ঘুরাঘুরি বা ভ্রমন আমরা সবাই পছন্দ করি। চাকুরি বা ব্যাবসার প্রয়োজনে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমন করে থাকি। আবার অনেকে সাপ্তাহিক দুইদিন ছুটির আগে বা পরে কোন সরকারী ছুটি মিলিয়ে তিন চার দিনের ছুটি পেলেই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ি। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমরা অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। কেউবা কোন প্রাকৃতিক স্থানে যেমন সমুদ্রের তীরে, কোন দ্বীপে, কোন বন জঙ্গলে বা পাহাড় পর্বতে বেড়াতে যাই আবার কেউবা প্রকৃতিতে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত কোন ইকো রিসোর্টে বেড়াতে যাই।
বর্তমানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও মিডিয়ার বদৌলতে আমরা দেশের মধ্যেই অনেক নুতন নুতন দর্শনীয় স্থানের সন্ধান পাচ্ছি এবং সুযোগ পেলেই ঐসব স্থানে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ছি। উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও অন্নান্য আনুসঙ্গিক সুবিধার কারনে অতি সহজেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছি এবং ভ্রমন শেষ করে আবার স্বল্প সময়ে ফিরে আসছি। অথচ কয়েক দশক আগেও তিন চারটা ফেরী পার হয়ে শুধু ঢাকা থেকে চিটাগাং পৌছাতেই প্রায় পুরো একদিন লাগত, আর যদি ফেরীর জ্যামে পরে তাহলেত দুই তিনদিনের নিচে ত আর কথাই নাই। কিংবা যমুনা নদীর ফেরী পার হয়ে বগুরা বা রংপুর যেতে এক দুদিন লাগত। যা কিনা বর্তমানে কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। সুন্দরবন, কক্সবাজার, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, জাফলং হাতেগোনা এই কয়েটি জায়গায় ছিল সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ভ্রমণের স্থান।
বর্তমানে যেমন ভ্রমণের স্থানের সাথে সাথে ভ্রমণকারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে তেমনই ভ্রমণের প্রকারভেদ ও হয়েছে। কেউ ভ্রমন করেন শুধু ভ্রমণকারী বা ট্র্যাভেলার হিসাবে, কেউবা ট্রেকার, কেউবা হাইকার হিসাবে আবার কেউবা মাউনটেনিয়ার।
ইংরেজি শব্দ ট্র্যাভেল (Travel) বলতে যা বুজায় তাহলো কোন ব্যাক্তি বা পরিবহনের চলাচল বা স্থানান্তর। অর্থাৎ আমরা যখন পৃথিবীর এক জায়গা থেকে অন্য কোন জায়গা বা গন্তবে বাস, ট্রেন, এরোপ্লেন, জাহাজ কিংবা অন্য কোন পরিবহনে ভ্রমণ করি তখন তাকে ট্র্যাভেল বলা হয়। এবং যিনি ট্র্যাভেল করেন তাকে বলে ট্র্যাভেলার। মানুষ নানা কারনে ট্র্যাভেল করে থাকেন। বেড়ানো, ভ্রমণ, ঘুরাঘুরি ছাড়াও অফিসিয়াল, ব্যাবসায়িক কিংবা অন্য কোন কারনেও ট্র্যাভেল করে থাকেন।
ট্রেক(Trek) বলতে বুজায় দীর্ঘ পায়ে হাটা পথ (কোথাও কোথাও বিপদজনক ও দুঃসাহসিক) যেখানে সাধারণত কোন পরিবহন বা যানবাহন চলাচল করে না। এই দীর্ঘ বিপদজনক ও দুঃসাহসিক পায়ে হাটা পথ অতিক্রম করাকে বলে ট্রেকিং(Trekking) এবং যিনি করেন তাকে বলে ট্রেকার(Trekker)। ট্রেক শব্দের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা, যার অর্থ হল টানা ভ্রমণ বা লম্বা ভ্রমণ। ১৯ শতকে ইংরেজি ভাষায় ইহা দীর্ঘ, কঠিন ও পরিশ্রমের পায়ে হাটা পথ হিসাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। মূলত এটি একটি Outdoor Activity, যেটা কিনা recreational purpose এ ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। এই ট্রেকিং এ ট্রেকাররা কোন আজানা, আচেনা বা আপ্রচলিত জায়গা, বন জঙ্গলের একটি নিদরিষ্ট স্থান থেকে ম্যাপ ও কম্পাসের সাহায্যে ট্রেক করে অন্য একটি নিদরিষ্ট স্থান বা গন্তবে পৌছায়।
হাইকিং (Hiking), ট্রেকিং (Trekking) এর মত একটি Outdoor Activity, যেটা কিনা recreational purpose এ ব্যাবহার করে থাকে। ট্রেকিং সাধারনত সমতলে করে থাকে এবং হাইকিং উঁচু নিচু অর্থাৎ পাহাড় পর্বতে করে থাকে। মূলত বলা যায় যে পাহাড় পর্বতে ট্রেকিং করাকে হাইকিং বলা হয়। তবে হাইকিং ট্রেকিংএর চেয়ে বেশী কষ্টকর।
মাউনটেনিয়ারিং (Mountaineering) পর্বতে শিখরে আরোহণের জন্য হাইকিং, ট্রেকিং, স্কিইং (skiing) ও ক্লাইম্বিং (climbing) কে বুজায়। ইহাকে mountain climbing ও বলা হয়ে থাকে। মাউনটেনিয়ারিংকে মূলত স্পোরস (sport), হবি (hobby), পেশা (profession) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বহুযুগ পূর্ব থেকেই মানুষের পর্বতের চূড়া বা শিখরে আরোহণের বা জয়ের নেশা ও চেষ্টা থেকেই মাউনটেনিয়ারিং উৎপত্তি বলা যায়। আমাদের দেশে মাউনটেনিয়ারিং করার মত কোন পাহাড় পর্বত না থাকায় ইহা তেমন কোন জনপ্রিয়তা পায় নাই। আলোচনার স্বার্থে তাই আমরা ট্রেকিং ও হাইকিং এ সীমাবধ্য থাকি।
“পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে”। ট্রেকিং এর ক্ষেত্রেও ট্রেকার তার পছন্দমত ট্রেক তৈরি করে, সেই ট্রেক আনুসরনে ট্রেকিং করে। এইজন্য প্রথমে ম্যাপে সম্পূর্ণ ট্রেকটির একটি রুট তৈরি করে এবং ম্যাপ ও ম্যাপিং কম্পাসের সাহায্যে সেই রুট ধরে ট্রেকিং করে থাকে। এইজন্য ট্রেকারদের ম্যাপ ও ম্যাপিং কম্পাসের সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা খুবই জরুরি। ম্যাপ, ম্যাপস্কেল, টোপগ্রাফিক ও ট্যাঁরেইন ম্যাপ, কণটোর লাইন, ম্যাপ ডাটাম, ম্যাপ গ্রিড ও ম্যাপের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান থাকা জরুরি। সাথে ম্যাপিং কম্পাস, কম্পাসের ওরিয়েন্টইং লাইন, ওরিয়েন্টইং এরো, ডাইরেকসন অফ ট্র্যাভেল এরো, কম্পাস নিডল সম্বন্ধে ভাল জ্ঞান থাকা জরুরি। বিশেষ করে যারা এডভেঞ্চার প্রিয় তাদের জন্য ত অবশ্যই।
ম্যাপ ও ম্যাপিং কম্পাসের জটিলতা অনেকাংশে সহজতর করে দিয়েছে বর্তমান সময়ের আধুনিক প্রযুক্তি জিপিএস, যা কিনা একটি নির্ভরযোগ্য নেভিগেসনাল প্রযুক্তি হিসাবে বহুল প্রচলিত। এইজন্য ট্রেকার ও হাইকাররা নেভিগেসনের জন্য ম্যাপ ও ম্যাপিং কম্পাসের পাশাপাশি জিপিএস ব্যাবহার করে থাকে, অনেকে ম্যাপ ও ম্যাপিং কম্পাসের বিকল্প হিসাবেও জিপিএস ব্যাবহার করে থাকে।
উল্লেখ্য যে আমাদের দেশের সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে যেসব ম্যাপ তৈরি হয় তা ট্রেকিং বা হাইকিং এর জন্য মোটেও নির্ভরযোগ্য নয়, বিশেষ করে যেসব এলাকায় ট্রেকিং বা হাইকিং করা হয় সেইসব এলাকার কোন ডিটেইল ইনফরমেসন ম্যাপে থাকে না। তবে গুগোল ম্যাপ বা গুগোল আর্থের সাহায্যে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রেকিং বা হাইকিং এর ম্যাপ তৈরি করে নিতে পারেন, কিংবা জিপিএস এ প্রয়োজনীয় ইনফরমেসনগুলো লোড করে নিয়ে ট্রেকিং বা হাইকিং করতে পারেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা যারা বাংলাদেশে ট্রেক করি তাহারা বেশীরভাগই বান্দারবানে কিছু খুবই পরিচিত ট্রেইলে যেমন বগালেক, কেউকারাডং, তাজিংডং, পুকুরপাড়া, তিনমাথা এই স্থানগুলোতে ট্রেক করতে যাই, তাও আবার অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত লোকাল বা স্থানীয় একজনকে গাইড হিসাবে সাথে নিয়ে। যার জ্ঞান কিনা শুধু ঐ স্থানগুলো চিনা পর্যন্ত এবং সে ঐ স্থানে পৌঁছান ও ফেরত নিয়ে আসা পর্যন্তই তার কাজ। এবং এর জন্য পারিশ্রমিক হিসাবে তার ডিম্যান্ড থাকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা যা কিনা আমরা সানন্দে পূরণ করি, শুধু তাই না পুরো ট্রিপে জামাই আদরের মতো তার থাকা খাওয়া ও বহন করে থাকি। তাছাড়া ধরা যাক আপনি নাফাখুম যাবেন কিন্তু গাইড রেমাক্রি পর্যন্তই চেনে, সেক্ষেত্রে সে রেমাক্রি থেকে আরেকজনকে গাইড হিসাবে সাথে নিবে নাফাখুম যাওয়ার জন্য এতে করে খরচ হবে আরও বাড়তি কয়েকশত টাকা। সব মিলিয়ে দেখা যায় আপনার সমস্ত ট্রিপের দের থেকে দুই গুন বেশী খরচ হয় শুধু অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত গাইডের জন্য। দেখা যায় সেই অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত গাইডই আমাদের সকল ভরসা, তাকে ছাড়া আমরা ট্রেকিং বা হাইকিং চিন্তাই করতে পারি না। এটাই কি আসলে হাওয়া উচিৎ? মনে হয় না। গাইড আপনার একমাত্র ভরসা বা অবলম্বন না, সে থাকবে আপনার সাহায্যের জন্য। একজন ট্রেকার বা হাইকার হিসাবে আপনার আসল গাইড হওয়া উচিৎ নেভিগেসনাল টুলস যথা ম্যাপ, কম্পাস, বা জিপিএস। যদি আপনি এইগুলাকে গাইড মনে করেন তাহলে যে এলাকায় আপনি ট্রেকিং যাবেন সেই এলাকা সম্বন্ধে কিছুটা হলেও আগে থেকে ম্যাপে স্টাডি করবেন এবং আপনার সম্পূর্ণ ট্রেকিং বা হাইকিং এর একটি রুট হয়ত সেই ম্যাপে বা জিপিএসে তৈরি করে আপনি সেই এলাকায় প্রবেশ করবেন। এইক্ষেত্রে ট্রেকিং এর ঐ এলাকা সম্বন্ধে আপনার ভাল একটা ধারণা হবে এবং ঐ এলাকায় ট্রেকিং এ আপনি আরও কনফিডেনছ পাবেন। অথচ আমরা অনেকেই না জেনে, না শুনে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পরে ঠিকই রওনা দেই নুতন জায়গা ঘুরে বেড়াব বলে।
আমরা অনেকেই ট্রেকিং বা হাইকিং এর এইসব এলাকাতে খুব সুন্দর সুন্দর পাহাড় আছে, লেক আছে, ঝরনা আছে, জলপ্রপাত আছে শুনে অথবা বিভিন্ন মাধ্যমে দেখে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাই এবং সুযোগ পেলে যাওয়ার জন্য ঝাপিয়ে পরি, অথচ বিনা পরিবহনে এক দুদিন পায়ে হেঁটে ট্রেকিং বা হাইকিং করে যাওয়ার কষ্টটার কথা মোটেও ভাবি না। পরিনামে যা হয় দেখার আনান্দ ত দূরের কথা ট্রেকিং এর কষ্টে মাঝপথে অসুস্থ হয়ে কান্নাকাটি আরম্ভ হয়। পুরো টিমের জন্য একটা বিপাকের অবস্থা সৃষ্টি হয়, অসুস্থকে ফেলে সামনে আগান যায় না আবার নিয়েও সামনে আগান যায় না। কি করবেন এই অবস্থায়??? যাওয়ার আগেই টিম মেম্বার বাছাইয়ের সময় সেটা মাথায় রেখে টিম মেম্বার সিলেক্ট করুন।
চলবে-