দিন ক্ষণ তেমন কিছুই মনে নাই, শুধু মনে পরে ১৯৯৮ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বেরের ঘটনা। বাসায় ফিরে শুনলাম কোন এক বন্ধু ফোন করেছিলো, কিন্তু নাম বলতে পারল না। সন্ধ্যার পর আবার ফোন আসল স্বপন, পুরনো এক বন্ধুর গলা শুনতে পেলাম। ছাত্র জীবন শেষ করার বেশ কয়েক বৎসর পর তার সাথে আলাপ। শুরুতেই সে জানাল যে অনেক দিন পর ছুটি নিয়ে ঢাকায় মা বাবার কাছে এসেছে। তার বাবা রেলওয়েতে চাকুরীরত, সেই সুবাদে সে রেলের একটি কেবিনের পাস/ টিকেট ম্যেনেজ করেছে, চিটাগাং হয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছে আসিফ ও আনিস, আরও দুইজন পুরনো বন্ধুকে নিয়ে। আমাকেও অফার দেয়া হল তাদের সাথে যোগ দিতে; ঐ রাতেই ট্রেন। অফারটা পাওয়ার সাথে সাথেই আগেপিছে কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম তাদের সাথে যেতে। বাসায় জানাইতেই আপত্তির ঝড় উঠে গেল, তবুও আমি যাবই বুজতে পেরে ভ্রমনের কিছু কন্ডিশন জুড়ে দেয়া হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কাপর চোপর গুছিয়ে সাথে আমার প্রাণহীন সঙ্গী যা কিনা আমার ভ্রমণের সব সৃতিকে আগলে রাখে সেই ক্যেমেরাটাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে কমলাপুর ষ্টেশনের দিকে রওনা হলাম। যথাসময়ে ষ্টেশনে পৌঁছে গেলাম। গাল গল্প, হাসি ঠাট্টা, পুরনো সৃতিচারন করতে করতে আমরা অনেকটা ক্লান্ত এরই মধ্যে ট্রেনটা আখাউরা ষ্টেশন পার হয়ে গেছে। সবাইকে একটু ঘুমিয়ে নিতে বললাম, কারন সকালে বাসে চেপে কক্সবাজার যেতে হবে, আবার কক্সবাজার থেকে আরেক বাসে টেকনাফ যেতে হবে। অনেক লম্বা পথ পারি দিতে হবে, সুতরাং একটু বিশ্রামের দরকার। সবাই শুয়ে পরলাম কিছুক্ষণ ঘুমাব বলে।
কিন্তু ঘুম আর হল না, সারাক্ষণই একজন আরেকজনকে এটা ওটা বলছে। খুব সকালে বাহিরে তাকিয়ে দেখলাম সীতাকুণ্ডের পাহারসারি আমাদের চিটাগাং প্রবেশের সংকেত দিচ্ছে। ট্রেন থেকে নেমেই সাথে সাথে বাসের জন্য রওনা হলাম। ষ্টেশন রোডের এস আলম কাউনটার থেকে জানান হল যে কক্সবাজারের বাস নিউমার্কেট কাউনটার থেকে ছারবে, কোন দেরি না করে একটা বেবিট্যাক্সিতে উঠে নিউমার্কেট কাউনটারে চলে গেলাম। জানতে পারলাম ৮/১০ মিনিটের মধ্যেই একটা বাস কক্সবাজারে রওনা দিবে, সাথে সাথে টিকেট কেটে একজনের হাতে দিয়ে বললাম যে আমার জন্য একটু অপেক্ষা করতে। বাসা থেকে জুড়ে দেয়া শর্ত অনুযায়ী চিটাগাং বসবাসরত বড়বোনকে ফোন করবার জন্য পাশে ফোনের দোকানে গেলাম। ফোনে কথা বলতে বলতে দেখতে পেলাম যে বাসটা আস্তে আস্তে এগুচ্ছে, অতএব ফোন শেষ করে তারতারি দৌড়ে আসলাম বাসের জন্য কিন্তু ততক্ষণে বাস আমাকে ফেলে চলে গেছে সাথে আমার বন্ধুরাও। কাউনটারে বলে কোন লাভ হল না, তাদের পরামর্শ আনুসারে একটি বেবিট্যাক্সিতে করে এস আলমের বহদ্দারহাট কাউনটারে চলে গেলাম, সেখানে যেয়ে জানলাম যে তাদের কোন প্যেছেঞ্চার না থাকায় বাস থামেনি মিনিট পাচেক আগে বাসটি চলে গেছে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে পরবর্তী বাসের টিকেট কেটে অপেক্ষা করতে থাকলাম। যথাসময়ে বাসে উঠে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। বাসটি বেশ জোরেশোরে চালাচ্ছিল, একটু আশ্বস্ত হলাম এই ভেবে যে বন্দুদেরকে পেতে খুব একটা অসুবিধা হবেনা। জানালার বাহিরের দৃশ্য দেখতে দেখতে অনেকটুকু পথ পেরিয়ে গেলাম। যতটুকু মনে পরে কেরানিহাটের পরে এস আলমের একটা বাস রাস্তায় দাঁড়ানো দেখেছিলাম, সম্ভবত বাসটির কোন সমস্যা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাসটি না দাঁড়ানোর কারনে তেমন কিছু বুজা গেল না। যথাসময়ে কক্সবাজারে পৌঁছে গেলাম।
পৌঁছেই বন্ধুদের খোজতে লাগলাম, কিন্তু তাদের কোন সন্ধান পাচ্ছিলাম না। এস আলমের কাউনটারে ওদের সন্ধান করেও কোন লাভ হল না। প্রায় ঘন্টাখানেক পার হয়ে গেল, তাদের কোন খোঁজ নেই। অবশেষে রাস্তায় বেড়িয়ে আশে পাশে ওদের গুছতে লাগলাম, এরই মধ্যে মনে হোল কেউ আমাকে উপর থেকে ডাকছে। উপরে তাকাতেই দেখি আসিফ পাশের দোতালা থেকে ডাকছে। উপরে যেয়ে দেখলাম তারা থাকার জন্য হোটেলে রুম ঠিক করছে, আমি আপত্তি জানিয়ে সরাসরি টেকনাফ যাওয়ার কথা বললাম। স্বপন সাতার জানে না বলে সেন্ট মারটিন যাওয়ার ব্যাপারে সে প্রথম থেকেই আপত্তি করে আসছিল, টেকনাফের কথা বলায় সে পুরোই আঁচ করতে পারল যে আমি সেন্ট মারটিন যাওয়ার প্ল্যান করছি। আসিফ, আনিসেরও ইচ্ছে সেন্ট মারটিন যাওয়ার শুধু বাধসাধল স্বপন, যাইহোক তাকে সবাইমিলে অনেক বলে কয়ে আজকের জন্য টেকনাফ পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাপারে রাজি করান সম্ভাব হল। হোটেল ম্যানেজারকে টেকনাফ থেকে ফিরে এখানে উঠবো এই আশ্বাস দিয়ে হোটেল থেকে বিদায় নিয়ে আবার বাসস্ট্যান্ডে চলে আসলাম। বাসের টিকেট কেটে আবার টেকনাফের উদ্দেশে যখন রওনা দিলাম ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেল। ইচ্ছা ছিল পথিমাধ্যে কোথাও কিছু খেয়ে নিব। কিন্তু তা আর হয়নি। সন্ধ্যায় যেয়ে আমরা টেকনাফে পৌঁছলাম। বাস থেকে নেমেই স্থানীও একটা হোটেলে ঢুকলাম খাওয়ার জন্য। ভাতের সাথে আর কি খেয়ে ছিলাম তা মনে নাই তবে এইটুকু মনে পরে যে সারাদিনের খাওয়াই একবারে খেয়ে নিলাম, রাতে খাওয়ার আর প্রয়োজন হোল না। খাওয়া শেষ করে হোটেল টেকনাফে যেয়ে উঠলাম রাত কাটানোর জন্য।
বলাবাহুল্য যে টেকনাফে এটা ছিল আমার দ্বিতীয় সফর, ঠিক প্রায় এক বৎসর আগে টেকনাফ হয়ে সেন্ট মারটিন গিয়েছিলাম। সাথে ছিল আমার দুই বন্ধু ও এক অফিস কলিক, যাদের টেকনাফ থেকে সেন্ট মারটিন যাওয়ার ঐ ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে নাকি এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। উল্লেখ্য সেই সময়ে সেন্ট মারটিন যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল লোকাল ট্রলার, আর টুরিস্টদের জন্য ছিল কিছু ছোট, ছোট রিজার্ভ ট্রলার। স্থানীয় লোকজন ছাড়া বহিরাগত অর্থাৎ আমাদের মত ভ্রমন পিপাসুদের কেউকে লোকাল ট্রলারে উঠতে দেয়া হতনা, তাদেরকে ট্রলার রিজার্ভ করে যেতে বাধ্য করা হত। যার জন্য গুনতে হত বাড়তি প্রায় হাজার খানেক টাকা। তাছারা সেন্ট মারটিনে খাওয়ার দুই তিনটা হোটেল ব্যাতিত থাকার মত কোন হোটেল ছিল না। থাকার জায়গা বলতে যা ছিল সেটা হল স্থানীয় চেয়ারম্যান ও প্রাক্তন স্কুল হেড মাষ্টারের টিনশেড বাড়ির অতিরিক্ত দুই তিনটা রুম মাত্র।
ছোট্ট শহর টেকনাফ, সন্ধ্যা হতে না হতেই পুরো শহরটি নীরব হয়ে যায়। রাস্তাঘাটেও লোকজনের আনাগোনা প্রায় নেই বললে চলে, এ যেন ঢাকা শহরের রাত ১১ টা ১২ টার সময়ের অবস্থা। সন্ধার পর ফ্রেশ হয়ে একটু বারমিস মার্কেটে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু হোটেলের লোকজন বলল ততোক্ষণে মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে যেয়ে কোন লাভ হবে না। এমনকি নিচের চায়ের দোকানও এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে যেয়ে ১ কাপ চা ও খাওয়া যাচ্ছে না। কি আর করা, অবশেষে হোটেল কক্ষে বসে সারাদিনের কর্মকাণ্ড ও আগামী দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। এমন সময় আমাদের কাছে একজন লোক এসে হাজির, জানতে চাইলো আমারা কি সেন্ট মারটিন যাব কিনা। তিনি একজন ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তাদের সেন্ট মারটিনে যাতায়াত সহ থাকা খাওয়ার সব ব্যাবস্থা আছে। সরাসরি হ্যাঁ না বলে পাশ কাটিয়ে গেলাম, বললাম ইচ্ছে আছে যাওয়ার দেখা যাক। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা আমাদেরকে টাকা খরচ করিয়ে তার ট্যুরিজম সুবিধা দিয়েই ছাড়বে। অবশেষে তাকে বললাম সেন্ট মারটিনে পরিচিত লোক আছে আমাদের, সেই সব ব্যাবস্থা করে দিবে আমাদের কোন সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। জানতে চাইলো কে আছে সেন্ট মারটিনে, কি নাম তার। নামটা ঠিক মনে নেই এখন, যতটুকু মনে পড়ে তার নাম ছিল আব্দুল খালেক বা আব্দুর রহিম, গাইবান্ধা বাড়ি। নাম শুনার সাথে সাথে লোকটি জানালো যে সে তাকে চিনে এবং আরও জানালো যে এখন টেকনাফেই আছে। আমি তার সাথে দেখা করার আগ্রাহ প্রকাশ করলাম এবং লোকটিও আমাকে তার সাথে দেখা করানোর আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিলেন। ঘণ্টা দেড়েক পরে সেই লোক আব্দুর রহিমকে নিয়ে ঠিকই হাজির। সালাম দিয়ে আব্দুর রহিম বলল আমি আপনার নাম শুনে চিনতে পারতেছিলাম কিন্তু এখন দেখে ঠিকই চিনতে পারছি। যদিও প্রায় ১ বৎসর পরে দেখা তাকে চিনতে আমার মোটেও অসুবিধা হয়নি, কিন্তু খুব আবাক হয়েছি। ১ বৎসর আগে যে সুদর্শন সাস্থবান যুবক রহিমকে দেখে গিয়েছিলাম, সে এখন পুরোদমে হুজুরে রূপান্তরিত হয়েছে। যার কথাবার্তায়, চালচলনে একজন পুরো ধর্মভীরু, নামাজী চরিত্রের প্রকাশ পায়। গতবারে তোলা তার ছবিগুলো ঢাকা থেকে প্রিন্ট করে পাঠিয়েছিলাম, পেয়েছিল কিনা জানতে চাইলাম। উত্তরে বলল ছবিগুলো পেয়েছিল এবং ছবিগুলো খুব সুন্দরও উঠেছিল, কিন্তু ছবি তোলা বা রাখা গুনাহর কাজ তাই সব ছবি সে ছিরে ফেলে দিয়েছে। শুনে মোটেও আবাক হলাম না, তার যা পরিবর্তন তাতে ছিরে ফেলাটাই স্বাভাবিক। পরদিন সকালে আমাদের সাথে সেন্ট মারটিনে যাবে জানিয়ে সে বিদায় নিল। পরদিন সকালে স্থানীয় একটি হোটেলে নাশতা সেরে ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
চলবে.........
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১২ দুপুর ১:০০