আমার বড় আপার বিয়ে হয়েছে আজ থেকে ১৯ বছর আগে। আর আমার বড় আপার হাসব্যান্ড মানে আমার বড় দুলাভাই আমাদের কাছে বড় ভাইয়ের তুল্য। আমরা কখনোই ভাবিনা যে আমাদের বড় ভাই নেই বা থেকেও নেই এমনটা কখনো ভাবিনা। আমাদের সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদের দিনে তিনি যতই দূরে থাকুন না কেন শত ঝড়-বৃষ্টি-তুফান উপেক্ষা করে হলেও সবার আগে একমাত্র তিনিই এসে হাজির হবেন। তাছাড়া দুলাভাই পাড়া প্রতিবেশীর বিপদে আপদে সবসময় সবার আগে এগিয়ে আসেন সাহায্য করার জন্যে, সবার সুখে-দুখে এক সাথে থাকতে তিনি বেশি পছন্দ করেন।
আর আমার দুলাভাইয়ের অন্যতম বিশেষত্ব হলো তিনি যেন এখনো সেই নতুন জামাইয়ের মতন আমাদের বাড়িতে আসেন অতি ঘটা করে আনন্দ উৎসব নিয়ে। কখনোই তিনি খালি হাতে আসেন না।
আসার সময় তিনি পারেননা যেন একেবারে বাজারের সবকিছু মাথায় তুলে নিয়ে আসবেন এমন এক পাগলামো অবস্থা ওনার।
মনে হয় যেন বিলেত ফেরত অনেকদিন পর কেউ দেশে এসেছে এমন বাজার সদাই করে নিয়ে আসেন সবার জন্যে। যেমন- যদি ফল নিয়ে আসেন তবে বাজারের সব রকমের ফলাদি একদম খাঁচি খাঁচি ভরে নিয়ে আসবেন।
তেমনি গত দু'দিন আগে দুলাভাই এসেছেন আমাদের বাড়িতে নানান রকম বাজার করে। তারপর আমাদের গ্রামের বাজারে তিনি হাঁটতে বের হয়ে দেখলেন সদ্য পুকুর হতে তুলে আনা তাজা দেশি কৈ ও শিং মাছ। তিনি তড়িঘড়ি করে একদম সব কৈ ও শিং মাছ প্রায় ১২কেজি কিনে নিয়ে আসলেন আমাদের বাড়িতে। দুলাভাইয়ের একটি বিশেষ দোষ হচ্ছে বাজারে ভালো বড় কোনো মাছ দেখলেই তিনি সেটার লোভ সামলাতে পারেন না, এতে পকেটে ওনার টাকা থাকুক বা না থাকুক তা হিসাব না করে সেই মাছটা কিনে বাসায় ফিরবেন-ই এতে আমার আপা দুলাভাইয়ের সাথে প্রায়ই রাগ করেন।
দুলাভাইয়ের এই এলাহিকান্ড দেখে আমার আম্মা ও আব্বা হাসবেন না কাঁদবেন এমন এক অবস্থা কারণ এত্তো মাছ কি করবেন দেখে!
তাছাড়া একসাথে এতো মাছ কাটাকুটি করাও নানান ঝামেলা। তাই বড় বড় পাতিল ও বালতিতে কিছু জিইয়ে রাখা হলো আর কিছু মাছ দুলাভাই নিজেই বটি নিয়ে গায়ে কোট সু পরা অবস্থায় বসে গেলেন কাটতে৷
আম্মা অনেকটা অসুস্থ তাই আম্মাকে ধরতে দেয়া হলো না। দুলাভাইয়ের বটি নিয়ে বসে পড়া দেখে আমি পড়লাম এক মহা বিপাকে৷ কারণ আমি এই জীবনে কৈ ও শিং মাছ কাটিনি। বলা যায় আমি অন্য কোনো মাছই কাটতে পারিনা কারণ বড় বোনেরা ছিল তাই ওরাই করতো আগে আর তাছাড়া এখনও আম্মা আমাকে মাছ কাটতে দেন না হয়তো আম্মা নিজেই কাটেন নাহয় সবসময় বাড়ির কোনো মহিলাকে দিয়ে কেটে নেন।
তো যাই হোক দুলাভাইয়ের মাছ কাটা দেখে আমিও লজ্জায় পড়ে বাধ্য হয়ে মাছ কাটতে বসে গেলাম আল্লাহর নাম নিয়ে সাহস করে। একে তো কৈ মাছ কাটার নিয়ম জানিনা তারউপর সব জ্যান্ত মাছ! মাছ ধরতে গেলেই দেয় লাফ সাথে ভয়ে আমিও দেই চিৎকার করে লাফ! আমার অবস্থা দেখে আব্বা আম্মা ও দুলাভাইয়ের সে কি হাসি! সাথে দুলাভাই কিছুটা মিষ্টিসুরে বকাও দিচ্ছে বুড়ি হয়ে গেছি এখনো মাছ ভয় পাই ও কাটতে জানিনা বলে!
আর মাশাল্লাহ আমার দুলাভাই এত্তো সুন্দর করে অতি দ্রুত মাছ কাটতে পারেন যা চোখে কেউ না দেখলে বিশ্বাসই করবেনা। আমি অবাক হয়ে ওনার মাছ কাটা দেখতেই থাকলাম। আর দুলাভাইয়ের প্রতি হিংসা হয়ে সাহস করে মাছের কাঁটার গুতাগাতা খেয়ে ও হাত কেঁটেছিঁড়ে বারোটা বাজিয়ে আমি এইজীবনে প্রথম এত্তোগুলো মাছ কাটলাম প্রায় ২কেজির মতন কৈ মাছ আর এতে আমার সে কী যে আনন্দ হচ্ছিল যেন আমি যুদ্ধ জয়ের মতন অসাধ্য সাধন করে ফেলেছি। এক দিনেই দুলাভাই আমাকে অতি সুন্দর করে মাছ কাটা শিখিয়ে দিলেন।
কিন্ত অতি দুঃখের বিষয় আমার কাটাছেঁড়া হাতের ব্যাথা এই দুদিনে এখনো একটুও কমেনি।
আজ ১৫ই ডিসেম্বর আমার বড় দুলাভাইয়ের জন্মদিন। দেশ স্বাধীন হয়েছে যত বছর আমার দুলাভাইয়ের বয়সও তত বছর। ১৯৭১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর আমার বড়ভাই তুল্য দুলাভাইয়ের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের কয়েকঘন্টা আগে। সেদিন তিনি ওনার মায়ের কোলে ভূমিষ্ট হয়েছিলেন বিজয়ের আগাম মহা আনন্দ-খুশি ও কান্না নিয়ে।
দোয়া করি সবসময় আমার বড় দুলাভাইকে আল্লাহ আজীবন নেক হায়াত দান করুন ও সবসময় সবার সাথে এমন হাসিখুশি জীবন অতিবাহিত করার তৌফিক দান করুন। আমীন...
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৪৬