জাফলং এর পুঞ্জির ভিতরের পথ
ভ্রমন লগঃ পূর্ব থেকে পশ্চিমে- প্রথম পর্ব
হাজীপুর বাজারের পাশে পানিশূন্য পিয়াইন নদী
হাজীপুর বাজারের পাশে পানিশূন্য পিয়াইন নদী
খুব শীতে পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল। মনে হচ্ছে স্লিপিং ব্যাগটা ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে আছে। এই দিকে এতটা ঠাণ্ডা পরবে আগে ভাবি নাই। উঠে দেখি তাবুর ভিতরের দিকে ঘেমে চুপচুপা হয়ে আছে। তাঁবু থেকে বেড়িয়ে এসে দেখি বাহিরের দিকে আরও খারাপ অবস্থা, মনে হচ্ছে মাত্র বৃষ্টি পড়েছে। পাঁশের তাঁবুরও একই অবস্থা। সূর্য উঠেনি তখনও, মনে হচ্ছে তাঁবুগুলো শুকানোর জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এরমধ্যে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সবার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলাম, সূর্যিমামা যদিও উঁকি দিয়েছে কিন্তু তার রোদের কোন ত্যাজ নাই বললেই চলে। তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে একটা কাপর নিয়ে তাঁবুগুলোকে ভাল করে মুছে নিলাম। তারপরও শুকানোর জন্য আরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য সকালের নাস্তা হিসাবে নুডুলস রান্নার সিধান্ত নিলাম আর সকালের নাস্তা হিসাবে রাতে রেখে দেওয়া বাকী খিচুড়িটুকু দিনের বেলায় খাওয়ার জন্য রাখলাম।
মোহাম্মদ আলীর ছোট্ট টিনের ঘরের পাশেই খোলা জায়গাতে তাঁর মাটির চুলায় রান্নার সাহায্য চাইতেই, সে তাঁর হাড়ি এগিয়ে ও তার পরিবারকে দিয়ে পিঁয়াজ, মরিচ ধুয়ে কেটে সব ব্যাবস্থা করে দিল। খুব ঝটপট কয়েক প্যাকেট ইনস্ট্যান্ট নুডুলস রান্না করে ফেললাম। মোহাম্মদ আলী তার ছোট্ট টিনের ঘরে আমাদের খাওয়ার ব্যাবস্থা করল তার পরিবারের সকলকে বাহিরে পাঠিয়ে দিয়ে। যদিও তাঁর ছোট্ট ঘরে বসেই বেশ তৃপ্তিতেই খেলাম কিন্তু মনে মনে নিজেকে কিছুটা অপরাধী বোধ করলাম, আমাদের কারনে তাঁর বয়স্ক মা, পরিবার পরিজনকে কিছুক্ষণের জন্য ঘর ছাড়তে হোল।
পান্তুমাই গ্রামের পথে
তখনও তাঁদের সকালের নাস্তা হয়নি। পাঁচ মিসালি শাক ভাঁজি, পোড়া শুকনো লাল মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল আলুর ভর্তা আর ভাত এই হচ্ছে তাঁদের সকালের নাস্তা। মোহাম্মদ আলী তার ঘরের ভাল মেলামাইনের প্লেটগুলো ধুয়ে আমাদের খাওয়ার জন্য এগিয়ে দিল। তাঁকে নিয়েই আমরা খেতে আরম্ভ করলাম। খেতে খেতে সে তাঁর পরিবেরের নাস্তাও আমাদের খাওয়ার জন্য এগিয়ে দিল। যদিও প্রথমে সবাই নিতে আপত্তি করলাম, কিন্তু তাঁর অনুরোধে আমি ও পিয়াল একটু শাক ভাঁজি ও একটু আলুর ভর্তা নুডুলসের সাথেই নিলাম। দুটোই এত মজা লেগেছে যে লোভ সামলাতে না পেরে আমি ও পিয়াল দুজনেই আবার একটু একটু করে আলুর ভর্তা নিলাম, সাথে শিবলি যোগ হয়ে কিছুটা নিল।
ভর্তা এমনিতেই আমার খুব পছন্দের খাবারের একটি, তার উপর তাঁর বাড়ির ভর্তাটি এতটাই মজা ছিল যে মনে হচ্ছিল পুরোটা একাই সাবার করে দেই। আগেও অনেকবার ভর্তা খেয়েছি কিন্তু এতটা তৃপ্তি পাইনি, যেটা তাঁর বাড়িতে পেয়েছি। আল্লাহ্ গরীবদের খুব ভাল ভাল খাওয়ার ভাগ্য দেন না সত্যি কিন্তু গরীবি খাওয়া যাই দেন, তার মধ্যে অনেক রহমত ও বরকত দিয়ে থাকেন মনে হয়। তাই হয়ত গরীব মানুষগুলো দুই মুঠো এই খাওয়া জুটানোর আশায় জীবন যুদ্ধে দৌড়াতে থাকে। আল্লাহ্র কাছে অনেক অনেক শুক্রিয়া যে তিনি ঐ সময় আমাকে এই রকম খুব তৃপ্তিদায়ক একটা খাবার আমার ভাগ্যে দিয়েছিলেন, যা কিনা পরম তৃপ্তিতে উপভোগ করেছি। হয়ত অনেক বড় লোকের বাসায় অনেক ভাল খাওয়া দাওয়াতেও এত তৃপ্তি পাব না যা মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছিলেন।
পান্তুমাই ঝরনার পাশে
পান্তুমাই ঝরনার পাশে
যাইহোক খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে, তাঁবু গুছিয়ে মোহাম্মদ আলীকে বিদায় জানিয়ে আমরা হাজীপুর বাজারে গিয়ে হাশেমের চায়ের দোকানে যেয়ে চা খেয়ে পান্তুমাই রওনা হতে হতে প্রায় সাড়ে ৯টা বেজে গেল। বাজারের পাশদিয়ে শর্টকাট পথে পিয়াইন নদী পাড় হয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বিজিবি চেকপোস্টের একজন সিপাহীর সাথে দেখা। তাঁকে আমাদের পরিচয় দিয়ে জানালাম যে আমরা পান্তুমাই হয়ে বিছানাকান্দি যাচ্ছি। সে আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে চেকপোস্টে গেল। কিছুক্ষণ পর এসে বেশ অমায়িকভাবে আমাদের জানাল যে তাঁদের কমান্ডার স্যার আমাদের দাওয়াত করেছেন একটু উনার সাথে দেখা করার জন্য। আবার চার পাঁচ কিলোমিটার পিছনে ফিরে আসতে হবে, ভাবতেই মেজাজটা খুব বিগরে গেল কিন্তু তার মুগ্ধ ব্যাবহারের কারনে রাগটা কোন রকমে চেপে রাখলাম। সেও আমাদের সময় নষ্টের কারনে ক্ষমা চাইল, উপরের অর্ডার তাই নিরুপায়ের মতো পালন করতে হচ্ছে।
পান্তুমাই ঝরনার পাশে
পান্তুমাই ঝরনার পাশে
তাঁকে নিয়ে আবার হাজীপুর বাজারে ফেরত আসলাম, সময় বাঁচানোর জন্য একটা ট্রাক্টরে উঠে বাজার পার হয়ে কতটুকু এগুতেই পাশে আরেকটা বিজিবি চেকপোস্টে অপেক্ষারত কমান্ডার সাহেবকে দেখতে পেয়ে আমরা সেখানেই নেমে গেলাম। ভাগ্য ভাল যে আমাদেরকে আরও দুই তিন কিলোমিটার পিছনে ক্যাম্পে যেতে হয়নি। চেকপোস্টে এগুতেই কমান্ডার সাহেব হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে হ্যান্ডসেক করে নিজেকে আমাদের সাথে পরিচিত করলেন। আমরাও নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যের কথা জানালাম। তিনি জানালেন যে, বিজিবি চেকপোস্টগুলোতে বিএসএফ এর দৃষ্টি থাকে আমরা চেকপোস্টের পাশ দিয়ে এই ব্যাগপত্র নিয়ে রওনা হলে বিএসএফ এর সন্দেহের কারন হতে পারি এবং এই কারনে হয়ত বিজিবিকেও প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে। তিনি আমাদের চেকপোস্টের পাশ দিয়ে শর্টকাট পথে না যেয়ে বাজার থেকে সোজা পথে গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলেন এবং আমাদের নিয়ে আসা সেই সিপাহিকে বললেন যেন সে আমাদের সেই পথে এগিয়ে দেয়।
পান্তুমাই ঝরনার পাশের মাঠে বিশ্রামরত
অতএব দেরি না কম্যান্ডার সাহেবকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার এগুতে আরম্ভ করলাম। হাজীপুর বাজার পার হয়ে কিছুটা এগিয়ে আবার শুকনো পিয়াইন নদী পার হয়ে পান্তুমাই গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পার হয়ে গেল। গ্রামের ভিতরে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে সিপাহি আমাদের সোজা একটি পথ দেখিয়ে দিয়ে সে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল। এর মধ্যে ৮/১০ বৎসর বয়সি এক বালকের সাথে পরিচয় হোল নাম জুয়েল, সে আমাদের পিছন পিছন অনেকটুকু এসেছে। আলাপ প্রসঙ্গে জানালো তাঁর বাড়ি বিছানাকান্দি তবে সে হাজীপুর থাকে। আমাদের সাথে বিছানাকান্দি যাওয়ার কথা বলতেই সে রাজী হয়ে গেল। প্রায় ৪০/ ৪৫ মিনিট সেই পথে হেঁটে আমরা পান্তুমাই ঝরনার কাছের মাঠে এসে পৌছালাম। ততোক্ষণে ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে।
ইসলামাবাদ গ্রামের পথে
সোনারহাট গ্রামের পথে
সবাই ব্যাগপত্র মাঠের একপাশে রেখে মাঠের কোনায় এগিয়ে গেলাম সেই ঝরনাটি দেখার জন্য। ঝরনাটি দেখে মোটামুটি বলা যায় অনেকটা নিরাশ হলাম, কারন গত ছয় মাস আগে মে...তে এসে এর যা রূপ যৌবন দেখেছিলাম এখন তার কানাকড়িও নাই। সেই অনেক দূর থেকে, প্রায় পান্তুমাই প্রবেশমুখ থেকে এর যে গর্জন শুনেছিলাম তখন, এখন মাঠে এসেও তা পাচ্ছি না। বর্ডার ঘেঁষা দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নেমে এসে ঝিরি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ঝরনার নিচে বিএসএফ এর একটি চেকপোস্ট, দুইজন বিএসএফ বেশ কিছুক্ষণ আমাদের পর্যবেক্ষণ করছিল। ঝিরির উল্টো দিকে মাঠে আমাদের অবস্থান। গতবার এখানে এসে স্থানীয় কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছিলো। ঝরনার নাম জিজ্ঞাসা করাতে কেউ বলল তারা এইটাকে পান্তুমাই ঝরনা বলে, আবার কেউ বলল তারা এইটাকে ফাটাছড়া ঝরনা বলে। যে মাঠটিতে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম স্থানীয়দেড় মতে এই মাঠটিও নাকি ভারতের সিমানার ভিতরে পরেছে, কিন্তু গুগোল আর্থের ম্যাপ অনুযায়ী আমার জিপিএস বলতেছে যে এই মাঠটি বাংলাদেশের ভিতরে এবং আমরা বাংলাদেশের ভিতরেই অবস্থান করছি। আগে একসময় নাকি বর্ডারের দুই পাশের লোকজনের ভিতর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। এই মাঠে দুই পাশের লোকই এক সাথে ফুটবল ম্যাচ খেলত। বর্ডারের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর বেশ কয়েক বৎসর যাবত সব বন্ধ।
ঝিরি পার হয়ে নোয়াগ্রামের পথে
ঝরনা দেখে ও ছবি তোলার পর্ব শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর ১২টা বেজে গেল। ঠিক করলাম এখানেই দিনের খাওয়ার পর্বটা সম্পূর্ণ করি সাথে নিয়ে আসা গতরাতের খিচুড়ি দিয়ে। সদ্য যোগ হওয়া আমাদের সর্ব কনিস্ট ট্রেকার জুয়েলকে সাথে নিয়ে সবাই খিচুড়ি দিয়ে দিনের আহার শেষ করে আবার রওনা হলাম। ততোক্ষণে ঘরিতে প্রায় পৌনে ১টা বাজে। গ্রামের মেঠোপথের দুইপাশে নান জাতের ঘন গাছপালা, তার মাঝে রোদের লুকোচুরি খেলার ভিতর দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে বাঁ পাশে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে কিছু কিছু ঘরবাড়ি আর ডান পাশে অর্থাৎ উত্তর দিকে পান্তুমাই ঝরনা থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঝিরিটা চোখে পরে। আস্তে ধীরে বেশ আয়েশ করেই সবাই এগুচ্ছিলাম যদিও জুয়েল তাড়াতাড়ি হাঁটার জন্য বার বার তাড়া দিচ্ছিল। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা হেঁটে আমরা পান্তুমাই পার হয়ে ইসলামাবাদ পার হয়ে সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পের কাছে এসে পৌঁছলাম।
ঝিরি পার হয়ে নোয়াগ্রামের পথে
বিজিবি ক্যাম্পের সিপাহীর সাথে আলাপ করে আমাদের উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে বিছানাকান্দি কোন পথে সুবিধাজনক হবে জানতে চাইলাম। তিনি উত্তর দিকে ঝিরি পার হয়ে নোয়াগ্রাম হয়ে, লক্ষণছড়া হয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিলেন। খুব অল্প পানির ঝিরি পার হয়ে নোয়াগ্রাম হয়ে আমরা লক্ষণছড়ার পথে রওনা হলাম। নোয়াগ্রাম পার হয়ে কিছু দূর এগুতেই আশে পাশের দৃশ্য পাল্টে গেল। খোলা পথের বাঁদিকে অর্থাৎ দক্ষিণে যত দূর চোখ যায় শুধু সোনালী ধানের ক্ষেত তারপর শিল্পীর আঁকা তুলির আচরের মতো দুরের গ্রামগুলো চোখে পরে, আর ডানদিকে অর্থাৎ উত্তরে মেঘালয়ের বিশাল পাহাড়ের হাতছানি। এইভাবে প্রায় ঘণ্টা খানেক হেঁটে আমরা লক্ষণছড়া গ্রামে এসে পৌঁছলাম।
গ্রামের ছোট্ট একটা হোটেলে কয়েক মিনিটের যাত্রা বিরতি করে, পিঁয়াজু ও চা খেলাম। হোটেলের ৫/৬ গজ পিছনে সীমানা পিলার চোখে পড়ল। নামেই বুঝা যায় যে ছড়া বা ঝিরির নামে গ্রামটির নাম। মেঘালয়ের পাহাড়ের গোঁড়ায় গ্রামটির অবস্থান। গ্রামটির পাশ দিয়ে ছোট্ট শান্ত এই ঝিরি বা ছড়াটি বয়ে চলেছে। গ্রামবাসীদের গোসল, কাপড় ও হাড়ি পাতিল ধোঁয়া থেকে বুঝা যায় যে গ্রামের প্রায় সব পানির চাহিদা এই ছড়াটি পুরন করে থাকে। উত্তর দিকে তাকাতেই প্রায় ৩০/৪০ গজ দূরে একটি সুন্দর পাকা ব্রিজ চোখে পড়ল, স্থানীয়রা জানাল যে সেটা ভারতের ভিতরে।
লক্ষণছড়া ঝিরি
লক্ষণছড়া ঝিরিতে কয়েক মিনিটের জন্য দাড়িয়ে দুই পাশটা এক পলক চোখ বুলিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে আবার রওনা হলাম বিছানাকান্দির পথে। এদিকে শিবলী ও তনময় অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। আমি ও পিয়াল কয়েক কদম এগুতেই পাশে চোখ পড়ল বাংলাদেশ ভারতের সীমানা পিলারের দিকে। পথের মাত্র ৮-১০ ফিট দূরে, পিলারের কাছে যেয়ে ছবি তোলতেই দূর থেকে শিবলী চেঁচিয়ে উঠল ছবি না তুলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাবার জন্য। আমরা তবুও কয়েক মিনিট দেরী করে ও ছবি তুলে আবার রওনা হলাম। ততোক্ষণে তনময় ও শিবলী আমাদের দৃষ্টি সীমা পেরিয়ে অনেক দূর চলে গেছে।
তাঁদেরকে ধরার জন্য বেশ জোরেশোরে প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটলাম, কিন্তু তাঁদের আর দেখা পাচ্ছি না। উত্তরে মেঘালয়ের বিস্তৃত পাহাড় আর দক্ষিণে শুধু পাঁকা ধানের ক্ষেত, দূরে একটি ছোট্ট গ্রাম চোখে পরে। স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে বিছানাকান্দি যাওয়ার পথ একটাই, যদি পাহাড়ে না উঠে থাকে তাহলে এই পথেই গিয়েছে। সেই ভরসাতেই এগুতে থাকলাম। একসময় লক্ষ্য করলাম যে আমরা পাহাড়ের খুব কাছে চলে এসেছি, আর মাত্র ২৫-৩০ ফিট দূরে পাহাড় এবং দুইজন বিএসএফ পাহাড় থেকে নেমে আমাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। আমাদের দেখে তারা কিছু জানার প্রয়োজন মনে করল না সুতরাং আমারাও তাঁদের সাথে কোন কথা না বলে তাঁদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে আসলাম।
ঝিরি নোয়াগ্রামের পথে
ঝিরি নোয়াগ্রামের পথে
আরও কিছুক্ষণ হেঁটে আমরা একটা গ্রামে কাছে চলে আসলাম। তনময় ও শিবলীর সমন্ধে নিশ্চিত হতে দুই একজন গ্রামবাসীকে তাঁদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে তারা কিছুক্ষণ আগেই এই পথে এগিয়ে গেছে। আরও কিছুটা এগিয়ে গ্রাম থেকে বেড় হতেই চোখে পড়ল তনময় ও শিবলী, জুয়েলকে নিয়ে একটা খালের পাশে আমাদের জন্য অপেক্ষায় রত। বেশ চওরা খালের উপরে বাশের তৈরি একটা লম্বা সাঁকো তাও আবার নড়বরা। সবাই যদিও সাঁকোটি নিরবিগ্নেই পার হলাম, তবে শিবলীর পার হওয়া ছিল দেখার মতো। শিবলীর মতো আমিও সাতার পারি না, তবে সাঁকো পার হওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যে সে পানিকে যতটা না ভয় পায় তার চেয়ে অনেক বেশী ভয় পেয়েছে সে সেই নড়বরে বাসের সাঁকো পার হতে।
সাঁকো পার হয়ে আরও কিছুটা এগুতেই দূর থেকে ইঞ্জিন চালিত মেশিনের শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগল। এগুতে, এগুতে মেশিনের শব্দ ক্রমেই আরও স্পষ্ট হতে লাগল। বুজতে পারলাম যে আমরা বিছানাকান্দির সেই নদীটির অনেকটা কাছে চলে এসেছি। নদী থেকে পাথর তোলার কাজে ব্যাবহার করা মেশিনের শব্দই এটা, যা কিনা ক্রমেই আরও স্পষ্ট হতে লাগল। আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই পাথর ও বালির স্তূপের কাছে পৌঁছলাম, স্থানীয় কয়েকজন পাথর শ্রমিকের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে এলাকাটি বিছানাকান্দির কুলুমছড়া গ্রাম। নদী পার হয়ে ওপারে গেলেই বগাইয়া পৌঁছাব। সূর্য ডুবু ডুবু প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো, জুয়েলের বাড়ি এপারে বিছানাকান্দিতে, তাই তাকে আর এগুতে না দিয়ে বিদায় জানালাম। সূর্যাস্তের আগেই নদীর ওপারে পৌঁছে রাতে বগাইয়াতে থাকার সিধান্ত নিলাম।
বিছানাকান্দি জিরো পয়েন্টে
ওপারে পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিকের সাথে পাথর ও বালির স্তূপ পেড়িয়ে ক্রমেই উত্তর পশ্চিম দিকে এগুতে থাকলাম। আলাপ প্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে তাঁরা কেউই এ এলাকার স্থানীয় না, বেশীর ভাগই নরসিংদি, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহের লোক জীবিকার প্রয়োজনে এখানে পাথর শ্রমিকের কাজ করে। কিছুক্ষণ তাঁদের সাথে এগিয়ে আমরা সেই নদীতে এসে থমকে দাঁড়ালাম, অবাক হয়ে কিছুক্ষণের জন্য নদীটি দেখলাম, মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম যে এতো সুন্দর জায়গা বাংলাদেশে আছে? নিজের চোখকেও মনে হয় বিশ্বাস হচ্ছিল না, সারাদিনের ক্লান্তি মনে হল নিমিষে উড়ে গেল। রক্তিম সূর্য সম্পূর্ণই পশ্চিমে হেলে পরেছে, বিশাল পাহাড়গুলোর ছায়ায় অন্ধকারের মাত্রাটা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। খুব, খুবই আফসোস হচ্ছিল কেন আরও কিছুটা আগে এখানে পৌছাতে পারলাম না। উত্তরের ভারতের পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে এসে সহস্র পাথরের মধ্যে দিয়ে আপন মনে নেচে চলেছে স্বচ্ছ টলটলে পানির এই ধারা। এতো সুন্দর একটা জায়গার বর্ণনা মনে হয় আমার দুই কলম লিখার দ্বারা কখনই সম্ভব না। খুব স্লো সাটারে বেশ কয়েকটা ছবি নিলাম এই অন্ধকারের ভেতরে। স্থানীয় শ্রমিকেরা জানাল যে আমরা বিছানাকান্দি জিরো পয়েন্টে আছি। নদীর পাশেই বিজিবির একটা চেকপোস্ট চোখে পরল। সেই পোস্টে যেয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বগাইয়ার দিকে রওনা হলাম।
বিছানাকান্দি জিরো পয়েন্টে
চলবে……
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৪৭