চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি পার্বত্য জেলার অন্তর্গত কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় দেশের সবচেয়ে বড় স্তম্ভবিহীন(পিলার বিহীন) মসজিদটি অবস্থিত। এ মসজিদটির চারপাশে চার দেয়াল ছাড়া মাঝখানে আর কোনো স্তম্ভ নেই। মসজিদের ভেতরে ২৩টি সারিতে নামাজ পড়ার কাতার হয়। আর প্রতি কাতারে শতাধিক মুসল্লি অনায়াসে দাঁড়াতে পারেন।
এই মসজিদের অন্যতম আকর্ষণ হলো- মুসল্লিরা যে যেখানেই নামাজের জন্য দাঁড়ান না কেন তারা প্রত্যেকেই খতিব কিংবা ইমাম সাহেবকে বাঁধাহীনভাবে সরাসরি দেখতে পারেন এবং ইমামের বয়ান ও ওয়াজ শুনতে পারেন।
অনেক বড় বড় মসজিদে মাঝখানের স্তম্ভের জন্য মুসল্লিদের কেউ কেউ ইমাম সাহেবকে সরাসরি দেখতে পান না। কিন্তু চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত এই মসজিদে সে সমস্যা নেই। ইমাম সাহেবও উপস্থিত মুসল্লিদের মাঝে নির্দিষ্ট কাউকে অনায়াসে সরাসরি দেখতে পান ও খেয়াল করতে পারেন।
২।
এই মসজিদের ছাদে রয়েছে ৮৪টি সিলিং ফ্যান। টিউবলাইট রয়েছে ৩৮টি। ছোট দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি রয়েছে ৩৮টি। এতগুলো ফ্যান ও বাতি বুকে নিয়ে মসজিদের ছাদ কিভাবে বছরের পর বছর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা এক অবাক করা ব্যাপার। মোজাইক করা মসজিদের মেঝেতে বসলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। শীতাতপ ব্যবস্থা না থাকলেও মসজিদের সামনে পিছে ১৬টি এবং দুই পাশে ১৪টি জানালা রয়েছে। জানালাগুলো সব সময় খোলা থাকে। জানালা দিয়ে খোলা ফুরফুরে বাতাস সবসময় মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে। আর উপরে সিলিং ফ্যানতো অবিরাম ঘুরছেই। মসজিদে প্রবেশ করার জন্য তিনটি ফটক রয়েছে। উল্লেখ্য যে স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন মসজিদটি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অন্যতম একটি পর্যটন আকর্ষণ যা অনেকেই দেখতে আসেন।
৩।
কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী পেপার মিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এই মসজিদের দেখভাল করেন। এটি স্থানীয়দের কাছে কেপিএম কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ বা বড় মসজিদ হিসেবে পরিচিত।
তৎকালীন দাউদ গ্রুব অব ইন্ডাষ্ট্রিজের চেয়ারম্যান আহমেদ দাউদ এইচ.কে সাহেবের মা হাজিয়ানী হানিফা বাঈ ১৯৬৭ সালের ৮ ডিসেম্বর (৫ রমজান ১৩৮৭ হিজরি) কেপিএম আবাসিক এলাকায় এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেই সময় কর্ণফুলী পেপার মিল দাউদ গ্রুপের অধীনস্থ ছিল।
৪।
আমরা যারা প্রিয় কেপিএম আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ছিলাম মা-বাবার চাকরি করার সূত্রে আমাদের এলাকার সব লোকজনের কাছেই এটি "আমাদের বড় মসজিদ" হিবেসেই বেশি পরিচিত! তাই এখনো যারা কেপিএম এলাকা ছেড়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করুক না কেন এখনো সবাই এক অদ্ভুত মায়ায় ও ভালোবাসায় অতি আপন করে বলি "আমাদের বড় মসজিদটা"! আর আমাদের এই মসজিদের সাথে কেপিএম আবাসিক এলাকার সব মানুষেরই কম-বেশি অনেক স্মৃতিবিজড়িত কথা জড়িয়ে আছে যা নিশ্চিত করে বলা যায়।
তেমনি আমারও অনেক স্মৃতিময় কথা জড়িয়ে আছে ফেলে আসা সেই শৈশবের দিনগুলোতে.....
৫।
আমি যখন ছোট ছিলাম প্রতিদিনই স্কুলে যাওয়া আসার সময় মসজিদের উত্তর দিকের সিঁড়ি বেয়ে মসজিদের পূর্ব দিকের সামনের ময়দানের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম। মসজিদের পাশ ঘেঁষে থাকা লোকজন ও গাড়ি চলাচলের আসল পিছঢালা পাহাড়ি ঢালু রাস্তা দিয়ে যেতাম না কারণ ওই রাস্তাটা সবসময়ই পিচ্ছিল ও ভেজা থাকতো পাহাড় ঘেমে পানি নামতো বলে। আর তাই এই রাস্তায় কতো যে পিছলিয়ে পড়ে আঘাত পেয়েছি ও লজ্জা পেয়েছি সবার সামনে যা কখনো ভুলার নয়। আর এখন তা মনে পড়ে খুব হাসিও পাচ্ছে। কারণ মনে আছে আমি একবার এমন জোরে হুমড়ে চিৎ হয়ে আঁচড়ে পড়েছিলাম যে একেবারে কাটা কম্পাসের মতন ৩৬০° কোণ করে দুই ঘুরান্তি খেয়ে আমি যেন তাজ্জব বনে গেলাম ও সম্পুর্ণ স্কুলের ড্রেসসহ ভিজে গেলাম! পরে আমার সাথে থাকা এক সহপাঠী আমাকে টেনে উঠালো। তা দেখে সবাই কী যে হাসাহাসি.....
আর ওইদিক দিয়ে মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে যেতেও মনের মধ্যে হাজার রকমের ভয় কাজ করত। কারণ মসজিদের সিঁড়িগুলোতে আরবি হরফের মতই উর্দু বর্ণে খোদাই করা লিখা ছিল। আর তখন ছোট্ট মনে জেনেছিলাম ও বিশ্বাস করতাম ওই সিঁড়িগুলাতে পায়ের পারা পড়লে নাকি ভীষণরকম গুণাহ হবে তাই এই ভয়ে লিখাওয়ালা সিঁড়িগুলো ভালোমতন খেয়াল করে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতাম। আর এইভাবে প্রায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত মসজিদের সামনের ময়দানের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতাম।
আর আমাদের এই মসজিদকে ঘিরে আরেকটা মজার স্মৃতি হচ্ছে, যখনই স্কুলে কোনো টার্মের প্রথমদিনের পরীক্ষা শুরু হতো সেদিন মসজিদের তিনটা ফটকের সামনেই লম্বা লাইন সৃষ্টি হতো। কারন আমরা বিশ্বাস করতাম মসজিদের ফটকের দেয়ালে থাকা সম্পুর্ন আরবি হরফে লিখাগুলোকে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে গেলে পরীক্ষা ভালো হবে। পরীক্ষার্থীদের ভীড়ে কিছুটা ঠেলাঠেলি হতো তাই তাড়াতাড়ি করে পরীক্ষা দিতে স্কুলে রওয়ানা দিতাম যেন মসজিদের সামনে ভীড়ের মাঝে লাইনে দাঁড়াতে না হয় যা খুব মনে পড়ে!
এখনো আমি প্রায়ই ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের মাঝে আমাদের বড় মসজিদটাকে দেখি। দেখি আমি সেই ছোট্ট বেলার মতই স্কুলে যাচ্ছি মসজিদের সিঁড়িগুলো বেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক ভয় নিয়ে। এই বুঝি আমার পা ভুলে পিছলিয়ে পড়ে যাচ্ছে সিঁড়ির আরবি লিখাগুলোতে... আর স্বপ্নের মাঝে ধপাস করে আমি পড়ে গিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠি বুক ধড়ফড় নিয়ে! জানিনা আমার মতন এমন করে কেউ আমাদের মসজিদটাকে স্বপ্নে দেখে কিনা তা খুব জানতে ইচ্ছে করে !
৬।
৭।
৮।
৯।
এই হচ্ছে আমাদের প্রিয় কেপিএম এলাকার বড় মসজিদটা নিয়ে আমার শৈশবের স্মৃতিকথন। যেখানে স্বপ্নের ঘোরেও আমি হারিয়ে যাই সেই প্রিয় দিনগুলোতে। যেখানের আলো বাতাসে জন্ম থেকেই বেড়ে উঠেছি সম্পুর্ণ আলাদা এক প্রাকৃতিক পরিবেশে পাহাড়ে ঘেরা মফস্বল শহরে।
১০।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:২৪