি অবশ্য সব বুঝলাম না। তুমি যে কী! এতকিছুর পরও তুমি খুশিই থাকো। যাইহোক তবুও তো সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তারপর বাবা কী করে বসল? কী ভয়ঙ্কর! আম্মু, বাবা তোমাকে মারল! আমি ঠিক বুঝতে পারলাম, তুমি পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছিলে। কোত্থেকে যেন তোমার হাত দুটো এসে আমার গায়ে ব্যাথা লাগতে দিল না। কিন্তু আম্মু তোমার জন্য না আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।
তুমি তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলে। তোমার কান্নার শব্দ আমি একদমই সইতে পারিনা। আমার আর তখন কিচ্ছু ভাল্লাগছিলো না। আমারও ভীষণ কান্না পেল।
পরে অবশ্য এজন্য বাবা তোমার কাছে মাফ চাইল, আবার তোমাকে জড়িয়ে ধরে সোহাগও করল; আর তুমিও তাই বাবাকে মাফও করে দিলে। আমি কিন্তু মাফ করব কিনা এখনও ঠিক বুঝতে পারছিনা।
আম্মু, এটাতো ঠিক যে বাবা যা করেছিল তা ঠিক হয়নি। তুমি বল সে তোমাকে ভালবাসে...... আমি বুঝিনা তাহলে সে তোমাকে মারবে কেন? তুমি যাই বল, পুরো বিষয়টা কিন্তু আমার কাছে কেমন কেমন ঠেকছে।
শেষ পর্যন্ত তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ এখন। তোমার পেটটা আগের চে একটু বড় হয়েছে, না! আমাকে নিয়ে বেশ ভালই আছ মনে হচ্ছে, আবার নানীর সাথে গিয়ে নতুন নতুন কাপড় চোপড়ও কিনে আনলে।
তুমি খুব খুশি হয়েছ, না আম্মু? এই যে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গুনগুন করে গানও গাইছ। সা---রা দুনিয়ায় তোমার গলার স্বরই সবচে ভাল, আর কারও না, এই আমি বললাম। তুমি যখন গান গাও তখন আমার বড্ড ভাল লাগে, আর যখন তুমি আমার সাথে কথা বল তখন আমার আর কোন ভয় লাগে না। একটু ধৈর্য্য ধর আম্মু, আমি তোমার একটা ছেলের মত ছেলে হব, তুমি আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারবে, হু। আর আমার মনের সবটুকু ভালবাসা শুধু তোমার জন্যই।
দেখ দেখ আম্মু, আমি আমার ক্ষুদে হাত পা গুলো নাড়াতে পারছি। যখনি তুমি আমাকে অনুভব করতে পেটে হাত রাখ তখনি আমি একটু নড়ে উঠি। আর তখন আমার যে সে কী হাসি আসে! তুমিও হেঁসে ফেল।
আজ আবার বাবা তোমাকে দেখতে এসেছে। আম্মু, এবার কিন্তু আমার সত্যিই বেশ ভয় ভয় করছে। বাবার ভাবভঙ্গি কিন্তু আমার ভাল্লাগছেনা। উল্টাপাল্টা কথা বলছে সে; কী বলছে, তোমাকে নাকি আর তার দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছিনা কী সব আজেবাজে কথা বলছে লোকটা।
তারপর...তারপর...সে কিন্তু আবারও তোমাকে ঘুষি মারল। নাহ, বাজে লোক তো! ঠিক আছে আমার রাগ তো দেখনি, আমি কসম কাটলাম, বড় হলে ওই নচ্ছাড় টাকে আর একবারও তোমাকে মারতে দেব না।
বাবা আসলেই একটা বাজে লোক। তুমি যতই বল যে সে ভাল, আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি সে খারাপ; না হলে তোমাকে অমন ভাবে মারবে কেন? আর সে কী বলল শুনেছ? সে আমাদের চায় না।
আসলে বাবা না আমাকে একদমই সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু কেন, বলতো আম্মু? বাবা আমাকে দেখতে পারেনা কেন?
আম্মু তোমার কী হলো, আজ রাতে কিন্তু তুমি আমার সাথে একটুও কথা বললে না; আগে না তুমি কত্ত কথা বলতে ! ঘুম পাড়ানি মাসি পিষি বলতে ! আম্মু সব ঠিক আছে তো ? তোমার কিছু হয়নি তো ?
শেষবার বাবা আসার পর আজ ৩ দিন হতে চলল। এই ৩দিনে তুমি আমার সাথে একটি বারও কথা বলনি, একবারের জন্য ভুলেও হাতটা বুলাওনি... আম্মু তুমিও কি আমাকে আর ভালবাসো না? আমি কিন্তু এখনও তোমাকে ভালবাসি। আমার ধারণা তোমার মনটা একটু খারাপ। খালি তুমি যখন ঘুমাও তখনি কেবল আমি এট্টুখানি তোমার হাতের ছোঁয়া পাচ্ছি। তোমার শোবার ধরনটা বেশ মজার – একদিকে কাত হয়ে কেমন একটু কুণ্ডুলি পাকিয়ে শোও! তোমার হাতগুলো তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। তোমার হাতের উষ্ণতায় আমার ভয়ডর সব উবে যায়। আবারও নিরাপদ মনে হয় নিজেকে। আচ্ছা, যখন জেগে থাকো তখন কেন তুমি আর আগের মত করছ না আম্মু?
আজ আমি সবে ২১ সপ্তায় পা দিলাম। আম্মু তোমার খুশি খুশি লাগছে না? আজ আমরা কোথায় যেন যাচ্ছি, হয়তো নতুন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি। ওওহ, আরে, এতো দেখতে একটা হাসপাতালের মত লাগছে। ঐ যে একজন ডাক্তার। আম্মু, আমি কিন্তু তোমাকে আগেই বলেছি, বড় হয়ে আমি ডাক্তার হবো, তখন কিন্তু বুয়েট এ পড়ার জন্য আমাকে চাপাচাপি করতে পারবে না, আগেভাগেই বলে দিলাম, হু ! আমার কিন্তু আর তর সইছে না আম্মু। তোমারও মনে হয় সেরকমই লাগছে, তাইনা আম্মু?
...আম্মু তোমার দেখি বুক খুব ধড়ফর করছে, আমার কিন্তু ভয় করছে। ডাক্তারটা তোমাকে কী সব বলছে, আমি তো আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে খুব শীগ্রই কিছু একটা হতে চলেছে ! আম্মু, এই আম্মু, সত্যিই আমার কিন্তু খুউব ভয় করছে! আম্মু একবারের জন্য হলেও একটু সাহস দাও। একবার বল তুমি আমাকে ভালবাস। তাহলেই আমার সব ভয়ডর কেটে যাবে। আম্মু, আমি না তোমাকে খুউব ভালবাসি।
...উঃ...আম্মু... এই আম্মু... ওরা কী করছে? আমার ভীষণ লাগছে তো! এই আম্মু, প্লীজ ওদেরকে থামতে বল না......উঃ... উঃ... আরে খুব ব্যাথা লাগছে তো। প্লীজ ... খোদার দোহাই আম্মু ওদেরকে থামতে বল। আরে, মরে যাব তো, প্লীজ আম্মু আমাকে বাঁচাও................................. আম্মু..................
ঠিক আছে ! ওকে !
আম্মু তুমি ভেবো না, আমি এখন ভালই আছি। আমি এখন জান্নাতে আছি। এখানে ইব্রাহীম নামের একজন বৃদ্ধ লোক আছেন,আমার সাথে সাথে আরও কত্ত বাবু যে সারাদিন তার আশেপাশে থাকে ! আমরা সবাই তাকে আব্বু বলে ডাকি। উনি রোজরোজ আমাদের কে গল্প শুনান। ফেরেশতারা এখানে আমার খেলার সাথী। ওরা আমাকে স- - -ব বলেছে, তোমরা যা যা করেছ সব। তোমরা নাকি গর্ভপাত করিয়েছিলে !
কিন্তু কেন আম্মু ? তুমি কেন এটা করতে গেলে? তবে কী তুমি আমাকে একটুও ভালবাসতে না ! কেনই বা তুমি আমার থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ? হয়তো আমার ই দোষ ছিল...নতুবা এমন হবে কেন ? আমি যদি সত্যিই অন্যায় করে থাকি তবে আমায় মাফ করে দিও আম্মুটি......
আমি কী চেয়েছিলাম আর কী পেলাম ? আম্মু আমি তো শুধু একটু বাঁচতে চেয়েছিলাম। তোমাকে ছেড়ে এখানে থাকতে আমার খুউব কষ্ট হচ্ছে মা মণি। খোদার দোহাই, আমি আবার তোমার আদর পেতে চাই আম্মু। এখানে আমি সবার ছোট। সবাই খুব আদর করে আমাকে। কিন্তু তুমি তো নেই এখানে, আমি তোমার আদর তো পাচ্ছিনা এখানে। আম্মু বল, তুমি আবার একটিবার আমায় জড়িয়ে ধরে আদর করবে। আমি তোমার তুলতুলে নরম কোলে শুয়ে আকাশের মেঘ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাব। তারপর তুমি আমার কপালে চুমু দিবে। ঘুম পাড়ানী মাসি পিষি বলতেই থাকবে... হেঁসে খেলে বড় হব আমি...ইয়া...ব্বড় ডাক্তার হব...
আম্মু আমার জন্য তুমি অনেক কষ্ট করেছ, আমার জন্যই বাবা তোমাকে অনেক মেরেছে, ডাক্তার টাও বুঝি অনেক ব্যাথা দিয়েছিল শেষবার...আম্মু তুমি আমাকে মাফ করে দিও.....................
আম্মু শোনো......আর বেশিক্ষণ তোমাকে জ্বালাব না......... শোনো......
আমি না- তোমায় বড্ড বেশীই ভালবাসি ।।।
একটি গর্ভপাত............
• একটি তাজা হৃদয়ের হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া
• দুটি ঘন কালো চোখের কখনই দেখতে না পাওয়া
• দুটি তুলতুলে হাত যা কখনই তার মায়ের গালদুটি ছোঁবে না
• দুটি পা যা কোনদিনই হাঁটবে না, দৌড়াবে না
• একটি মুখ যার অব্যক্ত কথাগুলি আর কখনই বলা হবে না
* অনুদিত ও ঈষৎ সম্পাদিত। ( আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে সামান্য কিছু সম্পাদনা ও সংযোজন করা হয়েছে ) মূল পোস্ট ফেসবুক পেজ
পোস্টটা যখন পড়ি তখন গলা কাঁপছিল, আর রাত দুটোর দিকে যখন অনুবাদ করছিলাম তখন আর কান্না থামাতে পারিনি।
আপনি যদি গর্ভপাত বিরোধী হন তবে পোস্টটি শেয়ার করুন।